বাংলাদেশ নিজেকে একটি দ্রুত ডিজিটাল রূপান্তরশীল দেশ হিসেবে উপস্থাপন করে। ডিজিটাল যুগে প্রবেশের সঙ্গে সঙ্গে ইন্টারনেট আজ সরকারি প্রশাসন, ব্যবসা–বাণিজ্য, শিক্ষাদীক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও বিনোদনসহ প্রায় সব ক্ষেত্রেই অপরিহার্য অবকাঠামো হিসেবে প্রতিষ্ঠিত। তবু বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে উচ্চগতির ও সাশ্রয়ী ইন্টারনেট এখনো বড় চ্যালেঞ্জের মুখে। বিশেষ করে গ্রামীণ ও শহরাঞ্চলের মধ্যে গতিশীল, নিরবচ্ছিন্ন এবং মানসম্মত সংযোগের যে বৈষম্য বিদ্যমান, তা সামগ্রিক ডিজিটাল রূপান্তরকে দৃশ্যত সীমিত করে দিচ্ছে।
একটি দেশের টেকসই উন্নয়ন মূলত তার ডিজিটাল অবকাঠামোর সক্ষমতার ওপর নির্ভরশীল। উচ্চগতির ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট কেবল শিক্ষা, ব্যবসা বা বিনোদনের হাতিয়ার নয়; এটি কার্যকর সরকারি সেবা প্রদান, সুশাসন, দুর্যোগ প্রস্তুতি, তথ্যপ্রাপ্তি এবং নাগরিক সুরক্ষা নিশ্চিত করার অন্যতম ভিত্তি। বাংলাদেশের মতো ঘনবসতিপূর্ণ, দ্রুত ডিজিটালাইজেশনের পথে অগ্রসর একটি দেশের জন্য সবার জন্য নির্ভরযোগ্য ও দ্রুত ইন্টারনেট প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, প্রযুক্তির অন্তর্ভুক্তিমূলক ব্যবহার এবং জবাবদিহিমূলক শাসনব্যবস্থা বাস্তবায়নের পূর্বশর্ত।
কিন্তু কুতুবদিয়া ও মহেশখালীর মতো উপকূলীয় দ্বীপাঞ্চলের বাস্তবতা এই জাতীয় অগ্রগতির বয়ানের সঙ্গে তীব্র বৈসাদৃশ্য তুলে ধরে। জলবায়ু পরিবর্তনজনিত ঝুঁকির সামনের সারিতে থাকা এই দ্বীপগুলো একই সঙ্গে মারাত্মক ডিজিটাল বঞ্চনারও শিকার। একদিকে ঘূর্ণিঝড়, জলোচ্ছ্বাস ও উপকূল ভাঙনের মতো জলবায়ু সংকট; অন্যদিকে দুর্বল, ব্যয়বহুল ও অনির্ভরযোগ্য ইন্টারনেট সংযোগ—এই দুই ধরনের বৈষম্য একে অন্যকে আরও গভীর করে তুলছে। জাতিসংঘ ঘোষিত “Leaving No One Behind” প্রতিশ্রুতির প্রেক্ষাপটে এটি শুধু প্রযুক্তিগত ঘাটতি নয়, বরং স্পষ্টভাবে সুশাসন, সমতা ও ন্যায্যতার প্রশ্ন হিসেবে সামনে আসছে।
মহেশখালী: দেশের প্রথম ‘ডিজিটাল দ্বীপ’ থেকে অপূর্ণ প্রতিশ্রুতির প্রতীক
২০১৭ সালে কক্সবাজারের মহেশখালীকে দেশের প্রথম ‘ডিজিটাল আইল্যান্ড’ হিসেবে ঘোষণা করা হয় উচ্চ প্রত্যাশা নিয়ে। লক্ষ্য ছিল—
- প্রায় চার লাখ দ্বীপবাসীর জীবনমান উন্নয়ন,
- শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবায় প্রযুক্তি–সমর্থিত সেবা সম্প্রসারণ,
- অনিরাপদ অভিবাসন ও মানবপাচার কমানো,
- এবং স্থানীয় অর্থনীতিকে ই–কমার্সের মাধ্যমে নতুন গতি দেওয়া।
জাতিসংঘের আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম), কোরিয়া টেলিকম, তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ এবং বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিলের অংশীদারিত্বে প্রায় ২২ কোটি টাকার বেশি ব্যয়ে এই প্রকল্প বাস্তবায়িত হয়। প্রায় ১৯ কিলোমিটার অপটিক্যাল ফাইবার টেনে একটি পৌরসভা ও দুটি ইউনিয়নে উচ্চগতির ইন্টারনেট পৌঁছে দেওয়া হয়।
এই অবকাঠামোর মাধ্যমে—
- ১০টি সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, ২টি মাদ্রাসা, উপজেলা স্বাস্থ্য কমপ্লেক্স ও ৪টি কমিউনিটি ক্লিনিকসহ প্রায় ২৫টি সরকারি স্থাপনায় সংযোগ দেওয়া হয়;
- ঢাকার শিক্ষকরা অনলাইনে পাঠদান শুরু করেন, স্থানীয় শিক্ষকরা আধুনিক পদ্ধতিতে প্রশিক্ষণ পান;
- হাসপাতালে টেলিমেডিসিনের মাধ্যমে শহরের বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের পরামর্শ পাওয়া সম্ভব হয়;
- স্থানীয় শুঁটকি ও মিষ্টি পানের জন্য অনলাইন প্ল্যাটফর্ম চালু হয়ে বাজার–অ্যাক্সেস বাড়ে;
আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী উচ্চগতির ইন্টারনেট ব্যবহার করে মানবপাচার ও অনিরাপদ সমুদ্রযাত্রা রোধে নজরদারি জোরদার করে।
এসব উদ্যোগ সরাসরি টেকসই উন্নয়ন অভীষ্ট—মানসম্মত শিক্ষা (এসডিজি ৪), সুস্বাস্থ্য (এসডিজি ৩), শোভন কাজ ও অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি (এসডিজি ৮), অসমতা হ্রাস (এসডিজি ১০) এবং টেকসই অবকাঠামো ও উদ্ভাবন (এসডিজি ৯)—অর্জনে অবদান রাখার কথা ছিল।
কিন্তু প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার পর কোনো সুস্পষ্ট exit strategy ও sustainability plan কার্যকর না থাকায় খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এ উদ্যোগ ভেঙে পড়তে শুরু করে।
- অযত্ন–অবহেলায় ল্যাপটপ, কম্পিউটার, প্রজেক্টরসহ সরঞ্জাম নষ্ট হয়;
- ১৯ কিলোমিটারের অপটিক্যাল ফাইবার চুরি হয়ে সব ইন্টারনেট–নির্ভর কার্যক্রম অচল হয়ে পড়ে;
- আইসিটি ট্রেনিং সেন্টারে চুরির ঘটনায় বহু মূল্যবান সরঞ্জাম হারিয়ে যায়;
- বিদ্যালয়, স্বাস্থ্যকেন্দ্র ও সরকারি কার্যালয়ের ডিজিটাল সেবা বন্ধ হয়ে যায়;
- কমিউনিটি ক্লাব, ই–কমার্স প্ল্যাটফর্ম ও প্রশিক্ষণকেন্দ্র স্থবির হয়ে পড়ে।
ফলে, অল্প কয়েক দিনের মধ্যে ‘ডিজিটাল দ্বীপ’ একটি জাতীয় প্রদর্শনী প্রকল্প থেকে স্থানীয় মানুষের জন্য কার্যত হারিয়ে যাওয়া একটি সুযোগে পরিণত হয়—এটাই ডিজিটাল সুশাসনের ঘাটতির বাস্তব উদাহরণ।
কুতুবদিয়া: জলবায়ু সম্মুখসারিতে, সংযোগ সংকট আরও গভীর
অন্যদিকে, কুতুবদিয়া দ্বীপ সংযোগ সংকটের আরও কঠোর বাস্তবতা তুলে ধরে। দীর্ঘদিনের উপকূল ভাঙন ও ঘূর্ণিঝড়ে দ্বীপটি ক্রমাগত ছোট হয়ে যাচ্ছে; হাজারো মানুষ বাস্তুচ্যুত হচ্ছে, ঝুঁকি বাড়ছে। মোবাইল নেটওয়ার্ক কাগজে–কলমে কক্সবাজার অঞ্চলকে কভার করলেও কুতুবদিয়ার মতো দ্বীপাঞ্চলে সেবার মান অস্থির—আবহাওয়া খারাপ হলে নেটওয়ার্ক ভেঙে পড়ে, ইন্টারনেটের গতি ব্যাপক ওঠানামা করে।
যখন দুর্যোগ–পূর্ব সতর্কবার্তা, ত্রাণ সমন্বয় ও সরকারি তথ্য দ্রুত অনলাইন প্ল্যাটফর্মে চলে যাচ্ছে, তখন দুর্বল সংযোগ একটি নতুন ধরনের শাসনব্যবস্থাগত বৈষম্য ও জীবন–বিপন্নকারী ঝুঁকিতে রূপ নেয়।
শিক্ষা ও জীবিকার ক্ষেত্রেও একই চিত্র। ডিজিটাল লার্নিং প্ল্যাটফর্ম ও অনলাইন পরীক্ষা ধরে নেয়, নির্ভরযোগ্য ৩জি/৪জি ও পর্যাপ্ত স্মার্ট ডিভাইস সহজলভ্য। কিন্তু কুতুবদিয়া ও মহেশখালীর দূরবর্তী অংশে অনেক শিক্ষার্থী এখনও একটি মাত্র পরিবারের ফোন আর সীমিত ডেটার ওপর নির্ভরশীল। জেলে, লবণচাষি ও ক্ষুদ্র ব্যবসায়ীরা ডিজিটাল পেমেন্ট, বাজার–তথ্য ও ই–কমার্স থেকে উপকৃত হতে পারতেন, কিন্তু অস্থির ব্যান্ডউইথ ও কম ডিজিটাল দক্ষতা তাদের এই সুযোগ থেকে দূরে রাখছে। ফলে ডিজিটাল প্রতিশ্রুতি বাস্তবে দাঁড়িয়ে যাচ্ছে সংযুক্ত শহর বনাম বিস্মৃত দ্বীপের এক ভৌগোলিক বৈষম্যে।
ডিজিটাল সুশাসনের দৃষ্টিতে এই সংকট কী বলছে?
ডিজিটাল সুশাসন মানে কেবল অ্যাপ বানানো বা ওয়েবসাইট চালু করা নয়। এটি এমন এক শাসনব্যবস্থা, যেখানে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করে রাষ্ট্র, স্থানীয় সরকার, প্রতিষ্ঠান ও নাগরিকদের মধ্যে স্বচ্ছতা, জবাবদিহিতা, দক্ষতা ও অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা হয়—মানবাধিকার, অন্তর্ভুক্তি ও ন্যায়বিচারের মানদণ্ড বজায় রেখে।
মহেশখালী ও কুতুবদিয়ার অভিজ্ঞতা দেখায়—
- টেকসই পরিকল্পনা ছাড়া প্রদর্শনমূলক প্রকল্প ঝুঁকিপূর্ণ;
- দায়িত্বশীল প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো, পর্যাপ্ত বাজেট ও নিয়মিত তদারকি ছাড়া প্রযুক্তি টিকিয়ে রাখা যায় না;
- কমিউনিটির মালিকানা ও অংশগ্রহণ না থাকলে অবকাঠামো দ্রুত অব্যবহৃত বা ঝুঁকিপূর্ণ হয়ে পড়ে;
- ডিজিটাল অবকাঠামোকে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, তথ্যপ্রাপ্তি, নিরাপদ অভিবাসনের মতো মৌলিক অধিকার ও জনসেবার সঙ্গে সরাসরি যুক্ত করে দেখতে হয়।
প্রযুক্তি যদি কেবল ক্ষমতাশালী বা শহর–কেন্দ্রিক গোষ্ঠীর হাতে কেন্দ্রীভূত থাকে, তা সুশাসন নয়; সত্যিকারের ডিজিটাল সুশাসন তখনই, যখন প্রযুক্তি ন্যায়বিচার, সমতা ও “কেউ পিছিয়ে থাকবে না” নীতির পক্ষে দাঁড়ায়।
অগ্রযাত্রার পথ: কভারেজ নয়, ‘অর্থবহ সংযোগ’ ও অধিকারে ভিত্তিক কাঠামো
প্রথমত, সংযোগকে মৌলিক জনসেবা হিসেবে স্বীকৃতি
জলবায়ু–ঝুঁকিপূর্ণ উপকূলীয় নাগরিকদের জন্য শক্তিশালী ইন্টারনেটকে বাঁধ, সাইক্লোন শেল্টার বা সড়ক অবকাঠামোর মতোই অপরিহার্য জন–স্বার্থের অবকাঠামো হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। নীতিমালা ও নিয়ন্ত্রণ কাঠামোতে কুতুবদিয়া ও মহেশখালীর মতো দ্বীপকে অগ্রাধিকার জোন হিসেবে ঘোষণা করা যেতে পারে।
দ্বিতীয়ত, সহনশীল ও টেকসই ‘লাস্ট–মাইল’ বিনিয়োগ
- ঘূর্ণিঝড় ও ভাঙন–সহনীয় অতিরিক্ত ফাইবার রুট ও মাইক্রোওয়েভ লিংক;
- ব্যাকআপ পাওয়ার সিস্টেমযুক্ত উন্নত মোবাইল টাওয়ার;
- স্কুল, ইউনিয়ন পরিষদ অফিস ও সাইক্লোন শেল্টারে কমিউনিটি ওয়াই–ফাই হটস্পট, যেখানে শিক্ষা ও জরুরি যোগাযোগের জন্য বিনা মূল্য বা কম দামে ইন্টারনেট পাওয়া যাবে।
তৃতীয়ত, সহনীয় মূল্য ও অন্তর্ভুক্তি
কম আয়ের পরিবার, শিক্ষার্থী ও নারী–প্রধান পরিবারের জন্য ডেটা ভর্তুকি বা সামাজিক ট্যারিফ, এবং টেলিসেন্টার, কমিউনিটি রেডিও ইন্টারনেট কর্নার ও তরুণদের পরিচালিত ডিজিটাল হাবের মাধ্যমে পাবলিক অ্যাক্সেস পয়েন্ট তৈরি—এসব উদ্যোগ “কাগুজে কভারেজ”কে বাস্তব ব্যবহারে রূপ দিতে পারে।
চতুর্থত, স্থানীয় ডিজিটাল সক্ষমতা ও মানবসম্পদ উন্নয়ন
শিক্ষক, স্বাস্থ্যকর্মী, জেলে, কৃষক ও যুবদের জন্য প্রাসঙ্গিক প্রশিক্ষণ জরুরি—
- আবহাওয়া ও আগাম সতর্ক বার্তা পড়া,
- ডিজিটাল আর্থিক সেবা ব্যবহার,
- অনলাইনে পণ্য বিপণন,
- এবং স্থানীয় সমস্যা দ্রুত সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানো—এসব দক্ষতা জীবন ও জীবিকায় সরাসরি প্রভাব রাখে।
পঞ্চমত, কমিউনিটির কণ্ঠকে কেন্দ্রীয় স্থানে রাখা
কুতুবদিয়া ও মহেশখালীর সংযোগ পরিকল্পনায় স্থানীয় নারী, তরুণ ও জলবায়ু–বাস্তুচ্যুত পরিবারকে নীতি প্রণয়ন, বাস্তবায়ন ও তদারক–সব ধাপে অংশীদার করতে হবে। তারা জানে, কখন, কোথায় এবং কেমন ধরনের সংযোগ সবচেয়ে জরুরি—ভোরের মাছঘাটে, সাইক্লোন শেল্টারে, কিংবা পরীক্ষার মৌসুমে স্কুলে।
উপসংহার: স্লোগান থেকে সুশাসনে
বাংলাদেশ যদি কেবল প্রতীকী “ডিজিটাল আইল্যান্ড” ব্র্যান্ডিং থেকে সরে এসে অধিকারভিত্তিক, কমিউনিটি–নেতৃত্বাধীন এবং জবাবদিহিমূলক ডিজিটাল সুশাসন কাঠামো গড়ে তুলতে পারে, তাহলে কুতুবদিয়া ও মহেশখালী ডিজিটাল অবহেলার প্রতীক না হয়ে স্থিতিশীল, অন্তর্ভুক্তিমূলক উপকূলীয় উন্নয়নের অনুকরণীয় মডেলে পরিণত হতে পারে।
একটি কথা আজ স্পষ্ট: টেকসই ডিজিটাল রূপান্তর কেবল স্লোগানে নয়, পরিকল্পিত রক্ষণাবেক্ষণ, অন্তর্ভুক্তিমূলক অংশীদারিত্ব এবং দৃশ্যমান জবাবদিহিতার ওপর দাঁড়ায়। মহেশখালী ও কুতুবদিয়ার অভিজ্ঞতা সেই সত্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ ও সময়োচিত স্মরণ–বার্তা—যা নীতিনির্ধারক, উন্নয়ন সহযোগী ও বেসরকারি খাত সবারই গুরুত্বের সঙ্গে গ্রহণ করা প্রয়োজন।
এ এইচ এম বজলুর রহমান, ডিজিটাল গণতন্ত্র উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশে দায়িত্বশীল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অ্যাম্বাসেডর, ই-মেইল: [email protected]








০ টি মন্তব্য