জাতিসংঘ ইন্টারনেট গভর্নেন্স ফোরাম (IGF)+২০: বাংলাদেশে সুশীল সমাজ সংগঠনসমূহের (CSOs) ভূমিকা – সাশ্রয়ী, নির্ভরযোগ্য ও টেকসই ইন্টারনেট নিশ্চিতকরণে সুযোগ, চ্যালেঞ্জ ও করণীয়*
জাতিসংঘ ইন্টারনেট গভর্নেন্স ফোরাম (IGF)+২০-এর ২০তম বার্ষিকী উদযাপনের প্রাক্কালে, সমতাভিত্তিক ডিজিটাল প্রবেশাধিকার, অন্তর্ভুক্তিমূলক গভর্নেন্স ও মানবাধিকারের ভিত্তিতে ইন্টারনেট ব্যবস্থাপনা নিয়ে আলোচনা এখন আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে বেশি প্রাসঙ্গিক। বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে যেখানে ডিজিটাল রূপান্তর একটি জাতীয় অগ্রাধিকার, সেখানে সুশীল সমাজ সংগঠনসমূহের (CSOs) ভূমিকা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ—ইন্টারনেট যাতে সাশ্রয়ী, নির্ভরযোগ্য ও টেকসই হয় এবং সবার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক ও ক্ষমতায়নমূলক হয় তা নিশ্চিত করার ক্ষেত্রে।
ইন্টারনেট গভর্নেন্স ফোরামের (IGF) সূচনা ও প্রেক্ষাপট
২০০৩ সালের ডিসেম্বর মাসে সুইজারল্যান্ডের জেনেভায় অনুষ্ঠিত World Summit on the Information Society (WSIS) সম্মেলনের একটি গুরুত্বপূর্ণ ফলাফল হিসেবে IGF গঠিত হয়। এই সম্মেলনে ইন্টারনেট গভর্নেন্সের গুরুত্ব স্বীকার করে Geneva Plan of Action গ্রহণ করা হয়। কিন্তু ইন্টারনেট গভর্নেন্সের সংজ্ঞা ও বিভিন্ন অংশীজনের ভূমিকা নির্ধারণ করা একটি জটিল কাজ ছিল।
এই চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায়, জাতিসংঘ মহাসচিব Working Group on Internet Governance (WGIG) গঠন করেন। এই কর্মীদল WSIS-এর দ্বিতীয় পর্যায়ের (নভেম্বর ২০০৫, তিউনিস) আগে একটি পূর্ণাঙ্গ রিপোর্ট তৈরি করে যা Tunis Agenda-তে স্থান পায়। এতে ইন্টারনেট গভর্নেন্সের সংজ্ঞা এবং বহু-অংশীজনভিত্তিক সহযোগিতা ও দায়িত্ব বণ্টনের গুরুত্ব তুলে ধরা হয়।
বৈশ্বিক প্রেক্ষাপট: IGF+২০ ও ডিজিটাল ভবিষ্যৎ
২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত IGF জাতিসংঘের ইন্টারনেট সম্পর্কিত নীতিমালার প্রধান বহু-অংশীজন প্ল্যাটফর্ম। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, তথ্য-সার্বভৌমত্ব, ও ডিজিটাল বিভাজন বৃদ্ধি—এসব প্রেক্ষাপটে IGF+২০ একটি পুনর্মূল্যায়নের ও সংহতকরণের সুযোগ দিচ্ছে। এটি বৈশ্বিক সহযোগিতার আহ্বান জানায় যেন ডিজিটাল রূপান্তর বিশ্বজুড়ে কাউকে পেছনে ফেলে না যায়।
এর পাশাপাশি জাতিসংঘ Global Digital Compact প্রণয়ন করছে—যা ২০২৪ সালের Pact for the Future-এর একটি মূল উপাদান এবং যা সবার জন্য অর্থবহ, নিরাপদ ও সার্বজনীন ডিজিটাল সংযোগ নিশ্চিত করার ওপর গুরুত্বারোপ করে।
বাংলাদেশে সুশীল সমাজের জন্য সুযোগ
বাংলাদেশের সুশীল সমাজ দীর্ঘদিন ধরে ডিজিটাল প্রবেশাধিকার, অধিকারভিত্তিক ইন্টারনেট এবং নীতিনির্ধারণে অংশগ্রহণমূলক ভূমিকা রেখে আসছে। IGF+২০ তাদের জন্য অনেক গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ উন্মোচন করেছে:
১. নীতিনির্ধারণে প্রভাব ও অংশীদারিত্ব
Smart Bangladesh Vision 2041-এর নীতিমালা তৈরিতে CSO-রা অংশ নিয়ে নেট নিরপেক্ষতা, সাশ্রয়ী ইন্টারনেট, ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল পরিষেবা বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
২. কমিউনিটি-নির্ভর ইন্টারনেট মডেল প্রচার
দুর্গম এলাকায় কমিউনিটি নেটওয়ার্ক গড়ে তুলতে CSO-রা বিশ্বব্যাপী উদ্ভাবনী মডেল অনুসরণ করে সাশ্রয়ী, টেকসই ও স্থানভিত্তিক সংযোগ প্রদান করতে পারে।
৩. ডিজিটাল সাক্ষরতা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি
নারী, যুব, প্রতিবন্ধী ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য ডিজিটাল সক্ষমতা বৃদ্ধি করতে CSO-রা নেতৃস্থানীয় ভূমিকা রাখতে পারে।
৪. ডিজিটাল অধিকার ও সুশাসনের অগ্রগতি
CSO-রা অনলাইন স্বাধীনতা, গোপনীয়তা, তথ্যের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে ভূমিকা রাখতে পারে। তারা অন্তর্ভুক্তিমূলক ও স্বচ্ছ ইন্টারনেট গভর্নেন্স কাঠামোর পক্ষে সোচ্চার।
৫. বৈশ্বিক সংযোগ ও সম্পদ আহরণ
IGF, WSIS, UNCTAD প্রভৃতি প্ল্যাটফর্মে অংশগ্রহণ করে CSO-রা জ্ঞান, অর্থায়ন ও অংশীদারিত্ব অর্জন করতে পারে।
চ্যালেঞ্জসমূহ
বাংলাদেশে CSO-দের সক্রিয়তা সত্ত্বেও কিছু গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ এখনো রয়ে গেছে:
১. সীমিত নীতিগত প্রবেশাধিকার
নীতিনির্ধারণ প্রক্রিয়ায় CSO-দের অংশগ্রহণ অনেক সময়ই প্রতীকি পর্যায়ে সীমিত থাকে।
২. অর্থায়নের অভাব
প্রতিষ্ঠানগুলো অনেক সময় পর্যাপ্ত অর্থ বা প্রযুক্তিগত সহায়তা না পাওয়ায় কার্যক্রম বিস্তারে বাধা পায়।
৩. ডিজিটাল বিভাজন ও অবকাঠামোগত ঘাটতি
গ্রামীণ ও প্রত্যন্ত অঞ্চলে নেটওয়ার্ক অবকাঠামো দুর্বল, এবং ইন্টারনেট ডিভাইস ও সেবার ব্যয় সাধারণ মানুষের নাগালের বাইরে।
৪. আইনি ও বিধিনিষেধমূলক প্রতিবন্ধকতা
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন ও কনটেন্ট নিয়ন্ত্রণ অনেক সময় মুক্ত মতপ্রকাশে বাধা দেয় এবং CSO-এর স্বাধীন কাজকে সীমিত করে।
৫. দক্ষতার ঘাটতি
অনেক গ্রাসরুট CSO-এর প্রযুক্তিগত ও প্রাতিষ্ঠানিক দক্ষতার অভাব রয়েছে।
করণীয়: অধিকারভিত্তিক ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল ভবিষ্যৎ
এই চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবিলায় এবং সুযোগগুলো কাজে লাগাতে বাংলাদেশের করণীয়:
নীতিনির্ধারণে CSO অন্তর্ভুক্তি নিশ্চিত করা
সরকারি নীতিতে সুশীল সমাজের প্রকৃত অংশগ্রহণ নিশ্চিত করতে হবে।
কমিউনিটি-ভিত্তিক ইন্টারনেট উন্নয়ন
স্থানীয়ভাবে পরিচালিত ইন্টারনেট সেবা সম্প্রসারণে রাষ্ট্র, বেসরকারি খাত ও দাতা সংস্থাগুলোকে সহায়তা করতে হবে।
অর্থায়ন ও প্রযুক্তিগত সহায়তা
CSO-দের জন্য নির্ধারিত বাজেট ও সক্ষমতা উন্নয়ন কর্মসূচি প্রয়োজন।
ডিজিটাল সাক্ষরতা ও অন্তর্ভুক্তি
নারী, শিশু, প্রতিবন্ধী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর জন্য যৌথভাবে ডিজিটাল শিক্ষা প্রসার করা প্রয়োজন।
অধিকার-সম্মত নীতিমালা প্রচার
ইন্টারনেট যেন উন্মুক্ত, নিরাপদ ও ক্ষমতায়নমূলক হয়, তা নিশ্চিত করতে CSO-দের অধিকারভিত্তিক নীতির পক্ষে কাজ করতে হবে।
বৈশ্বিক সংলাপে সক্রিয় অংশগ্রহণ
IGF-এর মতো আন্তর্জাতিক প্ল্যাটফর্মে বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব করা ও অর্জিত জ্ঞান দেশে প্রয়োগ করা গুরুত্বপূর্ণ।
উপসংহার
IGF+২০ কেবল একটি বার্ষিকী নয়—এটি একটি কর্মপন্থা ঘোষণা।
বাংলাদেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল সমাজ গড়তে হলে সুশীল সমাজকে ইন্টারনেট ইকোসিস্টেমের সহ-নির্মাতা হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে।
কমিউনিটি উদ্ভাবন, নীতিগত সপক্ষে প্রচার এবং অধিকারভিত্তিক কর্মসূচির মাধ্যমে CSO-রাই পারে ইন্টারনেটকে সবার জন্য সাশ্রয়ী, নির্ভরযোগ্য ও টেকসই করে গড়ে তুলতে।
IGF+২০ যখন আগামী দশকের জন্য ডিজিটাল গভর্নেন্সের রূপরেখা তৈরি করছে, তখন বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ হলো—সুশীল সমাজকে প্রান্তে নয়, বরং কেন্দ্রবিন্দুতে নিয়ে আসা।
এ. এইচ. এম. বজলুর রহমান | ডিজিটাল গণতন্ত্র উন্নয়নে বিশেষজ্ঞ, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা
বাংলাদেশ এনজিওস নেটওয়ার্ক ফর রেডিও অ্যান্ড কমিউনিকেশন (বিএনএনআরসি), এবং বাংলাদেশে দায়িত্বশীল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার রাষ্ট্রদূত, নীতি গবেষণা ফেলো, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে গণমাধ্যম, তথ্যের অখণ্ডতা ও সমাজ গঠনের ভবিষ্যৎ রূপায়ণে নিয়োজিত! [email protected]
০ টি মন্তব্য