https://powerinai.com/

সাম্প্রতিক খবর

বাংলাদেশের আদিবাসী জনগোষ্ঠীর ডিজিটাল সংযোগ: অগ্রগতি, চ্যালেঞ্জ, সম্ভাবনা ও করণীয়

আন্তর্জাতিক আদিবাসী জনগোষ্ঠী দিবস ২০২৫ উপলক্ষে – “আদিবাসী জনগণ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: অধিকার রক্ষা, ভবিষ্যৎ নির্মাণ”* আন্তর্জাতিক আদিবাসী জনগোষ্ঠী দিবস ২০২৫ উপলক্ষে – “আদিবাসী জনগণ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: অধিকার রক্ষা, ভবিষ্যৎ নির্মাণ”*
 

বিশ্বজুড়ে "আদিবাসী জনগণ এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: অধিকার রক্ষা, ভবিষ্যৎ গঠন" এই প্রতিপাদ্যের অধীনে আন্তর্জাতিক আদিবাসী দিবস পালন করা হচ্ছে। যার প্রতিপাদ্য “আদিবাসী জনগণ ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI): অধিকার রক্ষা, ভবিষ্যৎ নির্মাণ”। এই প্রতিপাদ্য উদীয়মান প্রযুক্তি, বিশেষ করে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা যেন ক্ষমতায়নের হাতিয়ার হয়, বঞ্চনার নয়—সে জরুরি প্রয়োজনকে তুলে ধরে। এটি জাতিসংঘের বিশ্ব তথ্যসমাজ শীর্ষ সম্মেলন (WSIS) অ্যাকশন লাইন C8-এর অংশ, যা সাংস্কৃতিক বৈচিত্র্য, ভাষাগত বৈচিত্র্য এবং স্থানীয় কনটেন্টকে প্রাধান্য দেয়।

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দ্রুত আমাদের জীবন, কাজ এবং পারস্পরিক সংযোগের ধরন পরিবর্তন করছে। একইসঙ্গে শিক্ষা, স্বাস্থ্য, কৃষি ইত্যাদি খাতে উন্নতির নতুন সম্ভাবনা সৃষ্টি করছে। তবে এই বিপুল সম্ভাবনার পাশাপাশি কিছু ঝুঁকিও রয়েছে, বিশেষ করে আদিবাসী জনগণের জন্য।

জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের ২০২৪ সালের প্রস্তাব A/RES/78/265-এ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পুরো জীবনচক্র জুড়ে মানবাধিকার ও মৌলিক স্বাধীনতা রক্ষা, সুরক্ষা এবং উন্নয়নের গুরুত্বের কথা বলা হয়েছে। আদিবাসী জনগণের অধিকার স্বীকৃতি ও সুরক্ষা নিশ্চিত করলেই AI-এর ইতিবাচক সম্ভাবনা কাজে লাগানো যাবে এবং এর সুফল সবার মাঝে সমভাবে পৌঁছানো সম্ভব হবে। কার্যকর সুরক্ষা ব্যবস্থা নিলে ডিজিটাল বিভাজন দূর হবে, ঔপনিবেশিক উত্তরাধিকার পুনরাবৃত্তি রোধ হবে এবং একটি আরও অন্তর্ভুক্তিমূলক ভবিষ্যৎ গড়া সম্ভব হবে।

শাসন, অধিকার ও অন্তর্ভুক্তির প্রশ্ন

আদিবাসী জনগণের আত্মনিয়ন্ত্রণ, ভূমি ও এলাকার মালিকানা, সম্পদে প্রবেশাধিকার, ভাষা সংরক্ষণ এবং বিনা মূল্যে, পূর্বানুমতি ও অবহিত সম্মতি (FPIC)—এসব অধিকার আন্তর্জাতিক আইনে স্বীকৃত। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উন্নয়ন, বাস্তবায়ন ও শাসন এই অধিকারগুলোকে সমর্থন করার বড় সুযোগ এনে দিয়েছে।

AI-তে আদিবাসী অধিকার সুরক্ষাকে অগ্রাধিকার দিলে দীর্ঘদিনের বঞ্চনা, প্রান্তিককরণ ও সাংস্কৃতিক আত্মসাতের ধারা ভাঙা সম্ভব। আদিবাসীরা ডেটা সার্বভৌমত্ব-এর পক্ষে জোর দিয়ে এসেছে, যা তাদের নিজস্ব ডেটার মালিকানা, নিয়ন্ত্রণ ও ব্যবহারের অধিকার নিশ্চিত করে। FPIC আদিবাসীদের ডেটা কীভাবে ব্যবহার ও ভাগ করা হবে সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত গ্রহণে তাদের অংশগ্রহণ নিশ্চিত করে।

কোম্পানি ও ডেভেলপারদের উচিত আদিবাসী জনগণের ডেটা, জ্ঞান বা সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য ব্যবহারে এই অধিকারগুলো সম্মান করা। এতে একটি ন্যায়সঙ্গত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ভবিষ্যৎ গড়ে উঠবে, যেখানে আদিবাসী জনগণের অবদান ও কণ্ঠস্বর স্বীকৃত হবে।

বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট

বাংলাদেশের আদিবাসীরা—পার্বত্য চট্টগ্রাম, সিলেট, ময়মনসিংহ এবং উত্তরাঞ্চলে বিস্তৃত—এখনও গভীর ডিজিটাল বিভাজনের মধ্যে রয়েছে। দেশের সামগ্রিক ডিজিটাল অবকাঠামো সাম্প্রতিক বছরগুলোতে উন্নত হলেও, আদিবাসী জনগণ সমান প্রবেশাধিকার, অর্থবহ ব্যবহার এবং সাংস্কৃতিক অন্তর্ভুক্তিতে নানা প্রতিবন্ধকতার সম্মুখীন হচ্ছে। AI যখন অর্থনীতি, শাসন ও যোগাযোগের ধরন বদলে দিচ্ছে, তখন তাদের ডিজিটাল সংযোগ নিশ্চিত করা অপরিহার্য।

স্থায়ী চ্যালেঞ্জ

ভৌগোলিক প্রতিবন্ধকতা – পাহাড়ি এলাকা, নদী-দ্বীপ ও অরণ্যাঞ্চলে সংযোগ সম্প্রসারণ ব্যয়বহুল ও প্রযুক্তিগতভাবে জটিল।

সাশ্রয়ী মূল্যের অভাব – ইন্টারনেট ও ডিভাইসের উচ্চমূল্য নিম্ন-আয়ের পরিবারের জন্য বড় বাধা।

অর্থবহ সংযোগের অভাব – দৈনিক ব্যবহার, স্মার্টফোনে প্রবেশাধিকার, পর্যাপ্ত ডেটা এবং দ্রুতগতির সংযোগ (ন্যূনতম ৪জি) নিশ্চিত করা প্রয়োজন।

ডিজিটাল সাক্ষরতার ঘাটতি – ICT দক্ষতার অভাব এবং মাতৃভাষায় প্রশিক্ষণ উপকরণের স্বল্পতা।

ভাষা ও সাংস্কৃতিক অন্তর্ভুক্তি – অনলাইনে আদিবাসী ভাষার ব্যবহার বৃদ্ধি করে বৈচিত্র্যময় জ্ঞানব্যবস্থার প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত করা দরকার।

নীতিগত ঘাটতি – জাতীয় ICT ও AI নীতিতে আদিবাসী জনগণের জন্য লক্ষ্যভিত্তিক ব্যবস্থা অন্তর্ভুক্ত করা প্রয়োজন।

ডেটা সার্বভৌমত্ব – সাংস্কৃতিক ও জ্ঞানসম্পর্কিত ডেটার মালিকানা, নিয়ন্ত্রণ ও সুরক্ষা নিশ্চিত করতে হবে।

সম্ভাবনা (AI যুগে)

স্থানীয়কৃত ডিজিটাল পাবলিক ইনফ্রাস্ট্রাকচার (DPI) – AI-সক্ষম শাসন, শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবা প্ল্যাটফর্ম আদিবাসী ভাষা ও সংস্কৃতিতে অভিযোজিত করা।

সংস্কৃতি সংরক্ষণে AI – বিপন্ন ভাষা নথিভুক্ত, অনুবাদ ও পুনরুজ্জীবনে প্রাকৃতিক ভাষা প্রক্রিয়াকরণ প্রযুক্তি ব্যবহার, ডিজিটাল গল্প বলার মাধ্যমে মৌখিক ঐতিহ্য সংরক্ষণ।

AI-সহায়ক কমিউনিটি নেটওয়ার্ক – নেটওয়ার্ক অপ্টিমাইজেশনের মাধ্যমে সাশ্রয়ী ও কার্যকর সংযোগ নিশ্চিত।

জলবায়ু সহনশীলতা – AI-ভিত্তিক পূর্বাভাস, সম্পদ মানচিত্রায়ণ ও অভিযোজন সরঞ্জাম ব্যবহার করে দুর্যোগ মোকাবিলা।

তরুণ নেতৃত্ব – AI সাক্ষরতা, কোডিং ও ডিজিটাল উদ্যোক্তা প্রশিক্ষণ দিয়ে তরুণদের প্রযুক্তি ব্যবহারকারী ও উদ্ভাবকে পরিণত করা।

করণীয় ও নীতি-প্রস্তাব

অবকাঠামো প্রবেশাধিকার – স্থিতিশীল ইন্টারনেট সংযোগ ও বিদ্যুৎ সরবরাহ নিশ্চিত করা।

শিক্ষায় অন্তর্ভুক্তি – প্রতিটি আদিবাসী সম্প্রদায়ের সামাজিক-সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপট অনুযায়ী শিক্ষা ও ইন্টারনেট ব্যবহার পরিকল্পনা।

খরচ কাঠামো সমন্বয় – মোবাইল ইন্টারনেট খরচ কমানো।

সরকারি-বেসরকারি সহযোগিতা – জ্ঞানভিত্তিক সেবায় প্রবেশাধিকারের জন্য সক্রিয় সহায়তা।

অন্তর্ভুক্তিমূলক নীতি কাঠামো – জাতীয় ICT নীতি, ব্রডব্যান্ড নীতি, AI শাসন কাঠামো এবং সোশ্যাল অবলিগেটরি ফান্ডে আদিবাসী অধিকার অন্তর্ভুক্ত।

লক্ষ্যভিত্তিক বিনিয়োগ – উচ্চ ব্যয় ও কম লাভজনক এলাকায় সংযোগ বিস্তারে ভর্তুকি ও প্রণোদনা।

SOF-এর ব্যবহার – আদিবাসী কমিউনিটি নেটওয়ার্ক, ব্যক্তিগত ডিভাইস ভর্তুকি এবং নারীদের ইন্টারনেট প্রবেশাধিকার বৃদ্ধি।

স্থানীয় ভাষায় কনটেন্ট – শিক্ষা, স্বাস্থ্য ও প্রশাসনিক সেবা আদিবাসী ভাষায় তৈরি।

ক্ষমতায়ন ও দক্ষতা উন্নয়ন – নারী, যুব ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে অগ্রাধিকার দিয়ে কমিউনিটি-নেতৃত্বাধীন ICT ও AI প্রশিক্ষণ কেন্দ্র।

নৈতিক AI ও ডেটা সুরক্ষা – অবহিত সম্মতি, স্থানীয় নিয়ন্ত্রণ এবং পক্ষপাতহীন, সংস্কৃতিসম্মত AI প্রয়োগ নিশ্চিত।

উপসংহার

বাংলাদেশ যখন ডিজিটাল ও AI-চালিত ভবিষ্যতের পথে অগ্রসর হচ্ছে, তখন আদিবাসী জনগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্তি সমষ্টিগত অগ্রগতির জন্য অপরিহার্য। সংযোগের অর্থ কেবল প্রযুক্তি নয়—এটি সমাজ, অর্থনীতি ও রাজনীতিতে পূর্ণাঙ্গ অংশগ্রহণের অধিকার।

AI-র ইতিবাচক সম্ভাবনা কাজে লাগাতে, বিশেষত আদিবাসী নেতৃত্বকে অগ্রভাগে রেখে, সংস্কৃতিনির্ভর ও আদিবাসী-নেতৃত্বাধীন ডিজিটাল উদ্ভাবনে বিনিয়োগ করা প্রয়োজন। তাদের সক্রিয়ভাবে AI উন্নয়ন, বাস্তবায়ন ও শাসনে অন্তর্ভুক্ত করলে ক্ষতি প্রতিরোধ এবং সুফল সর্বাধিক করা সম্ভব হবে।

আন্তর্জাতিক আদিবাসী জনগোষ্ঠী দিবস ২০২৫-এ আহ্বান স্পষ্ট—চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করে ক্ষমতায়নের পথ তৈরি করা, ডিজিটাল বিভাজন দূর করা এবং আদিবাসী ডেটা সার্বভৌমত্ব রক্ষা করা। সঠিক বিনিয়োগ, দূরদর্শী নীতি ও অর্থবহ অংশীদারিত্বের মাধ্যমে বাংলাদেশ এমন এক ভবিষ্যৎ গড়তে পারবে, যেখানে আদিবাসী সম্প্রদায় সক্রিয়ভাবে ডিজিটাল ও AI অঙ্গনে অবদান রাখবে, তাদের অধিকার সংরক্ষণ করবে এবং জাতির সম্মিলিত ভবিষ্যতে তাদের প্রাপ্য স্থান নিশ্চিত করবে।

এ. এইচ. এম. বজলুর রহমান | ডিজিটাল গণতন্ত্র উন্নয়নে বিশেষজ্ঞ, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা

বাংলাদেশ এনজিওস নেটওয়ার্ক ফর রেডিও অ্যান্ড কমিউনিকেশন (বিএনএনআরসি), এবং বাংলাদেশে দায়িত্বশীল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার রাষ্ট্রদূত, নীতি গবেষণা ফেলো, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে গণমাধ্যম, তথ্যের অখণ্ডতা ও সমাজ গঠনের ভবিষ্যৎ রূপায়ণে নিয়োজিত! [email protected]








০ টি মন্তব্য



মতামত দিন

আপনি লগ ইন অবস্থায় নেই।
আপনার মতামতটি দেওয়ার জন্য লগ ইন করুন। যদি রেজিষ্ট্রেশন করা না থাকে প্রথমে রেজিষ্ট্রেশন করুন।







পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন? পুনরায় রিসেট করুন






রিভিউ

আপনি লগ ইন অবস্থায় নেই।
আপনার রিভিউ দেওয়ার জন্য লগ ইন করুন। যদি রেজিষ্ট্রেশন করা না থাকে প্রথমে রেজিষ্ট্রেশন করুন।