একটি সময়োপযোগী প্রশ্ন
জাতিসংঘকে ঘিরে বহুপাক্ষিকতার ভবিষ্যৎ নিয়ে এখন গভীর আত্মসমালোচনা চলছে। এমন এক প্রেক্ষাপটে জাতিসংঘের মহাসচিব নিজেই প্রশ্ন তুলেছেন—প্রতিষ্ঠানটি প্রতিবছর যে হাজার হাজার রিপোর্ট তৈরি করে, সেগুলোর বাস্তব প্রভাব আসলে কতটুকু? নিঃসন্দেহে কিছু রিপোর্ট অত্যন্ত জরুরি, যেমন সংঘাতপূর্ণ অঞ্চলে প্রযুক্তি কোম্পানির ভূমিকা নিয়ে তদন্ত। কিন্তু অনেক রিপোর্টই কেবল আমলাতান্ত্রিক রীতিনীতির অংশ, যা কার্যকর পরিবর্তন আনতে ব্যর্থ হয়। প্রশ্ন হচ্ছে—এই রিপোর্ট-নির্ভর সংস্কৃতি কি জাতিসংঘের মূল কাজকে আড়াল করছে?
মূল উদ্দেশ্যে ফেরা
জাতিসংঘের আসল কাজ হলো দেশগুলোকে আলোচনার টেবিলে বসিয়ে সংকট সমাধান করা। সমালোচকরা বলেন, অতিরিক্ত রিপোর্ট তৈরির ফলে এই মূল দায়িত্ব থেকে মনোযোগ সরে যায়। তাছাড়া, জটিল গবেষণার কাজ প্রায়ই বিশ্ববিদ্যালয় ও থিঙ্ক ট্যাঙ্কগুলোই আরও দক্ষভাবে করতে পারে। তবে সমর্থকরা মনে করেন, জাতিসংঘের অনন্য বৈধতা রিপোর্টগুলোকে বাড়তি গুরুত্ব দেয়, যা প্রায়শই একাডেমিক বিশ্লেষণে থাকে না।
ইতিহাসের শিক্ষা
ভিয়েনা কংগ্রেস (১৮১৫) আলোচনার সাফল্যে এক শতাব্দীর শান্তি এনেছিল। কিন্তু ভার্সাই চুক্তি (১৯১৯) আলোচনাকে বৈজ্ঞানিক কাঠামোয় রূপ দিতে গিয়ে অপমানজনক শর্ত চাপিয়ে দেয়, যা শেষ পর্যন্ত নাৎসিবাদের উত্থান ও দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পথ প্রশস্ত করে। শিক্ষা স্পষ্ট—কূটনীতি বিজ্ঞানের নিয়মে নয়, বরং শিল্পের সূক্ষ্মতায় টিকে থাকে।
রিপোর্টের সীমাবদ্ধতা
ইতিহাস সাক্ষ্য দেয়, রিপোর্ট যুদ্ধ থামাতে পারে না। লীগ অব নেশনস আক্রমণের নিখুঁত দলিল তৈরি করেও বিশ্বযুদ্ধ ঠেকাতে পারেনি। রাজনৈতিক সদিচ্ছা ছাড়া কোনো বিশ্লেষণই অর্থহীন। তবুও বলা হয়, রিপোর্ট অন্তত একটি যৌথ বাস্তবভিত্তি তৈরি করে, যা ছাড়া কূটনীতিও পথ হারায়।
খসড়া তৈরির আড়ালের রাজনীতি
জাতিসংঘের রিপোর্ট প্রায়ই আলোচনার ফল, যেখানে শক্তিধর রাষ্ট্রকে বিরক্ত না করতে ভাষা নরম করা হয়। এর ফলে সাহসী সত্য-বলার বদলে রাজনৈতিক সমঝোতাই প্রাধান্য পায়। কিন্তু অনেকে এটিকে দুর্বলতা নয়, বরং সুযোগ মনে করেন—কারণ রিপোর্ট খসড়া করাই অনানুষ্ঠানিক সমঝোতার নতুন ক্ষেত্র তৈরি করে।
আস্থার সংকট ও এআই চ্যালেঞ্জ
আজকের বিভক্ত বিশ্বে অনেক রাষ্ট্র জাতিসংঘের রিপোর্টের চেয়ে নিজেদের সংস্থা বা পছন্দের থিঙ্ক ট্যাঙ্কের বিশ্লেষণেই আস্থা রাখে। তবে অনেকে মনে করেন, এই আস্থার সংকট কাটাতেই জাতিসংঘের নিরপেক্ষ রিপোর্ট অপরিহার্য। এদিকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) তথ্য বিশ্লেষণে বিপ্লব এনেছে। যা করতে জাতিসংঘের অফিসারদের মাস লাগে, এআই তা মিনিটে করতে পারে। তবুও মানুষের সৃজনশীলতা, সূক্ষ্ম ইঙ্গিত পড়ার ক্ষমতা এবং অপ্রত্যাশিত অন্তর্দৃষ্টি দেওয়ার দক্ষতাই জাতিসংঘকে আলাদা মূল্য দিতে পারে।
করণীয়: কম রিপোর্ট, বেশি কূটনীতি
জাতিসংঘের উচিত রিপোর্ট পুরোপুরি বাদ দেওয়া নয়, বরং সেগুলোকে সংক্ষিপ্ত, স্পষ্ট এবং কার্যকর করার দিকে মনোযোগ দেওয়া। পৃথিবী তথ্যের স্রোতে ভাসছে, কিন্তু প্রজ্ঞা ও কর্মের অভাবে কাতর। জাতিসংঘের নেতৃত্ব দেওয়া উচিত এমন এক পরিবর্তনে, যেখানে অগণিত পিডিএফ নয়, বরং কার্যকর অন্তর্দৃষ্টি থাকবে।
সবচেয়ে জরুরি হলো জাতিসংঘকে তার আসল শক্তিতে ফিরে আসা: মধ্যস্থতা, আলোচনার আয়োজন এবং অনানুষ্ঠানিক সংলাপের ক্ষেত্র তৈরি। রিপোর্ট থাকুক, তবে সেটি হোক আলোচনার সহায়ক, বিকল্প নয়। এটাই হয়তো বহুপাক্ষিক কূটনীতিকে নতুন প্রাণ দেবে।
০ টি মন্তব্য