বিশ্ব বর্তমানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI)–কেন্দ্রিক এক নতুন প্রতিযোগিতার যুগে প্রবেশ করেছে, যেখানে নেতৃত্ব দিচ্ছে দুটি বৈশ্বিক শক্তি—যুক্তরাষ্ট্র ও চীন। ২১শ শতকের এই কৌশলগত প্রতিদ্বন্দ্বিতা কেবল প্রযুক্তি উদ্ভাবন বা বাজার–অর্থনীতির প্রতিযোগিতা নয়; বরং এটি বৈশ্বিক ক্ষমতার পুনর্বিন্যাস, নতুন ভূরাজনৈতিক বলয় গঠন, এবং মানবজাতির উন্নয়নযাত্রার ভবিষ্যৎ নির্ধারণে প্রত্যক্ষ প্রভাব ফেলছে।
শান্তিপূর্ণ নন-অ্যালাইন্ড ঐতিহ্য বহনকারী বাংলাদেশকে এই পরিবর্তনশীল বৈশ্বিক পরিবেশে এখন সুচিন্তিত, নীতিনিষ্ঠ এবং ডিজিটাল কূটনৈতিক দক্ষতার সাথে নিজ অবস্থান নির্ধারণ করতে হবে।
এই প্রেক্ষাপটে যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের AI অ্যাকশন প্ল্যান শুধু দুই পরাশক্তির কৌশলগত আকাঙ্ক্ষাই তুলে ধরছে না; বরং বাংলাদেশের মতো উদীয়মান ডিজিটাল অর্থনীতির জন্য নীতি–দিকনির্দেশনারও গুরুত্বপূর্ণ উৎস হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে। উভয় পরিকল্পনা অনুধাবন করলে স্পষ্ট হয়—AI প্রতিযোগিতা প্রযুক্তিগত আধিপত্যের পাশাপাশি শাসনব্যবস্থা, অবকাঠামো, নিরাপত্তা ও বহুপাক্ষিক কূটনীতির ভবিষ্যৎকেও গভীরভাবে প্রভাবিত করছে।
বৈশ্বিক AI শাসনব্যবস্থায় সম্পৃক্ততা : বাংলাদেশের কৌশলগত প্রয়োজন
বাংলাদেশের উচিত জাতিসংঘের স্বাধীন আন্তর্জাতিক বৈজ্ঞানিক প্যানেল অন AI এবং গ্লোবাল ডায়ালগ অন AI গভর্নেন্স–এ সক্রিয়, অর্থবহ ও ধারাবাহিক অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা। এই সম্পৃক্ততা বাংলাদেশকে বৈশ্বিক ডিজিটাল শাসনযাত্রার সামনের সারিতে অবস্থান নিতে সহায়তা করবে এবং একটি উজ্জ্বল, নিরাপদ, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও মানবকেন্দ্রিক ডিজিটাল ভবিষ্যৎ নির্মাণে কার্যকর অবদান রাখবে।
বাংলাদেশ অবজারভেটরি : ডিজিটাল গভর্নেন্সে সময়োপযোগী ও জরুরি পদক্ষেপ
বাংলাদেশের জন্য এখন জরুরি হয়ে উঠেছে WSIS, IGF, GDC, AI গভর্নেন্স, এবং Pact for the Future–কে কেন্দ্র করে একটি পূর্ণাঙ্গ বাংলাদেশ অবজারভেটরি প্রতিষ্ঠা করা। এই অবজারভেটরি পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাথে সমন্বিতভাবে সরকারের জন্য গবেষণা–নির্ভর নীতি–পরামর্শ, প্রমাণভিত্তিক বিশ্লেষণ, এবং কৌশলগত অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করবে—যা জাতীয় ডিজিটাল গভর্নেন্স কাঠামোকে শক্তিশালী করবে।
অবজারভেটরি একটি সহজ-উপযোগী গবেষণা ও তথ্য–কেন্দ্র হিসেবে বৈশ্বিক এবং আঞ্চলিক ডিজিটাল নীতি অগ্রগতি পর্যবেক্ষণ, তথ্য সংগ্রহ ও বিশ্লেষণের কাজ করবে। WSIS, IGF, GDC, AI গভর্নেন্স এবং Pact for the Future–সংক্রান্ত জটিল ইস্যুগুলোকে বোধগম্য করে তোলা এবং নীতিনির্ধারক, গবেষক, সিভিল সোসাইটি ও সাধারণ জনগণের মধ্যে সচেতনতা বৃদ্ধি এর একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা হবে।
বিশ্বস্ত উৎস থেকে সংগৃহীত তথ্য বিশ্লেষণ করে অবজারভেটরি ডিজিটাল অধিকার, নিয়ন্ত্রক কাঠামো, সাইবার নিরাপত্তা, AI নীতি, ডেটা গোপনীয়তা, এবং ডিজিটাল প্রযুক্তির সামাজিক-অর্থনৈতিক প্রভাব–সংক্রান্ত উদীয়মান বিষয়ে মূল্যবান অন্তর্দৃষ্টি সরবরাহ করবে।
প্রতিষ্ঠানটির মূল লক্ষ্য হলো—ডিজিটাল গভর্নেন্সে গবেষণা, বিশ্লেষণ ও তথ্য–বিনিময়ের জন্য একটি কেন্দ্রীয়, সমন্বিত ও বহুপাক্ষিক প্ল্যাটফর্ম তৈরি করা।
আমরা বিশ্বাস করি যে বাংলাদেশ অবজারভেটরি একটি নিরাপদ, অন্তর্ভুক্তিমূলক, মানবকেন্দ্রিক এবং দায়িত্বশীল ডিজিটাল সমাজ নির্মাণে বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে উল্লেখযোগ্যভাবে ত্বরান্বিত করবে।
যুক্তরাষ্ট্রের AI অ্যাকশন প্ল্যান : বৈশ্বিক প্রাধান্য সুরক্ষার কৌশল
২০২৫ সালে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড জে. ট্রাম্প প্রশাসন প্রকাশিত America’s AI Action Plan–এ তিনটি কৌশলগত স্তম্ভ নির্ধারণ করা হয়েছে—
1. AI উদ্ভাবন ও গবেষণা ত্বরান্বিত করা – নিয়ন্ত্রণ শিথিলকরণ, ওপেন-ওয়েট মডেল প্রমোট করা এবং বেসরকারি খাতকে কেন্দ্রীয় ভূমিকা প্রদান।
2. AI অবকাঠামো নির্মাণ – শক্তিশালী ডেটা সেন্টার, সেমিকন্ডাক্টর উৎপাদন, নিরাপদ ডিজিটাল অবকাঠামো এবং দক্ষ মানবসম্পদ।
3. আন্তর্জাতিক AI কূটনীতি ও নিরাপত্তা – মিত্ররাষ্ট্রে প্রযুক্তি রপ্তানি, প্রতিদ্বন্দ্বীদের ওপর নিয়ন্ত্রণমূলক বিধিনিষেধ এবং একটি বৈশ্বিক “AI Alliance” গঠন।
যুক্তরাষ্ট্র স্পষ্টভাবে জানিয়ে দিয়েছে যে AI শুধুমাত্র প্রযুক্তি উন্নয়নের বিষয় নয়; বরং জাতীয় নিরাপত্তা, ভূরাজনৈতিক প্রভাব এবং বৈশ্বিক মান নির্ধারণের একটি কৌশলগত সরঞ্জাম।
চীনের AI অ্যাকশন প্ল্যান : সমন্বিত সহযোগিতা ও বহুপাক্ষিকতা
একই সময় চীন সাংহাইয়ে Global AI Governance Action Plan ঘোষণা করে, যা বৈশ্বিক সহযোগিতা ও অংশীদারিত্বকে অগ্রাধিকার দেয়। এর মূল বৈশিষ্ট্য—
• উন্নয়নশীল দেশগুলোর ডিজিটাল অবকাঠামো উন্নয়ন
• ডেটা গোপনীয়তা ও নৈতিক AI ব্যবহারে জোর
• বিশ্ব দক্ষিণকে AI ব্যবহারে সক্ষম করা
• রাষ্ট্র–নেতৃত্বাধীন ও জন–নিজি অংশীদারিত্ব ভিত্তিক AI প্রয়োগ
চীনের এই পরিকল্পনা বৈশ্বিক দক্ষিণে ব্যাপক গ্রহণযোগ্যতা পাচ্ছে, কারণ এতে প্রযুক্তি ও সক্ষমতা হস্তান্তরের সুস্পষ্ট প্রতিশ্রুতি রয়েছে।
বাংলাদেশের জন্য কৌশলগত তাৎপর্য
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের ভিন্ন আদর্শিক নীতি–পন্থা বাংলাদেশের জন্য চ্যালেঞ্জ ও সুযোগ—উভয়ই। এখন প্রয়োজন একটি ভারসাম্যপূর্ণ, দূরদর্শী ও বাস্তববাদী কৌশল। বাংলাদেশের জন্য প্রধান অগ্রাধিকারগুলো হলো
১. শক্তিশালী AI অবকাঠামো নির্মাণ
ডেটা সেন্টার, কম্পিউটিং ক্ষমতা, সেমিকন্ডাক্টর দক্ষতা এবং উচ্চগতির নেটওয়ার্ক—এসবই ভবিষ্যতের প্রযুক্তি–ভিত্তিক উন্নয়নের অপরিহার্য ভিত্তি।
২. দৃঢ় ডেটা সুরক্ষা ও নিরাপত্তা কাঠামো
AI ব্যবহারের ঝুঁকি মোকাবিলায় শক্তিশালী ডেটা গোপনীয়তা আইন, সাইবার নিরাপত্তা কাঠামো ও ঝুঁকি মূল্যায়ন অপরিহার্য।
৩. সমন্বিত জাতীয় AI কাউন্সিল গঠন
সরকার, একাডেমিয়া, শিল্পখাত ও সিভিল সোসাইটির সমন্বয়ে নীতি–প্রণয়ন ও দক্ষতা উন্নয়নের কেন্দ্রীয় প্ল্যাটফর্ম প্রয়োজন।
৪. বহুপাক্ষিক আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্ব
যুক্তরাষ্ট্রের “AI Alliance” এবং চীনের “Global AI Cooperation Framework”—উভয়ের সঙ্গেই ভারসাম্যপূর্ণ, কৌশলগত ও ন্যূনতম ঝুঁকিযুক্ত সম্পৃক্ততা প্রয়োজন।
৫. কৃষি, শিক্ষা ও স্বাস্থ্য—অগ্রাধিকার খাত
এই তিন খাতে AI প্রয়োগ বাংলাদেশকে পরবর্তী উন্নয়নধাপে নিয়ে যাবে।
উপসংহার : ভবিষ্যৎ নির্মাণের দায়িত্ব আজকের
যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের AI অ্যাকশন প্ল্যান দেখায় যে বৈশ্বিক AI প্রতিযোগিতা নতুন রাজনৈতিক অর্থনীতি তৈরি করবে। তবে এই প্রতিযোগিতা উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্যও নতুন পথ ও সম্ভাবনার দ্বার খুলে দিচ্ছে।
বাংলাদেশের জন্য বার্তা স্পষ্ট—ভবিষ্যৎ অপেক্ষা করে পাওয়া যায় না; ভবিষ্যৎ নির্মাণ করতে হয়। অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি, নৈতিক মানদণ্ড, শক্তিশালী অবকাঠামো এবং আন্তর্জাতিক অংশীদারিত্বের ভিত্তিতে নিজস্ব জাতীয় AI রোডম্যাপ প্রণয়ন করতে পারলে বাংলাদেশ AI যুগে কেবল অংশগ্রহণকারী নয়, বরং সক্রিয় নেতৃত্বদাতা হিসেবেও আত্মপ্রকাশ করতে সক্ষম হবে।
প্রযুক্তি এগোচ্ছে আমাদের নৈতিকতার চেয়ে দ্রুত, আমাদের শাসনব্যবস্থার চেয়ে দ্রুত, এমনকি আমাদের কল্পনাশক্তির চেয়েও দ্রুত। এই গুরুত্বপূর্ণ মুহূর্তে একটি সত্য স্পষ্ট, মানবতার ভবিষ্যৎ নির্ভর করছে কেবল আমরা কী নির্মাণ করি তার উপর নয়— বরং কীভাবে নির্মাণ করি, কেন নির্মাণ করি, এবং কার হাতে নেতৃত্ব তুলে দিই তার উপর।
এ এইচ এম বজলুর রহমান, ডিজিটাল গণতন্ত্র অগ্রগতি বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশের জন্য দায়িত্বশীল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অ্যাম্বাসেডর








০ টি মন্তব্য