কমপিউটার আমদানীতে অধিক শুল্ক ও ভ্যাট আরোপের গুঞ্জন,
ডিজিটাল বাংলাদেশ স্বপ্নপূরণে অশনি সংকেত!
গত এক যুগ এর বেশি সময় ধরে দেশের বহুল আলোচিত বিষয় “ডিজিটাল বাংলাদেশ”। ডিজিটাল বাংলাদেশ এর মূল লক্ষ্য বাংলাদেশকে একটি তথ্য ও প্রযুক্তি নির্ভর রাষ্ট্র হিসেবে গড়ে তোলা; যেটি ২০০৮ সালের জাতীয় নির্বাচনে জয়ী হওয়ার পূর্বে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগের একটি নির্বাচনী ইশতিহার ছিল যা রূপকল্প-২০২১ বা ভিশন-২০২১ নামেও পরিচিত যেখানে ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের অঙ্গীকার করা হয়। গত এক যুগে ডিজিটাল বাংলাদেশ পুরোপুরি প্রতিষ্ঠিত না হলেও তার একটা শক্ত ভিত ইতোমধ্যে তৈরী হয়েছে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ বলতে, ডিজিটাল পণ্য তথা কমপিউটারের ব্যাপক ব্যবহার এবং শিক্ষা, স্বাস্থ্য, সরকারী সেবা ও দারিদ্র্য নিরসনের প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে প্রযুক্তির কার্যকর ও উপযোগী ব্যবহারকে বুঝায়। কমপিউটারের ব্যাপক ব্যবহার নির্ভর করে কমপিউটারের সহজলভ্যতার উপর। কমপিউটার ও তার আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতিসমূহ সহজলভ্য রাখার প্রক্রিয়া হিসেবে ১৯৯৭-১৯৯৮ অর্থবছর হতে আমদানী পর্যায়ে আমদানী শুল্কে বিশেষ সুবিধা ও ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়েছিল এবং বিগত ২০১৭-১৮ সাল হতে বিক্রয় পর্যায়ে ও এসব পণ্যে ভ্যাট অব্যাহতি দেওয়া হয়েছিল। যার ফলশ্রুতিতে এ যাবৎকাল পর্যন্ত ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের প্রধান অনুসঙ্গ কম্পিউটার ও তার আনুষঙ্গিক যন্ত্রপাতিসমূহ গ্রাহক পর্যায়ে মোটামুটি সহজলভ্য ছিল। কমপিউটারের সকল কম্পোনেন্ট সমূহ কোন একক প্রতিষ্ঠান (OEM) উৎপাদন করে না, বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান (OEM) এসব কম্পোনেন্ট এর উৎপাদনকারী হওয়ায় করোনাকালীন সময়ে বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন সময়ে লকডাউনের কারনে প্রয়োজনীয় উপকরণ সমূহ সময়মত সংগ্রহ করতে কমপিউটার সংযোজনকারী প্রতিষ্ঠান সমূহ ব্যর্থ হয়। ফলে আমাদের দেশে কমপিউটার পণ্য সরবরাহে বিঘ্ন ঘটে, তার সাথে হেলথ ইস্যু, চিপ সেটের সংকট সহ বিভিন্ন কারনে প্রধান কম্পোনেন্ট সমূহের (প্রসেসর, হার্ডডিস্ক, মাদারবোর্ড) মূল্য বেড়ে যায়। সেই সাথে পাল্লা দিয়ে বাড়তে থাকে ফ্রেইট বিল। করোনার পূর্বে চায়নার সাংহাই পোর্ট থেকে FOB বেসিসে ৪০ হাই কিউ ফিট একটি Container এর ফ্রেইট ছিল কম-বেশি ৪০০০ ডলার বর্তমানে সেটি ৮০০০ ডলার, যা পূর্বের চেয়ে দ্বিগুন। এতে করে সকল প্রকার কমপিউটারের দাম ১৫% থেকে ২০% বেড়ে যায়। উদাহারণস্বরূপ বলা যায়, পূর্বে কোর আই-৩ মানের একটা ল্যাপটপ ৩৪,০০০-৩৫,০০০ হাজার টাকায় পাওয়া যেত বর্তমানে যার মূল্য ৪২,০০০-৪৩,০০০ হাজার টাকা। শতকরা হিসেবে যা ২০%। সাম্প্রতিককালে ডলারের অতি উচ্চ মূল্যের কারনে আরও ৭% থেকে ৮% মূল্য বৃদ্ধি পেয়েছে। এমতাবস্থায় ২০২২-২৩ অর্থ বছরের বাজেটে কমপিউটার আমদানীতে অধিক শুল্ক ও ভ্যাট আরোপিত হলে এসব পণ্যসমূহের দাম বর্তমানের তুলনায় আরো ২০%-৩০% বেড়ে যাবে যা বহন করতে হবে কৃষক ও স্বল্প আয়ের পরিবারের শিক্ষার্থীদেরকেও। কেননা কমপিউটার এখন শিক্ষার অন্যতম উপকরণ। শিক্ষার ডিজিটাল ভার্সন অনেক আগে থেকে শুরু হলেও করোনা অভিজ্ঞতায় তাতে অনেক বেশী গতি সঞ্চারিত হয়েছে।
বর্তমানে বাংলাদেশে ৫২ টি পাবলিক বিশ^বিদ্যালয় এবং ১০৩ টি প্রাইভেট বিশ^বিদ্যালয় থেকে প্রতি বছর ২০,০০০ কমপিউটার গ্র্যাজুয়েট বের হচ্ছে এবং প্রায় ৮০ থেকে ৯০ হাজার ছাত্র-ছাত্রী কমপিউটার সাইন্সে পড়াশোনা করছে। তাছাড়া ১৯৯৮ সাল থেকে মাধ্যমিক ও উচ্চমাধ্যমিকে কমপিউটার শিক্ষাকে বাধ্যতামূলক করা হয়েছে আর সেখানেও বিপুল শিক্ষার্থীর কমপিউটার প্রয়োজনীয় হয়ে পড়েছে।
দেশীয় কমপিউটার শিল্পের বিস্তারের অযুহাতে আমদানী পর্যায়ে শুল্ক ও ভ্যাট বৃদ্ধির গুঞ্জন শেনা যাচ্ছে যা মোটেও সমীচিন হবে না। কেননা দেশের কম্পিউটার বাজার এখনো আমদানী নির্ভর। দেশীয় শিল্পের পথচলা মাত্র শুরু হয়েছে এর বিস্তারে আরো সময়ের প্রয়োজন। রাতারাতি আর্ন্তজাতিক মানের আর্ন্তজাতিক ব্র্যান্ডের কমপিউটার তৈরী করা সম্ভব নয় ।
স্বনামধন্য আর্ন্তজাতিক মানের ব্র্যান্ড গুলোর সাথে নীতি নির্ধারণী কতৃপক্ষের আলাপ আলোচনা এবং সম্ভব্যতা যাচাই ছাড়া হুজুগে কোন সিদ্ধান্ত নিলে সেটা হবে আত্মঘাতি এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের অন্তরায়।
বলা হচ্ছে মোবাইল হ্যান্ডসেট আমদানীতে অধিক শুল্ক ও করহার আরোপের ফলে দেশে দেশীয় মোবাইল শিল্পের বিস্তার ঘটেছে। কিন্ত মনে রাখতে হবে মোবাইল মার্কেট আর কমপিউটার মার্কেট এক নয়। এছাড়া দু’য়ের ব্যবহারকারী ও ক্রয় পলিসি ও ভিন্ন ভিন্ন। বর্তমানে বাংলাদেশে মোবাইল হ্যান্ডসেটের মার্কেট সাইজ ১১,০০০ কোটি টাকার যেখানে কম্পিউটারের মার্কেট সাইজ ৫,০০০ কোটি টাকা। সংখ্যার হিসেবে বাংলাদেশে মোবাইল হ্যান্ডসেটের বাৎসরিক চাহিদা ৩ কোটি ২০ লক্ষ যেখানে কমপিউটারের চাহিদা মাত্র ৫ লক্ষ। সুতরাং এত ক্ষুদ্র সাইজের মার্কেটে আর্ন্তজাতিক ব্র্যান্ডগুলোর আগ্রহ তেমন থাকার কথা নয়। তাছাড়া মোবাইল সেটের গ্রাহক ইনডিভিজুয়্যাল ব্যক্তি, যারা তাদের পছন্দ, বাজেট ও মর্জির ভিত্তিতে ক্রয় করে থাকে, যেখানে কমপিউটারের একটি বৃহৎ মার্কেট কর্পোরেট ও ফরেন ফান্ডেড প্রকল্পসমূহ; যাদেরকে পণ্য কিনতে সুনির্দিষ্ট নিয়মাবলী কঠোরভাবে অনুসরণ করতে হয়। মোবাইল হ্যান্ডসেটের স্থায়ীত্ব কম হওয়াতে প্রতি ১ থেকে ২ বছর অন্তর পরিবর্তন করে থাকে যেখানে কমপিউটার পরিবর্তন করে ৫-৭ বছর অন্তর।
কমপিউটার পন্যের বিভিন্ন আর্ন্তজাতিক সার্টিফিকেশন ও OEM কোম্পানীর আর্ন্তজাতিক রেটিং এর কারনে বিদেশী সাহায্যপৃষ্ঠ প্রকল্প, বহুজাতিক কোম্পানী, কর্পোরেট প্রতিষ্ঠানসমূহের শর্তপূরনে দেশীয় কোম্পানীসমূহ প্রতিযোগিতামূলক OTM পদ্ধতির ক্রয় প্রক্রিয়ায় বাদ পড়বে। এসকল বিষয়সমূহ বিবেচনায় না নিয়ে মোবাইল শিল্পের উদাহারণ এবং একমাত্র দেশীয় শিল্পের উপর ভিত্তি করে কমপিউটার পন্যের আমদানীতে শুল্ক ও কর বৃদ্ধি সরকারের রূপকল্প ২০৪১ এবং ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মানের স্বপ্নে ব্যাঘাট ঘটবে। যেখানে সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশের বাস্তব রূপদানকল্পে বর্তমানে ৯,০০০ কোটি টাকার বিভিন্ন প্রকল্প চলমান রয়েছে যাদের মধ্যে ইনফো-সরকার, শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব, বাংলাদেশ ই-গর্ভনমেন্ট ইআরপি প্রকল্প অন্যতম। তাছাড়া সম্প্রতি সরকার ওয়ার্ল্ড ব্যাংকের আর্থিক সহায়তায় ডিজিটাল বাংলাদেশ বা রূপকল্প-২০৪১ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে ২,৫৪১ কোটি টাকার Enhancing Digital Government & Economy নামে আরো একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে যার মেয়াদকাল হবে ২০২২ থেকে ২০২৬ সাল পর্যন্ত।
কমপিউটার আমদানীতে শুল্ক ও ভ্যাট আরোপিত হলে সরকারের এসব প্রকল্পসমূহের ব্যয় বেড়ে যাবে এবং সরকারের অন্যান্য মন্ত্রনালয় ও বিভাগের ব্যয় ও বাড়বে সেই সাথে শিক্ষার্থী ও স্বল্প আয়ের মানুষের নাগালের বাইরে চলে যাবে।
ডিজিটাল বাংলাদেশ গঠনের প্রধান উপকরণ কমপিউটার। দেশীয় শিল্পের বিকাশে কমপিউটার আমদানী ও উৎপাদনে কর ও শুল্কের পার্থক্য গড়ার জন্য আমদানীর পর্যায়ে করহার বাড়ানোর অযুহাত মোটেও যৌক্তিক নয়। কেননা আমদানী ও উৎপাদনে বর্তমানে ১৬% এর মত করের পার্থক্য এখনই বিদ্যমান রয়েছে । নতুন করে এটা আরো বাড়ানোর চিন্তা অযৌক্তিক, অপরিপক্ক ও অমূলক। কমপিউটার উৎপাদন/সংযোজনকারী প্রতিষ্ঠান কর অবকাশ সুবিধা ভোগ করছে যার কারণে কাঁচামাল আমদানীতে ৫% অগ্রিম আয়কর (AIT) প্রদান করতে হয় না এবং আমদানী শুল্ক প্রদান করতে হয় মাত্র ১%, যেখানে আমদানীকারকরা দিচ্ছে ৫%। কর অবকাশ এর আওতায় থাকায় প্রাতিষ্ঠানিক বিক্রয়ের ক্ষেত্রে উৎসে কর কর্তন (TDS) থেকে রেহাই পাচ্ছে যেখানে আমদানীকারকের বিল থেকে মূল্য পরিশোধকারী প্রতিষ্ঠান সর্বোচ্চ ৭% হারে উৎসে কর কর্তন করে থাকে। সব মিলিয়ে দেশীয় শিল্প মোট (৫+৭+৪)=১৬% কর ও শুল্ক সুবিধা ভোগ করছে। সুতরাং আরো বেশী পার্থক্য গড়ার পরিকল্পনা কতটা যৌক্তিক বিষয়টি গভীরভাবে ভাবার অবকাশ রয়েছে।
ব্যাপক প্রণোদনা নিয়ে দেশে মোবাইল শিল্পের বিকাশ ঘটলেও স্থানীয় বাজারে এসব পণ্যের দাম ও মান নিয়ে ব্যাপক প্রশ্ন রয়েছে এবং এসব শিল্প হাইটেক প্রযুক্তির হওয়ায় কাংঙ্খিত কর্মসংস্থানের স্বপ্ন বাস্তবায়িত হয়েছে কিনা সেটাও দেখার বিষয়। তারপরেও সীমিত পরিসরে হলেও কমপিউটার উৎপাদনে যেতে পারা নিঃসন্দেহে আমাদের দেশের জন্য অত্যন্ত গর্বের ও স্বস্তির বিষয়। কিন্ত উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জনের পূর্বে এরূপ আত্মঘাতি সিদ্ধান্ত সরকারের ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নকে বিলম্বিত করবে। কমপিউটার সাধারণ মানুষ ও শিক্ষার্থীরদের ক্রয়ক্ষমতার বাইরে চলে যাবে। কমপিউটার উৎপাদনের সক্ষমতা অর্জনের জন্য সময়ের প্রয়োজন। বঙ্গবন্ধু হাইটেক পার্কে দেশের সকল প্রধান আমদানীকারকরা আইটি ইন্ডাষ্ট্রি স্থাপনের জন্য ইতোমধ্যে প্লট বরাদ্দ নিয়েছেন এবং অবকাঠামো নির্মান শুরু হয়ে দিয়েছেন। আগামী ২ বছরের মধ্যে অনেক আমদানীকারকগণই সীমিত আকারে উৎপাদনে চলে যাওয়ার সক্ষমতা অর্জন করবে। সুতরাং দেশীয় পণ্য দ্বারা দেশের মোট চাহিদার সিংহভাগ যোগানের সক্ষমতা অর্জনের পূর্ব পর্যন্ত কমপিউটার পণ্যের আমদানীর উপর পুনরায় কর ও শুল্ক আরোপ না করার জন্য সংশ্লিষ্ট কতৃপক্ষের সুদৃষ্টি জরুরী।
০ টি মন্তব্য