দেশে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারের সঙ্গে সমান্তরাল হারে বাড়ছে সাইবার অপরাধ। সহিংস উগ্রবাদ, গুজব, রাজনৈতিক অপপ্রচার, মিথ্যা সংবাদ, গ্যাং কালচার, আত্মহত্যা, পর্নোগ্রাফি, সাইবার বুলিং, জালিয়াতি, চাঁদাবাজি, পাইরেসি, আসক্তি এমনসব অপরাধমূলক কাজ সংগঠিত হচ্ছে প্রযুক্তির অপব্যবহারের মাধ্যমে। প্রযুক্তির অগ্রগতির সাথে আমাদেরকে থাকতে হবে। তবে প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রে ঝুঁকিমুক্ত থাকতে হলে প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার জানতে হবে। আমাদেরকে আরো সচেতন হতে হবে।
দেশে সাইবার অপরাধের পরিমাণ বাড়ছে। বুলিং কমলেও নতুন রূপে আবির্ভূত এই সাইবার অপরাধের শিকার হচ্ছেন সব শ্রেণির মানুষ। তবে এ অপরাধে সবচেয়ে বেশি শিকার হচ্ছে নারী ও শিশু। মাধ্যমটিকে ব্যবহার করে আর্থিক প্রতারণাও বেড়েছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ সাইবার অপরাধপ্রবণতা-২০২৩ প্রতিবেদনে এমন তথ্য উঠে এসেছে। স্বেচ্ছাসেবী সংগঠন সাইবার ক্রাইম অ্যাওয়ারনেস ফাউন্ডেশন (সিক্যাফ) ধারাবাহিকভাবে এ প্রতিবেদন প্রকাশ করে আসছে। চলতি বছরে পঞ্চমবারের মতো প্রকাশিত প্রতিবেদনে উদ্বেগজনক যে বিষয়টি উল্লেখ করা হয়েছে তা হচ্ছে, ২০১৮ সালে ৫টি জরিপে সাইবার অপরাধের শিকার ভুক্তভোগীদের মাঝে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে অভিযোগ দেওয়ার প্রবণতা কমেছে। ২০১৮ সালে এ হার ছিল ৬১ শতাংশ, কিন্তু সবশেষ তা নেমে দাঁড়িয়েছে ২০ দশমিক ৮৩ শতাংশে। তবে অভিযোগ দেওয়ার হার কমলেও দেশে সাম্প্রতিক সময়ে অপরাধের মাত্রা বেড়েছে ৩৮১ দশমিক ৭৬ শতাংশ।
আসলে অনলাইনের প্রতি মানুষের আগ্রহ বৃদ্ধি পাওয়ায় প্রতারকরাও এ মাধ্যমটিকে ব্যবহার করছে। অনলাইনে কেনাকাটায় ব্যবহারকারীদের আগ্রহ বাড়ায় পণ্য কিনতে গিয়ে হরহামেশাই প্রতারণার শিকার হচ্ছেন তারা। এছাড়া অ্যাপের মাধ্যমে ঋণের নামে ফাঁদ পাতার অভিনব পদ্ধতিও চোখে পড়ার মতো। অনলাইনে জুয়ার বিষয়টিও চলছে গোপনে। সাধারণ মানুষ প্রতারকদের চটকদার বিজ্ঞাপনের ফাঁদে পা দিয়ে অর্থ হারাচ্ছেন। প্রতারিত হওয়ার পর লজ্জা আর ঝামেলা এড়াতে তারাও আইনের শরণাপন্ন হচ্ছেন না। অনেকে আবার জানেন না, কীভাবে আইনি প্রক্রিয়ায় প্রতিকার মেলে। অবশ্য পর্নোগ্রাফি ব্যবহার করে হয়রানির পরিমাণ সাম্প্রতিক সময়ে কমতে দেখা গেছে। প্রতিবেদনের উল্লিখিত পরিসংখ্যান বলছে, ফটোশপে ছবি বিকৃত করে অনলাইনে প্রচারের হার ২০১৮ সালে ছিল ২২ দশমিক ৩১ শতাংশ, যা কমে ৭ দশমিক ৪৬ শতাংশে নেমেছে। অভিযোগের পর আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর তৎপরতায় এই পরিমাণ কমেছে। যদিও আইডি ডিজেবল করে দেওয়া, চাকরির কথা বলে প্রতারণা ও মিথ্যা আশ্বাস দিয়ে টাকা নেওয়ার মতো অপরাধ উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। এ বিষয়ে সুষ্ঠু তদন্তের মাধ্যমে অপরাধীদের আইনের আওতায় আনতে হবে।
অনলাইন দুনিয়ার আরেক নাম সাইবার জগৎ। সমাজের বেশিরভাগ মানুষ এখন কোনো না কোনোভাবে সাইবার দুনিয়ার বাসিন্দা। আর এই সাইবার জগৎ এখন খুবই বিক্ষিপ্ত। সাইবারযুদ্ধ তথা হামলা-পাল্টা হামলা, হ্যাকসহ নানা সংঘর্ষ চলছে সাইবার দুনিয়ায়। এর ফলে এখন সবচেয়ে জরুরি বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে সাইবার নিরাপত্তা। প্রাতিষ্ঠানিক বা ব্যক্তিগত ক্ষেত্রে কীভাবে নিজের গুরুত্বপূর্ণ বা স্পর্শকাতর তথ্য-উপাত্ত নিরাপদ রাখা যায়, সেটিই এখন বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়িয়েছে। ২০ বছর আগে যুক্তরাষ্টে্রর হোমল্যান্ড সিকিউরিটি এই অক্টোবর মাসকে জাতীয় সাইবার নিরাপত্তার বিষয়টি সামনে নিয়ে আসে। বর্তমান অবস্থার প্রেক্ষাপটে সাইবার নিরাপত্তা সচেতনতা আমাদের জন্য আগের তুলনায় অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ। ফিশিং আক্রমণ, রেনসম-ওয়ার আক্রমণ এবং অন্যান্য আক্রমণের প্রবণতা আগের তুলনায় অনেকগুণ বেড়েছে। পর্যবেক্ষণের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি ৩৯ সেকেন্ডে একটি সাইবার আক্রমণের তথ্য পাওয়া যায়। বিশ্বব্যাপী ৯৪ শতাংশ কোম্পানি যেকোনো এক ধরনের আক্রমণের সম্মুখীন হয়েছে। অত্যন্ত উদ্বেগজনক তথ্য হচ্ছে- কমপক্ষে ৯৫ শতাংশ মানুষ নিজের ভুলে সাইবার হামলার শিকার হন। অর্থাৎ সাইবার হামলাগুলো সাধারণত মানুষের অজ্ঞতা বা কোনো না কোনো ভুলের কারণে হয়ে থাকে। একন প্রতিনিয়ত ছোট এবং মাঝারি প্রতিষ্ঠানগুলোতে আক্রমণের সংখ্যা দিন দিন বৃদ্ধি পাচ্ছে। গ্লোবাল স্টেট অব সিকিউরিটির তথ্য অনুযায়ী, ৬৬ শতাংশ ছোট এবং মাঝারি প্রতিষ্ঠান গত এক বছরে কোনো এক ধরনের সাইবার হামলার সম্মুখীন হয়েছে।
বিভিন্ন প্রচার অভিযানের মাধ্যমে সাইবার নিরাপত্তার সর্বোত্তম অনুশীলন সম্পর্কে সচেতনতা বৃদ্ধি এবং সাইবার অনুপ্রবেশ প্রতিরোধের জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টার ওপর জোর দিতে হবে। এ ছাড়া সাইবার হামলার প্রতিরোধ এবং আক্রমণের ক্ষয়ক্ষতি থেকে পরিত্রাণের জন্য ব্যক্তিগত এবং প্রাতিষ্ঠানিকভাবে প্রয়োজনীয় নানা পদক্ষেপ নেওয়া যায়। লিংকে ক্লিক করার আগে চিন্তা করা। কোনো লিংকে ক্লিক করার আগে ভালো-মন্দ বা ঝুঁকির বিষয়গুলো ভালোভাবে খেয়াল করতে হবে। কারণ বিভিন্ন লিংকের মাধ্যমে ফিশিং বা ম্যালওয়ারগুলো ছড়িয়ে পড়ে এবং ইউজারের ‘স্পর্শকাতর তথ্যগুলো’ হ্যাক হয়ে যায়। সফটওয়্যার আপডেট সম্পর্কিত কোনো নোটিফিকেশন পেলে সঙ্গে সঙ্গে ‘ইনস্টল’ করার ব্যবস্থা করা এবং অটোআপডেট অপশনটি এনাবল বা অন করে রাখা। আমাদের কমপ্লেক্স পাসওয়ার্ড ব্যবহার করা প্রয়োজন। বিশেষ করে সোশ্যাল মিডিয়া, যেকোনো সফটওয়্যার এবং বিভিন্ন ডিভাইসে লগ-ইন করার জন্য কমপ্লেক্স পাসওয়ার্ড ব্যবহার করতে হবে। কমপ্লেক্স পাসওয়ার্ডের ক্ষেত্রে অবশ্যই ক্যাপিটাল লেটার, স্মল লেটার, নাম্বার এবং স্পেশাল ক্যারেক্টার থাকতে হবে। মাল্টিফ্যাক্টর অথেনটিকেশন অর্থাৎ অনলাইন লগ-ইন করার ক্ষেত্রে মাল্টিফ্যাক্টর অথেনটিকেশন অপশন চালু করে ওয়ানটাইম টোকেন দিয়ে ইউজার অথেন্টিকেশন যাচাই করতে হবে।
প্যাচ ম্যানেজমেন্ট অর্থাৎ অপারেটিং সিস্টেম এবং অন্যান্য সফটওয়্যারের নিয়মিত আপডেট রাখা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। প্রত্যেক মাসের দ্বিতীয় মঙ্গলবার মাইক্রোসফট তার অপারেটিং সিস্টেম ও অন্যান্য সফটওয়্যারের আপডেট রিলিজ দিয়ে থাকে। আমাদের উচিত নতুন আপডেট আসার সঙ্গে সঙ্গে যথাযথ পর্যালোচনা করে সেগুলো ইনস্টল করা। প্যাচ ম্যানেজমেন্টের জন্য একটি সুনির্দিষ্ট প্রক্রিয়া অনুসরণ করতে হবে।
প্রতিষ্ঠানের সব কর্মকর্তা-কর্মচারীর সাইবার নিরাপত্তা সম্পর্কে যথাযথ জ্ঞান থাকতে হবে। সে লক্ষ্যে সবার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করতে হবে। একমাত্র সচেতনতাই সোশ্যাল ইঞ্জিনিয়ারিং এবং ফিশিং আক্রমণ থেকে সুরক্ষিত থাকতে পারবেন। ব্যাকআপ প্ল্যান থাকতে পারে। প্রতিষ্ঠানের তথ্য বা ডাটা অত্যন্ত মূল্যবান। সব মূল্যবান তথ্যের সুরক্ষার লক্ষ্যে যথাযথ ডাটা ব্যাকআপ প্ল্যান তৈরি করতে হবে। ডাটা ব্যাকআপের একটি কপি অনসাইট এবং আরেকটি কপি অফসাইটে রাখতে হবে। আইটি নিরাপত্তা পলিসি তৈরি করতে হবে। ছোট-বড় সব প্রতিষ্ঠানের জন্য একটি আইটি সিকিউরিটি পলিসি থাকতে হবে। পলিসি অনুমোদন ও বাস্তবায়নের জন্য প্রতিষ্ঠানের ম্যানেজমেন্ট এবং আইটি সিকিউরিটি টিমকে একত্রে কাজ করতে হবে।
ইন্টারনাল এবং এক্সটারনাল টেস্টিং। প্রতিষ্ঠানের নেটওয়ার্ক, সিস্টেম এবং সফটওয়্যারের নিয়মিত সিকিউরিটি টেস্টিং বাধ্যতামূলক করতে হবে। প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব আইটি টিম প্রত্যেক মাসে একবার ইন্টারনাল সিকিউরিটি টেস্ট করবেন। এক্সটারনাল টেস্টের জন্য স্বনামধন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে নিয়োগ দেবেন, যাদেও পেনিট্রেশন টেস্টিংয়ের পূর্বঅভিজ্ঞতা রয়েছে। রেগুলেটরি এবং কমপ্লায়েন্স করা কয়েকটি আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান আইটি নিরাপত্তার নিয়ম-নীতি বা নির্দেশিকা নিয়ে কাজ করে থাকে, যেমন আইএসও, পিসিআই এবং এইচএইচএস তাদের মধ্যে অন্যতম। আপনার প্রতিষ্ঠানের ব্যবসার ধরন অনুযায়ী এক বা একাধিক কমপ্লায়েন্স অনুসরণ করতে পারেন যা প্রতিষ্ঠানের সার্বিক নিয়ম-নীতি তথা তথ্যপ্রযুক্তির সিকিউরিটি বৃদ্ধিতে সর্বোচ্চ অবদান রাখবে।











০ টি মন্তব্য