বিদ্যুৎ উৎপাদনসহ বিভিন্ন ক্ষেত্রে বিশ্বে বাড়ছে চতুর্থ প্রজন্মের পারমাণবিক প্রযুক্তির ব্যবহার। বিজ্ঞানীরা বলছেন, নতুন প্রজন্মের এসব প্রযুক্তি আগের তুলনায় আরও উন্নত, নিরাপদ ও পরিবেশবান্ধব। প্রশ্ন আসছে, এক্ষেত্রে বাংলাদেশের অবস্থান কী? নীতিনির্ধারকরা বলছেন, চোখ আছে প্রযুক্তির সবশেষ সংস্করণের দিকে। তবে আন্তর্জাতিক আণবিক শক্তি কমিশনের অনুমোদনের পরই কেবল তা ব্যবহার করবে বাংলাদেশ।
রুশ বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীরা যা বলছেন, তাতে সহজ ভাষায় দাঁড়ায়, অর্থনীতি—নিরাপত্তা আর পরিবেশগত দিক বিবেচনায় চতুর্থ প্রজন্মের প্রযুক্তি হবে আরও উন্নত, সাশ্রয়ী ও নিরাপদ। কমাবে কার্বন নিঃসরণ। অত্যাধুনিক রিঅ্যাক্টর বা চুল্লি সক্ষম হবে আরও দক্ষতার সঙ্গে বিদ্যুৎ উৎপাদনে। জ্বালানির প্রাপ্যতা নিয়েও ভাবতে হবে না তেমন। ব্যবহৃত জ্বালানি স্পেন্ট ফুয়েল পুনরায় ব্যবহারের মাধ্যমে করা যাবে বিদ্যুৎ উৎপাদন। রিঅ্যাক্টর বা চুল্লির আকৃতি ছোট হওয়ায় অল্প জায়গাতেই তৈরি করা যাবে পারমাণবিক বিদ্যুৎকেন্দ্র।
তথ্যপ্রযুক্তি খাতেও দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে বাংলাদেশ। এ পরিবর্তন আসছে সরকারি বিভিন্ন উদ্যোগের পাশাপাশি তরুণদের নানা উদ্যোগ আর প্রচেষ্টায়। তাঁদের হাত ধরেই দেশে স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটের ব্যবহার বাড়ছে। এতে দ্রুত বদলে যাচ্ছে দেশের বিভিন্ন খাত। যেমন : এক তরুণ কুষ্টিয়ার প্রত্যন্ত এলাকায় তথ্যপ্রযুক্তি প্রশিক্ষণের জন্য একটি প্রতিষ্ঠান দিচ্ছেন। তিনি জানালেন, নিজের এলাকায় তথ্যপ্রযুক্তির প্রশিক্ষক হিসেবে বেসিক কম্পিউটার, গ্রাফিকস ডিজাইন, ওয়েব ডেভেলপমেন্টের মতো নানা কাজ শেখানোর উদ্যোগ নিচ্ছেন তিনি। তাঁর মতো অনেক তরুণই দেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উন্নয়নে রাখছেন বিশেষ ভূমিকা।
সম্প্রতি আর্মেনিয়ার বিসিজি সিনিয়র পার্টনার ও গ্লোবাল লিডার ফর ডিজিটাল গভর্নমেন্ট মিগুয়েল কারারসকো বলেন, প্রযুক্তি কর্মসংস্থান তৈরি করে। আগামী দিনে যে রকম কাজ হবে, এর ১০ শতাংশ কম্পিউটার প্রোগ্রামিং, ২০ শতাংশ করবে প্রযুক্তি। বাকি ৭০ শতাংশের জন্য মানুষকেই লাগবে। অনলাইন লার্নিং প্ল্যাটফর্ম কোরসেরার বৈশ্বিক দক্ষতা সূচক বা ‘গ্লোবাল স্কিলস ইনডেক্স ২০১৯’ (জিএসআই) অনুযায়ী, প্রযুক্তিগত দক্ষতার দিক থেকে অপারেটিং সিস্টেম, সফটওয়্যার ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের মতো ক্ষেত্রে ভালো করছে বাংলাদেশ। ওই তালিকায় বাংলাদেশসহ এশিয়া—প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের দেশগুলোর পারফরম্যান্স তুলে ধরা হয়েছে। ওই সূচকে দেখানো হয়েছে, ৯০ শতাংশ উন্নয়নশীল অর্থনীতি এখন ক্রিটিক্যাল স্কিল বা জটিল দক্ষতা অর্জনের ক্ষেত্রে পেছনে পড়ে যাচ্ছে বা ঝুঁকিতে পড়ছে। এ ক্ষেত্রে প্রযুক্তিগত দক্ষতার ক্ষেত্রে ভালো করছে বাংলাদেশ।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রস্তুতিতে এখনো পিছিয়ে বাংলাদেশ
আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) এআই প্রস্তুতি সূচকে ১৭৪টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৩তম। ডিজিটাল অবকাঠামো, মানবপুঁজি ও শ্রমবাজার নীতি, উদ্ভাবন ও অর্থনৈতিক একীকরণ, নিয়ন্ত্রণ ও নীতি— এই চারটি ভিত্তির ওপর সূচক তৈরি করা হয়েছে। এই সূচকে বাংলাদেশের থেকে এগিয়ে আছে ভারত, শ্রীলঙ্কা, ভুটান, ভিয়েতনাম, ইন্দোনেশিয়া। আর কেনিয়া, রুয়ান্ডা, ঘানা, সেনেগালের মতো আফ্রিকার দেশগুলোও এই সূচকে বাংলাদেশের চেয়ে এগিয়ে আছে। এআইয়ের প্রস্তুতিতে সূচকে শীর্ষে রয়েছে সিঙ্গাপুর।
এই সূচক প্রসঙ্গে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তথ্যপ্রযুক্তি ইনস্টিটিউটের পরিচালক বলেন, এটা আসলে এআই ব্যবহারের অবস্থা নয়, প্রস্তুতির সূচক। এটা করা হয়েছে যাতে দেশগুলো তাদের পলিসি ও প্রস্তুতির সিদ্ধান্ত নিতে পারে। এখানে অবকাঠামো, দক্ষ মানবসম্পদ, শ্রম আইন— এইসব বিষয় তারা বিবেচনায় নিয়েছে। তাতে স্পষ্ট—এআইর জন্য যে মানবসম্পদ দরকার, সেদিকে আমাদের উদ্যোগ তেমন নেই।
আইএমএফ বলছে, এআই উৎপাদনশীলতা, অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ও আয় বাড়াতে পারে। অনেক লোকের কর্মসংস্থান হতে পারে। তবে এটা বৈষম্যও বাড়াতে পারে, কাজও হারাতে পারেন অনেকে।
আইএমএফের গবেষণা অনুযায়ী এআই উন্নত অর্থনীতির দেশের ৩৩ শতাংশ, উদীয়মান অর্থনীতির দেশের ২৪ শতাংশ ও নিম্ন আয়ের দেশে ১৮ শতাংশ চাকরিকে ঝুঁকিতে ফেলতে পারে। অন্যদিকে এআই বিদ্যমান চাকরির উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর ক্ষেত্রে ব্যাপক সম্ভাবনা নিয়ে আসছে। চাকরি হারানোর ঝুঁকি যেমন আছে, তেমনি নতুন কর্মসংস্থানও হবে। আর তার জন্য প্রয়োজন হবে উচ্চ দক্ষতা।
‘পাচশ'ও বেশি প্রতিষ্ঠান এআই নিয়ে কাজ করছে' বাংলাদেশে বিভিন্ন খাতে এআই এর ব্যবহার বাড়ছে। বিশেষ করে টেলিযোগাযোগ খাত, মোবাইল ব্যাংকিং, মার্কেটিং। কৃষি খাতেও এর ব্যবহার শুরু হয়েছে বলে জানান এআই নিয়ে কাজ করা প্রতিষ্ঠান টেক গার্লিক এর প্রধান নির্বাহী জানান, বাংলাদেশে এখন পাঁচ শতাধিক প্রতিষ্ঠান আছে, যারা এআই এবং মেশিন লার্নিং নিয়ে কাজ করে। তবে প্রতিষ্ঠানের বাইরে ব্যক্তিগতভাবে কাজ করেন— এরকম মানুষের সংখ্যা কমপক্ষে ১০ লাখ। বাংলাদেশে ২০০৮—৯ সাল থেকে এআই নিয়ে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে কাজ শুরু হয় বলে জানান তিনি।
মোবাইল ফোন কোম্পানি, মোবাইল ব্যাংকিংসহ অনেক কর্পোরেট হাউজ এখন এআই টেকনোলজির সুবিধা নিচ্ছে। বাংলাদেশের কৃষিখাতেও এর ব্যবহার শুরু হয়েছে।' তার প্রতিষ্ঠানটি কৃষিখাতে জলসেচের জন্য এআই প্রযুক্তি দিয়ে সহায়তা করছে।
বাংলাদেশের সব খাতেই এআই এর সম্ভাবনা আছে। বিশেষ করে প্রাকৃতিক দুর্যোগের ক্ষেত্রে এআই এর ব্যবহার অনেক ক্ষতি থেকে বাঁচিয়ে দিতে পারে।
আমাদের এখানে যারা কাজ করেন, তারা ব্যক্তিগত উদ্যোগে এই প্রযুক্তি আয়ত্ত করছেন। প্রতিদিনই এটা পরিবর্তন হয়। অর্থাৎ এটা একটা সার্বক্ষণিক শিখন প্রক্রিয়া। দক্ষতা ও প্রচণ্ড আগ্রহ না থাকলে এটা সম্ভব নয়। আবার এই খাতে বিনিয়োগ করতে ব্যাংক ঋণও তেমন পাওয়া যায় না।
‘সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা দরকার'। এখন মার্কেটিংয়ে দেশীয় এবং বহুজাতিক প্রতিষ্ঠানগুলো এআই ব্যবহার করছে। বাংলাদেশের প্রতিষ্ঠানগুলো কাজ পাচ্ছে। তবে আমাদের মাইন্ডসেটের এখনো তেমন পরিবর্তন আসেনি। আগে যখন কম্পিউটারের ব্যবহার শুরু হয় তখন চাকরি যাওয়ার ভয়ে অনেকে কম্পিউটার ব্যবহারকে নিরুৎসাহিত করতো। এখনো আমরা দেখছি বিমান বাংলাদেশের ওয়েবসাইট হ্যাক হওয়ার পরে কম্পিউটার বন্ধ করে রেখেছে। আসলে নতুন টেকনোলজিকে ওয়েলকাম করতে হবে।
এজন্য সরকারের পৃষ্ঠপোষকতা দরকার। ভারত সরকার গত এগ্রিল মাসে বিশ্বের সবচেয়ে বড় এআই কোম্পানির কাছে এক লাখ গ্রাফিক প্রসেসিং ইউনিট (জিপিইউ) অর্ডার করেছে। জিপিইউ হলো এআই—এর কাঁচামাল। আর আমরা ব্যক্তিগত উদ্যোগে এগুলো ইউএসএ বা সিঙ্গাপুর থেকে আনি। আমাদের প্রচুর ডলার খরচ হয়। সরকার যদি একটা এআই সেন্টার করে জিপিইউ এনে আমাদের কাছে ভাড়া দেয় তাহলে আমরা উদ্যোক্তারা লাভবান হবো।
এআই কোনো স্পর্শযোগ্য পণ্য বা বস্তু নয়। বাংলাদেশের ব্যাংক খাত এই পণ্য উৎপাদনের জন্য ঋণ দেয় না। তারা দেয় হার্ডওয়্যারের জন্য। ফলে আমরা ঋণ পাই না। আমাদের নানাভাবে অর্থ জোগাড় করতে হয়। সরকারের এটা দেখা দরকার। তারপরও বাংলাদেশের সাত—আটটি প্রতিষ্ঠান এখন দেশের বাইরেও এআই সলিউশন দিচ্ছে।
বাংলাদেশের প্রস্তুতি?
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রোবোটিক্স এন্ড মেকাট্রনিক্স ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের চেয়ারম্যান বলেন, আমরা আসলে এখনো এআই প্রযুক্তির জন্য প্রস্তুত নই। আমরা এখনো ডিজিটাল বাংলাদেশের মধ্য দিয়ে যাচ্ছি। আমাদের প্রযুক্তির তৃতীয় যুগে যেতে হলে দক্ষ ও প্রশিক্ষিত তরুণ লাগবে। সেই ব্যবস্থা আমাদের এখানে নেই, প্রতিষ্ঠান নেই। আবার যারা তৈরি হচ্ছে, তাদের আমরা ধরে রাখতে পারছি না, তারা দেশের বাইরে চলে যাচ্ছে। তাদের ধরে রাখার ব্যবস্থা যেমন করতে হবে, তেমনি এআই আমাদের বিভিন্ন পর্যায়ের শিক্ষায় যুক্ত করতে হবে।
আমাদের পাশের দেশে এআই নিয়ে অনেক স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানকে সরকার নানাভাবে সহায়তা করছে। কিন্তু আমাদের এখানে হচ্ছে না। তরুণ গবেষকদের ফান্ড দিতে হবে। মনে রাখতে হবে ওয়েবসাইটের ডিজাইন তৈরির দক্ষতা আর এআই এর দক্ষতা এক নয়। ডিজিটাল বাংলাদেশের জন্য শর্ট টার্মে কিছু প্রশিক্ষণ দিলেই হতো। কিন্তু এখানে সেটা সম্ভব নয়। আমাদের টেকনোলজি তৈরি করতে হবে। সেই দক্ষতা লাগবে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ঝুঁকি হলো তাকে যে তথ্য দিয়ে রেডি করা হবে সে সেই ভাবে বিশ্লেষণ করবে। তার চিন্তা মানুষের মতো না। ফলে তাকে দিয়ে গুজব ছড়ানো বা একপেশে বিশ্লেষণ করানো সম্ভব।
অ্যামাজন তাদের একটি টেকনিক্যাল রিক্রুটমেন্টের সিভি বাছাইয়ের জন্য মানুষের পরিবর্তে এইআইকে দায়িত্ব দেয়। তখন দেখা গেলো শুরুতেই এআই সব নারীর সিভি বাদ দিয়ে দেয়। আসলে তাকে যেভাবে প্রশিক্ষিত করা হয় সে সেইভাবে ফল দেয়। সুতরাং এআই ব্যবহারের নানা ঝুঁকিও আছে। সেটা অবশ্য নির্ভর করে মানুষের ওপর। আমরা কীভাবে ব্যবহার করতে চাই। এটা ক্ষতিকর কাজেও ব্যবহার করা যায়।
আইন তৈরির উদ্যোগ
বাংলাদেশ সরকার এরইমধ্যে এআই নিয়ে একটি আইন করার উদ্যোগ নিয়েছে। খসড়া আইনটি এখন আইন মন্ত্রণালয়ে আছে। বিশ্লেষকরা মনে করেন, আইন অবশ্যই এর অপব্যবহার রোধে প্রয়োজন। একই সঙ্গে এআই এর জন্য অবকাঠামো, দক্ষ মানবসম্পদ, প্রযুক্তিগত সহায়তা অনেক বেশি প্রয়োজন।
সম্প্রতি আগারগাঁওয়ে বাংলাদেশ কম্পিউটার কাউন্সিল অডিটোরিয়ামে সরকারের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ভিত্তিক জিপিটি প্ল্যাটফর্ম জি—ব্রেইন—এর উদ্বোধন করেছেন। স্টার্টআপ জিপিটি, কনস্টিটিউশন জিপিটি ও বাজেট জিপিটি এই তিনটি ফিচার নিয়ে উদ্বোধন করা হয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ভিত্তিক সরকারের জিপিটি প্ল্যাটফর্ম।
মৎস্য আহরণে স্মার্ট প্রযুক্তির সফলতা
গভীর সমুদ্রে মৎস্য শিকারে এসেছে আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া। গভীর সমুদ্রে মৎস্য শিকারে এসেছে আধুনিক প্রযুক্তির ছোঁয়া। ডিজিটাল প্রযুক্তির সহায়তায় বৈজ্ঞানিক পদ্ধতিতে মৎস্য শিকারের ফলে মৎস্যজীবীরা একদিকে যেমন অনেক লাভবান হচ্ছে অন্যদিকে সমুদ্রের সার্বিক পরিবেশ জলোচ্ছ্বাস, আবহাওয়া, তাপমাত্রা ইত্যাদি জানার পাশাপাশি স্থলভাগে মৎস্য ঘাটে, মাছের বাজার দর এবং পরিবার—পরিজনের সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ রক্ষা করতে পারছেন।
বিশ্বের অন্যান্য দেশের সঙ্গে তাল মিলিয়ে বাংলাদেশেও গ্লোবাল ফিশিং ওয়াচ, ফিশ ফাইন্ডার, ইকো সাউন্ডার, অ্যাকোয়াস্টিক ক্যামেরা ইত্যাদি আধুনিক প্রযুক্তি মৎস্য শিকারে ব্যবহৃত হচ্ছে। আরও আছে ওফিশ অ্যাপ, রিমোট কনট্রোল অপারেটেড ফিশ ফিডার, অটোমেটিক পদ্ধতিতে পানির গুণাগুণ নির্ণয়, স্মার্ট সেন্সর, স্মার্ট আন্ডারওয়াটার ক্যামেরা, গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম (জিপিএস) প্রযুক্তি।
গ্লোবাল ফিশিং ওয়াচ : ইন্টারনেট অ্যাক্সেসসহ বিশ্বব্যাপী মাছ ধরার কার্যকলাপ নিরীক্ষণ করতে এবং ব্যক্তিগত জাহাজের ট্র্যাক, সামুদ্রিক ফিশিং ও সুরক্ষিত এলাকা এবং অন্যান্য বৈশিষ্ট্যগুলো দেখতে সক্ষম। সমুদ্রে অতিরিক্ত মাছ ধরা, অবৈধ মাছ ধরা এবং মাছের আবাসস্থল ধ্বংস হচ্ছে কিনা এই প্রযুক্তির মাধ্যমে নির্ণয় করা সম্ভব। গুগলের সহায়তায় প্রযুক্তিটি ২০১৬ সালে ইউএস স্টেট ডিপার্টমেন্টের ওয়াশিংটন ডিসিতে মহাসাগর সম্মেলনে স্থাপন করা হয় এবং প্রয়োজনীয় পরীক্ষা—নিরীক্ষা শেষে ২০১৭ সালে একটি স্বাধীন ও অলাভজনক সংস্থা হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
গ্লোবাল ফিশিং ওয়াচ মাছের সংগৃহীত তথ্য ভিজুয়ালাইজ করে ৭২ ঘণ্টা পর ইন্টারনেটে প্রকাশ করা হয়। এই ভিজুয়ালাইজেশনে প্রবেশাধিকার সবার জন্য উন্মুক্ত। অর্থাৎ যে কেউ এই তথ্য ব্যবহার করতে পারে। সংগৃহীত তথ্য দিয়ে একটি মেরিন ডেটা ব্যাংক তৈরি করা হয়, যেখানে সাগরের তাপমাত্রা, পানির লবণাক্ততা ও অক্সিজেনের মাত্রা ইত্যাদি তথ্য জমা থাকে।
গ্লোবাল ফিশিং ওয়াচের এই উদ্যোগ অবৈধভাবে মৎস্য আহরণকারী ভেসেলগুলোর মালিক ও ক্যাপ্টেনদের আইনের আওতায় আনার ক্ষেত্রে বেশ সহায়ক ভূমিকা রাখছে। ফিশ ফাইন্ডার এবং ইকো সাউন্ডার : গভীর সমুদ্র তলে মাছ শনাক্ত করার ডিজিটাল প্রযুক্তি। এটি শোনার মতো শব্দশক্তির মাধ্যমে পানির ভেতরে উচ্চ তরঙ্গ তৈরি করে গ্রাফিক্যাল ডিসপ্লেতে প্রতিফলিত শব্দের পরিমাপ প্রদর্শন করে এবং সুমদ্রে মাছের অবস্থান শনাক্ত করতঃ স্মার্টফোনের মাধ্যমে প্রতিচিত্র পাঠায়।
এক্ষেত্রে স্মার্টফোন ও ফিশ ফাইন্ডারের মধ্যবর্তী দূরত্ব ১৫০ ফুট হতে হয়। কারণ এই রেঞ্জের মধ্যে ব্লুটুথ ভালোভাবে তথ্য আদান—প্রদান করতে পারে। মাছের অবস্থান নির্ণয় ছাড়াও, ফিশ ফাইন্ডার দিয়ে পানির গভীরতা এবং তাপমাত্রা জানা যায়। আধুনিক ইলেকট্রনিক ফিশ ফাইন্ডার সিস্টেম, সামুদ্রিক রাডার, কম্পাস এবং জিপিএস নেভিগেশন সিস্টেমের মধ্যে একটি ইন্টিগ্রেটেড ডিভাইস। সিস্টেমটি মাছের অবস্থান নির্ণয় ছাড়াও পানির নিচের কাঠামো সম্পর্কে রিয়েল—টাইম তথ্য প্রদান করে। ফলে মাছ ধরার সম্ভাবনাকে উন্নত, সময় ও শ্রম বাঁচাতে সহায়তা করে।
আন্তর্জাতিকভাবে পানির গভীরতা নির্ণয় করার জন্য জাহাজে ব্যবহৃত ইকো সাউন্ডারকে প্রায়শই ফ্যাদোমিটার বলা হয়। কারণ সমুদ্রে পানির গভীরতা পরিমাপের একক হিসেবে ফুটের পরিবর্তে ফ্যাদম ব্যবহৃত হয়।
অ্যাকোয়াস্টিক ক্যামেরা : শব্দ উৎস স্থানীয়করণ পদ্ধতি যেমন শব্দ স্তরের মিটার এবং মানুষের কানের তুলনায় বেশকিছু সুবিধা প্রদান করে। এই ক্যামেরা অত্যন্ত নির্ভুল, সুনির্দিষ্ট এবং কোলাহলপূর্ণ পরিবেশে বা অ্যাক্সেস করা কঠিন বা বিপজ্জনক এলাকায় শব্দ উৎস স্থানীয়করণ করতে ব্যবহার করা হয়।
ক্যামেরাটিতে ৬৪ থেকে ১০২৪ মাইক্রোফোনের একটি অ্যারে রয়েছে, যেগুলো একে অপরের সঙ্গে সংযুক্ত। একে অ্যাকোয়াস্টিক ক্যামেরা অ্যারে বলে। এই অ্যারে উৎপন্ন হয় সমুদ্রের গভীরে মাছের অবস্থান (উচ্চতা ও গভীরতা), অনুভূতি সাপেক্ষে মাছের শব্দ, চাপ, স্তরের উৎস খুঁজে একটি বিস্তৃৃত ফ্রিকোয়েন্সি পরিসীমা ব্যবহার করে একটি পরিমাপ ক্যাপচার করে। যা পরবর্তীতে মোবাইল মনিটরে দৃশ্যমান হয়।
এ পর্যায়ে পানির বিভিন্ন গুণাগুণ যেমন পানির স্তর, তাপমাত্রা, দ্রবীভূত অক্সিজেন পিএইচওআরপি, পরিবাহিতা এবং অস্বচ্ছতা অটোমেটিক পদ্ধতিতে পরিমিত হয়। অনেকে ব্যবহার করেন ‘স্মার্ট আন্ডারওয়াটার ক্যামেরা’। পেশাদার এবং অপেশাদার মৎস্যজীবীদের জন্য দিন—রাত ২৪ ঘণ্টা সরাসরি এবং পরিষ্কারভাবে মাছ দেখতে, মাছের অঞ্চলগুলো খুঁজে বের করতে সহায়তা করে।
মাছের লোকেশন বুঝতে অনেক জেলে টলনেট ব্যবহার করেন যা ট্রলারের সঙ্গে সংযুক্ত থাকে। মাছের ঝাঁক বোঝার জন্য সোলার নামক প্রযুক্তি ব্যবহার করা হয়, যা অনেকদূর থেকেও কাজ করে।
মৎস্য শিকারে গ্লোবাল পজিশনিং সিস্টেম’ (জিপিএস) ব্যবহারে এসেছে অনেক সফলতা। বিস্তীর্ণ জলরাশিতে প্রতিবছর প্রাকৃতিক দুর্যোগের কবলে পড়ে ট্রলার ডুবির ঘটনা যেমন ঘটে। পাশাপাশি এসব মৎস্যজীবীর আরেক ভয় ডাকাতের। মৎস্যজীবীর ছদ্মবেশে দুর্ধর্ষ জলদস্যুরা প্রতিবছর মাছ লুট, অর্থ ডাকাতি, খাবার কেড়ে নেওয়ার সঙ্গে অনেক জেলের জীবনহানির খবরও পাওয়া যায়।
অবশ্য সাগরে জলদস্যুতা রোধে জাহাজগুলোতে অটোমেটিক আইডেন্টিফিকেশন সিস্টেম (এআইএস) করা হয়। এর মাধ্যমে জেলেরা দ্রুত কোস্টগার্ড অথবা নৌবাহিনীর কাছে সাহায্য বার্তা পাঠাতে পারে। এছাড়া জরুরি পরিস্থিতিতে তাদের অবস্থান শনাক্ত করা সহজ হয়। ইলেকট্রনিক মনিটরিং সিস্টেম, কম্পিউটার ভিশন টেকনোলজি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রয়োগ ঘটিয়ে জলজ পরিবেশের যে কোনো পরিবর্তন সম্পর্কে জানা যায় এবং সে অনুযায়ী মাছ শিকার করা হয়।
যদিও জিপিএস—এর মাধ্যমে এখন এগুলো অনেকটা নিরসন হয়। নিরাপত্তা ও ব্যবস্থাপনা ছাড়াও সাগরে মৎস্য সম্পদ আহরণে কতসংখ্যক ট্রলার বা নৌযান কোন অবস্থানে রয়েছে তা মনিটরিং হচ্ছে জিপিএসের মাধ্যমে। যদিও গুগল অ্যাপস ব্যবহার করে তা সম্ভব হচ্ছে। ওপিশ অ্যাপের মাধ্যমেও জেলেদের নিয়মিত আবহাওয়ার হালনাগাদ তথ্য পাওয়া যায়। এটি মৎস্য আহরণের ক্ষেত্রে অনেকটা গুগল ম্যাপের মতো কাজ করছে।
জেলেরা এই অ্যাপ ব্যবহার করে সহজেই তার নিকটবর্তী ফিশিং জোনগুলো সম্পর্কে জানতে পারছেন। তবে স্যাটেলাইট ও সেলুলার নেটওয়ার্কভিত্তিক তথ্যপ্রবাহকে কাজে লাগিয়ে এই ধরনের সমস্যা দূর করা সম্ভব। গ্লোবাল ডায়ালগ অন সিফুড ট্রেসেবিলিটি সাপ্লাই চেনে সিফুডের সরবরাহ ট্র্যাক করে অটোমেটেড সিস্টেমে। ক্রেতারা কোনো রকম বিভ্রান্তি ছাড়াই জানতে পারেন যে, তাদের সিফুড কোথা থেকে আসছে এবং সেগুলো কতটা টেকসই উপায়ে আহরণ করা হয়েছে ইত্যাদি।
ক্রমবর্ধমান মানব জাতির ন্যূনতম মাছের চাহিদা মেটানো এক চ্যালেঞ্জিং বিষয়। তবে এসব স্মার্ট প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে সাগরে ফিশিং ভেসেলগুলোর মাছ ধরার সক্ষমতা প্রতিবছর গড়ে অন্তত ২ শতাংশ বেড়েছে বলে প্রতীয়মান হয়েছে।
বিভিন্ন পরিসংখ্যান বলছে ২০০৮—০৯ অর্থবছরে মাছের উৎপাদন ছিল ২৭ দশমিক ১ লাখ মেট্রিক টন, যা ২০২১—২২ অর্থবছরে বেড়ে হয়েছে ৪৭ দশমিক ৫৯ লাখ মেট্রিক টন। ২০২২—২৩ অর্থবছরে উৎপন্ন হয়েছে ৪৯.১৫ লাখ মেট্রিক টন এবং ২০২৩—২৪ অর্থবছরে উৎপাদন ছাড়িয়েছে অর্ধকোটি টন। এভাবে গত এক যুগে দেশে মাছের উৎপাদন বেড়েছে ৬০ শতাংশ। আগামী ২০৪১ সালে মাছ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে ৮৫ লাখ টন। বর্তমানে ১৪ লাখ নারীসহ ২ কোটি অর্থাৎ প্রায় ১২ শতাংশের অধিক মানুষ এই পেশায় জড়িত। এদিকে বিশ্বের ৫০টির বেশি দেশে বাংলাদেশ মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানি করা হচ্ছে।
২০২৩—২৪ অর্থবছরে ৭৭ হাজার ৪০৮ টন মৎস্য ও মৎস্যজাত পণ্য রপ্তানির মাধ্যমে প্রায় চার হাজার ৪৯৬.৩৮ কোটি টাকার বৈদেশিক মুদ্রা আয় হয়েছে এবং আগামী ২০৩০ সালের মধ্যে পাঁচ বিলিয়ন ডলার রপ্তানি লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। জাতিসংঘের প্রক্ষেপণ অনুযায়ী, ২০৩০ সালে বাংলাদেশের জনসংখ্যা হবে ১৮ কোটি ৪০ লাখ এবং ২০৫০ সালে হবে ২০ কোটি ৪০ লাখ। এই বিপুলসংখ্যক মানুষের জন্য মৎস্য সম্পদের প্রাপ্যতা নিশ্চিত করা একটি বড় চ্যালেঞ্জ। কিন্তু আধুনিক প্রযুক্তির ব্যাপক ব্যবহারের ফলে এই সমস্যার সমাধান হবে বলে আশা করা যাচ্ছে।
রোবটের বহুমুখী ব্যবহার
প্রযুক্তির যুগে রোবটের বহুমুখী ব্যবহার সকলের জানা। শিল্পক্ষেত্রে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধির জন্য ব্যাপকহারে রোবটের ব্যবহার হচ্ছে। এতে অনেকাংশে কমছে বিপজ্জনক কাজের ক্ষেত্রে শ্রমিকদের হতাহত বা প্রাণহানির ঝুঁকি। ডাক্তার, নার্স বা রোগীদের কাছে প্রয়োজনীয় জিনিস, ওষুধ দ্রুত পৌঁছাতে স্বাস্থ্য খাতে রোবটের ব্যবহার হচ্ছে। শরীরের কোনো অঙ্গহানিতে ব্যবহার হচ্ছে রোবটিক হাত—পায়ের মতো অঙ্গ। হাসপাতাল পরিষ্কার—পরিচ্ছন্নতায় অটোনমাস মোবাইল রোবট কাজে লাগছে কোনো কোনো জায়গায়।
বিভিন্ন প্রাকৃতিক বা কৃত্রিম খনি আছে, যেগুলো বিষাক্ত, দুর্গম ও মানুষের কাজের জন্য বিপজ্জনক, সেসব ক্ষেত্রে মানুষের নিরাপদ বিকল্প হিসেবে ব্যবহার হচ্ছে রোবট। বোমা চিহ্নিতকরণ, মাইন অপসারণ ও বোমা নিষ্ক্রিয়করণ রোবট, ড্রোন, চালকহীন রোবট বিমানসহ রোবটিক্সের অত্যাধুনিক কিছু আবিষ্কার কাজ করছে যুদ্ধ ও সামরিকক্ষেত্রেও। সেই দিন হয়তো দূরে নেই, যখন রোবট সেনারা যুদ্ধক্ষেত্রে লড়বে মানুষের হয়ে। মঙ্গল গ্রহে পাঠানো মার্স রোভার থেকে নাসার রোবোনট, পৃথিবীর গন্ডি পেরিয়ে মহাকাশেও বিচরণ করছে অত্যাধুনিক রোবটেরা।
সম্প্রতি দক্ষিণ কোরিয়ায় বিদ্যালয়ে শিক্ষাদানের জন্য রোবট শিক্ষক ব্যবহার শুরু হয়েছে। যাদের বলা হচ্ছে ‘টেলি—প্রেজেন্স’ রোবট। প্রাত্যহিক জীবনেও রোবটের ব্যবহার দিন দিন বেড়ে চলেছে— বীজ বপন, আগাছা পরিষ্কার, মাটি বিশ্লেষণ, ফসল সংগ্রহসহ কৃষিক্ষেত্রে। রোবটিক সুইপার, রোবটিক ভ্যাকুয়াম ক্লিনার, পুল ক্লিনারসহ বিভিন্ন ঘরোয় রোবট ব্যবহার করছে বিশ্বজুড়ে প্রচুর মানুষ। অনেক হোটেল, রেস্টুরেন্টেও খাবার আনা—নেওয়া ও পরিবেশনার কাজ করছে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত রোবট।
মানুষের জীবনযাত্রাকে সহজ ও সুবিধাজনক করতে রোবট নিরলসভাবে কাজ করলেও রয়েছে নানান অসুবিধাও। যেমন— রোবট ও এই সম্পর্কিত সব যন্ত্রপাতির দাম এখনো অনেক মানুষের হাতের নাগালে আসেনি। তাই রোবট ব্যবস্থাপনা ও রক্ষণাবেক্ষণ যথেষ্ট ব্যয়বহুল। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা না থাকার কারণে বেশিরভাগ রোবটেরই নেই কোনো সৃজনশীলতা।
তাই এগুলো ভুল করলেও বুঝতে পারে না। নানান ক্ষেত্রে রোবট ব্যবহারের ফলে বিশ্বজুড়ে প্রচুর মানুষ কর্মহীন হয়ে পড়ছে। মানুষের মতো সব রোবট পরিস্থিতির সঙ্গে নিজেকে মানিয়ে নিতে পারে না, যদি না তার প্রোগ্রাম পরিবর্তন করা হয়। রোবটনির্ভর শিল্পকারখানায় রক্ষণাবেক্ষণ খরচ, দক্ষ টিম ও বিদ্যুৎ প্রয়োজন। এসব সমস্যা থেকে কিছুটা রেহাই দিতে বিশ্ববাজারে এখন এসেছে কোবট। কোবট হলো এমন ধরনের রোবট, যেগুলো প্রচলিত রোবটের তুলনায় অনেক দক্ষভাবে মানুষের সঙ্গে কাজ করতে পারে।
কারখানায় সচরাচর ব্যবহৃত ইন্ডাস্টি্রয়াল রোবটের তুলনায় কোবট অনেকাংশেই আলাদা। ‘কোলাবরেশন’ ও ‘রোবট’ শব্দ দু’টি মিলিয়ে ‘কোবট’ শব্দটি এসেছে। কোবট এমন ধরনের রোবট, যারা কোনো ধরনের জটিলতা ছাড়াই মানুষের সঙ্গে একত্রে কাজ করতে পারে। ইন্ডাস্টি্রয়াল রোবট সাধারণত অনেক বেশি ক্ষমতাসম্পন্ন হয়। অনেক ক্ষেত্রেই এসব রোবট মানুষের সঙ্গে কাজ করা বা মানুষের কাজে সাহায্য করার জন্য অনেক বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। বেশিরভাগ ইন্ডাস্টি্রয়াল রোবট সেকেন্ডে ৮ মিটারের বেশি গতিতে নড়াচড়া করতে পারে এবং ১০০০ কেজি পর্যন্ত ওজন নিয়ে কাজ করতে পারে। এসব রোবট কাজ করার সময় আশপাশে মানুষ থাকলে তাদের আহত হওয়ার আশঙ্কা থাকে, এমনকি মৃত্যুর ঝুঁকিও থাকে।
পক্ষান্তরে, কোবট আকারে বেশ ছোট হয়। সাধারণত ১৬ কেজির চেয়ে কম এবং এর গতি থাকে সেকেন্ডে ৪ মিটারের মধ্যে। মানুষের সঙ্গে কাজ করার সুবিধার্থে প্রয়োজনে এর গতি আরও কমানো হয়। মূলত কোবটের গতিসীমা কত হতে পারে, সে ব্যাপারে বিভিন্ন ধরনের রোবটের সেফটি রেগুলেশনে নির্দেশনা দেওয়া থাকে। এছাড়া স্পর্শ বা সংঘর্ষ এড়াতে কোবটে বিশেষ ধরনের নিয়ন্ত্রণের ব্যবস্থা থাকে। যেমন— কোবটের কিছু মডেল ইলেক্টি্রক মোটরের মতো গিয়ারের সাহায্যে মনিটর করা হয়।
আবার কিছু কোবটে ‘ইন্টার্নাল ফোর্স টর্ক সেন্সর’ ইনস্টল করা থাকে। কোবট ব্যবহার করার আগে এর নিরাপত্তা সম্পর্কযুক্ত বিষয়গুলো খুবই গুরুত্বের সঙ্গে পরীক্ষা—নিরীক্ষা করা হয়। এর মধ্যে অন্যতম দু’টি হলো, বায়োমেট্রিক মেজারমেন্ট এবং কোবটের কাজের ধরন অনুযায়ী অ্যাপ্লিকশন টেস্ট। টেস্ট করে দেখা হয় কোবটের সর্বোচ্চ গতি কত হতে পারে এবং এতে আর কোনো সুরক্ষা ব্যবস্থার প্রয়োজন আছে কি না। যদি কোবটের গতি বা কার্যক্ষমতা বেশি হয়, তখন সেটা মানুষের জন্য বিপজ্জনক হতে পারে।
তাই বিপদ এড়ানোর অন্যতম একটা উপায় হলো গতি কমানো। আরেকটা উপায় হচ্ছে ‘এয়ারস্কিন’ নামের একধরনের সুরক্ষামূলক সরঞ্জাম ব্যবহার করা। মূলত এয়ারস্কিন হলো প্যাডযুক্ত একধরনের সেন্সর কাভার, যার ওপর বল প্রয়োগ করা হলে তা সবদিকে সমানভাবে ছড়িয়ে যায়। এছাড়াও এয়ারস্কিনের মাধ্যমে জরুরি মুহূর্তে খুব দ্রুত কোবটের কার্যক্রম বন্ধ করে ফেলা যায়। আবার মানুষের মতো কোবট ব্যবহারের সময়ও এর সুরক্ষা নিশ্চিত করেই কাজে নিযুক্ত করতে হয়। সাধারণত কোবটে বিভিন্ন ধরনের যন্ত্রপাতি সংযুক্ত থাকে, যেমন — ক্যাবল ক্যারিয়ার, ক্যামেরা এবং গ্রিপার। তবে কোবট দিয়ে যখন ধারালো ছুরি বা গ্লাসের মতো বিপজ্জনক যন্ত্রপাতি আনা—নেওয়া করা হয়, তখন যেন ঝুঁকি ছাড়াই সম্পূর্ণ কাজ করতে পারে, সেদিকে আলাদা খেয়াল রাখতে হয়।
সাধারণত সিকিউরিটি স্ক্যানারের মাধ্যমে কোবট তার চারপাশের পরিবেশের ব্যাপারে জানতে পারে। কোনো মানুষ কোবটের খুব কাছে চলে আসার সঙ্গে সঙ্গে এর গতি কমে যায়। এরপরে যদি বিপজ্জনকভাবে আরও কাছে চলে আসে, তাহলে কোবট একেবারেই থেমে যায়। অনেক সময় সুরক্ষার জন্য কোবটের কাজের জায়গা বা ওয়ার্কস্পেসের মেঝেতে সীমানা দেওয়া থাকে। এই সীমানা অতিক্রম করলে কোবটের গতি স্বাভাবিকের তুলনায় অনেক কমে আসে। আরেকটি উপায়েও কোবট মানুষের উপস্থিতি বুঝতে পারে, সেটা হলো এয়ারস্কিন। এয়ারস্কিনের সুবিধা হলো, কোবটের সঙ্গে এটি যুক্ত থাকলে কোবটকে স্পর্শ করা মাত্রই এর কার্যক্রম বন্ধ হয়ে যায়।
তাই ভুল করে কেউ কোবটের নির্ধারিত সীমানার মধ্যে প্রবেশ করলেও আহত হওয়ার আশঙ্কা থাকে না। মোটরগাড়ি শিল্পে অনেক বেশি পরিমাণে কোবট ব্যবহার করা হয়।
তাছাড়া অনেক ছোট ও মাঝারি সাইজের প্রতিষ্ঠানও আজকাল কর্মীদের সহায়তার জন্য কোবট ব্যবহার করছে। যেমন, একটি কারখানায় তরল অ্যালুুমিনিয়াম ধাতু ঢালাই করার জন্য কোবট এবং লেজার সেফটি স্ক্যানার ব্যবহার করা হচ্ছে। বিভিন্ন মালামাল গুদামজাত করা বা ক্ষুদ্র কোনো জিনিস ঝালাই করার মতো কাজও কোবটের সাহায্যে করা হয়। এছাড়াও আঠা দিয়ে কিছু যুক্ত করা, টোস্টে জ্যাম লাগানো বা ডিম ভাজার মতো দৈনন্দিন অনেক ধরনের কাজ করতেও কোবট ব্যবহার করা হয়।
বর্তমানে মোবাইল প্রযুক্তি, মেশিন ভিশন, জ্ঞানীয় কম্পিউটিং এবং স্পর্শ প্রযুক্তির অগ্রগতি সাপেক্ষে বড় বড়, ছোট ও নিম্ন—শক্তি তথা কোবট আকারে কর্মের পারিপার্শ্বিক অবস্থা বিবেচনা করে মানবকর্মী উপযোগী হিসেবে তৈরি করা হচ্ছে। এককথায় রোবট যেখানে অত্যন্ত ব্যয়বহুল, আকার অনেক বড় ও ভারি এবং নিরাপত্তার প্রশ্নে জর্জরিত, সেখানে কোবটগুলো এই ভয়কে মোকাবিলা করার জন্য ডিজাইন করা হয়েছে।
অনেক ক্ষেত্রে কোবট একটি বাহুর আকার ধারণ করে কর্মীকে একটি অতিরিক্ত হাত হিসেবে সাহায্য করে। কোবট রোবটেরই একটি পরিমার্জিত মানব উপযোগী যন্ত্র এবং এর ব্যবহার ক্রমে বেড়ে চলেছে, তাই দেশে এর নির্মাণ উপযোগী ইন্ডাস্টি্র থাকা উচিত। সম্পূর্ণ নিজের উদ্যোগে অনেক কোমলমতি শিক্ষার্থীকে রোবট ও কোবট বানাতে আগ্রহী দেখা যাচ্ছে। স্কুল ও কলেজ পর্যায়ের বিজ্ঞানমেলায় তাদেরকে দেখা যায়। প্রায় প্রত্যেকটি বিশ্ববিদ্যালয়েও এখন রোবটিক্স ল্যাবরেটরি আছে।
স্কুল পর্যায়েও এই চর্চা ছড়িয়ে দিতে পারলে এবং সরকারি উদ্যোগে বিভিন্ন প্রতিযোগিতার আয়োজনের পাশাপাশি, রোবটিক্সের যন্ত্রপাতি সহজলভ্য করা গেলে কিংবা এসব তৈরির কাঁচামাল দেশে তৈরি করতে পারলে দেশের তরুণ প্রজন্ম স্বাবলম্বী হতে পারবে এবং এগুলো রপ্তানি করে প্রচুর বৈদেশিক মুদ্রা আয় করতে সক্ষম হবে।
বন্যানিয়ন্ত্রণে জরুরি প্রযুক্তিগত উন্নয়ন
ভারতের ত্রিপুরার গোমতী নদীর ওপর ডুম্বুর ড্যাম ৩১ বছর পর ভারি বর্ষণের কারণে খুলে দেওয়া হয়। এ কারণে বর্তমানে বন্যা হয়েছে বাংলাদেশে। দায়ী অত্যধিক ভারি বৃষ্টিপাতও। ভারতীয় আবহাওয়া দপ্তর (আইএমডি) দিল্লিতে ভারি বৃষ্টির সম্ভাবনা থাকার সতর্কতা এবং ত্রিপুরায় রেড অ্যালার্ট জারি করেছিল। এসব তথ্য বাংলাদেশের আবহাওয়া অধিদপ্তরও নিশ্চয়ই পেয়েছিল এবং রাডারের মাধ্যমে বৃষ্টির বিষয়টিও জেনেছিল।
যাই হোক, বন্যার একমাত্র কারণ কিন্তু এটিই নয়। প্রধান কারণগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো— আমাদের বন্যানিয়ন্ত্রণ করার কারিগরি সক্ষমতার অভাব, প্রাথমিক প্রতিরোধ ও প্রস্তুতিমূলক দুর্বলতা, বন্যা পূর্বাভাসমূলক অত্যাধুনিক ডিজিটাল প্রযুক্তির অভাব এবং বাংলাদেশের অবস্থান গাঙ্গেয় ব—দ্বীপ এলাকায় হওয়ায় এবং বাংলাদেশের ওপর দিয়ে বঙ্গোপসাগরে প্রবাহিত বিভিন্ন উপনদীর কারণে দেশে প্রতিবছরই বর্ষাকালে ছোট, মাঝারি এবং ভয়ানক আকারের বন্যা হয়ে থাকে।
দেশের সীমান্তবর্তী এলাকা এবং ভেতরে ভারি বৃষ্টিপাতের ফলে অভ্যন্তরীণ নদীগুলোর পানি ধারণক্ষমতার অতিরিক্ত পানি বঙ্গোপসাগরে নিক্ষেপ করার ক্ষমতাও অত্যন্ত কম। ফলে, পানি উপচে এটি পরিণত হয় বন্যায়। এসব দুর্ভোগ মোকাবিলায় কিছু কাঠামোগত ব্যবস্থা যেমন— বন্যা বাঁধ, চ্যানেলের উন্নতি, নদী প্রশিক্ষণ, উপকূলীয় বাঁধ ইত্যাদি প্রাচীন রীতিগুলো বহুকাল যাবৎ চলে আসছে। কিন্তু ১৯৮৮ সাল এবং এ বছরের বন্যা ইতিহাসের সকল রেকর্ড ভঙ্গ করে ফেলেছে। এ বছরের বন্যার ভয়াবহতা হচ্ছে, পানির অতি উচ্চতা ও তীব্রতা। ফলে কোনোরকম প্রস্তুতি নেওয়ার সুযোগই পায়নি প্লাবিত এলাকার মানুষ।
সীমিত আকারের কিছু ডিজিটাল পদ্ধতি বন্যার পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণে অনেক সহায়তা করছে। ২০২০ সালে থেকে বাংলাদেশ পানি উন্নয়ন বোর্ড (বাপাউবো) এটুআই এবং গুগল স্যাটেলাইট ভিত্তিক উন্নত ভূ—উচ্চতা তথ্য, মেশিন লার্নিং প্রযুক্তির সহায়তায় পরীক্ষামূলক ভাবে ব্রহ্মপুত্র ও পদ্মা নদীর অববাহিকার ১৪টি জেলায় এই কার্যক্রমের সূচনা হয়। বর্তমানে ৫৫টি জেলায় এ কার্যক্রম পরিচালিত হচ্ছে।
এই উন্নততর বন্যার পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ ব্যবস্থায় আগাম পাঁচ দিনের বন্যার পূর্বাভাস উপাত্তকে প্রক্রিয়াকরণ করে উন্নত ভূ—উচ্চতা তথ্য ও মেশিন লার্নিং প্রযুক্তির মাধ্যমে মানচিত্র তৈরি করা হয়। ফলে, বন্যা শুরু হওয়ার তিন দিন থেকে তিন ঘণ্টা আগে পর্যন্ত স্থানীয় জনগোষ্ঠী ইন্টারনেট প্রযুক্তির মাধ্যমে তাৎক্ষণিকভাবে বিভিন্ন ধরনের পূর্বাভাস ও সতর্কীকরণ বার্তা পাচ্ছে। পূর্বাভাসের এই আগাম সময় আরও বর্ধিতকরণের জন্য গুগলের সঙ্গে কারিগরি কার্যক্রম চলমান রয়েছে। আধুনিক এই প্রযুক্তিটিতে গুগল ‘পুশ নোটিফিকেশন’—এর মাধ্যমে অ্যান্ড্রয়েড স্মার্টফোন ব্যবহারকারী এই পূর্বাভাস পাচ্ছে।
বর্তমানে এই প্রযুক্তির মাধ্যমে সারাদেশে ১০৯টি স্টেশনে বন্যা মনিটরিং এবং ৫৫টি স্টেশনে পাঁচ দিনের আগাম বন্যার পূর্বাভাস চালু আছে। পূর্বাভাসে পানির স্তরের উত্থান—পতন, বন্যার গভীরতা, তীব্রতাসহ বন্যার অঞ্চল সম্পর্কিত তথ্য প্রদান করছে। গুগল অনুসন্ধানে বন্যা সম্পর্কিত নানাবিধ তথ্য ও পরামর্শ, যেমন— সুরক্ষা সম্পর্কিত পরামর্শ, ফসল তোলার পরামর্শ, বন্যার অ্যাপ্লিকেশন সম্পর্কিত তথ্য, জরুরি সরবরাহের তথ্য ইত্যাদি প্রেরণ করা হচ্ছে। পাশাপাশি, গুগল ম্যাপ এবং আর্থ—এর মাধ্যমে সংশ্লিষ্ট স্থানের বন্যা সতর্কতার ভিত্তিতে প্লাবনের ছবি নিয়মিত হালনাগাদ করা হচ্ছে।
কিন্তু ভারত যখন ইচ্ছামতো তাদের সীমান্তবর্তী বাঁধগুলো খুলে দেয়, তখন অ্যাপস ভিত্তিক পূর্বাভাস দিয়ে বাংলাদেশের বন্যানিয়ন্ত্রণ করা কঠিন। তাই বিশ্বের অনেক উন্নত দেশ আধুনিক প্রযুক্তির সহায়তায় কিভাবে বন্যা, জলোচ্ছ্বাস ও অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগকে পরাভূত করেছে, তাদের সহযোগিতা খুবই দরকার। বন্যানিয়ন্ত্রণে নেদারল্যান্ডসের বাঁধের ইতিহাস বিশ্বে পরিচিত। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম কৃষিপণ্য উৎপাদন এবং রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে পরিচিত।
দেশটি খুবই ঘনবসতিপূর্ণ এবং অর্ধেকের বেশি মানুষ কৃষিকাজে জড়িত। কিন্তু দেশটির অধিকাংশ কৃষি জমি সমুদ্রপৃষ্ঠের অনেক নিচে। অথচ পানি ব্যবস্থাপনা, বন্যা মোকাবিলা এবং সমুদ্র জলোচ্ছ্বাস নিয়ন্ত্রণে দেশটি বিশ্বে শীর্ষে। প্রাকৃতিক বালির টিলা এবং ডাইক, বাঁধ এবং ফ্লাডগেট সমুদ্র থেকে, ঝড়ের ঢেউ থেকে রক্ষা করে। ডাইকগুলো প্রধান নদী রাইন এবং মিউসের দ্বারা দেশে প্রবাহিত পানি থেকে বন্যা প্রতিরোধ করে এবং নিষ্কাশন, খনন এবং পাম্পিং স্টেশনগুলোর নিচু অংশগুলোকে বাসস্থান এবং কৃষির জন্য শুকনো রাখে।
ডাইক, বাঁধ, ফ্লাডব্যাংক বা স্টপ ব্যাংক হলো একটি কাঠামো, যা নদীর গতিপথ পরিবর্তন থেকে রক্ষা করতে এবং নদী বা উপকূল সংলগ্ন এলাকার বন্যা থেকে রক্ষা করতে ব্যবহৃত হয়। এটি সাধারণত মাটির হয় এবং প্রায়ই এটির রোবটের বহুমুখী ব্যবহার বনভূমিতে বা নিচু উপকূলরেখা বরাবর নদীর গতিপথের সমান্তরালে চলে। আধুনিক সময়ে বন্যা বিপর্যয় এবং প্রযুক্তিগত উন্নয়নের ফলে সমুদ্রের প্রভাব কমাতে এবং ভবিষ্যতের বন্যা প্রতিরোধে বড় ধরনের নির্মাণকাজ অব্যাহত আছে। এগুলো ভৌগোলিক, সামরিক এবং পরিবেশগতভাবে খুবই টেকসই, যা ক্ষতিগ্রস্ত শহরগুলোতে বসবাসকারী মানুষের জীবনকে ব্যাপকভাবে উপকৃত করে আসছে।
সম্প্রতি পশ্চিমবঙ্গ সরকার সুন্দরবনের নদীভাঙন ও বন্যা সমস্যা নিরসনে নেদারল্যান্ডস সরকারের সহযোগিতায় পাঁচ বছর মেয়াদি একটি প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এতে সুন্দরবনের ৫৪টি দ্বীপের মধ্যে ৩৩টি দ্বীপকে বিপজ্জনক হিসাবে চিহ্নিত করে প্রত্যেকটি দ্বীপের জন্য বাঁধ রক্ষা ও বন্যা নিয়ন্ত্রণের উদ্দেশ্যে পৃথক মাইক্রো প্ল্যান তৈরি করেছে। এ ছাড়া নদী, খালের সংস্কার, পানির লবণ নিয়ন্ত্রণ, বন্যা নিয়ন্ত্রণ, মৎস্য চাষ ও কৃষির ক্ষেত্রে প্রতিবন্ধকতা দূর করা এবং বায়োডাইভারসিটি রক্ষায় প্রয়োজনীয় উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি প্রাকৃতিক বিপর্যয়ে ক্ষয়ক্ষতি পুনরুদ্ধারে নতুন প্রযুক্তির সরবরাহ করবে নেদারল্যান্ডস সরকার।
উপকূলবর্তী দুই জেলা দক্ষিণ ২৪ পরগনা ও পূর্ব মেদিনীপুরকে ঘূর্ণিঝড় ও নদীভাঙনের সমস্যা দূরীকরণেও অনুরূপ উদ্যোগ নিয়েছে। ইতোমধ্যেই পাইলট প্রকল্পের আওতায় মৌসুনি দ্বীপের কাছে পাটিবুনিয়া এবং পাথরপ্রতিমার কাছে গোপীবল্লভপুরে ডাচ প্রযুক্তি ব্যবহার করে বাঁধ তৈরি করা হয়েছে। পরবর্তী ধাপে অন্যান্য এলাকাতে এই প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে বন্যা নিয়ন্ত্রণের কাজ এগিয়ে নিতে সম্প্রতি দিল্লিতে এক উচ্চ পর্যায়ের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এ পর্যায়ে বন্যা পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণে আনতে এবং পানি সংরক্ষণের জন্য মুম্বাই, চেন্নাই এবং ব্যাঙ্গালুরুসহ সাতটি শহরে হ্রদের মতো জলাশয় সম্প্রসারণ এবং ড্রেন নির্মাণের মেগা প্রকল্পের আওতায় আগামী দুই বছরে আড়াই হাজার কোটি রুপি (প্রায় ৩০ কোটি ডলার) বরাদ্দ দিয়েছে।
ভারত তার সুবিধামতো বাঁধ খুলে এবং বন্ধ করে— এ ধরনের বিতর্ক আছে বহু বছর ধরে। তাদের ভাষ্যমতে, উজান থেকে আসা অতিরিক্ত পানির চাপে সীমান্তবর্তী এলাকাগুলো প্লাবিত হয় এবং একপর্যায়ে পানির চাপ ধরে রাখতে না পারায় বাঁধ খুলে দেওয়া হয়।
ফলে, বাংলাদেশে তীব্র গতিতে পানি ঢুকে ভয়াবহ বন্যার সৃষ্টি এবং ফসল, ঘরবাড়ি ও জানমালের ব্যাপক ক্ষতি করে। অর্থাৎ সমস্যাটা প্রাকৃতিকভাবেই ঘটে, রাজনৈতিক নয়। এমতাবস্থায় দুই দেশের মধ্যে জাতিসংঘের মধ্যস্থতায় একটি গ্রহণযোগ্য সমাধান দরকার। নেদারল্যান্ডসের আদলে পরিবেশবান্ধব স্থায়ী বন্যানিয়ন্ত্রণ বাঁধ কিভাবে আমাদের এই অঞ্চলে স্থাপন করা যায়, তা নিয়ে ভাবতে হবে এখনই। এই বাঁধ নির্মাণের ফলে দুই দেশই যেন উপকৃত হয় কিংবা কোনো দেশই যাতে কোনোভাবেই ক্ষতিগ্রস্ত না হয়, সেদিকে খেয়াল রাখতে হবে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ও ইন্টারনেটের সম্পর্ক
বর্তমানে এআই এবং আইওটি একসঙ্গে এমন সব সমস্যার সমাধান করছে। যা সম্পন্ন করা শুধু কঠিনই নয়, বরং বেশ ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষও বটে। এই প্রযুক্তিদ্বয়ের সংযোগের ফলে কিছু আশ্চর্যজনক সমস্যার সমাধান পাওয়া যায়। যেমন— এটি অনেক সমস্যার সমাধান আগে থেকেই করে ফেলতে পারে, যা হয়তো পরবর্তীতে ঘটার সম্ভাবনা রয়েছে।
এআই ও আইওটির মাধ্যমে অসংখ্য সংযুক্ত ডিভাইস থেকে প্রাপ্ত রিয়েল—টাইম ডেটা একবারেই সংগ্রহ এবং পরিচালনা করে কোনো একটা সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্রে তৎক্ষণাৎ ব্যবহার করা যায়। আইওটি যেটা করতে পারে না, সেটা কৃত্রিম—বুদ্ধিমত্তা করতে পারে। অপরদিকে, যেটা কৃত্রিম—বুদ্ধিমত্তা করতে পারে না, সেটা আইওটি করতে পারে। আর এই দুইয়ের সংমিশ্রণ এআইওটি বলতে গেলে সবকিছুই করে ফেলতে পারে। যেটা শুধু অসামান্যই নয়, বরং মহাবৈপ্লবিকও বটে। এআইওটি সিস্টেমের আর্কিটেকচার হলো একটি জটিল কাঠামো, যা দক্ষতার সঙ্গে কাজ করার জন্য নির্বিঘ্নে বিভিন্ন উপাদানকে একত্রিত করে। এআইওটি, আইওটি ডিভাইসগুলো থেকে সংগৃহীত ডেটা প্রক্রিয়া এবং বিশ্লেষণ করার জন্য অ্যালগরিদমগুলো ব্যবহার করে। এতে সেন্সর এবং ডিভাইস রয়েছে, যা মূলত পরিবেশ থেকে তথ্য সংগ্রহের করে।
এআইওটি বুদ্ধিমান, সংযুক্ত সিস্টেম তৈরি করতে আইওটি পরিকাঠামোর সঙ্গে এআই প্রযুক্তির একীকরণকে বোঝায়। আর এটি আইওটি ডিভাইসগুলোর দ্বারা সংগৃহীত ডেটার ওপর ভিত্তি করে বিশ্লেষণ, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং সিদ্ধান্ত নিতে পারে। মেশিন লার্নিং অ্যালগরিদম ব্যবহার করে, এআই সিস্টেমগুলো ডেটা থেকে প্রয়োজনীয় উপকরণ নিতে পারে, প্যাটার্ন শনাক্ত করতে পারে এবং স্বায়ত্তশাসিতভাবে ভবিষ্যদ্বাণী বা সিদ্ধান্ত নিতে পারে।
এআইওটি সিস্টেমগুলো মেশিন লার্নিং, ন্যাচারাল ল্যাঙ্গুয়েজ প্রসেসিং, ভয়েস রিকগনিশন, ইমেজ অ্যানালাইসিসের মতো বিভিন্ন ধরনের মূল প্রযুক্তি ব্যবহার করে থাকে। এটি শুধু রিয়েল—টাইম অ্যাকশনগুলোকে সক্ষম করে না, বরং ক্রিয়াকলাপগুলোকে অপ্টিমাইজ করতে, দক্ষতা উন্নত করতে এবং উদ্ভাবন চালাতে সহায়তা করে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) এবং ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) এতদিন যাবত বৈচিত্র্যময় আইটি সিস্টেমের স্বতন্ত্র ক্ষেত্র হিসেবে বিবেচিত হয়ে এসেছে। তবে তাদের মধ্যে এক অন্তর্নিহিত বন্ধন সবসময়ই ছিল। আর যতদিন যাচ্ছে এদের মধ্যে তফাৎ ততই কমে আসছে এবং এরা একে অন্যের প্রতিরূপ হিসেবে আত্মপ্রকাশ ঘটাচ্ছে।
যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে একটা সিস্টেমের ব্রেন হিসেবে কল্পনা করা হয়, তাহলে আইওটিকে সেই সিস্টেমের ডিজিটাল নার্ভাস সিস্টেম কিংবা বাকি গোটা শরীর হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। যত সময় গড়াচ্ছে আইওটি ততই স্মার্ট হয়ে যাচ্ছে। আইওটির ব্যবহার বাস্তবিকভাবে সবখানেই বিদ্যমান। হোম অটোমেশন সিস্টেম এবং ম্যানুফেকচারিং ন্যানোবোট থেকে শুরু করে সেলফ—ড্রাইভিং কার এবং হেভি ইন্ডাস্টি্রয়াল মেশিনারিজ পর্যন্ত এমন কোনো ক্ষেত্র নেই যেখানে আইওটির প্রয়োগ নেই।
এআইয়ের বিশ্লেষণাত্মক এবং সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষমতার সঙ্গে আইওটিয়ের ডেটা সংগ্রহের ক্ষমতা একত্রিত করে, এআইওটি আরও দক্ষ, স্বায়ত্তশাসিত এবং প্রাসঙ্গিকভাবে প্রাসঙ্গিক সিস্টেমগুলোকে সক্ষম করে। প্রযুক্তির এই সংমিশ্রণে রিয়েল—টাইম অন্তদৃর্ষ্টি, স্বয়ংক্রিয় প্রক্রিয়া এবং সামগ্রিক কর্মক্ষমতা বৃদ্ধি করে স্মার্ট শহর, স্বাস্থ্যসেবা, উৎপাদন, কৃষি এবং পরিবহনসহ বিভিন্ন শিল্পে বিপ্লব ঘটানোর সম্ভাবনা রয়েছে।
আগে আইওটি ডিভাইসগুলোকে মূলত ডাটা সংগ্রহের জন্য ব্যবহার করা হতো।
এক্ষেত্রে ধারণা ছিল— সংযুক্ত ডিভাইসগুলোর একটি মেশ (সবাই সবার সঙ্গে সংযুক্ত) নেটওয়ার্ক তৈরি করা, যা ক্রমাগত অ্যাডমিনদের কাছে গুরুত্বপূর্ণ তথ্য সরবরাহ করবে। যদিও এখন আইওটির ধারণা অনেক ব্যাপক ও বিস্তৃত হয়েছে, তবে ইদানীং এআইওটি এক্ষেত্রে নতুন একটা মাত্রা যোগ করেছে!
ডাটা প্যাটার্ন বিশ্লেষণ ও বিশাল বিশাল সাইজের ডাটা প্রক্রিয়াজাত করে সুনির্দিষ্ট তথ্য এবং সিদ্ধান্ত প্রদান করার মাধ্যমে কৃত্রিম—বুদ্ধিমত্তা আইওটিকে অন্য এক মাত্রায় নিয়ে গেছে! এর ফলে আইওটি ডিভাইসগুলো শুধু তথ্য সংগ্রহই নয়, বরং সেই তথ্যকে কাজে লাগিয়ে নিজে থেকেই সিদ্ধান্ত নিয়ে নেয়। যার ফলে প্রচুর সময় এবং নেটওয়ার্কিং ও প্রসেসিংয়ের কাজ বেঁচে যায়। প্রায়োগিক ক্ষেত্রে, স্মার্ট সেন্সর ও ইন্টিগ্রেটেড চিপের মাধ্যমে বৈচিত্র্যপূর্ণ ডাটা থেকে প্যাটার্ন রিকগনিশনের মাধ্যমে এই কাজগুলো করা হয়।
উদাহরণস্বরূপ, এআইওটি পদ্ধতিতে একটা স্বয়ংক্রিয়—মেশিন তাপমাত্রা, চাপ, আর্দ্রতা, বাতাসের অবস্থা এবং এ রকম আরও অনেক রকমের ডাটা সংগ্রহ ও বিশ্লেষণ করে থাকে। এআইওটি পদ্ধতিতে অন্যান্য যে কোনো পদ্ধতির থেকে অন্তত ২০—২৫ গুণ আগে ফল প্রকাশ বা নির্ণয় অর্থাৎ প্রেডিকশন করার ক্ষমতা রয়েছে।
এআইওটি যে কোনো পরিপূর্ণ ও পরিণত (ম্যাচিউর) ইকো—সিস্টেম তৈরির ক্ষেত্রে নতুন একটা দিগন্ত খুলে দিয়েছে, যেটার গুরুত্ব যেকোনো প্রতিষ্ঠানের ক্ষেত্রে অনেক বেশি। আইওটি বিশাল সংখ্যক পোর্টেবল ডিভাইস, হোম অ্যাপ্লায়েন্স, ওয়ারেবল এবং অন্যান্য ইলেকট্রনিক্স ও ইন্ডাস্টি্রয়াল মেশিনকে ইন্টারনেটের মাধ্যমে একে—অন্যের সঙ্গে সংযুক্ত করে।
এই সংযুক্ত ডিভাইসগুলো তাদের পরিবেশকে পর্যবেক্ষণ করতে পারে এবং এদেরকে দূর থেকে পর্যবেক্ষণ, নিয়ন্ত্রণ এবং পরিচালনা করা সম্ভব হয়। আইওটির মাধ্যমে এই বিশাল পরিমাণ ডাটা সংগ্রহ করার পরে এবার সেই ডাটাগুলোকে দিয়ে কাজ করার জন্য বিগডাটা প্রসেসিং এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অবশ্যই লাগবে। এভাবে এরা একসঙ্গে কাজ করে অনেক অসম্ভবকেও সম্ভব করে ফেলতে পারে।
আর তাই যতদিন যাবে এই প্রযুক্তিগুলো স্বতন্ত্র না থেকে একে অন্যের পরিপূরক অংশ হিসেবে একটা সিস্টেমে কাজ করবে, ততই প্রযুক্তির বৈপ্লবিক উন্নয়ন ঘটবে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং ইন্টারনেট অব থিংসের সংমিশ্রণের মাধ্যমে বর্তমানে রোগীর যত্ন এবং চিকিৎসা ব্যবস্থাপনায় একটি উজ্জ্বল এবং গুরুত্বপূর্ণ দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। স্বাস্থ্যসেবায় এখন এআইওটির প্রযুক্তির দ্বারা রোগ নির্ণয়ের উন্নতি করতে, চিকিৎসা প্রক্রিয়াগুলো ত্বরান্বিত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।
স্বাস্থ্যসেবাতে এআইওটি—এর ব্যাপক ব্যবহার অবশ্য ডেটা নিরাপত্তা, গোপনীয়তা এবং আইনি সম্মতির সঙ্গে কিছু সমস্যাও উপস্থাপন করে। এক্ষেত্রে স্বাস্থ্যসেবা সেটিংসে এআইওটি সিস্টেম প্রয়োগ করার সময়, নৈতিক মান বজায় রাখা, ইন্টারঅপারেবিলিটির গ্যারান্টি দেওয়া এবং সংবেদনশীল মেডিক্যাল ডেটা রক্ষা করাসহ গুরুত্বপূর্ণ বিষয়গুলি বিবেচনায় নেওয়া উচিত।
এআইওটি, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং ইন্টারনেট অব থিংসের সংমিশ্রণ। এই সংমিশ্রণটি শিল্প থেকে স্বাস্থ্যসেবা পর্যন্ত অনেক সেক্টরকে রূপান্তর করার বিশাল সম্ভাবনা সরবরাহ করে। এটি নিঃসন্দেহে বর্তমান সময়ের তথ্যপ্রযুক্তির অন্যতম বৃহত্তম প্রযুক্তি প্রবণতা। এআইওটি সর্বাগ্রে আমাদের আরও স্মার্ট, স্বায়ত্তশাসিত সিস্টেম তৈরি করার ক্ষমতা দেয়, যা বাস্তব সময়ে পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে সাড়া দিতে পারে।
আমাদের সমাজ ও অর্থনীতিকে পরিবর্তন করার জন্য এর সম্ভাবনা প্রচুর। যে কোনো নতুন প্রযুক্তির মতোই এই প্রযুক্তিতেও চ্যালেঞ্জ রয়েছে। এআইওটি প্রযুক্তির ক্ষেত্রে গোপনীয়তা এবং উদ্বেগ বড় একটি চ্যালেঞ্জ। প্রকৃতপক্ষে বিপুল পরিমাণ তথ্য সংগ্রহ এবং বিশ্লেষণ গোপনীয়তার সমস্যা উত্থাপন করে। এআইওটি ডিভাইসগুলো পর্যাপ্তভাবে সুরক্ষিত না হলে সাইবার আক্রমণের জন্য ঝুঁকিপূর্ণ হতে পারে। তাই নিরাপত্তা, গোপনীয়তা এবং নৈতিকতা সম্পর্কিত সমস্যাগুলোকে নিশ্চিত করতে হবে।
এআইওটি এমনভাবে ব্যবহার করতে হবে যেন এটি ব্যবহারকারীর মূল্যবোধ এবং মানগুলোর সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ হয়। ব্যক্তি, ব্যবসা এবং সমাজ হিসাবে আমাদের অবশ্যই প্রযুক্তির এই সুযোগটি কাজে লাগাতে প্রস্তুত থাকতে হবে। পাশাপাশি এই প্রযুক্তি থেকে আসা চ্যালেঞ্জগুলোর মুখোমুখি হতে হবে।
হীরেন পণ্ডিত: প্রাবন্ধিক ও গবেষক
দেশী ও বিদেশী সকল তথ্যসূত্র ধন্যবাদের সাথে গৃহীত
ফিডব্যাক: [email protected]
ছবি: ইন্টারনেট
০ টি মন্তব্য