অনলাইন শ্রমবাজার বা ফ্রিল্যান্সিং খাতে বিশ্বে দ্বিতীয় স্থানে রয়েছে বাংলাদেশ। মোট অনলাইন শ্রমবাজার বাংলাদেশের অংশ প্রায় ১৬ শতাংশ। গত এক বছরে দেশে ই—কমার্স খাতেও প্রায় এক লাখ লোকের কর্মসংস্থান হয়েছে প্রায় ৭ লাখ মানুষ ফ্রিল্যান্সিংয়ের সাথে সম্পৃক্ত। আমাদের দেশের ছেলেমেয়েরা নিজেদের চেষ্টায় ফ্রিল্যান্সিং কাজে ঝাঁপিয়ে পড়ে। বাংলাদেশে বসে বিশ্বের উন্নত দেশের কাজ করতে শুরু করে। তবে বিদেশ থেকে টাকা আনা নিয়ে হাজারও ঝক্কি পোহাতে হয়, যেগুলো এখন অনেকটাই ঠিক হয়ে এসেছে। কিন্তু এগুলো আরও ১০ বছর আগেই ঠিক হয়ে যেতে পারত। শুধু নীতিগত কারণে পিছিয়ে যাওয়া। বাংলাদেশ ফ্রিল্যান্সিং ক্ষেত্রে বেশ ভালো একটি জায়গা করে নিয়েছে। এ কাজটিতে বাংলাদেশ আরও ভালো করতে পারত, যদি প্রত্যন্ত অঞ্চলে ইন্টারনেটের ভালো গতি পৌঁছে দেয়া যতো এবং ডিজিটাল পেমেন্টাকে সহজতর করতে পারত।
এ দশকেও বাংলাদেশ তার ইন্টারেনেটের গতি ঠিক করতে পারেনি। বাংলাদেশের মানুষ দুই উপায়ে ইন্টারনেট পেয়ে থাকে। একটি হলো ফাইবার অপটিক ব্রডব্যান্ড, আরেকটি হলো মোবাইল ইন্টারনেট। বাংলাদেশে পরিকল্পিত উপায়ে ফাইবার অপটিক নেটওয়ার্ক গড়ে ওঠেনি। ঢাকার চেয়ে জেলা শহরগুলোতে ইন্টারনেটের গতি কম। সরকারের ঘোষিত এক দেশ এক রেট এর সফল বাস্তবায়ন। বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত এখনো ঢাকাকেন্দ্রিক। ঢাকায় কিছু কিছু এলাকা ফাইবারের আওতায় এসেছে। কিন্তু সেগুলো আন্তর্জাতিক মানের করতে হবে।
আর মোবাইল ইন্টারনেটের অবস্থা এখনো খারাপ, সেটি তো আমরা সবাই জানি। ঢাকা শহরের মানুষ কিছুটা গতি পেলেও ঢাকার বাইরের অবস্থা খুবই নাজুক। এটি মূলত হয়েছে মোবাইল অপারেটররা ঢাকার বাইরে তেমন বিনিয়োগ করেনি, যা তাদের লাইসেন্সের আওতায় করার কথা এবং বাংলাদেশ যেহেতু এটি নিশ্চিত করতে পারেনি, তাই দেশ আরও দশ বছরের বেশি সময় পিছিয়ে গেল। বাংলাদেশের মানুষ জেলা শহরেই অনেক সময় ভালো নেটওয়ার্ক পায় না। তথ্যপ্রযুক্তি খাত প্রাইভেট সেক্টরে প্রসারিত হওয়ার জন্য যেই অবকাঠামোর প্রয়োজন ছিল, তা এখনো তৈরি হয়নি।
বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের তিনটি চ্যালেঞ্জের মধ্যে প্রথমটি হলো উন্নত মানের ইন্টারনেট সমস্যা, যার সমাধান আরও ১০ বছর আগেই হওয়া দরকার ছিল। দ্বিতীয়টি হলো উন্নত বুদ্ধির মানুষ। তথ্যপ্রযুক্তি হলো এমন একটি খাত, যেখানে বুদ্ধির প্রয়োজন হয়। এর জন্য চাই প্রকৃত বুদ্ধিমান মানুষ। কিন্তু বাংলাদেশ এখন বড় ধরনের ‘ব্রেইন—ড্রেইন’—এর ভেতর পড়ে গেছে। পৃথিবীর বড় বড় প্রতিষ্ঠানগুলো বাংলাদেশ থেকে সরাসরি ভালো লোকগুলোকে নিয়ে যাচ্ছে। ফলে, সেবা তৈরি করার মতো মানুষ এ দেশে থাকছে না। আমরা মূলত কনজ্যুমার হচ্ছি। আমাদের যদি প্রস্তুতকারকের ভূমিকায় আসতে হয়, তাহলে আরও বুদ্ধি লাগবে। আর তৃতীয়টি হলো ইন্টিলেকচুয়াল কপিরাইট প্রটেকশন, যা বাংলাদেশে এখনো বেশ দুর্বল। মেধাস্বত্ব যদি সঠিকভাবে সংরক্ষণ করা না যায়, তাহলে মেধাবীরা এখানে থাকবে না। আর এ শিল্পে মেধার কোনো বিকল্প নেই।
দেশে ইন্টারনেট প্রাপ্তি সহজ হওয়ায় ডিজিটাল অর্থনীতি দ্রুত এগিয়ে যাচ্ছে। গত এক বছরে দেশে ইকমার্স খাতে প্রায় এক লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হয়েছে। আগামী এক বছরে আরও পাঁচ লাখ মানুষের কর্মসংস্থান হবে। ভারতের পর বর্তমানে অনলাইন কর্মসংস্থানে বাংলাদেশের অবস্থান এবং বিশ্বে দ্বিতীয়। বিশ্ব অনলাইন ওয়ার্কার্সের (ফ্রিল্যান্সার) ১৬ শতাংশ বাংলাদেশের। করোনার কারণে যারা চাকরি হারিয়েছিলেন, তাদের অনেকেই উদ্যোক্তা হিসাবে ই—কমার্সে প্রবেশ করেছেন।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রধান হাতিয়ার তথ্যপ্রযুক্তি। এখন যারা বিশ্ব্যব্যাপী সবচেয়ে বেশি পরিবহণ সুবিধা দিচ্ছে, তাদের নিজস্ব কোনো যানবাহন নেই। যারা সবচেয়ে বড় হোটেল নেটওয়ার্ক সুবিধা দিচ্ছে, তাদের নিজস্ব কোনো হোটেল নেই। প্রতিদিন নিত্যনতুন প্ল্যাটফরম তৈরি হচ্ছে। নতুন নতুন কর্মসংস্থান হচ্ছে। একই অবস্থা বাংলাদেশেও। দিনে দিনে অনলাইন লেনদেনও ব্যাপক বেড়েছে। দেশের বর্তমানে প্রায় ৫ কোটি মানুষ ফেসবুক ব্যবহার করছে। এ খাতেও বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। ফেসবুককেন্দ্রিক উদ্যোক্তা ৫০ হাজার, ওয়েবসাইটভিত্তিক উদ্যোক্তার সংখ্যা দুই হাজার। দেশে এখন ক্রিয়েটিভ ও মালটিমিডিয়ার সঙ্গে সম্পৃক্ত আছেন ১৯ হাজার ৫৫২ জন।
এ খাতে অনেক চ্যালেঞ্জ রয়েছে। যে ডিজিটাল প্ল্যাটফরমগুলো তৈরি হচ্ছে, তার জন্য রেগুলেটরি ফ্রেমওয়ার্ক আছে কিনা; এখাতের জন্য ইনটেনসিভ আছে কি না; নতুন উদ্যোক্তাদের জন্য কোনো রাজস্ব ছাড় আছে কি না; এরা করজালে আসছেন কি না—তা দেখতে হবে। এটাকে এটা সুষ্ঠু প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর মধ্যে নিয়ে আসতে হবে। ই—কমার্স একটি উদীয়মান খাত। এ খাতে শুধু ভোক্তার স্বার্থই নয়, উদ্যোক্তার সুবিধা নিশ্চিতেও একটি নীতিমালা অপরিহার্য। এ ছাড়া এলডিসি উত্তরণে ডিজিটাল প্ল্যাটফরম ইকোনমি বেশ গুরুত্বপূর্ণ। সেজন্য বিদ্যমান বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সম্মিলিতিভাবে কাজ করতে হবে।’
আর উদ্যোক্তাদের জন্য চ্যালেঞ্জের মধ্যে রয়েছে—ডিজিটাল ডিভাইসের অভাব। দেশে গরিব জনসংখ্যার প্রতি এক হাজার জনের মধ্যে চারজনের কম্পিউটার রয়েছে। এ ছাড়া, নীতি সহায়তার অভাব, নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সুবিধার অভাব, ইন্টারনেটের ধীর গতি, বিনিয়োগ, ইংরেজি ভাষার দক্ষতার অভাব, কারিগরি জ্ঞানের অভাব। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব মোকাবিলা করতে হলে দক্ষ জনবল তৈরি করতে হবে। প্রযুক্তির সঙ্গে খাপ খাইয়ে নিতে হবে। নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে আরও সহজভাবে সেবা দিতে হবে। একই সঙ্গে একটি জাতীয় নীতিমালাও তৈরি করতে হবে। এ খাতকে এগিয়ে নিতে নির্দিষ্ট সময় পর্যন্ত কর অব্যাহতি দিতে হবে।
বিদেশি বিভিন্ন প্ল্যাটফরমে কাজ করে আয় করায় উৎসাহ বাড়াতে ফ্রিল্যান্সারদের প্রাথমিকভাবে ৫৫টি স্বীকৃত প্ল্যাটফরম নির্ধারণ করে দিয়েছে সরকার। এসব অনলাইন মার্কেটপ্লেসে কাজ করে আয় করলে চলতি ২০২১—২২ অর্থবছর থেকে ৪ শতাংশ নগদ প্রণোদনা পাচ্ছেন ফ্রিল্যান্সাররা। বাংলাদেশ ব্যাংক এক সার্কুলারে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ স্বীকৃত এসব মার্কেটপ্লেসের তালিকা প্রকাশ করে। ব্যক্তি পর্যায়ের ফ্রিল্যান্সাররা সফটওয়্যার ও আইটিইএস সেবা অনলাইন মার্কেটপ্লেসের মাধ্যমে রপ্তানি করে থাকে। সফটওয়্যার ও আইটিইএস সেবা রপ্তানির বিপরীতে নগদ সহায়তা পেতে হলে সংশ্লিষ্ট অনলাইন মার্কেটপ্লেসকে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিভাগ কর্তৃক স্বীকৃত হওয়ার শর্ত রয়েছে।
মার্কেটপ্লেসের ওই তালিকায় নাম রয়েছে— আপওয়ার্ক, ফাইভার, ফ্রিল্যান্সার ডটকম, গুরু, পিপল পার আওয়ার, টপটাল, ফ্লেক্সজব, ৯৯ ডিজাইনস, সিমপ্লি হায়ার্ড, অ্যাকুয়েন্ট, পাবলফট, ডিজাইনহিল, বার্ক, গোলেন্স, ফ্রিআপ, হাবস্টাফ ট্যালেন্ট, সলিড গিগস, উই ওয়ার্ক রিমোটলি, গিগস্টার, ড্রিববল, বিহেন্স, ক্লাউডপিপস, এনভাটো, হ্যাকারন, আমাজান মেকানিকাল টার্ক, শাটারস্টক, অ্যাডোবি স্টক, আই স্টক, ডিপোজিট ফটোসস, ১২৩ আরএফ, পন্ড৫, ড্রিমসটাইম, ক্রিয়েটিভ মার্কেট, ক্যানস্টকফটো, অ্যালামি, ইউনিটি অ্যাসেট স্টোর, স্কেচফ্যাব, ফ্রিপিক, অ্যাউইন, শেয়ারঅ্যাসেল, ফ্লেক্সঅফারস, ম্যাক্সবাউন্টি, ট্রেডডাবলার, সিজে অ্যাফিলিয়েট, ভিগলিংক, জেভিজু, রাকুটেন, ক্লিকব্যাংক, আমাজন অ্যাসোসিয়েটস, ওয়ালমার্ট অ্যাফিলিয়েট, গুগল অ্যাডসেন্স, ফেসবুক মনিটাইজেশন, ইউটিউব মনিটাইজেশন, অ্যাপস্টোর ও প্লেস্টোর।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের নির্বাহী চেয়ারম্যান ক্লাউস শোয়াব ২০১৫ সালে ফরেন অ্যাফেয়ার্সে প্রকাশিত একটি নিবন্ধের মাধ্যমে চতুর্থ শিল্প বিপ্লব শব্দটিকে বৃহৎ পরিসরে সামনে নিয়ে আসেন। শোয়াব তখন এমন সব প্রযুক্তির কথা উল্লেখ করেন, যার মাধ্যমে হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার ও বায়োলজিকে (সাইবার—ফিজিক্যাল সিস্টেমস) একত্র করে পৃথিবীকে উন্নতির পথে আরো গতিশীল করা যায়। শোয়াব মনে করেন, যুগটি রোবোটিক্স বুদ্ধিমত্তা, ন্যানোটেকনোলজি, কোয়ান্টাম কম্পিউটিং, বায়োটেকনোলজি, ইন্টারনেট অব থিংস, ইন্ডাস্টি্রয়াল ইন্টারনেট অব থিংস, ডিসেন্ট্রালাইজড কনসেনসাস, পঞ্চম প্রজন্মের ওয়্যারলেস প্রযুক্তি, থ্রিডি প্রিন্টিং ও সম্পূর্ণ ড্রাইভারবিহীন গাড়ি উদীয়মান প্রযুক্তির যুগান্তকারী যুগ হিসেবে চিহ্নিত হবে।
ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের ওই প্রস্তাবনার বাস্তবায়ন পর্যায়ে বর্তমানে অবশ্য চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে কোভিড—১৯ মহামারী—পরবর্তী অর্থনীতি পুনর্গঠনের কৌশলগত টেকসই সমাধান হিসেবে অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। বিগত সময়ের সব হিসাব—নিকাশ বাতিল করে আমাদের দরজায় এখন যে শিল্প বিপ্লবটি কড়া নাড়ছে, সেটি হচ্ছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাভিত্তিক চতুর্থ শিল্প বিপ্লব; যার গতির দৌড় কল্পনার চেয়েও বেশি। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবটির ভিত হচ্ছে ‘জ্ঞান ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা’ ভিত্তিক কম্পিউটিং প্রযুক্তি।
রোবটিক্স, আইওটি, ন্যানো প্রযুক্তি, ডাটা সায়েন্স ইত্যাদি প্রযুক্তি প্রতিনিয়ত চতুর্থ শিল্প বিপ্লবকে নিয়ে যাচ্ছে অনন্য উচ্চতায়। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের প্রভাব সবচেয়ে বেশি পড়বে কর্মবাজারে। অটোমেশন প্রযুক্তির ফলে ক্রমে শিল্প—কারখানা হয়ে পড়বে যন্ত্রনির্ভর। টেক জায়ান্ট কোম্পানি অ্যাপলের হার্ডওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠান ফক্সকন এরই মধ্যে হাজার হাজার কর্মী ছাঁটাই করে তার পরিবর্তে রোবটকে কর্মী হিসেবে নিয়োগ দিয়েছে।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ফলে বিপুল পরিমাণ মানুষ চাকরি হারালেও এর বিপরীতে সৃষ্টি হবে নতুন ধারার নানা কর্মক্ষেত্র। নতুন যুগের এসব চাকরির জন্য প্রয়োজন উঁচু স্তরের কারিগরি দক্ষতা। ডাটা সায়েন্টিস্ট, আইওটি এক্সপার্ট, রোবটিক্স ইঞ্জিনিয়ারের মতো আগামী দিনের চাকরিগুলোর জন্য সবচেয়ে বেশি উপযোগী তরুণ জনগোষ্ঠী।
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের এক গবেষণা অনুযায়ী, আগামী দুই দশকের মধ্যে মানবজাতির ৪৭ শতাংশ কাজ স্বয়ংক্রিয় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন যন্ত্রের মাধ্যমে হবে। চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের ফলে শ্রমনির্ভর এবং অপেক্ষাকৃত কম দক্ষতানির্ভর চাকরি বিলুপ্ত হলেও উচ্চ দক্ষতানির্ভর যে নতুন কর্মবাজার সৃষ্টি হবে, সে বিষয়ে আমাদের তরুণ প্রজন্মকে তার জন্য প্রস্তুত করে তোলার এখনই সেরা সময়। দক্ষ জনশক্তি প্রস্তুত করা সম্ভব হলে জনমিতিক লভ্যাংশকে কাজে লাগিয়ে চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের সুফল ভোগ করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অন্য অনেক দেশ থেকে অনেক বেশি উপযুক্ত।
এক্ষেত্রে আমাদের জন্য সবচেয়ে ভালো উদাহরণ হতে পারে জাপান। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ভঙ্গুর অর্থনীতি থেকে আজকের দ্বিতীয় বৃহত্তম অর্থনীতির দেশ জাপান পৃথিবীকে দেখিয়ে দিয়েছে শুধু মানবসম্পদকে কাজে লাগিয়ে অর্থনৈতিক ও সার্বিক জীবনমানের উত্তরণ ঘটানো যায়। জাপানের প্রাকৃতিক সম্পদ অত্যন্ত নগণ্য এবং আবাদযোগ্য কৃষিজমির পরিমাণ মাত্র ১৫ শতাংশ।
জাপান তার সব প্রাকৃতিক প্রতিকূলতা অতিক্রম করেছে জনসংখ্যাকে সুদক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তর করার মাধ্যমে। জাপানের এ উদাহরণ আমাদের জন্য সবচেয়ে বেশি উপযোগী। বাংলাদেশের সুবিশাল তরুণ জনগোষ্ঠীকে জনসম্পদে রূপান্তর করতে পারলে আমাদের পক্ষেও উন্নত অর্থনীতির একটি দেশে পরিণত হওয়া অসম্ভব নয়।
শিল্প—কারখানায় কী ধরনের জ্ঞান ও দক্ষতা লাগবে, সে বিষয়ে আমাদের শিক্ষাক্রমের তেমন সমন্বয় নেই। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব মোকাবেলায় শিক্ষা ব্যবস্থাকেও ঢেলে সাজাতে হবে। সারা দেশে সাশ্রয়ী মূল্যে ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের ব্যবস্থা করতে হবে। সরকারি—বেসরকারি অফিসের ফাইল—নথিপত্র ডিজিটাল ডকুমেন্টে রূপান্তর করতে হবে। আর নতুন ডকুমেন্টও ডিজিটাল পদ্ধতিতে তৈরি করে সংরক্ষণ ও বিতরণ করতে হবে।
এ বিষয়ে বর্তমানে ব্যাপক আলোচনা হচ্ছে, তবে সুনির্দিষ্ট ও বিস্তারিত পদক্ষেপ নেয়ার প্রস্তাব এখনো অনেকটা অনুপস্থিত মনে হয়। কেবল পরিকল্পনার মধ্যে সীমাবদ্ধ না থেকে অবকাঠামোগত উন্নয়নের পাশাপাশি আমাদের মানবসম্পদকেও যথাযথভাবে প্রস্তুুত করতে হবে এ পরিবর্তনের জন্য। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, আইওটি, ব্লকচেইন এসব প্রযুক্তিতে বাংলাদেশ এখনো অনেক পিছিয়ে। এসব প্রযুক্তি কাজে লাগিয়ে ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা, পণ্য সরবরাহ, চিকিৎসা, শিল্প—কারখানা, ব্যাংকিং, কৃষি, শিক্ষাসহ নানা ক্ষেত্রে কাজ করার পরিধি এখনো তাই ব্যাপকভাবে উন্মুক্ত।
সত্যিকার অর্থে যেহেতু তৃতীয় শিল্প বিপ্লবের সুফলই আমরা সবার কাছে পৌঁছতে পারিনি, চতুর্থ বিপ্লব মোকাবেলার জন্য আমাদের প্রস্তুতি কতটকু তা আরো গভীরভাবে ভাবতে হবে। ব্যাপক সমন্বিত কর্মপরিকল্পনা ও প্রয়োজনীয় অবকাঠামো স্থাপনের মাধ্যমে তা করা সম্ভব। উল্লেখ্য, শুধু আমাদের দক্ষ জনগোষ্ঠী নেই বলে পোশাক শিল্পের প্রযুক্তিগত খাতে কম—বেশি তিন লাখ বিদেশী নাগরিক কাজ করেন।
অবাক হতে হয় যখন দেখা যায় প্রায় এক কোটি ৫৫ লাখ ৫০ হাজার শ্রমিক বিদেশে হাড়ভাঙা পরিশ্রম করে আমাদের দেশে যে রেমিট্যান্স পাঠান, আমরা তার প্রায় সবটাই তুলে দিই মাত্র ১ লাখ বিদেশীর হাতে। তাই শুধু শিক্ষিত নয়, দেশে দক্ষ জনগোষ্ঠী গড়ে তোলার দিকে মনোযোগ দিতে হবে। শুধু দেশেই নয়, যারা বিদেশে কাজ করছেন তাদেরকেও যথাযথ প্রশিক্ষণ দিয়ে বিদেশে পাঠাতে হবে। বিদেশে আমাদের এক কোটি শ্রমিক আয় করেন ১৫ বিলিয়ন ডলার।
যেখানে বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের গ্র্যাজুয়েট তৈরি করার জন্য স্কিল বিষয়ে নিজেরা প্রশিক্ষিত হবেন। শিক্ষার্থীদের প্রচলিত প্রশ্নোত্তর থেকে বের করে এনে তাদের কেস স্টাডি, অ্যাসাইনমেন্ট, প্রজেক্ট ইত্যাদির মাধ্যমে শিক্ষকদের মূল বিষয়ের সঙ্গে যুক্ত করতে হবে। শিক্ষার্থীদের প্রকাশযোগ্যতা, দলীয় কাজে দক্ষতা তৈরির জন্য ওইসব কেস স্টাডি, অ্যাসাইনমেন্ট কিংবা প্রজেক্টের উপস্থাপনাকে করতে হবে বাধ্যতামূলক এবং সেটি শুধু নিজ নিজ শ্রেণীকক্ষে সীমাবদ্ধ রাখলে হবে না, ছড়িয়ে দিতে হবে নানা অঙ্গনে।
উচ্চশিক্ষার সর্বস্তরে শিল্পের সঙ্গে শিক্ষার্থীর সংযোগ বাড়াতে হবে। প্রয়োজনে শিক্ষানবিশী কার্যক্রম বাধ্যতামূলক করতে হবে, যাতে শিক্ষার্থীরা তাদের ডিগ্রি অর্জনের পাশাপাশি বাস্তব জীবনের কার্যক্রম সম্পর্ক হাতে—কলমে শিখতে পারেন। চতুর্থ শিল্প বিপ্লব মোকাবেলা করে এটিকে আশঙ্কার পরিবর্তে সম্ভাবনায় পরিণত করতে হলে আমাদের বর্তমান শিক্ষা ব্যবস্থার পরিবর্তন আনা প্রয়োজন।
দেশে প্রচলিত সব শিক্ষা ব্যবস্থাকে একীভূত করে বিশেষ করে উচ্চমাধ্যমিক স্তর পর্যন্ত এক ধারায় নিয়ে আসতে হবে এবং সেই ধারায় বিজ্ঞানভিত্তিক শিক্ষাকে প্রাধান্য দিতে হবে। শিক্ষকমণ্ডলীর দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে ট্রেনিংয়ের ব্যবস্থা করতে হবে। চৌকস প্রতিভাবান লোকজনকে শিক্ষকতায় আগ্রহী করার জন্য নানা সুযোগ—সুবিধার ব্যবস্থা করতে হবে। উচ্চ শিক্ষাস্তরে গবেষণাভিত্তিক শিক্ষা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে হবে এবং যারা বুদ্ধিবৃত্তির চর্চা ও গবেষণায় নিয়োজিত, তাদের মূল্যায়ন করতে হবে।
বাংলাদেশে এখন ঘরে বসে ইন্টারনেটে আয় বা অনলাইনে কাজ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে। চাকরির চেয়ে স্বাধীনভাবে কাজ করার সুযোগ নিয়ে অনেকেই এখন ঝুঁকছেন ফ্রিল্যান্সিংয়ে। বর্তমানে বিশ্বে আউটসোর্সিং তালিকায় বাংলাদেশ দ্বিতীয় অবস্থানে।
এখানে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ ফ্রিল্যান্সার রয়েছেন। তাঁদের মধ্যে পাঁচ লাখ কাজ করেন মাসিক আয়ের ভিত্তিতে। বিশাল এ জনগোষ্ঠীর অধিকাংশ তরুণ। তাঁরা চাকরির বদলে ফ্রিল্যান্সিংকেই পেশা হিসেবে নিয়েছেন। ফ্রিল্যান্সিং অনেকের কাছে ভালো লাগে। কারণ, এতে কাজের স্বাধীনতা আছে। ডলারে আয় করার সুযোগ আছে। পছন্দমতো কাজ বেছে নেওয়ার সুযোগ আছে, যা বাঁধাধরা চাকরিতে নেই। এ কাজে চ্যালেঞ্জ আছে। কাজ বাছাই করা ও কাজটি ঠিকভাবে সম্পন্ন না করলে এখাতে সফল হওয়া যায় না। দক্ষতা ও অভিজ্ঞতা প্রথাগত চাকরির চেয়ে ফ্রিল্যান্সারকে এগিয়ে রাখতে পারে।
এখন প্রতিযোগিতার বাজার। নতুনদের জন্য কাজ পাওয়া কঠিন। কিন্তু অভিজ্ঞতা আর নতুন দক্ষতা বাড়াতে পারলে এ ক্ষেত্রে সফল হওয়া যায়। কিন্তু কারও দীর্ঘমেয়াদি পেশা হিসেবে ফ্রিল্যান্সিং করা ঠিক হবে না। এর চেয়ে ক্রমাগত দক্ষতা বাড়াতে হবে। কেউ যদি চাকরি ছেড়ে ফ্রিল্যান্সিং করতে চান, তা করা ঠিক হবে না। কাজের দক্ষতা থাকলে চাকরির পাশাপাশি বাড়তি আয়ের জন্য কিছু করতে পারেন। এ ক্ষেত্রে অভিজ্ঞজনেরা ভালো করেন।
দীর্ঘ মেয়াদে কেউ একা ফ্রিল্যান্সিং করুক সেটি ভালো নয়। একটি সময় পর্যন্ত একা একা ফ্রিল্যান্সিং করা যেতে পারে বা দক্ষতা বাড়ানো যেতে পারে। এরপরই চাকরিতে ঢোকা উচিত। নিজের প্রতিষ্ঠান দাঁড় করাতে হলে বা স্টার্টআপ দিতে হলেও কিছুদিন চাকরি করা উচিত। তা না হলে পেশাদার কর্মক্ষেত্রের অভিজ্ঞতাগুলো, বিশেষ করে ব্যবস্থাপনা, দলগত কাজের বিষয়গুলো জানা উচিত। এতে আয় বাড়ে। ফ্রিল্যান্সিংয়ে নিজের ব্যবসা শুরুর আগে বা পেশা হিসেবে নেওয়ার আগে কোম্পানির অভিজ্ঞতা জরুরি।
ফ্রিল্যান্সিং স্বাধীন কাজের সুযোগ রয়েছে বলে এটি অনেকের পছন্দের। কিন্তু এখাতে দক্ষতা না হলে কাজ করা কঠিন। বর্তমান ফ্রিল্যান্সিং প্রেক্ষাপট বদলে গেছে। দেশজুড়ে নামমাত্র প্রশিক্ষণে অনেকেই দক্ষ না হয়ে এ পেশায় আসছেন। কাজের মান ভালো না হওয়ায় কাজ পাওয়া যেমন কঠিন হচ্ছে, তেমনি কাজের দর পড়ে যাচ্ছে। দক্ষ না হয়ে ফ্রিল্যান্সিং করলে সবার ক্ষতি। তবে দক্ষ হয়ে দলগতভাবে কাজ করলে এ ক্ষেত্রে সফলতা আসবে।
নির্দিষ্ট কাজে দক্ষতা অর্জনের মাধ্যমে যে—কেউ ফ্রিল্যান্সার হতে পারে। তবে কাজে দক্ষ হয়ে তবে এ পেশায় আসা উচিত। সরকার যে ফ্রিল্যান্সিং খাত থেকে আরও বেশি বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের স্বপ্ন দেখছে, তাতে ফ্রিল্যান্সারদের জন্য আরও সুবিধা নিশ্চিত করা দরকার। বিশেষ করে জেলা শহরগুলোতে দ্রুতগতির ইন্টারনেট নিশ্চিত করা এবং ইন্টারনেটের দাম সহনীয় রাখা। এ বিষয়গুলোয় জোর দেওয়া হচ্ছে।
সরকার ও সফটওয়্যার নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোর সংগঠন বেসিস চাইছে, এই ফ্রিল্যান্সাররা এখন প্রতিষ্ঠান হিসেবে গড়ে উঠুক। এতে কর্মসংস্থান বাড়বে, আরও নতুন ফ্রিল্যান্সার আসবে। ফ্রিল্যান্সিংকে একটি প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিলে তা তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের উন্নয়নে অবদান রাখতে পারে। সরকার স্টার্টআপদের জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে। ব্যাংকও এ খাতে কাজ করছে। অর্থাৎ বাজার তৈরি রয়েছে। বেসিস থেকে ফ্রিল্যান্সারদের বিশেষ প্রশিক্ষণ দেওয়া হচ্ছে। ফ্রিল্যান্সিংকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। এ জন্য সুবিধাও ঘোষণা করা হয়েছে। যেমন ব্যাংক এশিয়া থেকে ফ্রিল্যান্সারদের সুবিধা দিতে বেসিসের সঙ্গে মিলে স্বাধীন নামে প্রি—পেইড কার্ড চালু করা হয়েছে। এ কার্ডের মাধ্যমে ফ্রিল্যান্সাররা বিদেশ থেকে দেশে লেনদেন করতে পারছেন।
ফ্রিল্যান্সারদের উদ্যোক্তা হিসেবে গড়ে তুলতে হবে। এ জন্য বেসিসের পক্ষ থেকে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। দলগতভাবে বা এককভাবে (প্রোপ্রাইটরশিপ) বেসিসের সদস্য হওয়ার সুযোগ আছে। পুরো প্রক্রিয়াটা সহজ করার পদক্ষেপ নেওয়ার আরো প্রয়োজন রয়েছে। এর মধ্যে সহজে ট্রেড লাইসেন্স পাওয়া, আইনি সহায়তা, ঋণ, দক্ষতা বৃদ্ধির প্রশিক্ষণ, বিপণন কৌশল ও ব্র্যান্ডিংয়ে সহায়তা করার বিষয়গুলো রয়েছে। এ ছাড়া দেশে যেসব হাইটেক পার্ক হচ্ছে, সেগুলোয় ফ্রিল্যান্সারদের জন্য একটি করে ফ্লোর রাখার বিষয়ে কাজ চলছে।
নিজস্ব এলাকা থেকে কাজ করতে পেরেই অনেকে খুশি। তবে দ্রুতগতির ইন্টারনেট আর এর দাম কমাটা জরুরি। ঢাকাসহ সারা দেশে ফ্রিল্যান্সিং নিয়ে যেসব সেমিনার হয়, সেখানে তরুণদের অংশগ্রহণ থাকে চোখে পড়ার মতো। দেশে ইতিমধ্যে ফ্রিল্যান্সিংয়ের বিভিন্ন বিষয় নিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাও বেড়েছে।
সরকারি ও বিভিন্নভাবে প্রশিক্ষণ দেওয়া ছাড়া বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে। গড়ে উঠছে ফ্রিল্যান্সারদের নিজস্ব প্রতিষ্ঠান বা স্টার্টআপ। এ খাতের উদ্যোক্তারা বলছেন, সরকার স্টার্টআপদের জন্য বিভিন্ন ধরনের প্রশিক্ষণ দিয়ে আসছে। ব্যাংকও এ খাতে কাজ করছে।
অর্থাৎ বাজার তৈরি আছে। তবে এ খাতের মূল সমস্যা হচ্ছে ফ্রিল্যান্সারদের ‘আইডেনটিটি ক্রাইসিস’। কিন্তু বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এ সমস্যা কাটতে শুরু করেছে। অনেকেই এ খাতে ভালো করে উদাহরণ সৃষ্টি করেছেন। কারণ, ফ্রিল্যান্সারদের নিয়ে এখন সবখানেই আলোচনা চলছে। অনেকেই বিশ্বদরবারে বাংলাদেশকে তুলে ধরছেন। আইডেনটিটি ক্রাইসিস নয়, বাংলাদেশের পরিচয় তুলে ধরছেন। এভাবেই এই ফ্রিল্যান্সিং খাতটি হয়ে উঠছে প্রতিশ্রম্নতিশীল একটি খাত।
পিছিয়ে নেই নারীরাও
আজকাল কাজকর্মের পৃথিবীতে ব্যাপক পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। প্রথাগত যে কাজ আগে মানুষ করত, তা এখন ক্রমাগত প্রযুক্তির দখলে চলে যাচ্ছে। একই সঙ্গে পাল্লা দিয়ে তৈরি হয়ে চলেছে প্রযুক্তিপ্রবণ পেশা। এগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো অনলাইন ফ্রিল্যান্সিং সোজা কথায় যার অর্থ অনলাইনে নিজের দক্ষতা বিক্রি। ফ্রিল্যান্সিংয়ের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এরই মধ্যে একটি অবস্থান তৈরি করতে সমর্থ হয়েছে। বৈশ্বিক অনলাইন শ্রম সরবরাহে ভারতের পর বাংলাদেশের দ্বিতীয় অবস্থান; ৬৫ হাজার নিবন্ধিত ফ্রিল্যান্সার নিয়ে বৈশ্বিক বাজারের প্রায় ১৭ শতাংশ বাংলাদেশের দখলে। তা ছাড়া এই মঞ্চ এবং সুখ্যাতি বাংলাদেশের অনলাইন কর্মীদের জন্য বিশ্বব্যাপী পর্যাপ্ত গ্রহণযোগ্যতা সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছে।
কিন্তু দুর্ভাগ্যবশত অন্যান্য কারিগরি কর্মের ক্ষেত্রে যেমন, ফ্রিল্যান্সিংয়ে নিবন্ধিত সব অনলাইন কর্মীর মধ্যেও নারীদের অংশ মাত্র ৯ শতাংশ। ব্র্যাক ইউনিভার্সিটির ব্র্যাক ইনস্টিটিউট অব গভন্যর্ান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (বিআইজিডি) কয়েকজন গবেষক ফ্রিল্যান্সিংয়ে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত প্রায় এক হাজার নারীর আয়, কর্মসংস্থান, আস্থা, আকাক্সক্ষা, ক্ষমতায়ন, দক্ষতা এবং জীবনযাত্রার ধরনের ওপর এই কর্মসূচির প্রভাব মূল্যায়ন করেন। প্রাপ্ত প্রশিক্ষণের প্রভাবের পরিমাণ ও গুণগত দিক বিবেচনায় নিয়ে তাঁরা একটি মিশ্রণ পদ্ধতি অনুসরণ করেন। পরিমাণগত ফলাফল পর্যালোচনা করতে রেনডমাইজড কন্টে্রাল ট্রায়াল (আরসিটি) পদ্ধতি ব্যবহার করা হয়।
বিআইজিডি পরিচালিত সমীক্ষা থেকে প্রাপ্ত পরিমাণগত পর্যবেক্ষণ বলছে, প্রকল্প বাস্তবায়ন সময়ে দু’টি শর্তই প্রায় শতভাগ পূরণ হয়েছে অর্থাৎ প্রশিক্ষণপ্রার্থীদের শতভাগ এসএসসি ডিগ্রিধারী এবং তাদের ৯৫ শতাংশের বয়স ১৮ থেকে ৩৫ বছর। ফলোআপ সমীক্ষার ভিত্তিতে প্রভাব মূল্যায়নে দেখা যায়, শ্রমবাজারে এ ধরনের প্রশিক্ষণের প্রভাব বেশ উৎসাহব্যঞ্জক; যেমন প্রশিক্ষণ শেষে কর্মসংস্থান, কাজের ঘণ্টা এবং আয় বৃদ্ধি পায় যথাক্রমে ২৬, ৪২ ও ৫৪ শতাংশ। এর অর্থ দাঁড়ায়, প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত নারী কর্ম ও উৎপাদনশীলতায় অগ্রগামী। এর ফলে তাদের আয়ও বেশি ছিল। বলা বাহুল্য, যেহেতু প্রশিক্ষণ নিয়েছে ফ্রিল্যান্সিংয়ের ওপর, তাই আপাতত ইতিবাচক ফলাফলের পেছনের কারণ প্রশিক্ষণ বলে ধরে নেওয়া যায়। তবে এটিও দেখা যায় যে যারা বেশি বেশি ক্লাস করেছে, তাদের উন্নতিও বেশি হয়েছে; যেমন যারা ৪৮টি ক্লাসের মধ্যে কমপক্ষে ২৫টি ক্লাসে যোগ দিয়েছে, তাদের ফ্রিল্যান্সিং কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ৪২ শতাংশ।
অথচ ১১ থেকে ২৪ ক্লাসে যোগ দিয়ে বৃদ্ধি ঘটেছে ২১ শতাংশ এবং ১৬ শতাংশ বৃদ্ধি, যারা আরো কম ক্লাস করেছে তাদের জন্য। স্বাভাবিকভাবেই এই তিন ধরনের অংশগ্রহণকারীর ফ্রিল্যান্সিং থেকে আয় প্রতি মাসে যথাক্রমে দুই হাজার ৫০০, দুই হাজার ৮৩ ও ৬৪৩ টাকা। এর বিপরীতে নিয়ন্ত্রিত গোষ্ঠীর বেলায় কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ঘটেছে ১২ শতাংশ মাত্র এবং মাসিক আয় ৭৭৮ টাকা।
স্মরণ করা দরকার, ফ্রিল্যান্সিং কর্মকাণ্ডে কম্পিউটার সফটওয়্যার প্রয়োগ নিয়ে প্রশিক্ষণ দেওয়া। তাই প্রথমেই ইতিবাচক প্রবণতা লক্ষ্য করা যায় যন্ত্রটি নাড়াচাড়া আর ব্যবহারের ক্ষেত্রে। এই বর্ধিত দক্ষতা আয়কে প্রভাবিত করেছে বলে প্রতীয়মান হয়। যেমন যারা প্রশিক্ষণ নেয়নি, তাদের চেয়ে ৩৮ শতাংশ বেশি আয় ছিল যারা প্রশিক্ষণ নিয়েছে তাদের। স্বভাবতই বর্ধিত আয় উত্তরদাতার ভোগও বাড়ায়। যেমনতাদের খাদ্য ও খাদ্যবহির্ভূত ব্যয় বৃদ্ধি যথাক্রমে ৪৮ ও ৪১ শতাংশ।
এর তাৎপর্য সুদূরপ্রসারী। কেননা এটির জন্য ভোগ বৃদ্ধি মানবপুঁজি গঠনে ইতিবাচক ভূমিকা রাখে। অন্যদিকে ঋণগ্রস্ত খানার অনুপাত হ্রাস ও সঞ্চয়কারী খানার অনুপাত বৃদ্ধি পায়; যদিও আস্থা ও আকাক্সক্ষাজনিত প্রভাব তেমন তাৎপর্যপূর্ণ নয় বলে লক্ষ্য করা যায়, তার পরও সমীক্ষায় নারীর ক্ষমতায়নের কিছু নির্দেশকে তাৎপর্যপূর্ণ পরিবর্তন দেখা যায়।
অংশগ্রহণকারীদের মনোবৈজ্ঞানিক মঙ্গল বেড়েছে সুখ ও চাপের ওপর তাৎপর্যপূর্ণ প্রভাব পরিলক্ষিত হয়। যেমন ট্রিটমেন্ট গোষ্ঠীর চার—পঞ্চমাংশ জানিয়েছে যে গেল এক মাসে তারা কোনোভাবেই চাপের মধ্যে ছিল না। এর একটি কারণ হয়তো এই যে নিয়ন্ত্রিত গোষ্ঠীর তুলনায় তিন—চতুর্থাংশ বেশি ট্রিটমেন্ট গোষ্ঠী অবহিত করেছে যে তারা গেল মাসে কোনো আর্থিক সংকটের সম্মুখীন হয়নি। এবং প্রত্যাশিতভাবে এই হস্তক্ষেপের ফলে ফ্রিল্যান্সিং সংক্রান্ত জ্ঞান বৃদ্ধি ঘটেছে ১২ শতাংশ।
মূল্যায়নে দেখা যায়, অংশগ্রহণের হার বা আপটেক খুব একটা বেশি ছিল না, মাত্র ৫৫ শতাংশ অংশগ্রহণকারী কমপক্ষে মোট ক্লাসের অর্ধেক করেছে, যেখানে অংশগ্রহণকারীদের মাত্র এক—পঞ্চমাংস সব ক্লাসে উপস্থিত ছিল। উপদেশমূলক অধিবেশনে অংশগ্রহণের হার ছিল খুবই কম। এ থেকে প্রতীয়মান হয়, প্রশিক্ষণ ও পরামর্শ সংক্রান্ত অধিবেশনে অংশগ্রহণ বৃদ্ধি সাপেক্ষে প্রকল্পটির প্রভাবের প্রসার সম্ভবত আরো বেশি হতে পারত।
গুণগত পর্যালোচনা করতে গিয়ে গবেষকরা মূলত প্রকল্প প্রক্রিয়ার অংশগ্রহণকারীদের অভিজ্ঞতা বিবেচনায় নিয়ে প্রতিটি ধাপের আলোকে কাজের ক্ষেত্রে ইতিবাচক ও নেতিবাচক দিকে দৃষ্টি নিক্ষেপ করেন। তুলনামূলক আলোচনা তুলে ধরে তাঁরা সফল ও ব্যর্থ অংশগ্রহণকারীদের বৈশিষ্ট্যের প্রতি মনোযোগ আকর্ষণে ব্রতী হন।
প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ না করা কিংবা ফ্রিল্যান্সিং চালিয়ে না যাওয়ার পেছনে প্রধান একটি কারণ হচ্ছে সফলতার জন্য যে সময় বিনিয়োগ করা দরকার, সে সময়ের অভাব। বেশির ভাগ প্রশিক্ষণার্থীকে তাদের নিজ নিজ খানার ব্যবস্থাপনায় সময় দিতে হয়, সবার দেখভাল ও খানার অন্যান্য কাজ সেরে প্রশিক্ষণ ক্লাসে যাওয়ার সময় থাকে না অথবা সময় থাকে খুব কম। আবার ক্লাসে এলেও খানার বিভিন্ন বিষয়, দায়িত্ব এবং ঘটনা মনোযোগ ছিনিয়ে নেয়। দ্বিতীয় কারণ ক্রেতার সঙ্গে অব্যাহতভাবে ইংরেজি ভাষায় যোগাযোগ রক্ষা করার ক্ষেত্রে কর্মদক্ষতার ঘাটতি।
কিছু প্রার্থীর ধারণা এই যে তাদের লব্ধ ইংরেজি জ্ঞান ক্রেতার সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষায় পর্যাপ্ত নয়, যা প্রতিনিধিত্ব বা দর—কষাকষির জন্য উপযুক্ত নয়। তৃতীয়ত, কিছুসংখ্যক প্রশিক্ষণার্থীকে মা—বাবার নৈতিক সমর্থন না পেয়ে তাঁদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে প্রশিক্ষণে অংশগ্রহণ করতে হয়েছে। তারা মনে করে, মা—বাবার সহযোগিতা পেলে প্রশিক্ষণ থেকে আরো ভালোভাবে লাভবান হতে পারত। এমনকি কারো কারো ক্ষেত্রে পরিবারের প্রতি চ্যালেঞ্জের বিপরীতে ফ্রিল্যান্সিং থেকে পাওয়া উপার্জন দেখাতে হয়েছে। চতুর্থত, দরকারি সফটওয়্যার মসৃণভাবে চালাতে হলে চাই উঁচু ক্ষমতা এবং মানসম্মত কম্পিউটার, যা অনেক প্রার্থীর লভ্যতার বাইরে ছিল বলে প্রতীয়মান হয়।
অবশ্য এর সম্পূর্ণ বিপরীত মেরুতে অবস্থান ছিল সফলকামীদের। তাদের না ছিল সময়ের অভাব, না ছিল পারিবারিক প্রতিবন্ধকতা। খুব সুন্দর করে দক্ষতার সঙ্গে দুই দিক সামলাতে পেরেছে এই সফল নারীরা। আসলে বাড়িতে বসে ফ্রিল্যান্সিং করতে সময় পাওয়াটা যেমন সুবিধাজনক, পারিবারিক সমর্থন তার চেয়ে কম গুরুত্বপূর্ণ নয় বলে তাদের ধারণা।
ফ্রিল্যান্সিং যারা সফলভাবে শেষ করতে পেরেছে, তাদের ক্ষেত্রে দ্বিতীয় কারণ হচ্ছে সুপারিশ ও জাতীয় ফ্রিল্যান্সিং বাজারে চাকরির খোঁজ পাওয়ার নিমিত্তে বন্ধুবান্ধব এবং পরিবারের সদস্যদের সংযোগ। তৃতীয়ত, কারো কারো শিক্ষাগত যোগ্যতা অথবা ইংরেজি ভাষায় দক্ষতা দর—কষাকষি করে নিজের নৈপুণ্য বিক্রির বেলায় অন্যের চেয়ে সুবিধা বেশি ছিল। সব শেষে নিরবচ্ছিন্ন মনোযোগে কাজ করে যাওয়া এবং উন্নতি করার বেলায় বিজ্ঞ পরামর্শদাতা কিংবা সমকক্ষের সহযোগিতা সফলতার অন্যতম স্তম্ভ¢ হিসেবে বিবেচনা করেছে কেউ কেউ।
উপসংহারে উপলব্ধি এই যে ফ্রিল্যান্সিং কর্মসূচিতে নিয়মিত অংশগ্রহণ শিক্ষিত, স্বল্প প্রাধিকারপ্রাপ্ত নারীদের আর্থিক ক্ষমতায়নে বড়মাপের প্রভাব রাখতে পারে। কার্যকর সম্প্রসারণের স্বার্থে বাস্তবায়নকারী, অংশগ্রহণকারী এবং নীতিনির্ধারক—এই তিন শ্রেণির জন্য কয়েকটি সুপারিশ তুলে ধরা যায়। বাস্তবায়নকারীর জন্য সুপারিশ : প্রত্যেক প্রার্থীর আবেদন তার অন্তর্নিহিত সামর্থ্য ও দক্ষতার ভিত্তিতে মূল্যায়নের নিমিত্তে লক্ষ্যপ্রক্রিয়া শাণানো। প্রশিক্ষণার্থীদের দরকার এবং দক্ষতা অনুযায়ী বিভিন্ন গোষ্ঠীর জন্য পাঠ্যসূচি প্রবর্তন এবং প্রশিক্ষণ থেকে অর্জিত দক্ষতা যথাযথ কাজে লাগানোর জন্য অতিরিক্ত দক্ষতা ও জ্ঞানের ওপর জোর দেওয়া।
অনলাইন বাজারে বিদ্যমান ভালো এবং মন্দ অভ্যাসগুলো সম্পর্কে ধারণা দেওয়া। অপেক্ষাকৃত দুর্বল প্রার্থীকে যথেষ্ট পরিমাণে সহায়তা এবং অতিথিপরায়ণ পরিবেশ সৃষ্টি করা এবং সব শেষে দক্ষ বাজার কৌশল গ্রহণ করা। যোগদান করার আগে প্রশিক্ষণ ইনস্টিটিউট এবং কাজের সুযোগ সম্পর্কে সব জেনেশুনে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করতে হবে। ফ্রিল্যান্স কার্যক্রমে কার্যকর অংশ নিন এবং ভালো আচরণ প্রদর্শন করতে হবে। বেশি পাওয়ার জন্য দর—কষাকষির দক্ষতা উন্নত করা। ফ্রিল্যান্সিংয়ের জন্য বিদ্যমান বহুবিধ সুযোগ—সুবিধার সদ্ব্যবহারকল্পে করণীয় নিয়ে ভাবতে হবে।
শ্রমবাজারে যারা পিছিয়ে রয়েছে, তাদের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক অনলাইন ফ্রিল্যান্সিং চাহিদা সৃষ্টিতে সাহায্য করতে হবে। অনলাইন ফ্রিল্যান্সিং যাতে প্রয়োজনীয় সামাজিক বৈধতা পায় তার জন্য কাজ করতে হবে। শক্তিশালী নিয়ন্ত্রণযোগ্য নীতিমালা ও লাইসেন্সিং পদ্ধতির মাধ্যমে প্রশিক্ষণকেন্দ্রগুলো শক্তিশালী করা। অনলাইন ফ্রিল্যান্সিংয়ে ব্যবহৃত প্রয়োজনীয় কলকবজার ওপর আমদানি শুল্ক হ্রাস করা। ফ্রিল্যান্সিং দক্ষতা উন্নয়নের জন্য আরো গবেষণা সহায়তা প্রদান করা। দক্ষতার সঙ্গে কর্মসূচির সম্প্রসারণ এবং কার্যকারিতা বৃদ্ধিতে প্রমাণসাপেক্ষ মডেল তৈরি করা।
একটি স্থিতিশীল চাহিদা সরবরাহ ইকোসিস্টেম সৃষ্টির জন্য বিশ্বাসযোগ্য অর্থায়ন মডেল তৈরি করা। প্রাপ্তি আদায়ে যেন জটিলতা না হয় সে জন্য আন্তর্জাতিক আর্থিক বিনিময় মসৃণ করা।
০ টি মন্তব্য