https://powerinai.com/

সাম্প্রতিক খবর

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: বৈদেশিক সহায়তা নাকি ডিজিটাল উপনিবেশবাদ?

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: বৈদেশিক সহায়তা নাকি ডিজিটাল উপনিবেশবাদ? কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা: বৈদেশিক সহায়তা নাকি ডিজিটাল উপনিবেশবাদ?
 

পাঁচ দশক ধরে বাংলাদেশ ঐতিহ্যবাহী বৈদেশিক সহায়তা—নগদ অনুদান, স্বল্পসুদে ঋণ, অবকাঠামো বিনিয়োগ ও মানবিক সহায়তা—গ্রহণ করে আসছে। এসব সহায়তা দারিদ্র্য হ্রাস, স্বাস্থ্য উন্নয়ন ও অবকাঠামো বিকাশে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে। তবে বৈশ্বিক সহায়তার চিত্র এখন বদলাচ্ছে। উন্নয়ন বাজেট সংকুচিত হচ্ছে, দাতাদের অগ্রাধিকার পরিবর্তিত হচ্ছে এবং বাংলাদেশ এলডিসি (স্বল্পোন্নত দেশ) থেকে উত্তরণের ফলে স্বল্পসুদে অর্থায়নের সুযোগও কমে আসবে।

একই সময়ে, বৈশ্বিক দক্ষিণে এক নতুন ধরনের “সহায়তা” দেখা দিচ্ছে—উন্নয়ন ও মানবিক কর্মকাণ্ডের হাতিয়ার হিসেবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই)। নগদ অর্থ বা পণ্য আকারে নয়, এই সহায়তা এখন অ্যালগরিদম, প্ল্যাটফর্ম ও ডিজিটাল অবকাঠামো হিসেবে আসছে। এই প্রবণতা যেমন বিপুল সম্ভাবনা নিয়ে এসেছে, তেমনি এতে রয়েছে এক নতুন ধরনের ডিজিটাল উপনিবেশবাদ—যেখানে প্রযুক্তিগত নিয়ন্ত্রণ পুরনো রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক আধিপত্যের স্থলাভিষিক্ত হয়।

বৈদেশিক সহায়তা থেকে ডিজিটাল সহায়তা

ঐতিহ্যগতভাবে বৈদেশিক সহায়তা মানেই ছিল সম্পদ সরবরাহ—সেতু নির্মাণের অর্থায়ন, ভ্যাকসিন সরবরাহ বা কৃষি প্রকল্পে অর্থ বিনিয়োগ। আজ এআই উন্নয়ন চ্যালেঞ্জগুলো দ্রুত ও কম খরচে সমাধানের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে:

পূর্বাভাসমূলক কৃষি: এআই মডেল ফসল উৎপাদনের পূর্বাভাস দিতে পারে, পোকামাকড় শনাক্ত করতে পারে এবং কৃষকদের তাৎক্ষণিক পরামর্শ দিতে পারে।

স্বাস্থ্য নির্ণয়: এআই-চালিত সরঞ্জাম মোবাইল ডিভাইসের মাধ্যমে যক্ষ্মা, ডেঙ্গু ও নবজাতকের শ্বাসকষ্ট শনাক্ত করতে পারে।

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা: এআই স্যাটেলাইট ও আবহাওয়ার তথ্য বিশ্লেষণ করে বন্যা ও ঘূর্ণিঝড় আরও আগে ও নির্ভুলভাবে পূর্বাভাস দিতে পারে।

শিক্ষা: ব্যক্তিগতকৃত এআই টিউটরিং গ্রামীণ অঞ্চলের শিক্ষক সংকট দূর করতে পারে।

এই সক্ষমতাগুলো বৈদেশিক সহায়তার এক নতুন রূপ হিসেবে কাজ করতে পারে—দ্রুত, প্রসারণযোগ্য এবং স্থানীয় চাহিদার সাথে মানানসই—যা প্রায়শই বৈশ্বিক প্রযুক্তি কোম্পানি, দাতা সংস্থা বা আন্তর্জাতিক এনজিও দ্বারা সরবরাহ করা হয়।

নতুন ডিজিটাল উপনিবেশবাদের ঝুঁকি

“ডিজিটাল উপনিবেশবাদ” বলতে বোঝায় আধুনিক যুগের এমন এক আধিপত্য, যেখানে বিদেশি প্রতিষ্ঠান কোনো দেশের ডেটা, অ্যালগরিদম ও প্রযুক্তিগত অবকাঠামোর নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করে—প্রায়ই উন্নয়ন সহায়তার ছদ্মবেশে। এই মডেলে:

ডেটা সার্বভৌমত্ব ক্ষুণ্ণ হয়: নাগরিক ও জাতীয় ডেটা বিদেশি সার্ভারে সংরক্ষিত থাকে, ফলে সংবেদনশীল তথ্যের ওপর বিদেশি প্রতিষ্ঠানের নিয়ন্ত্রণ তৈরি হয়।

ভেন্ডর লক-ইন তৈরি হয়: এআই সিস্টেমগুলো স্বত্বাধিকারী প্ল্যাটফর্মে তৈরি হয়, যা রক্ষণাবেক্ষণ ও আপগ্রেডের জন্য স্থানীয় সরকার ও এনজিওগুলোকে বিদেশি সরবরাহকারীর ওপর নির্ভরশীল করে তোলে।

সাংস্কৃতিক ও ভাষাগত বঞ্চনা অব্যাহত থাকে: অধিকাংশ এআই মডেল পাশ্চাত্যের ডেটায় প্রশিক্ষিত, যা বাংলাভাষা ও স্থানীয় প্রেক্ষাপটে কম কার্যকর।

বাংলাদেশে এই ঝুঁকি বাস্তব। একটি বিদেশি কোম্পানি পরিচালিত বন্যা পূর্বাভাস মডেল প্রাণ বাঁচাতে পারে, কিন্তু যদি ডেটা, অ্যালগরিদম ও কম্পিউটিং সম্পদ দেশের নিয়ন্ত্রণের বাইরে থাকে, তবে দেশ নিজে এসব ব্যবস্থা উদ্ভাবন বা অভিযোজিত করার ক্ষমতা হারাতে পারে।

পুরনো উপনিবেশিক ধাঁচে এআই-সহায়তার প্রতিফলন

যেমন অতীতে ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো বাণিজ্য পথ ও প্রাকৃতিক সম্পদের নিয়ন্ত্রণ করত, আজকের ডিজিটাল শক্তিগুলো ডেটা পথ ও জ্ঞান সম্পদ নিয়ন্ত্রণ করতে পারে। আসল ক্ষমতা শুধু এআই সরঞ্জামেই নয়, বরং কম্পিউট ক্ষমতা, উচ্চ-ক্ষমতাসম্পন্ন সার্ভার এবং উন্নত ভাষা মডেলের মধ্যে নিহিত—যা কয়েকটি দেশ ও কোম্পানির হাতে কেন্দ্রীভূত।

জাতিসংঘের ডিজিটাল প্রযুক্তি বিষয়ক দূত আমানদীপ সিং গিল সতর্ক করেছেন, আফ্রিকা বিশ্বের ডেটা সেন্টারের ক্ষমতার ১% এরও কম এবং ১,০০০-এরও কম জিপিইউ নিয়ন্ত্রণ করে। বাংলাদেশের পরিস্থিতিও প্রায় একই—দেশীয় এআই অবকাঠামোতে উল্লেখযোগ্য বিনিয়োগ ছাড়া এটি প্রযুক্তিগত নির্ভরতার ফাঁদে পড়তে পারে।

সুযোগ ও ঝুঁকি মোকাবিলা

এআই বৈদেশিক সহায়তা নিজেই ক্ষতিকর নয়—এটি বিপুল উপকার বয়ে আনতে পারে। চ্যালেঞ্জ হলো বাংলাদেশের জন্য এর সম্ভাবনাকে কাজে লাগানো, একই সাথে এমন ডিজিটাল নির্ভরতা এড়ানো যা সার্বভৌমত্বকে দুর্বল করে। এর জন্য প্রয়োজন:

দেশীয় এআই সক্ষমতা তৈরি

স্থানীয় ডেটা সেন্টার ও ক্লাউড অবকাঠামোতে বিনিয়োগ।

বাংলাদেশি এআই প্রকৌশলী, ডেটা বিজ্ঞানী ও নীতি নির্ধারকদের প্রশিক্ষণ।

কৃষি, স্বাস্থ্য ও শিক্ষায় এআই সমাধান তৈরি করছে এমন স্থানীয় স্টার্টআপকে সহায়তা।

ডেটা সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত

সংবেদনশীল নাগরিক ডেটা দেশের ভেতরে সংরক্ষণ ও প্রক্রিয়াকরণ।

বিদেশি অংশীদারদের সাথে স্বচ্ছ ডেটা-শেয়ারিং নীতি তৈরি।

উন্মুক্ত ও অন্তর্ভুক্তিমূলক এআই প্রচার

স্বত্বাধিকারী সিস্টেমের ওপর নির্ভরতা কমাতে ওপেন সোর্স এআই মডেল উৎসাহিত করা।

বাংলাসহ স্থানীয় ভাষায় এআই সরঞ্জাম উন্নয়ন।

নৈতিক ও আইনি সুরক্ষা ব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা

এআই প্রকল্পগুলোকে মানবাধিকার নীতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ রাখা।

অপব্যবহার রোধে জবাবদিহিমূলক প্রক্রিয়া তৈরি।

উন্নয়ন অংশীদারদের ভূমিকা

উন্নয়ন অংশীদাররা ডিজিটাল উপনিবেশবাদ এড়াতে গঠনমূলক ভূমিকা রাখতে পারে:

বিদেশি সার্ভারের ওপর নির্ভর না করে স্থানীয় ডেটা সেন্টারের জন্য অবকাঠামো অনুদান প্রদান।

স্থানীয় বিশেষজ্ঞ তৈরির জন্য সক্ষমতা বৃদ্ধিমূলক কর্মসূচি সমর্থন।

প্রযুক্তি হস্তান্তর সহজতর করা, যাতে বাংলাদেশ নিজের এআই সরঞ্জাম মালিকানায় রাখতে ও আপগ্রেড করতে পারে।

গ্লোবাল পার্টনারশিপ অন এআই (GPAI), ইউনেস্কোর এআই নীতি সুপারিশ এবং ইউরোপ কাউন্সিলের ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন অন এআই মানবাধিকার-ভিত্তিক, অন্তর্ভুক্তিমূলক এআই শাসনের দৃষ্টান্ত দেয়। বাংলাদেশ এগুলো নিজস্ব প্রেক্ষাপটে গ্রহণ করতে পারে।

উদ্ভাবন ও সার্বভৌমত্বের ভারসাম্য

এআই-সহায়তা বাংলাদেশের উন্নয়ন লক্ষ্যকে সম্পূরক হওয়া উচিত, নির্দেশক নয়। ডিজিটাল উপনিবেশবাদের ঝুঁকি হলো এটি নীরবে সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষমতা স্থানীয় প্রতিষ্ঠান থেকে বিদেশি কর্পোরেশন বা দাতা-চালিত এজেন্ডার দিকে সরিয়ে নিতে পারে।

এটি এড়াতে, বাংলাদেশকে হাইব্রিড মডেল গ্রহণ করতে হবে—যেখানে প্রয়োজনে বৈশ্বিক এআই সম্পদ ব্যবহার করা হবে, তবে সর্বদা দেশীয় সক্ষমতা, ডেটা নিয়ন্ত্রণ ও স্থানীয়ভাবে প্রাসঙ্গিক উদ্ভাবনে বিনিয়োগ করা হবে।

উপসংহার

কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বৈদেশিক সহায়তার নতুন প্রাণরস হয়ে উঠতে পারে, যা বাংলাদেশের উন্নয়ন ও মানবিক চ্যালেঞ্জগুলোর জন্য দ্রুত, স্মার্ট ও প্রসারণযোগ্য সমাধান দিতে পারে। কিন্তু সঠিক শাসন ব্যবস্থা ছাড়া এটি এক নতুন নির্ভরতার যুগ—নতুন ডিজিটাল উপনিবেশবাদ—শুরু করতে পারে, যেখানে দেশের ডেটা, অ্যালগরিদম ও প্রযুক্তিগত ভবিষ্যৎ দেশের বাইরের হাতে গড়ে উঠবে।

বাংলাদেশের চ্যালেঞ্জ স্পষ্ট: এআই-সহায়তাকে গ্রহণ করা, কিন্তু নিজের শর্তে। এর অর্থ হলো দেশীয় সক্ষমতা গড়ে তোলা, ডেটা সার্বভৌমত্ব নিশ্চিত করা, এবং এআই সরঞ্জামকে অন্তর্ভুক্তিমূলক, নৈতিক ও জাতীয় অগ্রাধিকারের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ করা। তবেই এআই হবে ক্ষমতায়নের প্রকৃত হাতিয়ার, নিয়ন্ত্রণের নয়।

এ. এইচ. এম. বজলুর রহমান | ডিজিটাল গণতন্ত্র উন্নয়নে বিশেষজ্ঞ, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা

বাংলাদেশ এনজিওস নেটওয়ার্ক ফর রেডিও অ্যান্ড কমিউনিকেশন (বিএনএনআরসি), এবং বাংলাদেশে দায়িত্বশীল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার রাষ্ট্রদূত, নীতি গবেষণা ফেলো, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে গণমাধ্যম, তথ্যের অখণ্ডতা ও সমাজ গঠনের ভবিষ্যৎ রূপায়ণে নিয়োজিত! [email protected]








০ টি মন্তব্য



মতামত দিন

আপনি লগ ইন অবস্থায় নেই।
আপনার মতামতটি দেওয়ার জন্য লগ ইন করুন। যদি রেজিষ্ট্রেশন করা না থাকে প্রথমে রেজিষ্ট্রেশন করুন।







পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন? পুনরায় রিসেট করুন






রিভিউ

আপনি লগ ইন অবস্থায় নেই।
আপনার রিভিউ দেওয়ার জন্য লগ ইন করুন। যদি রেজিষ্ট্রেশন করা না থাকে প্রথমে রেজিষ্ট্রেশন করুন।