সাইবার অপরাধ প্রতিরোধ ও মোকাবিলায় প্রথম সমন্বিত ও আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক আন্তর্জাতিক নথি হিসেবে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদ ২৪ ডিসেম্বর ২০২৪ তারিখে সাইবারক্রাইমবিরোধী কনভেনশন গৃহীত করে এবং ২০২৫ সালের অক্টোবর মাসে হানয়ে স্বাক্ষরের জন্য উন্মুক্ত করে। এটি বৈশ্বিক সাইবার নিরাপত্তা রক্ষায় এক ঐতিহাসিক মাইলফলক।
হানয়ে আয়োজিত উচ্চ পর্যায়ের স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে ৭২টি সদস্যরাষ্ট্র এই কনভেনশনে স্বাক্ষর করে—যা পাঁচ বছরের আন্তঃসরকারি আলোচনার সফল পরিসমাপ্তি নির্দেশ করে। ভিয়েতনাম ও জাতিসংঘের মাদক ও অপরাধ দমন বিষয়ক দপ্তর (UNODC) এর যৌথ আয়োজনটিতে ১১৯টি দেশের ২,৫১৪ প্রতিনিধি—মন্ত্রী, কূটনীতিক, সিনিয়র কর্মকর্তা এবং প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ—অংশগ্রহণ করেন।
কনভেনশনটি নানান ধরনের সাইবার নির্ভর ও সাইবার সক্ষম অপরাধ—র্যানসমওয়্যার আক্রমণ, আর্থিক জালিয়াতি থেকে শুরু করে সম্মতি ছাড়া ব্যক্তিগত অন্তরঙ্গ ছবি বা ভিডিও ছড়িয়ে দেওয়া পর্যন্ত—তদন্ত, বিচার ও আন্তর্জাতিক সহযোগিতার জন্য একটি সার্বজনীন কাঠামো প্রতিষ্ঠা করে। এটি প্রথম আন্তর্জাতিক চুক্তি যেখানে সম্মতি ছাড়া অন্তরঙ্গ ছবি প্রচারকে একটি অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে—যা প্রযুক্তিনির্ভর সহিংসতা ও অনলাইন নির্যাতন মোকাবিলায় বড় অগ্রগতি।
স্বাক্ষর অনুষ্ঠানে জাতিসংঘ মহাসচিব বলেন—
“সাইবারক্রাইমবিরোধী কনভেনশন একটি শক্তিশালী, আইনগতভাবে বাধ্যতামূলক উপকরণ—যা আমাদের সম্মিলিত সাইবার প্রতিরক্ষা সক্ষমতা আরও দৃঢ় করবে। এটি বহুপাক্ষিকতার শক্তির পুনঃপ্রতিষ্ঠা এবং এ প্রতিশ্রুতি যে—কোনো দেশকে, তাদের উন্নয়নের স্তর যাই হোক, সাইবার অপরাধের বিপরীতে অসহায় রাখা হবে না।”
কনভেনশনটি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির অপব্যবহার—সাংগঠনিক অপরাধ, সন্ত্রাসবাদ, মানবপাচার, আর্থিক জালিয়াতি ও মাদক চোরাচালান—রোধে বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া জোরদার করতে উদ্দিষ্ট। এর লক্ষ্য হলো প্রতিরোধশক্তি তৈরি, তদন্ত সক্ষমতা বাড়ানো এবং বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে কারিগরি সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা সম্প্রসারণ।
কনভেনশনের প্রধান বৈশিষ্ট্য
• ইলেকট্রনিক প্রমাণ সংগ্রহ, সংরক্ষণ, ভাগাভাগি ও আদালতে গ্রহণযোগ্যতার জন্য প্রথম বৈশ্বিক মানদণ্ড নির্ধারণ।
• সাইবার নির্ভর অপরাধ, অনলাইন জালিয়াতি, শিশু যৌন নিপীড়ন বিষয়ক কনটেন্ট এবং শিশুদের অনলাইন গ্রুমিংকে অপরাধ হিসেবে চিহ্নিত।
• সম্মতি ছাড়া অন্তরঙ্গ ছবি প্রচারকে প্রথমবারের মতো আন্তর্জাতিক অপরাধ হিসেবে স্বীকৃতি।
• জাতীয় কর্তৃপক্ষগুলোর জন্য দ্রুত সহায়তা প্রদানে বৈশ্বিক ২৪/৭ সহযোগিতা নেটওয়ার্ক স্থাপন।
• উন্নয়নশীল দেশগুলোর সক্ষমতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রযুক্তি হস্তান্তর, সক্ষমতা উন্নয়ন ও কারিগরি সহায়তার ওপর জোরারোপ।
কনভেনশনটি ৪০তম অনুসমর্থননামা জমা দেওয়ার ৯০ দিন পর কার্যকর হবে।
ডিজিটাল যুগে সম্মিলিত প্রতিরক্ষা কাঠামো
পারস্পরিক সংযুক্ত ডিজিটাল পরিবেশে এক স্থানের দুর্বলতা সারা বিশ্বের প্রতিষ্ঠান ও জনগণকে ঝুঁকির মুখে ফেলে। তাই কনভেনশনটি ক্রমবর্ধমান, জটিল ও বহুমাত্রিক সাইবার হুমকির বিপরীতে বৈশ্বিক প্রতিক্রিয়া পুনর্গঠনের গুরুত্বপূর্ণ সুযোগ তৈরি করে।
বিশেষ করে গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোর জন্য এটি প্রশিক্ষণ, সক্ষমতা উন্নয়ন, তথ্য বিনিময় ও প্রযুক্তি হস্তান্তরের নতুন পথ উন্মোচন করবে। মহাসচিবের ভাষায়
“আসুন এমন এক সাইবারস্পেস গড়ে তুলি যা সবার মর্যাদা ও মানবাধিকারকে সম্মান করে—এবং নিশ্চিত করি যে ডিজিটাল যুগ শান্তি, নিরাপত্তা ও সমৃদ্ধি বয়ে আনবে সবার জন্য।”
বাংলাদেশের জন্য তাৎপর্য
বাংলাদেশ এখন এমন এক গুরুত্বপূর্ণ পর্যায়ে দাঁড়িয়ে আছে—যেখানে এই কনভেনশনে স্বাক্ষরকারী ৭২টি রাষ্ট্রের সারিতে যুক্ত হওয়ার সুযোগ রয়েছে। যেকোনো আন্তর্জাতিক চুক্তির মতো স্বাক্ষর শেষে জাতীয় প্রক্রিয়া অনুযায়ী অনুসমর্থন প্রয়োজন হবে। প্রারম্ভিক স্বাক্ষর বাংলাদেশকে আন্তর্জাতিক সহযোগিতা, আইনগত প্রস্তুতি ও সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থায় অগ্রগামী অবস্থান প্রদর্শনের সুযোগ দেবে।
দ্রুত ডিজিটাল রূপান্তর ও সাইবার-সক্ষম অপরাধের বাড়তি ঝুঁকি বিবেচনায়, এই কনভেনশনের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হওয়া বাংলাদেশের জন্য আইনগত আধুনিকায়ন, তদন্ত সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং বৈশ্বিক অংশীদারদের সাথে গভীরতর সহযোগিতার একটি বাস্তব সুযোগ। সফল বাস্তবায়নে সরকার, সিভিল সোসাইটি, বেসরকারি খাত, একাডেমিয়া এবং প্রযুক্তি সম্প্রদায়ের সমন্বিত বহুপক্ষীয় সম্পৃক্ততা প্রয়োজন।
উদ্দেশ্য সমূহ
১. উত্তম চর্চা চিহ্নিত করা
জাতীয়, আঞ্চলিক ও বৈশ্বিক অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা নিয়ে অধিক কার্যকর ও মানবাধিকারসম্মত জাতীয় বাস্তবায়ন মডেল তৈরি।
২. অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রক্রিয়া এগিয়ে নেওয়া
পোস্ট-কনভেনশন পর্যায়ে সিভিল সোসাইটি, একাডেমিয়া, প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও বেসরকারি খাতের কাঠামোবদ্ধ অংশগ্রহণ নিশ্চিত করা—বিশেষ করে ভবিষ্যৎ Conference of the States Parties (CoSP)-এ।
৩. বাস্তবায়ন-চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা
বিধি সংস্কার, প্রাতিষ্ঠানিক সক্ষমতা, প্রযুক্তি প্রাপ্তি ও সম্পদ সীমাবদ্ধতার মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর চ্যালেঞ্জ চিহ্নিত করা এবং লক্ষ্যভিত্তিক সহায়তার পথ নির্ধারণ।
৪. মানবাধিকার ও আইনের শাসন রক্ষা
গোপনীয়তা, তথ্য সুরক্ষা, ন্যায়বিচারের প্রক্রিয়া এবং অন্যান্য মৌলিক অধিকার সুরক্ষার নিশ্চয়তা দেওয়া—আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ড অনুসারে।
প্রধান অগ্রাধিকার ক্ষেত্র ও বিষয়ভিত্তিক আলোচ্যসূচি
১. জাতীয় বাস্তবায়ন ও আইনগত সামঞ্জস্যতা
প্রেক্ষাপট:
কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য জাতীয় আইনকে কনভেনশনের অপরাধীকরণ অধ্যায়, প্রক্রিয়াগত বিধান ও তদন্ত ক্ষমতার সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হতে হবে।
পথনির্দেশ:
• UNODC-এর সহায়তায় মডেল আইন প্রণয়ন নির্দেশিকা তৈরি
• আইসিটি, আইন, স্বরাষ্ট্র ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সমন্বিত কাঠামো গড়ে তোলা
বহুপক্ষীয় দৃষ্টিভঙ্গি:
• প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ ও বেসরকারি খাতকে যুক্ত করে ভবিষ্যৎ প্রযুক্তিগত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় সক্ষম আইন প্রণয়ন
২. আন্তর্জাতিক সহযোগিতা ও প্রমাণ বিনিময়
প্রেক্ষাপট:
কনভেনশনটি পারস্পরিক আইনি সহায়তা (MLA), ইলেকট্রনিক প্রমাণ বিনিময় ও তাৎক্ষণিক সহযোগিতার শক্ত ভিত্তি তৈরি করে।
পথনির্দেশ:
• MLA সংক্রান্ত পরিষ্কার জাতীয় প্রক্রিয়া তৈরি
• ২৪/৭ আইন-প্রয়োগকারী সহযোগিতা জোরদার
বহুপক্ষীয় দৃষ্টিভঙ্গি:
• ISP, ক্লাউড প্ল্যাটফর্ম ও ডিজিটাল সেবাদাতার সাথে নির্ভরযোগ্য ও অধিকারসম্মত ডেটা সংরক্ষণ ও বিনিময় ব্যবস্থা
৩. কারিগরি সহায়তা ও সক্ষমতা বৃদ্ধি
প্রেক্ষাপট:
অনেক দেশ ডিজিটাল ফরেনসিক, প্রতিষ্ঠানিক দক্ষতা ও উন্নত প্রযুক্তি প্রাপ্তিতে সীমাবদ্ধতার সম্মুখীন।
পথনির্দেশ:
• UNODC গ্লোবাল সাইবারক্রাইম প্রোগ্রাম ব্যবহারে আঞ্চলিক প্রশিক্ষণ
• আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, প্রসিকিউটর, বিচারক ও ফরেনসিক বিশেষজ্ঞদের বিশেষায়িত প্রশিক্ষণ
বহুপক্ষীয় দৃষ্টিভঙ্গি:
• বেসরকারি খাতের দক্ষতা ও পাবলিক–প্রাইভেট পার্টনারশিপ
• সিভিল সোসাইটির সম্পৃক্ততার মাধ্যমে অধিকার পর্যবেক্ষণ ও সচেতনতা বৃদ্ধি
৪. প্রতিরোধ, ভুক্তভোগী সহায়তা ও মানবাধিকার সুরক্ষা
প্রেক্ষাপট:
সাইবার হুমকি মোকাবিলায় প্রতিরোধমূলক উদ্যোগ ও ভুক্তভোগীকে কেন্দ্র করে সেবা নিশ্চিত করা অপরিহার্য।
পথনির্দেশ:
• জাতীয় প্রতিরোধ কৌশল ও সচেতনতা কর্মসূচি তৈরি
• ভুক্তভোগী সহায়তা সেবা ও অভিযোগ গ্রহণ ব্যবস্থা শক্তিশালী করা
বহুপক্ষীয় দৃষ্টিভঙ্গি:
• এনজিওর মাধ্যমে কমিউনিটি-স্তরের সচেতনতা
• মানবাধিকার প্রতিষ্ঠানকে পর্যবেক্ষণে যুক্ত করে জবাবদিহিতা বাড়ানো
প্রত্যাশিত ফলাফল
• জাতীয় আইন ও বাস্তবায়ন প্রক্রিয়ায় সমন্বিত অগ্রগতি বিষয়ে অভিন্ন ধারণা
• ভবিষ্যৎ CoSP-এ বহুপক্ষীয় অংশগ্রহণের সুস্পষ্ট প্রস্তাব
• সক্ষমতা উন্নয়ন, প্রযুক্তি হস্তান্তর ও সম্পদ বণ্টনে অগ্রাধিকার ক্ষেত্র নির্ধারণ—বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য
উপসংহার
জাতিসংঘ সাইবারক্রাইম কনভেনশনের সফল বাস্তবায়নে একটি অন্তর্ভুক্তিমূলক, সমন্বিত ও দূরদর্শী দৃষ্টিভঙ্গি অপরিহার্য। বহুপক্ষীয় শাসন মডেল গ্রহণের মাধ্যমে বাংলাদেশ কেবল জাতীয় সাইবার নিরাপত্তা ও স্থিতিস্থাপকতা শক্তিশালী করবে না, বরং নাগরিক ও প্রতিষ্ঠানের অধিকার ও নিরাপত্তা নিশ্চিত করবে—আইনের শাসনকে আরও সুসংহত করবে। সমন্বিত প্রচেষ্টা ও ধারাবাহিক সম্পৃক্ততার মাধ্যমে আমরা সবাই মিলে আরও নিরাপদ, বিশ্বস্ত ও ন্যায্য একটি ডিজিটাল ভবিষ্যৎ নির্মাণে অবদান রাখতে পারি।
এ এইচ এম বাজলুর রহমান | ডিজিটাল গণতন্ত্র বিশেষজ্ঞ এবং বাংলাদেশে দায়িত্বশীল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার অ্যাম্বাসেডর








০ টি মন্তব্য