গুগল, অ্যামাজন, মাইক্রোসফট, মেটা ও অ্যাপলের মতো বিগ টেক কোম্পানিগুলো আজকের বিশ্বের প্রযুক্তি অবকাঠামোর কেন্দ্রবিন্দুতে অবস্থান করছে। তবে জলবায়ু পরিবর্তনের প্রেক্ষাপটে তাদের ভূমিকা জটিল ও দ্বৈত। একদিকে তারা নবায়নযোগ্য জ্বালানিতে বিনিয়োগ, শক্তি-দক্ষ ডেটা সেন্টার নির্মাণ ও সবুজ প্রযুক্তি উন্নয়নের প্রতিশ্রুতি দিচ্ছে; অন্যদিকে তাদের বিশাল সার্ভার ফার্ম, ডেটা সেন্টার ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI) ব্যবস্থাপনার জন্য বিপুল পরিমাণ বিদ্যুৎ ও পানির প্রয়োজন হচ্ছে, যা পরিবেশের ওপর গুরুতর প্রভাব ফেলছে।
দুটি প্রযুক্তি বিশেষভাবে জলবায়ু সংকটে প্রযুক্তিকে কেন্দ্রে নিয়ে এসেছে—ক্রিপ্টোকারেন্সি ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence)। এই দুটি প্রযুক্তির কম্পিউটার অপারেশন এতটাই শক্তিখরচি যে সাধারণ ইন্টারনেট সেবার তুলনায় এগুলোর বিদ্যুৎ ব্যবহার বহু গুণ বেশি। ইতিহাসের বিভিন্ন সময়ে ক্রিপ্টোকারেন্সি ও এআই উভয়ই কিছু দেশের মোট বিদ্যুৎ ব্যবহারের পরিমাণকেও অতিক্রম করেছে।
অতিরিক্ত বিদ্যুৎ প্রয়োজনীয়তার কারণে ডেটা সেন্টারের সংখ্যা দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।
এর ফলে মাইক্রোসফটকে পুনরায় চালু করতে হয়েছে থ্রি মাইল আইল্যান্ড পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, আর নতুন ডেটা সেন্টার স্থাপনের কর্পোরেট উদ্যোগ বহু স্থানে স্থানীয় জনগণের প্রতিবাদ ও আন্দোলনের জন্ম দিয়েছে। এসব সেন্টার সাধারণত দরিদ্র বা প্রান্তিক অঞ্চলে স্থাপন করা হয় এবং “চাকরির সুযোগ সৃষ্টি” বা “অর্থনৈতিক উন্নয়ন” এর নামে স্থানীয় ভূমি ও জলসম্পদ ব্যবহৃত হয়। বাস্তবে এসব প্রকল্প প্রায়ই স্থানীয় পরিবেশের ওপর নেতিবাচক প্রভাব ফেলে। স্পেনসহ বিভিন্ন দেশে “Tu nube seca mi río” (তোমার ক্লাউড আমার নদী শুকিয়ে দেয়) নামে একটি প্রচারণা এই ক্ষতির বিরুদ্ধে আন্দোলন করছে।
বিগ টেক কোম্পানিগুলোর ডিজিটাল অর্থনীতি নির্ভর ব্যবসায়িক মডেলও জলবায়ু পরিবর্তনের কাঠামোর সঙ্গে গভীরভাবে জড়িত। তারা এমন প্রযুক্তি তৈরি করছে যা ক্রমবর্ধমান শক্তি ও সম্পদ ব্যবহার করে—যেমন ক্রিপ্টোকারেন্সি, এআই এবং বৃহৎ ডেটা বিশ্লেষণ। এই প্রবণতা টেকসই ভবিষ্যতের পথে এক বড় প্রতিবন্ধক।
বিগ টেকের উপর আমাদের নির্ভরশীলতার সমস্যা শুধুমাত্র সফটওয়্যার বা প্ল্যাটফর্ম নির্বাচনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নয়। গত দুই দশকে পুঁজিবাদ ইন্টারনেট প্রযুক্তির মাধ্যমে নিজেকে নতুনভাবে রূপান্তর করেছে। এর ফলে সহযোগিতা ও সম্প্রদায়ের চেতনার পরিবর্তে ব্যক্তিকেন্দ্রিকতা, প্রতিযোগিতা ও ভোক্তাবাদী সংস্কৃতি জোরদার হয়েছে—যা টেকসই উন্নয়নের যেকোনো ধারণার সঙ্গে সাংঘর্ষিক।
প্রযুক্তি আজ আমাদের দৈনন্দিন জীবনের অবিচ্ছেদ্য অংশ—এটি আমাদের কাজ, অনুভূতি এবং বিশ্ব সম্পর্কে ধারণাকে নির্ধারণ করছে। আধুনিক প্রযুক্তি এখন প্রতিটি বড় রাজনৈতিক, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ইস্যুর কেন্দ্রে অবস্থান করছে।
অতএব, জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় কেবল প্রযুক্তিগত উদ্ভাবন নয়, বরং প্রযুক্তি ব্যবহারের নৈতিক, সামাজিক ও রাজনৈতিক কাঠামোতেও মৌলিক পরিবর্তন আনতে হবে। যতদিন পর্যন্ত প্রযুক্তি উন্নয়নের মূল চালিকা শক্তি পুঁজিবাদ থাকবে, ততদিন বিগ টেকের প্রযুক্তি পরিবেশবান্ধবের চেয়ে বেশি শক্তিখরচি, মুনাফাকেন্দ্রিক ও বৈষম্য বৃদ্ধি-উদ্দীপক হিসেবেই থেকে যাবে।
এ. এইচ. এম. বজলুর রহমান | ডিজিটাল গণতন্ত্র উন্নয়ন বিশেষজ্ঞ, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা
বাংলাদেশ এনজিওস নেটওয়ার্ক ফর রেডিও অ্যান্ড কমিউনিকেশন (বিএনএনআরসি), এবং বাংলাদেশে দায়িত্বশীল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার রাষ্ট্রদূত, নীতি গবেষণা ফেলো, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে গণমাধ্যম, তথ্যের অখণ্ডতা ও সমাজ গঠনের ভবিষ্যৎ রূপায়ণে নিয়োজিত! [email protected]
বাংলাদেশ এনজিও নেটওয়ার্ক ফর রেডিও অ্যান্ড কমিউনিকেশন (BNNRC) গর্বের সাথে জাতিসংঘ জলবায়ু পরিবর্তন সংক্রান্ত ফ্রেমওয়ার্ক কনভেনশন (UNFCCC)-এর পর্যবেক্ষক সংস্থা হিসেবে দায়িত্ব পালন করছে।
০ টি মন্তব্য