আইটি/আইটিইএস বা বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং সেবাখাত বাংলাদেশের জন্য এমন একটি ক্ষেত্র যেটি বহু বছর ধরে আশার আলো সঞ্চার করে এসেছে দেশের উদ্যোক্তা, বিনিয়োগকারী, এবং যুব সমাজের কাছে। সম্ভাবনাময় এ খাতটিতে রয়েছে প্রচুর কর্মসংস্থানের সুযোগ। বিনিয়োগের জন্য পরীক্ষিত একটি খাত হিসেবেও দেশের অর্থনীতিতে এ শিল্পখাতের অবদান অনস্বীকার্য।
সম্ভাবনাময় এ শিল্পখাতটি সম্প্রতি মুখোমুখি হয় দুর্যোগপূর্ণ এক সময়ের। বাংলাদেশের চলমান অস্থিতিশীলতায় গত ১৮ জুলাই থেকে ইন্টারনেট অবকাঠামো ভেঙে পড়ে। দুর্বৃত্তদের দেয়া আগুনে ক্ষতিগ্রস্ত হয় ইন্টারনেট সঞ্চালন লাইন এবং ডাটা সেন্টার, যার ফলে বাংলাদেশের সাথে সমগ্র বিশ্বের ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। গত ২৩ জুলাই থেকে ইন্টারনেট সংযোগ পুনঃস্থাপন করা হলেও, বিচ্ছিন্ন এবং ধীরগতিসম্পন্ন ইন্টারনেট সংযোগ এর ফলে ব্যাপকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয় বিপিও শিল্পের প্রতিষ্ঠানগুলো। বলা বাহুল্য, এ সেবাখাতের আওতায় অন্তর্ভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো দেশে ও দেশের বাইরের স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠানগুলোকে জরুরি সেবা প্রদান করে থাকে, যার মধ্যে অসংখ্য সেবা রয়েছে যেগুলো লাইভ কল, চ্যাট, ক্লাউড কম্পিউটিং প্রভৃতি ব্যবস্থায় সরাসরি গ্রাহককে প্রদান করা হয়।
গত ৩১ জুলাই ২০২৪ তারিখে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ থাকাকালীন সময়কার ক্ষয়ক্ষতির পরিমাণ নির্ধারণ এবং এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে ভবিষ্যৎ করণীয় নির্ণয়ে বাংলাদেশ অ্যাসোসিয়েশন অফ কন্ট্যাক্ট সেন্টার অ্যান্ড আউটসোর্সিং (বাক্কো)’ “সাম্প্রতিক ইন্টারনেট শাটডানের প্রভাব” শীর্ষক একটি আলোচনা সভা আয়োজন করে। সভায় বাক্কো কার্যনির্বাহী কমিটির সদস্যবৃন্দ, বাক্কোর সদস্য প্রতিষ্ঠানসমূহের প্রতিনিধিগণ এবং এ শিল্পের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তিবৃন্দ অংশগ্রহণ করেন। আলোচনা চলাকালীন সময় নানা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়সমূহ উঠে আসে, অংশগ্রহণকারীরা সকলেই তাদের মূল্যবান মতামত ও পরামর্শ প্রদান করেন।
আলোচনার শুরুতে বাক্কো সহ-সভাপতি ও অনুষ্ঠানটির সঞ্চালক তানভীর ইব্রাহিম বলেন, এই শিল্পখাতের আওতাভুক্ত প্রতিষ্ঠানগুলো ২০২৫ সালের মধ্যে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলার রাজস্ব আয় অর্জন ও ১ লক্ষ কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে বিরামহীনভাবে ২৪ ঘণ্টা কলসেন্টার পরিষেবা, জরুরি গ্রাহক সেবা এবং ব্যাক অফিসের মতো সেবাসমূহ প্রদান করে আসছে। হঠাৎই সারাদেশে ইন্টারনেট সংযোগ বন্ধ হয়ে যাওয়ায় বন্ধ হয়ে যায় এ খাত সংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রাতিষ্ঠানিক কার্যালয়সমূহ, ক্লায়েন্টদের জানানো পর্যন্ত সম্ভব হয়ে ওঠেনি, এতে করে প্রচুর ক্লায়েন্ট হারাতে হয় আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলোকে। আমরা যে সকল সেবা সমূহ নিয়ে কাজ করি তা শুধু আমাদের দেশের জরুরি সেবাই নয়, মনে রাখা প্রয়োজন আমরা বহির্বিশ্বের দেশগুলোর জরুরি সেবাও প্রদান করে থাকি । আমরা বিগত ১৫ বছর যাবত চেষ্টা করছি বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পকে একটি অন্যতম গন্তব্যস্থল হিসেবে বিশ্ব দরবারে তুলে ধরতে, এই সময়ের মধ্যে আমাদের উদাহরণ সৃষ্টিকারী সফলতার পরিমাণও কম নয়। অথচ সাম্প্রতিক এই ইন্টারনেট শাটডাউনে, মাত্র কয়েকদিনের মধ্যেই আমরা পিছিয়ে পড়েছি অনেকখানি।
আলোচনা সভায় বাক্কো নির্বাহী পরিচালক লে: কর্নেল (অব:) মো: মাহতাবুল হক, পিএসসি সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলো হতে প্রাপ্ত তথ্য উপাত্ত সম্বলিত একটি জরিপ প্রতিবেদন উপস্থাপন করেন । প্রতিবেদনে উঠে আসে যে, ইন্টারনেট সংযোগ না থাকায় এ শিল্পের প্রতিষ্ঠানগুলো জরুরি গ্রাহক সেবা প্রদান, ক্রেতাদের সাথে যোগাযোগ ও চলমান প্রকল্পসমূহ সম্পাদন করতে ব্যর্থ হয়। ফলশ্রুতিতে প্রতিষ্ঠানগুলোকে বড় অঙ্কের জরিমানার সম্মুখীন হতে হয়েছে, বহু ক্রেতা হারাতে হয়েছে, এবং আন্তর্জাতিক মহলে প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যাপকভাবে আস্থা হারিয়েছে। আশঙ্কা করা হচ্ছে, এই শিল্পের প্রায় ৫৩ শতাংশ প্রতিষ্ঠানে বার্ষিক রেভিনিউ কমতে পারে প্রায় ৩০ শতাংশ। যা প্রত্যক্ষভাবে দেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টিতে এবং অর্থনীতিতে আঘাত হানতে যাচ্ছে।
এ সময় বাক্কো যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক তানজিরুল বাশার বলেন, আউটসোর্সিং সেবা প্রদানকারী প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য একটি আলাদা ইন্টারনেট অব কাঠামো নির্মাণের জন্য সরকারকে পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানাচ্ছি । কেননা ইন্টারনেটই আমাদের লাইফলাইন, এই খাতে ইন্টারনেটের কোন বিকল্প নেই।
ইন্টারনেট সংকট চলাকালীন সময়ে কি ধরনের পদক্ষেপ নেয়া হয়েছিল এই প্রশ্নের উত্তরে সদস্যরা জানান, কয়েকটি প্রতিষ্ঠান তাদের গুরুত্বপূর্ণ কর্মকর্তাদের প্রতিবেশী দেশগুলোতে প্রেরণ করেছিলো ক্রেতাদের সাথে যোগাযোগ রক্ষা করার জন্য এবং কিছু প্রতিষ্ঠান দেশের বাইরের শাখা অফিস থেকে সাপোর্ট দিয়েছিলো। তবে অধিকাংশ প্রতিষ্ঠানগুলোকেই তাদের প্রাতিষ্ঠানিক কার্যক্রম বন্ধ রাখতে হয়েছে।
বিপিও শিল্পের মতো সম্ভাবনাময় একটি শিল্পখাতকে যাতে ভবিষ্যতে কখনোই আর এ ধরনের কোনো সমস্যার মুখোমুখি হতে না হয় সে বিষয়ে করণীয় নির্ণয়ে নিম্নোক্ত বিষয়গুলো তথ্যবহুল এ আলোচনা অনুষ্ঠানে উঠে আসে।
১। বিপিও/ কলসেন্টার শিল্পকে জরুরি সেবার আওতাভুক্ত সেবা হিসেবে বিবেচনা করতে প্রয়োজন, যাতে করে অন্যান্য জরুরি সেবার ন্যায় এ খাতের সেবাসমূহ সকল ক্রান্তিকালেও নির্বিঘ্নে চলমান থাকে।
২। বিপিও/ কলসেন্টার শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোর জন্য একটি আলাদা ইন্টারনেট অবকাঠামো নির্মাণ বা পৃথক ডেটা সেন্টার স্থাপনের বিষয়ে সরকারের সাথে আলোচনায় অংশগ্রহণ ও তা বাস্তবায়নে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণ।
৩। স্যাটেলাইট ইন্টারনেট ব্যবহারের জন্য সরকার কর্তৃক শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলোকে অনুমতি প্রদান।
৪। সকলে সম্মিলিতভাবে অনতিবিলম্বে একটি সংকট ব্যবস্থাপনা পরিকল্পনা প্রতিষ্ঠা, একইসাথে দুর্যোগ পরিস্থিতি মোকাবেলায় তথ্য প্রযুক্তি জোন প্রতিষ্ঠা। এতে জরুরি অবস্থায় শিল্পখাতের ভারসাম্য নিয়ন্ত্রণ করা সহজতর হয়ে উঠবে।
৫। যেহেতু ইতোমধ্যেই দেশের তথ্যপ্রযুক্তি শিল্পের ভাবমূর্তি আন্তর্জাতিক অঙ্গনে ক্ষুণ্ন হয়েছে, তাই অনতিবিলম্বে বিপিও পরিষেবার জন্য একটি নির্ভরযোগ্য গন্তব্য হিসাবে বাংলাদেশকে পুনরায় তুলে ধরা বা রি-ব্র্যান্ডিং করা।
৬। নিরবচ্ছিন্ন ইন্টারনেট সেবা নিশ্চিত করতে নীতিমালা/ আইন প্রণয়ন। এই ধরনের নীতিমালা সমূহ অবিচ্ছিন্ন সংযোগ বাধ্যতামূলক করবে এবং বিপিও শিল্প সচল থাকার প্রয়োজনীয়তাকে অগ্রাধিকার দেবে।
উল্লেখ্য, আলোচনা সভায় গৃহীত সিদ্ধান্তসমূহ বাস্তবায়নের জন্য বিপিও শিল্পের পক্ষে একটি টাস্কফোর্স গঠন করার উদ্যোগ নেয়া হয় এ অনুষ্ঠানে।
এছাড়াও, আলোচনা সভায় বাক্কো কার্যনির্বাহী কমিটির জ্যেষ্ঠ উপদেষ্টা আহমাদুল হক, অর্থ সম্পাদক মো. আমিনুল হক, পরিচালক মো. ফজলুল হক, জায়েদ উদ্দীন আহমেদ, আবদুল কাদের উপস্থিত ছিলেন । বাক্কো সদস্য প্রতিষ্ঠানগুলোর প্রতিনিধিগণ এরকম একটি গুরুত্বপূর্ণ সভা আয়োজনের জন্য বাক্কোকে ধন্যবাদ জানান এবং গৃহীত সিদ্ধান্তের দ্রুত বাস্তবায়নের জন্য কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণের অনুরোধ জানান ।
০ টি মন্তব্য