আমাদের দেশের বর্তমান ব্যাংকিং ব্যবস্থা আগের চেয়ে অনেক উন্নত হয়েছে। কেননা এদেশের ব্যক্তিমালিকানাধীন ব্যাংকগুলোতে অনেক আগে থেকেই তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার হয়ে আসছে। তথ্যপ্রযুক্তির আশীর্বাদকে কাজে লাগিয়ে সেবার মান উন্নত করার মাধ্যমে এগিয়ে যাচ্ছে ব্যাংকগুলো। সেই ১৯৮৩ সালে স্ট্যান্ড অ্যালোন কমপিউটার ব্যবহারের মধ্য দিয়ে কমপিউটারাইজড সেবা দেয়া শুরু করে ব্যাংকগুলো। আজ ব্যাংকগুলোতে চলছে কেন্দ্রীয় ডাটাবেজসমৃদ্ধ অনলাইন ব্যাংকিং সেবা। বিশ্বের কোনো দেশ থেকে আজ আর পিছিয়ে নেই এদেশের ব্যাংকিং। কোটি কোটি টাকা খরচ করে অনলাইন ব্যাংকিং সফটওয়্যার কেনা হলেও অনেক ক্ষেত্রেই এগুলোর সব সুবিধা আমরা ভোগ করতে পারছি না বেশ কিছু কারণে।
মূল কারণগুলো হলো-
০১. আমাদের স্থানীয় বাজারে সফটওয়্যার লাইনে লোকের অভাব।
০২. সফটওয়্যার লাইনে এদেশে যারা কাজ করছেন, তাদের বেশিরভাগেরই ব্যাংক সংশ্লিষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও ব্যাংকিং জ্ঞান নেই।
০৩. ব্যাংকিংয়ে যারা আইটি দেখাশোনা করছেন, তাদের বেশিরভাগই কমবেশি আইটি বুঝলেও ব্যাংকিং বুঝেন অনেক কম।
০৪. অনলাইন ইমপ্লিমেন্টেশনের পরে অনেক ক্ষেত্রেই নিজেদের লোকবল দিয়ে সরাসরি মেইনটেনেন্স না করিয়ে বিদেশী ভেন্ডরের ওপর ভরসা করে বসে থাকা।
০৫. ব্যাংকগুলোর আইটি প্রশিক্ষণ বাবদ তেমন কোনো আলাদা বাজেট না থাকা।
০৬. আইটির ধারণা প্রতিদিন পরিবর্তিত হয়। ফলে সারাবছরই যে পর্যায়ক্রমে আইটিতে কর্মরত লোকদের প্রশিক্ষণ প্রয়োজন তার প্রয়োজনীয়তা অনুভব না করা।
০৭. অনলাইন বাস্তবায়ন করার পর এর হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার আপডেট করার জন্য যথেষ্ট মনোযোগী না হওয়া।
০৮. ব্যাংকিং ম্যানেজমেন্টের উচ্চ পর্যায়ের লোকদের আইটি সম্পর্কিত কম জ্ঞান বা অদক্ষতা।
০৯. আইটি পলিসি না থাকা বা থাকলেও তার সঠিক বাস্তবায়ন না থাকা।
১০. ব্যাংকগুলোর মধ্যে নিজস্ব দক্ষ আইটি অডিট না থাকা।
এবার উপরন্তু বিষয়গুলো আলোচনা করলেই বুঝতে পারবো আমাদের করণীয় সম্পর্কে।
০১. বর্তমানে আমাদের দেশে মোটামুটি মানের সফটওয়্যার আছে, যেগুলো অনলাইন ব্যাংকিংয়ে কমবেশি উপযুক্ত। কিন্তু আমাদের নজর বিদেশী সফটওয়্যারের দিকে। আমরা বুঝে হোক আর না বুঝে হোক সেই প্রথম থেকে বিদেশী অনলাইন সফটওয়্যার কিনে চলেছি বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে। প্রথম থেকে মনোযোগী হলে আমরা দেশীয় সফটওয়্যার কোম্পানিগুলোকে এক্ষেত্রে কাজে লাগাতে পারতাম প্রয়োজনীয় সফটওয়্যার ডেভেলপ করার জন্য। ফলে বাজারে লোকবলের কোনো অভাব থাকত না। আমরা নিশ্চিন্ত থাকতে পারতাম বিক্রয়োত্তর সেবার ব্যাপারে। কিন্তু বিদেশী সফটওয়্যার কেনার ফলে আমরা পরে যে অসুবিধাগুলোর সম্মুখীন হচ্ছি সেগুলো হলো-
ক. আমাদের অনেক বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করতে হচ্ছে।
খ. মেইনটেনেন্স চুক্তির জন্য প্রতিবছর বাড়তি টাকা খরচ করতে হচ্ছে।
গ. বিদেশে প্রশিক্ষণ নেয়ার জন্যও অতিরিক্ত টাকা খরচ করতে হচ্ছে।
ঘ. বিদেশ থেকে লোক এসে কাজ করতে অনেক সময় লাগছে। তার আগ পর্যন্ত ব্যাংকগুলোকে ভুগতে হচ্ছে। ফলে ব্যাংকের সামগ্রিক সেবার মান কমে যাচ্ছে ও গ্রাহক অসমেত্মাষ তৈরি হচ্ছে।
০২. সফটওয়্যার লাইনে এদেশের ব্যাংকিংয়ে যারা কাজ করছেন তাদের ব্যাংকিং সংশ্লিষ্ট প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা ও ব্যাংকিং জ্ঞান নেই। তাদের পেশাগত এ কাজে সর্বক্ষণিক সহযোগিতা করতে হয় একজন পূর্ণাঙ্গ ব্যাংকারকে। ফলে সময়ের অনেক অপচয় হয়।
০৩. ব্যাংকিং আইটিতে যারা কাজ করেন তাদের বেশিরভাগেরই আইটি জ্ঞান যথেষ্ট থাকলেও ব্যাংকিং জ্ঞান থাকে অনেক কম। ফলে এসব লোককে ব্যাংকিং প্রশিক্ষণ দিয়ে যোগ্য করে গড়ে তুলতে হয়। এর জন্য ব্যাংকগুলোকে অর্থ খরচ করতে হয়। এই অর্থ খরচ হতে খুব সহজেই ব্যাংকগুলো রেহাই পেতে পারে যদি প্রথমেই আইটি জ্ঞানসমৃদ্ধ যোগ্য ব্যাংকার নিয়োগ দিতে পারে। এই ধরনের লোকবল নিয়ে অনলাইনপরবর্তী কার্যক্রম সুষ্ঠুভাবে চালিয়ে যাওয়া ব্যাংকের জন্য অনেক কষ্টসাধ্য।
০৪. বিদেশী কোম্পানিগুলো অনলাইন ব্যাংকিং সফটওয়্যার বেচার সাথে সাথে যে কাজটি করে তা হলো একটি মেইনটেনেন্স অ্যাগ্রিমেন্ট করে যা অনেক ব্যয়বহুল। শুধু ব্যয়বহুল হলে কথা ছিল। তারা অনেক সমস্যার সমাধান নিজেদের হাতে রেখে দেয়। ফলে বিদেশ থেকে এসে কাজ করে যাবার জন্য অপেক্ষা করা ছাড়া ব্যাংকের আর কিছুই করার থাকে না। এই সমস্যাগুলো একটু বেশি আকারে দেখা দিলে গ্রাহক অসমেত্মাষ তৈরি হতে বেশি সময় লাগে না। বিদেশী সফটওয়্যার কিনলে ব্যাংক এই ভুলটি করতে বাধ্য হয়।
০৫. আইটির ধারণা প্রতিদিন পরিবর্তিত হয়। ফলে যারা আইটিতে কাজ করেন তাদের সাম্প্রতিক আইটির বিষয়গুলো সম্পর্কে সবসময় আপডেট থাকতে হয়। এই লোকবলকে সব সময়ের জন্য কর্মোপযোগী করে রাখার জন্য সারাবছরই প্রশিক্ষণের মধ্যে থাকা প্রয়োজন। তাদের সর্বপ্রথম প্রয়োজন আইটির সাধারণ ধারণাগুলো সম্পর্কে পরিষ্কার হওয়া। এর পর অনলাইন ব্যাংকিং সফটওয়্যারের বিষয়গুলো সম্পর্কে। কিন্তু ব্যাংকগুলোকে দেখা যায় সারা বছরই ব্যাংকিং সফটওয়্যার অপারেশনের প্রশিক্ষণের জন্য অর্থ খরচ করলেও আইটির সামগ্রিক বিষয়গুলো প্রশিক্ষণের জন্য কোনো অর্থ বরাদ্দ নেই বা পরিকল্পনা নেই।
০৬. অনলাইন ব্যাংকিং সেবা দেয়ার নির্দিষ্ট মান বজায় রাখার জন্য আইটিতে কর্মরত লোকদের ব্যাংকিং সফটওয়্যারের ওপর প্রশিক্ষণ দিতে হবে দ্বিতীয় পর্যায়ে। প্রথম পর্যায়ে দিতে হবে আইটির সামগ্রিক জ্ঞান। তবেই সফলতার সাথে গ্রাহকসেবা নিশ্চিত করা যাবে।
০৭. অনলাইন বাস্তবায়ন করার আগেই ব্যাংককে নিশ্চিত হতে হবে ভবিষ্যতে এর মেইনটেনেন্সের জন্য প্রয়োজনীয় অর্থ বরাদ্দ আছে কি না। নতুবা কোটি কোটি টাকা দিয়ে বিদেশী অনলাইন সফটওয়্যার কিনেও এর সুফল গ্রাহকের কাছে পৌঁছে দেয়া যাবে না। ছোট মেইনটেনেন্সের জন্য ব্যাংককে নিজস্ব লোকবল রাখতে হবে।
০৮. ব্যাংকে ম্যানেজমেন্টের উচ্চ পর্যায়ে লোকজনের মধ্যে বেশিরভাগেরই ভালো আইটি জ্ঞান না থাকায় অনলাইন সুষ্ঠুভাবে পরিচালনার জন্য প্রয়োজনীয় গাইডলাইন দিতে হয়।
০৯. কেন্দ্রীয় ব্যাংকের গাইডলাইন অনুযায়ী ব্যাংকগুলো আইটি পলিসি তৈরি করলেও তার বাস্তবায়ন খুব কমই থাকে। ফলে অনলাইনপরবর্তী সামগ্রিক ঝামেলা রক্ষা করা কঠিন হয়ে পড়ে। এই শৃঙ্খলা বা পলিসি বাস্তবায়নের জন্য ব্যাংকের মোটামুটি সব লোককেই আইটি জ্ঞানসমৃদ্ধ হতে হবে যা আমাদের দেশের প্রেক্ষাপটে বর্তমানে নেই। ভবিষ্যতে হয়ত সম্ভব হতে পারে। ফলে পলিসি হয়ে যাচ্ছে কাগুজে নিয়ম মাত্র।
১০. আইটিকে সঠিকভাবে পরিচালনা করতে হলে তাদের ভুলভ্রান্তিগুলো ধরিয়ে দিতে হবে। এ জন্য শক্তিশালী অভ্যন্তরীণ নিজস্ব আইটি অডিট থাকা জরুরি। কেন্দ্রীয় ব্যাংকের এ ব্যাপারে পরিষ্কার গাইডলাইন আছে। কিন্তু বাস্তবে দেখা যায় ব্যাংকের একটি অভ্যন্তরীণ আইটি অডিট থাকলেও তাদের সামগ্রিক দক্ষতা নেই। কোথাও কোথাও প্রয়োজনীয় লোকবলই তারা জোগাড় করতে পারে না। তারা আইটি জানলে ব্যাংকিং জানেন না। আর ব্যাংকিং জানলে আইটি জানেন না। এটি এদেশে একটি পুরনো চিত্র।
যা হোক দেশ অনেক এগিয়েছে। এই অগ্রযাত্রার পেছনে ব্যাংকিংয়ের অবদান অনেক। যতই দিন যাচ্ছে ব্যাংকিং পরিচালনায় ব্যাংকগুলো তাদের ভুলগুলো ধরতে পারছে। প্রতিটি ব্যাংকেরই অনলাইনের অবস্থা আগের থেকে অনেক ভালো। আমরা আশা করি এ অবস্থা আরো দ্রুত ভালোর দিকে যাবে এবং অচিরেই তার সুফল দেখতে পাব। সবক্ষেত্রেই আমরা যদি দেশীয় রিসোর্স কাজে লাগানো শুরু করি, তবে আশা করা যায় অদূর ভবিষ্যতে আমরা এদেশেও আন্তর্জাতিক মানের ব্যাংকিং সেবা দিতে সক্ষম হব। আশা করা যায় সেটা সময়ের ব্যাপার মাত্র।
০ টি মন্তব্য