অধ্যাপক আবদুল কাদের এবং বাংলাদেশে তথ্যপ্রযুক্তি আন্দোলন
বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি আন্দোলন আর অধ্যাপক আবদুল কাদের সমামত্মরাল দুটি নাম। অধ্যাপক আবদুল কাদেরের নাম উচ্চারিত হওয়ার সাথে সাথে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি আন্দোলনের একটা চিত্র যেমনি আমাদের সামনে ভেসে ওঠে, তেমনি তথ্যপ্রযুক্তি আন্দোলনের কথা আসলে অবধারিতভাবে অধ্যাপক আবদুল কাদেরের নামটিও চলে আসে। তার মরণোত্তর এই সময়ে আজ বিতর্কাতীতভাবে তিনি অভিহিত হচ্ছেন বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি আন্দোলনের অগ্রপথিক অভিধায়। ২০০৩ সালের ৩ জুলাই এই অনন্য ব্যক্তিত্বকে আমরা হারাই। আমরা যারা বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি আন্দোলনের সাথে কোনো না কোনোভাবে সংশ্লিষ্ট ছিলাম বা আছি, তারা তীব্রভাবে তার অভাব অনুভব করছি। তাকে হারিয়ে আমাদের মনে হয়েছে, আমরা যেনো বাংলাদেশের আজ তথ্যপ্রযুক্তি আন্দোলনের অনন্য এক অভিভাবককেই হারিয়ে ফেলেছি। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে আবার এ সান্ত্বনারও সন্ধান পেয়েছি, মরহুম আবদুল কাদেরের কর্ম ও সাধনা তার অবর্তমানে আমাদের প্রেরণা যুগিয়ে যাচ্ছে সমভাবে। আজ ২০০৮ সালে তার জন্ম মাস ডিসেম্বরে এসে আমরা তেমনটিই অনুভব করছি। আজ সুস্পষ্টভাবে মনে হচ্ছে, লোকামত্মরের আবদুল কাদের ইহজাগতিক আবদুল কাদেরের চেয়ে অনেক বেশি শক্তিধর। আজকের ও ভবিষ্যতের প্রযুক্তিপ্রজন্ম অব্যাহতভাবে মরহুম আবদুল কাদেরকে নিশ্চিতভাবে দেখবে প্রেরণার উৎস হিসেবে, একজন পথ-প্রদর্শক হিসেবে।
অধ্যাপক আবদুল কাদের বিশ্বাস করতেন, একটি পত্রিকাই হতে পারে আন্দোলনের অনন্য-সাধারণ এক হাতিয়ার। সে বিশ্বাসতাড়িত হয়েই তিনি ১৯৯১ সালের মে মাসে সূচনা করেন এদেশের প্রথম বাংলা তথ্যপ্রযুক্তিবিষয়ক সাময়িকী মাসিক কমপিউটার জগৎ। তার জীবদ্দশায় তিনি এ পত্রিকাটি পরিচালনার সুযোগ পান মাত্র ১২ বছর। কিন্তু তিনি এই সময়ে যে ভবিষ্যৎ পথরেখা তৈরি করে গেছেন, সে পথরেখা ধরে তার উত্তরসূরিরা আজো এ পত্রিকাটির প্রকাশনা নিরবচ্ছিন্নভাবে অব্যাহত রেখেছেন। সংশ্লিষ্টরা সবাই জানেন, মরহুম আবদুল কাদের ছিলেন মাসিক কমপিউটার জগৎ ও এদেশের তথ্যপ্রযুক্তি আন্দোলনের প্রাণপুরুষ। কিন্তু প্রচারবিমুখ নেপথ্যচারী এ মানুষটি কখনোই সসত্মা আত্মপ্রচার কিংবা বাহবা কুড়াবার জন্য নিজেকে প্রচারের সম্মুখভাগে নিয়ে আসতেন না। তথ্যপ্রযুক্তি আন্দোলনের প্রয়োজনে আয়োজিত অনেক অনুষ্ঠান আয়োজনে তিনি মুখ্য ভূমিকা পালন করলেও অন্যদের সামনের সারিতে ঠেলে দিয়ে নিজেকে যথাসম্ভব আড়ালে রাখতেই বেশি সচেষ্ট ছিলেন। তথ্যপ্রযুক্তি আন্দোলনের সহায়ক যাবতীয় উদ্যোগ-আয়োজনে তিনি আন্দোলনকারীদের যুগিয়েছেন প্রেরণা
যেকোনো আন্দোলনকে একটি যৌক্তিক সাফল্যে পৌঁছানোর জন্য প্রয়োজন একটি সঠিক দর্শন ও সুদৃঢ় বিশ্বাস। সে দর্শন ও সুদৃঢ় বিশ্বাস যথাযথই ধারণ করতেন অধ্যাপক আবদুল কাদের। সেজন্যই তিনি জানতেন, তথ্যপ্রযুক্তির সুফল সর্বোচ্চমাত্রায় পৌঁছাতে আমাদের সাধারণ মানুষের কাছে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার সহজলভ্য করে তুলতে হবে। তাই তিনি মাসিক কমপিউটার জগৎ-এর সূচনা সংখ্যাটির প্রচ্ছদ প্রতিবেদনের শিরোনামটি বেছে নেন এ দাবির প্রতিফলন ঘটিয়ে। সে সংখ্যাটির প্রচ্ছদ প্রতিবেদনের শিরোনাম ছিল : জনগণের হাতে কমপিউটার চাই। এই যে উচ্চারণ, তা যে যথার্থ তাতে কোনো বিতর্কের অবকাশ নেই। তথ্যপ্রযুক্তি আন্দোলনে এটাই হচ্ছে মৌল দাবি।
জনগণের হাতে কমপিউটার পৌঁছানো যে তথ্যপ্রযুক্তির অগ্রগমনের জন্য বড় প্রয়োজন, সে বিশ্বাসতাড়িত হয়েই অধ্যাপক আবদুল কাদের মাসিক কমপিউটার জগৎ ও এর বাইরের তথ্যপ্রযুক্তি আন্দোলনে বেশকিছু মাইলফলক সৃষ্টি করতে সক্ষম হয়েছেন। মাসিক কমপিউটার জগৎ-এর সূচনা সংখ্যার মাধ্যমে ১৯৯১ সালের মে মাসে এদেশে প্রথম দাবি তোলা হয় : জনগণের হাতে কমপিউটার চাই। সমৃদ্ধির হাতিয়ার কমপিউটারকে সাধারণ মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার মৌল দাবি প্রথম কমপিউটার জগৎ জনপ্রিয় করে তোলে। আর জনগণের হাতে কমপিউটার পৌঁছাতে হলে অপরিহার্যভাবেই কমপিউটারের দাম কমাতে হবে। সে উপলব্ধিসূত্রেই অধ্যাপক আবদুল কাদের কমপিউটার জগৎ-এ জোরালোভাবে চালিয়ে যান বিভিন্ন দাবিমুখী লেখালেখি। সেই সাথে চলে সংবাদ সম্মেলন ও সেমিনার আয়োজন। কমপিউটার জগৎ ও তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উন্নয়নে সংগ্রামরত ব্যক্তিবর্গের শুল্কমুক্ত কমপিউটার পাওয়ার আন্দোলন শেষ পর্যমত্ম যৌক্তিক পরিণতি পায় ১৯৯৬ সালে। দেশে সুযোগ সৃষ্টি হয় শুল্কমুক্ত কমপিউটার পণ্য আমদানির। প্রযুক্তি পণ্য হয়ে ওঠে অনেকটা সস্তাতর।
অধ্যাপক আবদুল কাদের সবসময় চাইতেন তথ্যপ্রযুক্তি জগতের সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রগুলোকে দেশের সবার সামনে তুলে ধরতে। তিনি মনে করতেন, তবেই সর্বসাধারণের মধ্যে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার ও সুফলকে কাজে লাগানোর ব্যাপারে অধিকতর আগ্রহ সৃষ্টি হবে। সেই সূত্রে প্রথম বর্ষের অক্টোবর সংখ্যার কমপিউটার জগৎ-এর প্রচ্ছদ প্রতিবেদনে ডাটা এন্ট্রির সূত্রে অফুরান কর্মসংস্থানের সুযোগের সম্ভাবনার কথা সর্বপ্রথম এদেশের মানুষের সামনে তুলে ধরা হয়। এ ছাড়া বিশ্বের লাখ লাখ প্রোগ্রামের চাহিদা ও সম্ভাবনাময় ক্ষেত্রসমূহের ওপর গুরুত্বারোপ করে ১৯৯১ সালের অক্টোবরের সংখ্যায় দ্বিতীয় প্রচ্ছদ প্রতিবেদন প্রকাশ করে কমপিউটার জগৎ। সার্ভিস খাত যে আমাদের অর্থনৈতিক মুক্তির কার্যকর হাতিয়ার হতে পারে, সে বিষয়টিও জাতির সামনে সর্বপ্রথম উপস্থাপন করে কমপিউটার জগৎ, এর ১৯৯১ সালের নভেম্বর সংখ্যার মাধ্যমে। মাতৃভাষা বাংলার কমপিউটার কোড ও বাংলা কীবোর্ড প্রমিত করার তাগিদও সর্বপ্রথম তুলে ধরে কমপিউটার জগৎ। এমনি অনেক উদ্যোগ আয়োজন কমপিউটার জগৎ-এর মাধ্যমে জাতির কাছে নিয়ে আসেন এর প্রাণপুরুষ অধ্যাপক আবদুল কাদের। গ্রামের ছাত্রদের মধ্যে প্রথম কমপিউটার নামের যন্ত্রটিকে পরিচিত করে তোলা, কমপিউটারের দাম কমানোর আন্দোলন, দেশের প্রথম মাল্টিমিডিয়া ও কমপিউটার প্রদর্শনীর আয়োজন, দেশের প্রথম প্রোগ্রামিং প্রতিযোগিতার আয়োজন, সেরা ব্যক্তিত্ব ও পণ্য পুরস্কার চালু, টেলিকম প্রযুক্তির প্রথম দিক-নির্দেশনা, কমপিউটারে শিশু প্রতিভাদের জাতির কাছে তুলে ধরা, জাতীয় তথ্যপ্রযুক্তি ক্যাডার সার্ভিসের প্রথম জোরালো দাবি, ইন্টারনেটের গুরুত্ব জাতির সামনে তুলে ধরা, ব্যাংকখাতে কমপিউটারের প্রয়োজনীয়তা, ফাইবার অপটিক ক্যাবলের প্রয়োজনীয়তা, আদালতে কমপিউটার ব্যবহারের প্রয়োজনীয়তা, দেশের সফটওয়্যার শিল্পের সম্ভাবনা, দারিদ্র্য বিমোচন ও মানবসম্পদ উন্নয়নে কমপিউটারের ভূমিকা, ওয়াইটুকে সমস্যা, টেলিযোগাযোগ উন্নয়ন ইত্যাদি ধরনের নানা বিষয়ে জাতীয় পর্যায়ে সচেতনতা সৃষ্টিতে কমপিউটার জগৎ জোরালো ভূমিকা রাখে অধ্যাপক আবদুল কাদেরের দূরদর্শী দিক-নির্দেশনায়।
অধ্যাপক আবদুল কাদের বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের সমৃদ্ধির স্বপ্ন দেখতেন। তার প্রতিচিত্রই হচ্ছে তার প্রতিষ্ঠিত মাসিক কমপিউটার জগৎ-এর প্রতিটি পাতা। নিয়মিত ১৮ বছরের প্রকাশনা-সময়ে কমপিউটার জগৎ সে প্রয়াসই অব্যাহত রেখেছে। তার উত্তরসূরি কমপিউটার জগৎ পরিবারের প্রতিজন সদস্য নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন তারই প্রদর্শিত মহাসড়কে।
০ টি মন্তব্য