ডিজিটাল প্রযুক্তির জ্বালানি সাশ্রয়ে ফাইভ-জি’র নয়া প্রতিশ্রুতি
ফাইভ-জি হচ্ছে পঞ্চম প্রজন্মের মোবাইল নেটওয়ার্ক। এটি ওয়ান-জি, টু-জি, থ্রি-জি ও ফোর-জি’র পরবর্তী নতুন গেøাবাল ওয়্যারলেস স্ট্যান্ডার্ড। ফাইভ-জি একটি নতুন ধরনের নেটওয়ার্ক। এটি ডিজাইন করা হয়েছে কার্যত মেশিন, বস্তু ও ডিভাইসসহ প্রায় সবকিছুর সাথে সংযুক্ত করার জন্য। ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক দেয় মাল্টি-জিবিপিএস পিক ডাটা স্পিড ও অধিকতর ইউনিফরম ইউজার এক্সপেরিয়েন্স। এ নেটওয়ার্কে ডাউনলোড ও আপলোডের ল্যাটেন্সির (বিলম্বের) মাত্রা খুবই কম। এই নেটওয়ার্ক অধিকতর আস্থাযোগ্য, সক্ষম ওউপলভ্য তথা পাওয়ার উপযোগী।
২০১৭ সাল থেকে ফাইভ-জি’র বাস্তবায়ন চলছে। এর বাস্তবায়নের নেতৃত্বে রয়েছে স্যামসাং, ইন্টেল, কোয়ালকম, নোকিয়া, হুয়াওয়ে, এরিকসন, জেডটিই এবং আরো কয়েকটি প্রতিষ্ঠান। যদিও ২০২০ সাল নাগাদ বাণিজ্যিকভাবে বিশ্বব্যাপী উপলভ্য করার পরিকল্পনা নেয়া হয়েছিল, তবু ২০১৮ সালেই দক্ষিণ কোরিয়া শীতকালীন অলিম্পিকের দর্শকদের ফাইভ-জিসেবা দিতে সক্ষম হয়। মোবাইল অপারেটরদের পাশাপাশি শিল্পক্ষেত্র, এন্টারপ্রাইজ নেটওয়ার্কিং ও জরুরি যোগাযোগের ক্ষেত্রে ব্যক্তিগত নেটওয়ার্ক হিসেবেও ফাইভ-জি প্রয়োগের ব্যাপারেআশাবাদ ব্যক্ত করা হচ্ছে বিভিন্ন মহল থেকে।
আজকের দিনে ওয়্যারলেস ডিভাইসের প্রায় সব অ্যাপ ও প্রোগ্রাম অব্যাহত যোগাযোগ রক্ষা করে ইন্টারনেটের সাথে। এগুলো আমাদের চাহিদামতো ছবি, ভিডিও ও অন্যান্য ফাইল টেনে আনে দূরবর্তী কোনো ডাটা সেন্টার থেকে। যেসব অ্যাপ ও প্রোগ্রাম ক্লাউড কমপিউটিং ব্যবহার করে তাদের ডাটা প্রসেসিংও সম্পন্ন হয় এসব ডাটা সেন্টারে। সাধারণত মোবাইল ফোন ও ডাটা সেন্টারগুলোর মধ্যে ডাটা অদলবদল হয় ওয়াই-ফাই বা মোবাইল নেটওয়ার্কের মাধ্যমে। এসব ডাটা বহন করা হয় রেডিও তরঙ্গের(ওয়েবের) মাধ্যমে। রেডিও তরঙ্গ ব্যবহার হয় রেডিও টেলিভিশন সিগন্যাল সম্প্রচারের কাজে। এসব ওয়েবের বিস্ফোরণের জন্য প্রয়োজন হয় জ্বালানির। আজকের দিনে নেটওয়ার্ক এই জ্বালানির অনেক অপচয় করে। কিন্তু বিকাশমান ফাইভ-জি প্রযুক্তি এক্ষেত্রে অনেক উপকার বয়ে আনতে পারে।
২০২০ সালের দিকে টেলিযোগাযোগ কোম্পানিগুলো শুরু করে একদম নতুন এই নেটওয়ার্ক। এটি ব্যবহার করে স্বল্পপাল্লার ৫ গিগাহার্টজের ওয়াই-ফাই সিগন্যাল। যেসব নেটওয়ার্কের জায়গা এগুলো দখল করতে যাচ্ছে, সেগুলোর তুলনায় এগুলো অপারেট করে আরো উচ্চতর ফ্রিকুয়েন্সি। তবে ফাইভ-জি আরো গতিশীল, জ্বালানিব্যবহারও করে আরো কম। যুক্তরাষ্ট্রে ও অনেক শিল্পোন্নত দেশে ২০২৩ সালের মধ্যে ফাইভ-জি হবে প্রমিতমানের নেটওয়ার্ক।
একটি সেলুলার নেটওয়ার্কে থাকে কিছু অ্যান্টিনা। অ্যাটিনা বলতে আমরা বুঝি এমন একটি ডিভাইসকে, যেটি টেনে নিয়ে আসে ইলেকট্রোম্যাগনেটিক এনার্জি। সেলুলার নেটওয়ার্কের এই অ্যান্টিনাগুলোই রেডিও তরঙ্গ গ্রহণ ও প্রেরণ করে।ফাইভ-জি’র আগে এসব প্রতিটি অ্যান্টিনা জুড়ে দেয়া হতো উঁচু টাওয়ারের একদম মাথায়। এগুলো কাজ করতো কয়েক মাইল ব্যাসার্ধের বৃত্তাকার এলাকায়। এই বৃত্তাকার এলাকাটি পরিচিত একটি সেল নামে। এসব সেলের ভেতরের একটি ফোন এই নেটওয়ার্ক ব্যবহারের সুযোগ পায়। যেসব মোবাইল ফোন এসব সেলের ওপর নির্ভরশীল সেগুলোকে বলি সেলফোন। একটি টাওয়ার থেকে অনেক দূরের এলাকায় সিগন্যাল পাওয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়।
সুপ্রিয় পাঠক, আপনি হয়তো ভাবতে পারেন ফাইভ-জি আরো বেশি উঁচু ও বড়বড় টাওয়ার ব্যবহার করে নেটওয়ার্কের এলাকা আরো অনেকদূর পর্যন্ত সম্প্রসারিত করে তুলবে। না, বাস্তবতা আপনার এ ভাবনার পুরোপুরি উল্টো। ফাইভ-জি নির্ভর করে আরো ছোট ছোট টাওয়ারের ওপর। একটি টাওয়ার কাজ করেমাত্র কয়েক মাইল বৃত্তাকার এলাকায়। ফাইভ-জি অ্যান্টিনাগুলো আরো দ্রæতগতির ইন্টারনেট সুবিধা দেয়। ফাইভ-জি সর্বোচ্চ গতির ইন্টারনেট সুবিধা দেয় অ্যান্টিনা থেকে মাত্র ৫০০ মিটার বা মোটামুটি ৫০০ গজের ভেতরে। আপনি যদি একটি বড় এলাকায় ছোট ছোট সবগুলো সেল একসাথে জুড়ে দেন তবে আপনি একটি বড় এলাকায় ফাইভ-জি সুবিধা পেতে পারেন। তবে এসব ছোট ছোট অ্যান্টিনা কম জ্বালানি ব্যয় করবেÑ এমনটিই জানিয়েছেন কেরি হিন্টন। তিনি একজন অবসরপ্রাপ্ত প্রকৌশলী। কাজ করতেন অস্ট্রেলিয়ার ভিক্টোরিয়ায় মেলবোর্ন বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানে তিনি টেলিযোগাযোগে জ্বালানি ব্যবহারের বিষয়টি নিয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালিয়েছেন।
কেরি হিন্টনের মতেÑ কম মানুষের বসবাসে এলাকার জন্য ছোট ছোট সেল সৃষ্টি করে নেটওয়ার্ক চালু করলে জ্বালানির অপচয় কম হবে। তিনি উদাহরণ তুলে ধরেন খেলাধুলার এলাকা ও বিনোদন এলাকার। যখন একটি ইভেন্ট চালু থাকে, তখন সে এলাকায় প্রচুরসংখ্যক মানুষের নেটওয়ার্কেরপ্রয়োজন হয়। একটি ছোট্ট সেল সৃষ্টি করে তাদের নেটওয়ার্ক সহায়তা দেয়া যেতে পারে। কিন্তু রাতে কিংবা যখন কোনো ইভেন্ট থাকে না, করোনাভাইরাসের এই সময়ে শাটডাউন এলাকায় এই সেলের নেটওয়ার্ক বন্ধ করে রাখা যেতে পারে। ফলে জ্বালানি সাশ্রয় হবে। তার মতে, ছোট ছোট সেল নেটওয়ার্ককে আরো স্মার্ট করে তুলতে পারে।
রোনাল্ড হিশ্চিয়ার একজন পরিবেশ বিশেষজ্ঞ। কাজ করেন সুইজারল্যান্ডের সেন্ট গ্যালেনের ‘সুইস ফেডারেল ল্যাবরেটরিজ ফর ম্যাটেরিয়াল সায়েন্স অ্যান্ড টেকনোলজি’-তে। তিনি বলেনÑ ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক ডাটা কমপ্রেস করতে পারে আগেকার নেটওয়ার্ক অর্থাৎ ফোর-জি নেটওয়ার্কের তুলনায় বেশি। অতএব ফাইভ-জি নেটওয়ার্ক একই সময়ে ফোর-জি নেটওয়ার্কের চেয়ে বেশি পরিমাণ ডাটাপাঠাতে পারে। এর অর্থ এতে পাওয়া যাবে অধিকতরদ্রæতগতির আপলোড ও ডাউনলোড সুবিধা। একটি হিসাব মতে, ফোর-জি’র তুলনায় ফাইভ-জি নেটওয়ার্কে এই গতি ৬০০ গুণ বেশি। কমপ্রেশনের ফলেও প্রতি ইউনিট ডাটা পাঠানোর জ্বালানি খরচও কমে।
গত বছরে পরিচালিত এক জরিপে রোনাল্ড হিশ্চিয়ার ও তার টিম দেখিয়েছেন, সুইজারল্যান্ডে আগামী ১০ বছরের মধ্যে মোবাইল নেটওয়ার্কে প্রতি ইউনিট ডাটা পাঠানোর পরিবেশগত খরচ ৮৫ শতাংশ কমে যাবে। এর বেশিরভাগ সাশ্রয় হবে ফাইভ-জি নেটওয়ার্কে উত্তরণের ফলে। তার টিমের কাজের মধ্যে অন্তর্ভুক্ত রয়েছে নতুন অ্যান্টিনা গড়ে তোলা ও পুরনোগুলোর উন্নততর করার পরিবেশগত খরচ।
তিনি উল্লেখ করেন, ফাইভ-জি থেকে জ্বালানি সাশ্রয় শুধু নেটওয়ার্ক থেকে সরাসরি আসবে না। এ ধরনের অগ্রসর মানের নেটওয়ার্ক গড়ে তুলে এখন অন্যান্য উপায়েও জ্বালানি সাশ্রয় করা ও জ্বালানি উৎস রক্ষা করা সম্ভব।উদাহরণত, এখন অনেক কৃষক তাদের জমিতে বিমান দিয়ে সার বা কীটনাশক ছিটায়। এই কাজটি এখন প্রায় সবখানের জমিতেই চলছে। এসব রাসায়নিক উৎপাদনের ফলে ক্ষতিকর দূষণ ঘটে। ফাইভ-জি সুবিধা দেবে, যাতে ড্রোনগুলো শুধু প্রয়োজনের এলাকাকে টার্গেট করছে কিনা, তা জানার। অতএব এক্ষেত্রে পরিবেশের ওপর কৃষিকাজের ক্ষতিকর প্রভাবও কমিয়ে আনা সম্ভব হবে।
ফাইভ-জি ছড়িয়ে পড়ার সাথে সাথে হুমকির মুখে পড়েছে প্রচলিত ব্যবস্থার টেলিভিশন সম্প্রচার শিল্প। সম্প্রচার জগতে আগামী দিনে টেলিভিশনের আধিপত্য কতটা টিকে থাকবে, তা নিয়ে সংশয় দেখা দিয়ছে। ফাইভ-জি সম্প্রচার-প্রযুক্তিকে কাজে লাগানোর ক্ষেত্রে টেলিভিশনের চেয়ে বেশ সুবিধাজনক অবস্থানে রয়েছে।
০ টি মন্তব্য