স্পেসএক্সের স্যাটেলাইট ইন্টারনেট প্রজেক্ট
স্টারলিঙ্ক। একটি স্যাটেলাইট নেটওয়ার্কের নাম। প্রাইভেট স্পেসফ্লাইট কোম্পানি স্পেসএক্স (SpaceX) এই নেটওয়ার্ক গড়ে তুলছে। প্রত্যন্ত এলাকায় কম খরচে ইন্টারনেট সেবা সরবরাহ এর লক্ষ্য। স্পেসএক্সের আশা, চ‚ড়ান্ত পর্যায়ে এই মেগাকনস্টেলেশনে যোগ করা হবে ৪২ হাজার উপগ্রহ। এই স্টারলিঙ্ক প্রকল্পের আকার ও মাত্রা জ্যোতির্বিদদের ও অ্যামেচার স্কাইওয়াচারদের হতভম্ব করেছে। তাদের আশঙ্কা, কক্ষপথে প্রদক্ষিণরত উজ্জ্বল উপগ্রহগুলো বাধাগ্রস্ত করবে তাদের মহাকাশ পর্যবেক্ষণের কাজকে।
স্টারলিঙ্ক: প্রাথমিক পরিকল্পনা
স্পেসএক্সের ‘স্যাটেলাইট ইন্টারনেট প্রপোজেল’ প্রকাশ করা হয় ২০১৫ সালের জানুয়ারিতে। যদিও তখন এর কোনো নাম দেয়া হয়নি। স্পেসএক্সের প্রধান নির্বাহী এলন মাস্ক জানিয়েছিলেন, তার কোম্পানি আন্তর্জাতিক রেগুলেটরদের কাছে এই মর্মে কাগজপত্র জমা দিয়েছে যে, তারা পৃথিবীর কক্ষপথে চার হাজার উপগ্রহ স্থাপন করতে চায়। এলন মাস্ক তখন তার বক্তৃতায় বলেছিলেন,আমরা আসলে এমন একটা কিছুর কথা বলছিলাম, যা দীর্ঘমেয়াদে তৈরি করবে একটি ‘ইন্টারনেট স্পেস’। মাস্ক ইলেকট্রিক গাড়ি কোম্পানি ‘তেসলা’র মালিক। তবে তেসলা উপগ্রহ তৈরি করে না। কিন্তু স্বল্প সময়েই মাস্কের অনুমিত উপগ্রহের সংখ্যা বেড়ে যায়। কারণ, তিনি তার মঙ্গল গ্রহের উপনিবাসায়ন তথা ‘কলোনাইজেশন ভিশন’বাস্তবায়ন করে বিশ্বের ১ ট্রিলিয়ন ডলারের ইন্টারনেট বাজারে একটা উল্লেখযোগ্য ভাগ বসাতে চান। যুক্তরাষ্ট্রের ‘ফেডারেল কমিউনিকেশনস কমিশন’ (এফসিসি) স্পেসএক্স-কে অনুমতি দিয়েছে ১২০০০ স্টারলিঙ্ক উপগ্রহ কক্ষপথে ছাড়ার ব্যাপারে। আর এই কোম্পানি ইন্টারন্যাশনাল রেগুলেটরদের কাছে আরো অতিরিক্ত ৩০ হাজার উপগ্রহ ছাড়ার ব্যাপারে কাগজপত্র দাখিল করেছে।
‘ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি’র তথ্যমতে, বর্তমানে ৪ হাজার ৩০০ সক্রিয় কৃত্রিম উপগ্রহ পৃথিবীকে প্রদক্ষিণ করছে। এবং এ পর্যন্ত ১১ হাজার ৬৭০টি উপগ্রহ কক্ষপথে উৎক্ষেপণ করা হয়েছে। স্পেসএক্স ২০১৮ সালের ফেব্রুয়ারিতে পরীক্ষামূলকভাবে TinTinA এবং TinTinB নামেএর প্রথম দুটি স্টারলিঙ্ক উপগ্রহ কক্ষপথে পাঠায়। এই মিশন ভালোভাবেই কাজ করে। প্রাথমিক ডাটার ওপর ভিত্তি করে এই কোম্পানি রেগুলেটরদের বলে নিম্ন উচ্চতায় তাদের উপগ্রহ বহর স্থাপনের অনুমোদন দেয়ার জন্য। এফসিসি তাতে রাজি হয়। স্টারলিঙ্ক প্রথম ৬০টি উপগ্রহ কক্ষপথ ছাড়ে ২০১৯ সালের ২৩ মে। এসব উপগ্রহ সফলভাবে তাদের অপারেশনাল অলটিচুডে (৩৪০ মইল বা ৫৫০ কিলোমিটার উচ্চতায়) পৌঁছে। এর চেয়ে কম উচ্চতায় থাকলে তা মধ্যাকর্ষণের টানে ভ‚পৃষ্ঠে নেমে আসত।
স্টারলিঙ্ক যেভাবে কাজ করে
স্টারলিঙ্ক উপগ্রহের বর্তমান সংস্করণটির ওজন ২৬০ কেজি। ‘স্টার অ্যান্ড টেলিস্কোপ’ ম্যাগাজিনের বর্ণনা মতে, এর আকার একটি টেবিলের সমান। বৈদ্যুতিক তারের সাহায্যে ইন্টারনেট সিগনতাল পভঠানোর পরিবর্তে বরং স্যাটেলাইট ইন্টারনেট কাজ করে আকাশে ইনফরমেশন বিমিংয়ের মাধ্যমে। ‘বিজনেস ইনসাইডার’-এর দেয়া তথ্যমতে, স্যাটেলাইট ইন্টারনেটে তথ্য সঞ্চালিত হয় ফাইবার অপটিক ক্যাবলের তুলনায় ৪৭ শতাংশ বেশি গতি নিয়ে।
বর্তমানে স্যাটেলাইট ইন্টারনেট কাজ করে বড় স্পেসক্রাফট ব্যবহার করে, যা পৃথিবীর সুনির্দিষ্ট স্থানের ৩৫ হাজার ৭৮৬ কিলোমিটভরদূরে কক্ষপথে চলে। কিন্তু এই দূরত্বে ডাটা পাঠানো ও গ্রহণে উল্লেখযোগ্য দেরি হয়। উপগ্রহ ও নেটওয়ার্কিং কাছাকাছি হওয়ায় স্টারলিঙ্ক উপগ্রহ বিপুল পরিমাণ ইনফরমেশন দ্রুত বহন করে আনতে পারবে পৃথিবীতে, এমনকি সমুদ্রের ওপরেও।
মাস্ক বলেছেন, স্টারলিঙ্ক নেটওয়ার্ক ‘মাইনর’ ইন্টারনেট কভারেজ দিতে সক্ষম হবে ৪০০ স্পেসক্রাফট ওড়ানো ও ৮৮ স্যাটেলাইট চালু করার পর। ২০২১ সালের মে পর্যন্ত সময়ে স্পেসএক্স সার্বিকভাবে চালু করেছে ১ হাজার ৭৩০টি স্টারলিঙ্ক স্যাটেলাইট। এই কনস্টেলেশন বেটা-টেস্ট প্রোগ্রামের আওতায় এখন বিশ্বব্যাপী সুনির্দিষ্ট কিছু স্থানে ব্রডব্যান্ড সার্ভিস জোগান দিচ্ছে। ব্যবহারকারীরা স্পেসএক্সের সরবরাহ কিট কিনে ব্রডব্যান্ড সেবায় প্রবেশ করতে পারছেন। কোম্পানি ওয়েবসাইট থেকে জানা যায়Ñ এই কিটে রয়েছে একটি ছোট্ট স্যাটেলাইট ডিশ, একটি ওয়াই-ফাই রাউটার, একটি ট্রিপড, ক্যাবল ও বিদ্যুৎ সরবরাহ ব্যবস্থা।
প্রথম ৬০টি স্টারলিঙ্ক উপগ্রহ চালুর পর থেকে স্কাইওয়াচারারেরা আকাশে দেখতে পান আলোর সরলরৈখিক এক শিকল। এটি যেন এক অবাক করা দৃশ্য। একজন স্কাইওয়াচার যখন এই আলোর শিকল দেখতে পান, তখন তিনি বিস্ময়ে চিৎকার করে ওঠেন: ‘ওয়ায়ায়ায়াউ’। এই উজ্জ্বল আলো সবাইকে অবাক করে, এমনকি স্পেসএক্সসহ জ্যোতির্বিদ কমিউনিটির অন্যদেরও। তারা বলছে, স্টারলিঙ্ক প্রকল্প মহাকাশের কাঠামোর জন্য একটি হুমকি হয়ে দাঁড়াতে পারে। গবেষকেরা এর ছবি দেখে বিস্মিত হন। অনেকে এ নিয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করে বলেন, এটি স্বাভাবিক মহাকাশ পর্যবেক্ষণকে বাধাগ্রস্ত করবে। বিভিন্ন মানমন্দির থেকেও একই ধরনের উদ্বেগ প্রকাশ করা হয়। ‘ইন্টারন্যাশনাল অ্যাস্ট্রোনমিক্যাল ইউনিয়ন’ ২০১৯ সালের জুনে এক বিবৃতি প্রকাশ করে এ ব্যাপারে তাদেরউদ্বেগ প্রকাশ করে। তারা স্যাটেলাইট কনস্টেলেশনের প্রভাব সম্পর্কে জ্যোতির্বিজ্ঞানী সমাজের সাথে আলোচনার জন্য স্পেসএক্সকে আহŸানও জানায়। আরো বড় ধরনের প্রতিক্রিয়া আসে ২০১৯ সালের সেপ্টেম্বরে। তখন ইউরোপিয়ান স্পেস এজেন্সি ঘোষণা দেয়, এটি এর ইয়লাস স্যাটেলাইটকে ভিন্নপথে চালিয়েছে, ‘স্টারলিঙ্ক৪৪’-এর সাথে সংঘর্ষ এড়াতে। ‘স্টারলিঙ্ক৪৪’-এর প্রথম ৬০টি উপগ্রহের একটি।
স্পেসএক্সের করণীয়
স্পেসএক্স বলেছে, এরা বিভিন্ন সংগঠন ও মহাকাশ সংস্থার সাথে কাজ করবে তাদের মেগাকনস্টেলেশনের প্রভাব নিয়ে। এরা জ্যোতির্বিজ্ঞানীদের উদ্বেগ আমলে নেবে, যাতে স্টারলিঙ্ক মহাকাশ পর্যবেক্ষণে বাধা হয়ে না দাঁড়ায়। কারণ, এরা প্রতিশ্রুতিবদ্ধ মহাকাশ গবেষণায় বাধা সৃষ্টি না করার ব্যাপারে। স্পেসএক্স জ্যোতির্বিদ সমাজের উদ্বেগ আমলে নিয়ে কিছু পদক্ষেপও নিয়েছে। যেমন: সম্প্রতি সানলাইট বাধাগ্রস্ত করার জন্য চালু করেছে ‘স্টারলিঙ্ক স্যাটেলাইট স্পোর্ট ভিজরস’। কিন্তু এরপরও স্পেসএক্স ও ‘ওয়ানওয়েব’-এর মতো অন্যান্যমহাকাশ কোম্পানির স্যাটেলাইটের মেগাকনস্টেলেশেন আলো-দূষণের কারণ হয়ে দাঁড়াতে পারে।
০ টি মন্তব্য