দেহ প্রহরায় প্রস্তুত মাইক্রোস্কোপিক রোবট
গত সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ড. মার্ক মিসকিন, ড. ইতাই কোহেন এবং পল ম্যাকইউয়েন যৌথভাবে মাইক্রোরোবটের ক্ষেত্রে বড় ধরনের সমস্যাগুলোর মধ্যে একটি সমস্যার সমাধান করেন। তারা এসব রোবটকে একটি নিয়ন্ত্রণযোগ্য অবস্থায় আনেন। আমাদের উপহার দেন অতি ক্ষুদ্র আকারের একটি মাইক্রোরোবট। অন্য কথায় মাইক্রোস্কোপিক বা আণুবীক্ষণিক রোবট। এর রয়েছে মারাত্মক ধরনের কিছু অ্যাকচুয়েটর বা মোটর, যা রোবটটিকে চলতে সহায়তা করে। এ ক্ষেত্রে এই রোবটের প্রবর্তকেরা এর জন্য তৈরি করেছেন ভিন্ন ধরনের পা। প্রতিটি পা এত ছোট যে, এগুলো মানুষের চুল যতটুকু মোটা, তার অর্ধেকের চেয়ে ছোট।
এসব রোবটের রয়েছে ব্লকি বডি। বিভিন্ন ব্লকের সমন্বয়ে এই বডি গঠিত। এর বডি সজ্জিত সোলার সেল তথা সৌরকোষ দিয়ে। প্রতিটি রোবটের রয়েছে দুই জোড়া প্লাটিনামের পা। এই পাগুলোকে লেজার জেপ ব্যবহার করে স্বাধীনভাবে চালানো যায়। পাগুলোর নিয়ন্ত্রণ এতটাই সঠিক যে, পুরো রোবট বাহিনী একটি মার্চ করার সময় একতালে পাগুলো তুলতে ও নামাতে পারে মানব সেনাবাহিনীর মতোই।
মাইক্রোস্কোপিক রোবট
এখানেই শেষ নয়, আগেকার মাইক্রোরোবট চুম্বকের ওপর নির্ভরশীল। এ ক্ষেত্রে আলোচ্য মাইক্রোরোবট ব্যতিক্রম। এগুলোকে চুম্বকত্বের ওপর নির্ভর করতে হয় না। এগুলো মূলত অতিক্ষুদ্রায়িত তথা মিনিয়েচারাইজড রোবট। সামরিক রোবট ‘বিগডগ’-এর মতো এগুলোর রয়েছে মেকানিক্যাল পা। পাগুলো নিয়ন্ত্রিত হয় সিলিকনভিত্তিক ইলেকট্রনিক উপাদান দিয়ে। এর অর্থ, কয়েক দশকের ন্যানো ফেব্রিকেশনের অভিজ্ঞতা কাজে লাগিয়ে ব্যাপকভাবে এসব রোবট একসাথে তৈরি করা যাবে না; যেভাবে বর্তমানে আমরা কমপিউটার চিপ তৈরি করি।
এসব রোবটের ‘মস্তিষ্ক’ কনভেনশনাল তথা প্রচলিত ধরনের এবং এগুলো ক্লাসিক্যাল ইলেকট্রনিক সার্কিটভিত্তিক। তাই এগুলো বিদ্যমান লজিক সার্কিটের সাথে আরো সহজে সমন্বিত করে পরবর্তী প্রজন্মের এমন ধরনের অধিকতর স্মার্ট রোবট তৈরি করা যাবে, যেগুলো অধিকতর জটিল নির্দেশ পালনে সক্ষম হবে।
এমআইটি’র ড. অ্যালান ব্রুকস ও ড. মাইকেল স্ট্রানো যৌথভাবে তাদের এক লেখায় উল্লেখ করেছেন : ‘তারা তাদের রোবটে নতুন ধরনের নকশা-ধারণা ব্যবহার করেছেন। কারণ, অ্যাকচুয়েটরগুলো চালানো যাবে কম শক্তির বিদ্যুৎ দিয়ে, যা প্রবাহিত হয় ইলেকট্রনিক সার্কিটের মধ্য দিয়ে। তাই সেন্সর ও লজিক উপাদান অব্যাহতভাবে সমন্বিত করা যাবে অ্যাকচুয়েটরের সাথে। এর ফলে দুয়ার খুলে গেছে কমপক্ষে ৫০ বছরের মাইক্রো ইলেকট্রনিকস গবেষণালব্ধ এত ছোট রোবটে সংযুক্ত করার ব্যাপারে, যে রোবট খালি চোখে দেখা যায় না।
কেনো মাইক্রোবট?
রোবট দীর্ঘকাল থেকেই আমাদের ভাবনায়-কল্পনায়। বিশেষ করে চিকিৎসার ক্ষেত্রে রোবট নিয়ে আছে নানা প্রতিশ্রুতি। গত শতাব্দীর ষাটের দশকে হলিউডের লোকজন ও বিখ্যাত পদার্থবিজ্ঞানী ড. রিচার্ড ফিনম্যান কল্পনা করেছিলেন ‘সোয়ালেবল সার্জন’ তথা ‘গলাধঃকরণের উপযোগী সার্জন’-এর একটি টিমের কথা। তার কল্পনায় ছিল এই রোবট সার্জন টিম মানবদেহের ভেতরে সব জায়গায় ঘুরে বেড়াবে এবং চাহিদা অনুযায়ী সার্জারি সম্পাদন করবে। বিগত কয়েক দশকে মাইক্রো ও ন্যানো-ফ্যাব্রিকেশন টেকনিকের প্রভূত অগ্রগতি সাধিত হয়েছে। ফলে বায়োকম্পাটিবল সেল আকারের রোবট তৈরির লক্ষ্য বাস্তবায়নের বিষয়টি এখন আর ততটা বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর বিষয় মনে হয় না। এসব রোবট আমাদের দেহে প্রহরা বা প্যাট্রল দিয়ে বেড়াবে। মনে হচ্ছে এর বাস্তবায়ন এখন বৈজ্ঞানিকভাবে অপরিহার্য হয়ে পড়েছে। তবে তা বাস্তবায়নের পথে এখনো কিছু গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ রয়েছে।
প্রধান একটি চ্যালেঞ্জ হচ্ছে, দেহের ভেতরে এই মাইক্রোরোবট বাহিনীকে আস্থার সাথে চলাচলে সক্ষম করে তোলা। এটি একটি বড় ধরনের সমস্যা। শরীরের মাইক্রো-এনভায়রনমেন্ট (অতিক্ষুদ্র পরিবেশ) প্রধানত গঠিত তরল জাতীয় পদার্থ দিয়ে। এর ফলে এসব রোবটের চলাচলের
স্বাভাবিক গতি কিছুটা বাধাগ্রস্ত হবে। এই চলাচল সমস্যার সমাধান করতে বিজ্ঞানীরা মাইক্রোরোবটের ডিজাইন এমনভাবে করেছেন, যাতে যেগুলো সাড়া দেয় আলো, শব্দ, চুম্বকত্ব, তাপমাত্রা অথবা রাসায়নিক নিয়ন্ত্রকের প্রতি। উদাহরণত, এরই মধ্যে আমরা পেয়ে গেছি ছোট্ট পোকাসদৃশ ক্ষুদ্র রোবট, যেগুলো হাঁটতে, লাফাতে, গড়াগড়ি দিতে, এমনকি চুম্বক ব্যবহার করে সাঁতার কাটতে পারে মানুষের দেহকোষের বিরূপ পরিবেশে তাদের চলাচল নিয়ন্ত্রণ করতে। যদিও এই ডিজাইনের ধারণা খুবই সৃজনশীল ও চতুর, তবুও এটি মূলত তৈরি করছে রোবটের একটি নিয়ন্ত্রণ কেন্দ্রে, অর্থাৎ এর ‘মস্তিষ্ক’। প্রশ্ন হচ্ছে যে মাইক্রোইলেকট্রনিক ও সার্কিট বোর্ডের শক্তিতে বিগত অর্ধশতাব্দী ধরে আমাদের কমপিউটার ও ফোনগুলো চলছে, তার পরিবর্তে কেনো এই আমরা এই নতুন ডিজাইনে পদার্পণ করলাম?
পাগুলো তৈরি হাঁটার জন্য
সবচেয়ে বড় সমস্যা ছিল ইলেকট্রনিকভাবে নিয়ন্ত্রিত পাগুলো বা অ্যাকচুয়েটর নিয়ে। এগুলো তৈরি সত্যিই কঠিন কাজ। অতএব গবেষকদেরকে এখান থেকেই তাদের কাজ শুরু করতে হয়েছিল। চূড়ান্ত সমাধানটি ছিল বিস্ময়করভাবে সরল এবং খুবই অভিনব। প্রতিটি পা তৈরি প্লাটিনামের এক টুকরা পাত দিয়ে। পাত ঠিক ৭ ন্যানোমিটার পুরু। এটি
তৈরি লিথোগ্রাফি নামের একটি প্রমিত মানের সেমিকন্ডাক্টর (কমপিউটার চিপ) প্রিন্টিং টেকনোলজি ব্যবহার করে। এর পায়ের এক পাশে আবরণ দেয়া হয়েছে গ্র্যাফিন বা টাইটানিমের মতো একটি নিষ্ক্রয় পদার্থ দিয়ে।
যখন রোবটটির অর্ধেকটা পানিতে ডুবে যায় এবং একটি বিদ্যুতের আঘাতের সাহায্যে এর পাগুলো পানি থেকে বস্তু আকর্ষণ করে, যা বাধা পড়ে পায়ের বিদ্যুৎবাহিত পাশে। আর তা পাটিকে নিচের দিকে টেনে বাঁকা করে। এর ফলে এটি হাঁটতে বা সাঁতার কাটতে পারে। চূড়ান্ত পরীক্ষা হচ্ছে এসব অ্যাকচুয়েটর ঠিকমতো কাজ করে কি-না, তা দেখা। আর এজন্যই তৈরি হচ্ছে এই ছোট্ট আকারের মাইক্রোবট। এই গতিতে একটি রোবট দেহের এক মাথা থেকে অন্য মাথায় যেতে পারে ১ মিনিটে।
প্রতিটি বটের বডিতে রয়েছে দুটি করে সোলার সেল, যেগুলো আলোকশক্তিকে রূপান্তর করে বিদ্যুৎশক্তিতে। আর পা চালানো শুরু করার প্রয়োজন হলে এর পায়ে সংযোজন করা হয় বিদ্যুতের জেপ বা ঝাপটা আঘাত। একটি সোলার সেল নিয়ন্ত্রণ করে সামনের পা দুটিকে, অন্যটি নিয়ন্ত্রণ করে পেছনের পাজোড়া। ধারাবাহিকভাবে সামনের ও পেছনের সোলার সেল আলো প্রতিফলিত করে বোটগুলো তরলের ওপর ভেসে থাকতে পারে। যদিও এ সময় রোবটগুলোর ওপর এক ধরনের ঝাঁকুনি সৃষ্টি হয়।
রোবটগুলো ৪০ ন্যানোমিটার চওড়া ও
৭০ ন্যানোমিটার লম্বা একটি এককোষী শেওলার চেয়েও ছোট। মানুষের একটি চুলের সমান মোটা। লবণের একটি ছোট দানার সমান। এই রোবটগুলো অনবোর্ড ইলেকট্রনিকসমৃদ্ধ সবচেয়ে ছোট রোবট। এটি তাপমাত্রা ১০০ ডিগ্রি ফারেনহাইটেও টিকে থাকতে পারে। এগুলোর ক্ষুদ্র আকারের কারণে সবচেয়ে সঙ্কীর্ণ সূচের ভেতর দিয়েও চলে যেতে পারে এর কোনো ক্ষতি না করেই। আর এটি ক্ষুদ্রতম এককোষী প্রাণীর ভেতর ঢুকিয়ে দিলেও এটি কাজ করতে পারে।
ক্ষুদ্র বট বড় অগ্রগতি
যেহেতু অ্যাকচুয়েটর ও বডি উভয়েই তৈরি স্ট্যান্ডার্ড লিথোগ্রাফি ব্যবহার করে, তাই এসব রোবট সহজেই সমান্তরালভাবে একটি চার ইঞ্চি সিলিকন ওয়েফারে ১০ লাখ পর্যন্ত রোবট সাজানো যায়। এর অর্থ এগুলো তৈরি করা যায় খুবই সস্তায়। মোটামুটি খরচ ০.০০১ ডলার। যেহেতু মাইক্রোফেব্রিকেশন টেকনিক অব্যাহতভাবে পরিপক্ব হয়ে উঠছে, তাই এর খরচ আরো কমে আসার সম্ভাবনাই প্রবল। এখন এসব বট চলে খুব কম বিদ্যুতে প্রায় ১০ ন্যানোওয়াটে। কিন্তু এগুলো এখনো প্রাথমিক অবস্থা কাটিয়ে ওঠেনি। এগুলো এখনো পুরোপুরি অটোনোমাস নয়। এগুলোর নেই অনবোর্ড পাওয়ার সোস
০ টি মন্তব্য