ঘাম দিয়ে চলবে স্মার্টওয়াচ
ভাসমান খামার, ব্রেইন ওয়েব পাসওয়ার্ড, জীবন্ত রোবট, সেলফ রিপেয়ারিং সিমেন্ট এবং কফি-চালিত গাড়ি ইত্যাদি হচ্ছে বিভিন্ন অবিশ্বাস্য ধরনের যুগান্তকারী উদ্ভাবন, যা আমাদের ভবিষ্যৎকে নতুন আকারে সাজাবে। পাল্টে দেবে আমাদের জীবনযাপন, আচার-আচরণ ইত্যাদি সবকিছু। পরিবর্তন আনবে আমাদের প্রবণতায়। এমনি ধরনের একটি প্রাযুক্তিক উদ্ভাবন হচ্ছে ঘামচালিত স্মার্টওয়াচ। এ লেখায় তুলে ধরার প্রয়াস পাব সেই সুইট-পাওয়ার্ড স্মার্টওয়াচ বা ঘাম-চালিত স্মার্টওয়াচের ওপর আলোকপাত করার।
সুইট-পাওয়ার্ড স্মার্টওয়াচ
প্রিয় পাঠক, আপনারা নিশ্চয় শুনে থাকবেন ব্যাটারি-চালিত কিংবা সৌরবিদ্যুৎ-চালিত স্মার্টওয়াচের কথা। কিন্তু শুনেছেন কি শরীরের ঘাম তথা সুইট দিয়ে চালিত স্মার্টওয়াচের কথা। আর হ্যাঁ, সেটাই এখন বাস্তবতা। বিজ্ঞানীরা একটি উপায় খুঁজে পেয়েছেন, যার মাধ্যমে প্রচলিত ব্যাটারির ইলেকট্রোলাইটের স্থানে ব্যবহার হবে মানুষের শরীরের ঘাম। এ সম্পর্কিত গবেষণাটি করা হয় গ্লাসগো বিশ্ববিদ্যালয়ে। সেখানকার স্কটিশ ইনস্টিটিউশনের প্রকৌশলীরা উদ্ভাবন করেছেন নতুন ধরনের একটি ফ্লেক্সিবল সুপার-ক্যাপাসিটর। এটি জ্বালানি মজুদ করে প্রচলিত ব্যাটারিতে থাকা ইলেকট্রোলাইটের পরিবর্তে ঘাম থেকে। এ পদ্ধতিতে ব্যাটারি পুরোপুরি চার্জ করা যায় ২০ মাইক্রোলিটার ফ্লুইড দিয়ে। ফ্লুইড বলতে আমরা বুঝি প্রবাহিত হতে সক্ষম তরল পদার্থ বা গ্যাসকে। এখানে তরলের কথাই বলা হচ্ছে। আর এই ফ্লুইডটিই হচ্ছে মানবদেহে সৃষ্ট আমাদের চির পরিচিত ঘাম। মানুষ যখন অতিরিক্ত পরিশ্রম করে কিংবা উষ্ণ আবহাওয়ার পরিবেশে অবস্থান করে, তখন মানবদেহ থেকে এই ঘাম নির্গত হয়। এ ক্ষেত্রে প্রযুক্তির মাধ্যমে আপনার শরীরে স্বাভাবিকভাবে তৈরি ঘাম সংগ্রহ করে তা দিয়ে জ্বালানি উৎপাদনে ব্যবহার করা হয়। এ কাজটি করা হয় একটি বিশেষ ধরনের পলিমারের পাতলা স্তরে পলিস্টার কাপড়ের কোটিং ব্যবহার করে।
এই বস্তুটির শোষণ-ক্ষমতা রয়েছে। এই ক্ষমতার বলে এটি শরীরের ঘামকে শুষে নেয়। এই ঘামে থাকা আয়ন পলিমারের সাথে বিক্রিয়া করে বিদ্যুৎ সৃষ্টি করে। এই বিদ্যুতেই চলবে আপনার ‘সুইট-পাওয়ার্ড স্মার্টওয়াচ’। বাংলায় বলতে পারি ‘ঘাম-চালিত স্মার্টওয়াচ’। আর এই ব্যাটারি আপনার পরিধানযোগ্য স্মার্টওয়াচের জন্য খুবই উপযোগী। গবেষকেরা এই প্রযুক্তির কার্যকারিতা পরীক্ষার জন্য ২ সেমি বাই ২ সেমি মাপের ব্যাটারি কয়েকজন খেলোয়াড়ের দেহে স্থাপন করেন। তখন এই খেলোয়াড়েরা ট্রেডমিলে ব্যায়াম করছিলেন। এদের শরীরে যে ঘাম সৃষ্টি হয়, তা দিয়ে একটি এলইডির লোড নেয়ার মতো যথেষ্ট বিদ্যুৎ উৎপাদন করা যায়। এর ফলে গবেষকেরা নিশ্চিত হলেন ঘামচালিত এই ব্যাটারি সত্যিই কার্যকর।
‘প্রচলিত ব্যাটারিগুলো বেশ সস্তা। আর এটি এখন আগের চেয়ে প্রচুর পরিমাণে পাওয়াও যায়। কিন্তু এগুলো কখনো কখনো এমন ভঙ্গুর বস্তু দিয়ে বানানো হয়, যেগুলো পরিবেশের জন্য ক্ষতিকর। এর ফলে এগুলো নিরাপদ বর্জ্য নয়। আর পরিধানযোগ্য ডিভাইসে এসব ব্যাটারি ব্যবহার নিরাপদ নয়। অনেক সময় একটি ভেঙে পড়া
ব্যাটারি থেকে নির্গত বিষাক্ত ফ্লুইড মানবদেহের চামড়ার সাথে মিশে যেতে পারে। আর তখন তা চামড়ার ভয়াবহ ধরনের ক্ষতি করতে পারে’ বললেন অধ্যাপক রবিন্দর দাহিয়া। তিনি এই গবেষণা-প্রকল্পের প্রধান।
তিনি আরো বলেন, ‘আমরা প্রথমেই জানতে পারি মানবদেহের এই ঘাম কী করে আমাদের সত্যিকারের সুযোগ করে দেয় চমৎকার চার্জিং ও ডিসচার্জিংয়ের মাধ্যমে এই বিষাক্ত ফ্লুইড চামড়ায় ছড়িয়ে পড়া পুরোপুরি বন্ধ করা যায়।’
প্রশ্ন হচ্ছে কবে শুরু হবে সুইট-পাওয়ার্ড স্মার্টওয়াচের বাণিজ্যিক ব্যবহার? এ পর্যন্ত ঘাম থেকে যে ব্যাটারি সৃষ্টি করা হয়েছে, এর বিদ্যুৎ-শক্তির পরিমাণ ১০ মিলিওয়াট। এটি পর্যাপ্ত বিদ্যুৎ নয়। এটি দিয়ে আপনার পরিধানযোগ্য ডিভাইস চলতে পারে। তবে তা অনির্দিষ্টকালের জন্য নয়। আপনার প্রয়োজন এটি একবারই রিচার্জ করা, বারবার নয়। কাজটি নির্ভর করে প্রমিত মানের চার্জিং ব্যবস্থার ওপর। গবেষকেরা অবশ্য তেমন প্রতিশ্রুতিই দিচ্ছেন, যদিও এ সম্পর্কিত পুরো বিষয়টি রয়েছে গবেষণার পর্যায়ে। তবে সবচেয়ে ভালো হয় যদি আগামী কয় বছরের মধ্যেই তা দেখতে পাই। আসলে ঘাম-চালিত ব্যাটারির বাণিজ্যিক ব্যবহার সফলভাবে শুরু হয়ে গেছে। কিন্তু গবেষকেরা পরিকল্পনা করছেন এই গবেষণাকে আরো এগিয়ে নিতে। এর মাধ্যমে তারা চান, ঘাম থেকে উৎপাদিত বিদ্যুৎকে পরিধানযোগ্য স্মার্ট ডিভাইসে সংযুক্ত করতে। এ প্রযুক্তির জন্য এটিই সঠিক পরিকল্পনা। কারণ, এই সুইট-পাওয়ার্ড স্মার্টওয়াচ খেলোয়াড়েরা পরিধান করবে ব্যায়াম করা বা খেলা চলার সময়। ঘাম-চালিত স্মর্টওয়াচের আরেকটি বিকল্প হতে পারে সৌরশক্তি ব্যবহারে সক্ষম ‘গারমিন ফেনিক্স ৬ ওয়াচের’ মতো একটা কিছু। এগুলোতে রয়েছে ‘পায়ার গ্লাস’, যা আসলে স্বচ্ছ সোলার চার্জিং লেন্স। এই লেন্স বসানো আছে ঘড়ির ওপরে। এই লেন্স সূর্যকিরণকে রূপান্তর করে জ্বালানিতে। এর ফলে ব্যাটারির আয়ু বেড়ে যায় ১০-১৫ শতাংশ।
এখানেই শেষ নয়, আমরা প্রথমবারের মতো পেতে যাচ্ছি এর চেয়েও আরো বেশি উন্নত স্মার্টওয়াচ। সেটিকে বলা হচ্ছে ‘পাওয়ারওয়াচ’। এটি চলবে আপনার শরীরের তাপমাত্রা দিয়ে। ফলে পাওয়ারওয়াচ কখনোই আপনাকে কষ্ট করে চার্জ করার প্রয়োজন হবে না। এই পাওয়ারওয়াচে থাকবে এক ধরনের একটি ‘মেট্রিক্স-পাওয়ার্ড থার্মোডিনামিকস ইঞ্জিন’। এটি চলবে ব্যবহারকারীর শরীরের তাপ দিয়েই। এই ইঞ্জিনটি স্মার্টওয়াচে সংযোজন করলে সর্বোচ্চ কার্যকর ফল পাওয়া যায়। বলা হচ্ছে, এটি হচ্ছে বিশ্বের প্রথম স্মার্টওয়াচ, যেটি কার্যত কখনোই চার্জ করতে হয় না।
পাওয়ারওয়াচ
দ্বিতীয় প্রজন্মের পাওয়ারওয়াচ হচ্ছে ‘পাওয়ারওয়াচ ২’। এটি এখনো বাজারে আসেনি। কবে নাগাদ বাজারে আসবে তাও নিশ্চিত বলা যাচ্ছে না। এটি স্যামসাং গ্যালাক্সি, আইপ্যাড, ট্যাবলেট ও আইফোনে কম্প্যাটিবল। এটি চলবে শরীরের তাপে। এটি একটি ফিটনেস ট্র্যাকার। এতে থাকবে নানা সেন্সর। এটি জানিয়ে দেবে আপনার শারীরিক অবস্থা। জিপিএস সিস্টেমসমৃদ্ধ এই পাওয়ারওয়াচ মাপতে পারবে আপনি কত কদম হাঁটলেন বা দৌড়ালেন। খরচ করলেন কত ক্যালরি। পাবেন বিভিন্ন ধরনের স্মার্ট নোটিস। অদূর ভবিষ্যতে হয়তো আমরা দেখব আরো চমকপ্রদ বিভিন্ন স্মার্টওয়াচ।
মানুষ খাবারের মাধমে যে ক্যালরি গ্রহণ করেন, মানবদেহ এই ক্যালরিকে রূপান্তর করে তাপে। আপনার দেহ কত ক্যালরি খরচ করলো এই পাওয়ারয়াচ সঠিকভাবে পরিমাপ করে। আর এ কাজে ব্যবহার হয় অগ্রসর মানের থার্মোইলেকট্রিকট্রিক টেকনোলজি
০ টি মন্তব্য