দুর্নীতিবিরোধী লড়াইয়ে চার প্রযুক্তি
গণতন্ত্রের জন্য অন্যতম শর্ত হচ্ছে তথ্য প্রকাশ ও স্বচ্ছতা বিধানের অপরিহার্যতা। গণতন্ত্রে দুর্নীতিবিরোধী লড়াই জারি রেখে সরকার ও বাজারের মধ্যে উন্মুক্ত সমতল ক্ষেত্র তথা লেভেল প্লেয়িং ফিল্ড তৈরি করা। দুর্নীতি চিহ্নিতকরণ, বন্ধকরণ ও বিশ্লেষণ পদ্ধতিতে বিপ্লব আনায় আমাদের সুযোগে করে দিয়েছে প্রযুক্তি। আমরা এ ক্ষেত্রে চারটি বিশেষ প্রযুক্তির নাম বিশেষত উল্লেখ করতে পারি : বিগ ডাটা, ডাটা মাইনিং, মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন এবং ফরেনসিক টুলস।
বিগ ডাটা : অটোমেশন বাড়িয়ে তুলে বিভিন্ন সংগঠন যথার্থ স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে ব্যবহার করছে প্রযুক্তি। আন্তর্জাতিক সংগঠনগুলো প্রতারণা ও দুর্নীতিরোধী ইনোভেটিভ সফটওয়্যার তৈরির বিপ্লবে একদম সামনের সারিতে। জাতিসংঙ্ঘ বলছে, অধিকতর প্রবেশযোগ্য ও উন্নত মানের ডাটা সুযোগ করে দেয় উন্নততর সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও বৃহত্তর জবাবদিহির। জাতিসংঘের সাম্প্রতিক বেশ কিছু প্রতিবেদনে উল্লেখ করা হয়েছে, কী করে ডাটা বিপ্লবকে অন্তর্ভুক্ত করা যায় টেকসই উন্নয়ন প্রতিশ্রুতিতে। এর সাথে সংশ্লিষ্ট রয়েছে প্রযুক্তি ও উদ্ভাবন দক্ষতা বাড়ানোর জন্য বিগ ডাটা, উন্নত নেটওয়ার্ক ও ডাটাসংশ্লিষ্ট অবকাঠামোকে একসাথে জোড়া, সক্ষমতা সমস্যা দূর করা, গুরুত্বপূর্ণ ফাঁকগুলো চিহ্নিত করা, সহযোগিতা বাড়ানো ও সবার কল্যাণের স্বার্থে উদ্ভাবনে প্রণোদনা দেয়া। বিগ ডাটা প্রাথমিকভাবে কাজে লাগানো হচ্ছে জনস্বাস্থ্য, ব্যবসা-বাণিজ্য ও করারোপের ক্ষেত্রে, যেখানে প্রিডিকটিভ অ্যানালাইসিস ও ভিজ্যুয়ালাইজেশন নির্ধারণ করে প্রবণতা, ধরন ও সম্পর্ক। একটি বিষয়কে গভীরভাবে জানতে বিপুল পরিমাণ ডাটা ব্যবহার হয়। প্রচলিত পদ্ধতিতে বিপুল পরিমাণ ডাটা বিশ্লেষণ করে দুর্নীতি উদঘাটন করা কঠিন ছিল। কিন্তু এখন ডিজিটাইজেশন ও বিগ ডাটা জনপ্রিয় হয়ে ওঠার কারণে আমরা পেয়েছি ডাটা ব্যবস্থাপনার এক নয়া কৌশল, যার ফলে সরকারি খাতে প্রতারণা রোধে সহজতর হয়েছে। ফ্রড অ্যানালাইটিকস এখন বিভিন্ন ক্ষেত্রে চিহ্নিত করতে পারে সন্দেহজনক লেনদেন।
ডাটা মাইনিং : মাল্টিলেটারেল ডেভেলপমেন্ট ব্যাংকগুলো বিভিন্ন টুল ব্যবহার করছে বিভিন্ন প্রক্রিয়া তদারকির কাজে। সরকারি ক্রয়ে ডাটা মাইনিং ব্যবহার হচ্ছে অডিটের কাজে। এটি ব্যবহার হচ্ছে লেনদেনে ডাটা ভিজ্যুয়ালাইজেশনের মাধ্যমে ‘অসৎ উদ্দেশ্য’ চিহ্নিত করার কাজেও। বুদাপেস্টের করাপশন রিসার্চ সেন্টার বিপুল পরিমাণ ডাটাগুচ্ছ পরীক্ষা করে দেখেছে। এগুলো ইইউ দেশগুলোর সরকারি ক্রয়সংক্রান্ত ডাটা। তারা অস্বাভাবিক ধরনের ডাটা খুঁজে পেয়েছেন। শর্ট বিডিংয়ের সময় এসব অস্বাভাবিক লেনদেন ঘটেছিল। দেখা গেছে, এসব দরপত্রে কোনো প্রতিযোগী ছিল না। তা ছাড়া একই পক্ষের দরপত্র বারবার অনুমোদিত হয়েছে। অ্যান্টি-করাপশন সফটওয়্যার বিশেষ করে ডিজাইন করা হচ্ছে প্রতারণা চিহ্নিত ও বন্ধ করার উপযোগী করে। এর মধ্যে আছে ডাটা সেটের ‘ইন্টেলিজেন্ট মাইনিং’ ও ‘অ্যাডমিনিস্ট্র্যাটিভ প্রসিজিউর’। ইউরোপীয় কমিশন ও ট্র্যান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল উভয়ে তৈরি করেছে ডাটা অ্যানালাইটিকস সফটওয়্যার, যা বিভিন্ন ধরনের সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের ডাটা ক্রস-চেক করে।
মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন : নানা ধরনের মোবাইল টেকনোলজি ও অ্যাপ্লিকেশন ব্যবহার হচ্ছে দ্রুত ডাটা পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে ভেতরের সত্যিকারের চিত্রটা জানার জন্য। উন্নয়নশীল দেশে এই প্রযুক্তি ব্যবহার হচ্ছে প্রত্যন্ত অঞ্চলের নাগরিকদের ক্ষমতায়নের কাজে। তাদের সুযোগ দেয়া হচ্ছে তথ্যে অধিকতর প্রবেশের। ফলে এরা দুর্নীতি রোধে আগের চেয়ে বেশি ভ‚মিকা রাখতে পারছে। এর একটি উদাহরণ হচ্ছে, এমন কিছু অ্যাপ্লিকেশন ও ওয়েবসাইট যেগুলো দুর্নীতি চিহ্নিত ও বন্ধ করায় সহায়ক। যেমন এই বিষয়টি বিশ্বব্যাংককে উদ্বুদ্ধ করেছে এর নিজস্ব সংস্করণ ‘ও ‘I paid a bribe’’ সৃষ্টি করতে। ‘ইন্টিগ্রিটি’ অ্যাপটির লক্ষ্য হচ্ছে নাগরিক সাধারণকে সুযোগ করে দেয়া, বিশ্বব্যাংকের প্রকল্পগুলোর তথ্যে সহজ-প্রবেশের। এর মাধ্যমে তারা তাৎক্ষণিকভাবে কোনো প্রতারণা ও দুর্নীতি-সম্পর্কিত তথ্য বিশ্বব্যাংককে জানাতে পারে। যেমন মানুষ এর মাধ্যমে অর্ধনির্মিত কোনো স্কুলের ছবি পাঠাতে পারে কিংবা জানাতে পারে কোনো ঘুষের খবর।
ফরেনসিক টুল : জাতিসংঙ্ঘের টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্য (এসডিজি) বাস্তবায়নে উন্নততর তদারকি ও জবাবদিহি নিশ্চিত করা জরুরি হয়ে পড়েছে। সবার স্বার্থে জাতিসংঙ্ঘ প্রস্তাব করেছে ‘নেটওয়ার্ক অব ডাটা ইনোভেশন নেটওয়ার্কস’ নামের একটি নেটওয়ার্ক সৃষ্টির। এই নেটওয়ার্ক সংগঠনগুলো ও বিশেষজ্ঞবর্গকে একসাথে নিয়ে আসবে তদারকি ও দক্ষতা উন্নয়নের সর্বোচ্চ অনুশীলন নিশ্চিত করতে। সরকারি ও বেসরকারি খাতে ‘সেলফ মনিটরিং, অ্যানালাইসিস অ্যান্ড রিপোর্টিং টেকনোলজি’ (SMART)-এর মতো অডিটরদের বিভিন্ন ফরেনসিক টুল ব্যবহার হচ্ছে দুর্নীতির ঝুঁকি এড়ানোর কাজে। প্রযুক্তির অগ্রগতির ফলে এসব টুল ডাটার গতি মোকাবিলায় যথেষ্ট উপযোগী। এগুলো সক্ষম লেনদেনের রিয়েলটাইম বিশ্লেষণ, প্রিডিকটিভ মডেলিং, অ্যানামলি ডিটেকশন ও রিস্ক স্কোরিং অ্যালগরিদম করতে।
অন্যান্য ক্ষেত্রেও আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলো দুর্নীতিবিরোধী নানা ধরনের অভিজাত টুল উদ্ভাবন করছে, যা প্রমাণ করে দুর্নীতির অবসানে প্রযুক্তি হতে পারে বড় ধরনের হাতিয়ার। দুর্নীতিতে আকণ্ঠ জর্জরিত বাংলাদেশের নীতি-নির্ধারকেরা এ নিয়ে ভাবতে হবে বৈ কি!
০ টি মন্তব্য