তথ্য প্রযুক্তি পরিষেবায় বর্তমানে ২৭টি খাতে কর অব্যাহতির সুবিধা পেলেও কমেছে আসন্ন বাজেটে এই পরিষেবার সংখ্যা। নতুন ২০২৪—২৫ অর্থবছরের বাজেটে তা কমিয়ে ১৯টি খাতে কর অব্যাহতির ব্যবস্থা রাখার প্রস্তাবানা দেওয়া হয়। এরসঙ্গে কর অব্যাহতির পরিষেবায় নতুন করে আরও চারটি সেক্টর যুক্ত করা হবে। সেগুলো হলো— কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ভিত্তিক সল্যুশন ডেভেলপমেন্ট, ব্লকচেইন—ভিত্তিক সল্যুশন ডেভেলপমেন্ট, সফটওয়্যার পরিষেবা এবং ডেটা বিজ্ঞান ও ডিজিটাল তথ্য বিশ্লেষণ।
বাদ পড়া পরিষেবাগুলোর মধ্যে রয়েছে— দেশব্যাপী টেলিকমিউনিকেশন ট্রান্সমিশন নেটওয়ার্ক, আইটি প্রসেস আউটসোর্সিং, ওয়েবসাইট হোস্টিং, বিদেশি মেডিকেল ট্রান্সক্রিপশন, সার্চ ইঞ্জিন অপ্টিমাইজেশন পরিষেবা, ক্লাউড পরিষেবা এবং সিস্টেম ইন্টারোগেশন। তথ্যপ্রযুক্তি সক্ষম পরিষেবা খাতকে আরও সমৃদ্ধ করতে (আইটিইএস) উদ্যোক্তারা অতিরিক্ত তিন বছরের কর ছাড় পাবেন ২০২৪—২৫ অর্থবছরের বাজেটে। তবে ক্ষেত্রে প্রধান শর্ত হলো, সকল উদ্যোক্তরা তাদের আর্থিক লেনদেন ব্যাংকের মাধ্যমে করতে হবে। নগদ অর্থের পরিবর্তে যারা ব্যাংকে লেনদেন করবেন তারাই এই সুবিধা পাবেন। এর মাধ্যমে সরকারের উদ্দেশ্য হলো, সকলকে ক্যাশলেস অর্থনীতিতে আগ্রহী করে তুলা। ফলে আর্থিক লেনদেনকে আরও উন্নত করা।
বিশ্ব অর্থনৈতিক অস্থিরতা, ইউক্রেন—রাশিয়া যুদ্ধের মধ্যে ইরান—ইসরায়েল অস্ত্রের ঝনঝনানি ও নানা ভূ—রাজনৈতিক সংকটকের মধ্যেই আরও একটি বাজেট সমাগত। বাজেটকে কেন্দ্র করে সংশ্লিষ্ট স্টেকহোল্ডারগণ তাদের মতামত পেশ করছেন, নিজেদের ব্যবসায়ীক খাতের উন্নয়নে দাবিদাওয়া উত্থাপন করছেন। ডিজিটাল থেকে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে টেকসই অর্থনীতির ভিত্তি গড়তে আসলেই কি কর অব্যবহিত বা প্রণোদনা সুবিধা আরো কিছুদিন রাখা উচিত? আমাদের বিগত দুই দশকের কিছু উন্নয়ন অগ্রগতির সূচক এবং বৈশ্বিক তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যেতে পারে।
১৯৯৩ সালে দেশে বিনামূল্যে সাবমেরিন ক্যাবল স্থাপনের সযোগ এলেও তৎকালীন বিএনপি সরকারের অদূরদর্শী নেতৃত্বের কারণে বাস্তবে রূপ না নেয়ার দুঃখজনক কাহিনী আমাদের সবারই জানা। বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ সরকারই সাবমেরিন ক্যাবলের সাথে যুক্ত করে ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণের পদক্ষেপ গ্রহণ করে। আইটি ইনফ্রাস্ট্রাকচার গড়ে তুলে ইন্টারনেট সহজলভ্য করে সরকারের ধারাবাহিক পলিসি সাপোর্টের মাধ্যমে আজ ডিজিটাল বাংলাদেশের ব্রান্ডিং ছড়িয়েছে বিশ্বব্যাপী। এই পথ চলায় আইটি প্রোডাক্ট আমদানী কর মুক্ত রাখা, তথ্যপ্রযুক্তি খাতের ওপর কর অব্যাহতি, সফটওয়্যারের উৎপাদন পর্যায়ে ভ্যাট মওকুফ, আইটি ও আইটিইএস রপ্তানীতে ক্যাশ ইন্সেটিভসহ নানা যুগান্তকারী সাহসী সিদ্ধান্ত ছিল। বিনিময়ে দেশ আজ ডিজিটাল হয়েছে কিন্তু দীর্ঘ এই পথ চলায় সরকারকে কখনো নির্মম ট্রলের শিকার হতে হয়েছে, কখনো অপপ্রচারের নিষ্ঠুর বলি হতে হয়েছে এখনো হতে হচ্ছে।
এনবিআর তথ্য বলছে আইটি ইন্ডাস্টি্রর বাৎসরিক প্রফিট ৫ হাজার কোটি টাকা। এই খাত করের আওতায় আনলে সরকারের অনেক রাজস্ব আদায় হবে। আইটিতে সর্বোচ্চ করদাতা প্রতিষ্ঠানে কাজ করার সুবাদে এই তথ্যটিতে অনেকে একমত নন। এখানে দরকার স্টেকহোল্ডার, এনবিআর ও আইএমএফ এর এক সাথে বসে সঠিক তথ্য বিশ্লেষণ, যাতে সরকার এই শিল্পের রাজস্ব এবং মুনাফা সঠিকভাবে নির্ধারণ করতে পারে। সঠিক তথ্য বিশ্লেষণে সরকার সিদ্ধান্ত নিতে পারবে জুন ২০২৪ এর পর আইটি খাতে কর অব্যবহিত বা প্রণোদনা সুবিধা উঠিয়ে দিয়ে বা অব্যাহত রেখে কতটা কল্যাণকর হবে দেশীয় আইটি ইন্ডাস্টি্র।
তথ্য প্রযুক্তি কে একটি নির্দিষ্ট খাত হিসাবে বিবেচনা করাই আমাদের ভুল। শিক্ষা, স্বাস্থ্য, যোগাযোগ, কৃষি ব্যবস্থা, ভূমিব্যবস্থাপনা, কর ব্যবস্থাপনা, ট্রাফিক সিস্টেম, সিটিজেন সার্ভিস সব কিছুতেই আছে তথ্য প্রযুক্তির মেলবন্ধন। সবগুলো খাতকে আধুনিক ও ব্যবহার উপযোগী করতে তথ্য প্রযুক্তির সংযুক্তি নিশ্চিত করতে হচ্ছে। তাই তথ্য প্রযুক্তি স্বকীয় একটি খাত হিসাবে বিবেচনা না করে সবগুলো খাতের সংমিশ্রণ মনে করাই শ্রেয়। আইসিটি ইন্ডাস্টি্রর সুবিধাদি সংকুচিত করলে তার প্রভাব পড়বে প্রত্যেকটা শিল্পের উন্নয়নে, সামগ্রিক অগ্রগতিতে। সরকারের দৃষ্টিভঙ্গির কেন্দ্রবিন্দুতে রয়েছে স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণ, তাই দেশের সামগ্রিক অগ্রগতিতে তথ্য প্রযুক্তির সুবিধা অব্যাহত রাখতেই হবে। এই খাত যে কর অব্যাহতি সুবিধা পেয়ে আসছে ১০ বছর ধরে, ২০২৪ সালের জুন মাসে তার মেয়াদ শেষ। ৫ বিলিয়ন ডলার আইটি এক্সপোর্ট এর লক্ষ্যমাত্রা নির্দিষ্ট সময়ে অর্জনে ব্যর্থ হয়ে আবার নতুন সময় নির্ধারণ করেছি। তাই সময় এসেছে এলডিসি গ্র্যাজুয়েশনের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলায় দেশের আইটি খাতের সহায়ক পরিবেশ আরো সুদৃঢ় ও জোরদার করা, যাতে করে আইটি খাত একটি শক্ত ভিত্তির উপর দাঁড়াতে পারে।
আইটি খাতকে দৃঢ় অর্থনৈতিক ভিত্তিতে দাঁড় করাতে বিগত দিনে দেয়া কর সুবিধা যথেষ্ট কিনা? পাশের দেশ ইন্ডিয়া বা আইটিতে দ্রুত বিকশিত ফিলিপিন্স ও ভিয়েতনামের ইন্ডাস্টি্র বিশ্লেষণ করা যায়। সেখানেও সরকারের দেয়া সাপোর্ট ছিল নিদিষ্ট সময়ের জন্য। ইন্ডিয়া আইটি স্টার্টআপকে ৩ বছর, ফিলিপিন্স ২ বছর এবং ভিয়েতনাম ৫ বছর করের আওতামুক্ত রেখেছে। কর অব্যবহিত, ভর্তুকি বা প্রণোদনা কখনো গতিশীল অর্থনীতির স্থায়ী বৈশিষ্ট্য হতে পারে না।
তাই আমাদের দেশেও সরকারি সাপোর্ট একটা সময়ে প্রত্যাহার করতেই হবে। সরকার যদি মনে করে টেকসই অর্থনীতির ভিত্তি গড়তে নতুন করে আইটি খাতে কর অব্যবহিত বা প্রণোদনা সুবিধা অব্যহত রাখবে না তাহলে কি হতে পারে। এই শিল্পে নতুন বিনিয়োগ হওয়ার সুযোগ কমে আসবে, বর্তমান দেশীয় প্রতিষ্ঠানের বিকাশ বাধাগ্রস্ত হবে , সরাকারী প্রসেস অটোমেশন বা শিল্প অটোমেশনের খরচ খরচ বাড়বে। মাঝারি ও ক্ষুদ্র উদ্যোক্তা এবং স্টার্টআপ প্রতিষ্ঠানগুলো অগ্রগতি বাধাগ্রস্ত হবে। তাই সরকারকে দূরদর্শিতার সাথে হিসাব করে সাহসিকতার সাথে সিদ্ধান্ত নিতে হবে।
ডিজিটাইজেশনের পথকে রুদ্ধ না করে প্রসারিত করতে সাহসী সিদ্ধান্ত নিতে হবে। দেশের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিয়ে, দেশীয় আইটি খাতকে দৃঢ় অর্থনৈতিক ভিত্তিতে দাঁড় করাতে সাহসী যুগান্তকারী সিদ্ধান্তই নিতে হবে। ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকার এবং স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা বর্তমান সরকার প্রধান এবং মন্ত্রণালয় আইটি খাতের চলমান প্রশ্নে যুগোপযোগী সিদ্ধান্তই নিবেন এটি সবার প্রত্যাশা।
০ টি মন্তব্য