২০২৫ সালের ২৮ আগস্ট নেপালের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় নেপাল টেলিকমিউনিকেশন কর্তৃপক্ষকে নির্দেশ দেয় যে ২০২৩ সালের সোশ্যাল নেটওয়ার্ক ব্যবহারের ব্যবস্থাপনা বিষয়ক নির্দেশিকা অনুযায়ী ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫-এর মধ্যে নিবন্ধন না করা সব অনলাইন প্ল্যাটফর্ম নিষিদ্ধ করতে। ২০২৫ সালের ৫ সেপ্টেম্বর থেকে এই নিষেধাজ্ঞা কার্যকর হয়েছে। মোট ২৬টি প্ল্যাটফর্ম নিষিদ্ধ করা হয়েছে, এর মধ্যে রয়েছে: ফেসবুক, ফেসবুক মেসেঞ্জার, ইনস্টাগ্রাম, ইউটিউব, হোয়াটসঅ্যাপ, এক্স, লিঙ্কডইন, স্ন্যাপচ্যাট, রেডডিট, ডিসকর্ড, পিন্টারেস্ট, সিগনাল, থ্রেডস, উইচ্যাট, কোরা, টাম্বলার, ক্লাবহাউস, মাস্টডন, রাম্বল, ভিকে, লাইন, আইএমও, জালো, সোল এবং হাম্রো পাত্রো।
আমরা নেপাল সরকারের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম প্ল্যাটফর্ম নিষিদ্ধ করার একনায়কতান্ত্রিক সিদ্ধান্তের তীব্র নিন্দা জানাই। এই পদক্ষেপ মৌলিক স্বাধীনতার ওপর স্পষ্ট আঘাত—বিশেষ করে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, তথ্যপ্রাপ্তির অধিকার, সংগঠিত হওয়ার অধিকার এবং ডিজিটাল প্ল্যাটফর্মে অংশগ্রহণের অধিকারের ওপর। এটি ভিন্নমত দমন, সমালোচনামূলক কণ্ঠস্বর স্তব্ধ করা এবং নাগরিক পরিসর সীমিত করার একটি বিপজ্জনক প্রচেষ্টা।
এই নিষেধাজ্ঞা এসেছে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলোকে ২০২৩ সালের নির্দেশিকার আওতায় আনতে সরকারের বারবার ব্যর্থ প্রচেষ্টার পর। মেটা, এক্স, হোয়াটসঅ্যাপ, সিগনাল, ডিসকর্ড, ইউটিউব ও মাস্টডনসহ মোট ২৬টি প্ল্যাটফর্ম ৪ সেপ্টেম্বর ২০২৫ থেকে নিষিদ্ধ করা হয়েছে নিবন্ধন না করার কারণে। এই নির্দেশিকা অনুযায়ী প্ল্যাটফর্মগুলোকে ছদ্মনাম ও বেনামী একাউন্ট, “বীভৎস” (সংজ্ঞাহীন), “অশ্লীল” (সংজ্ঞাহীন) বিষয়বস্তু, এবং “জাতীয় অখণ্ডতা”, “সার্বভৌমত্ব” ও “স্বার্থ” (সবগুলো সংজ্ঞাহীন) লঙ্ঘনকারী প্রকাশনা নিষিদ্ধ করতে হবে। নির্দেশিকায় স্ট্রিমিং প্ল্যাটফর্ম, সামাজিক নেটওয়ার্ক এবং সার্চ ইঞ্জিনের মধ্যে কোনো পার্থক্য করা হয়নি—ফলে হাম্রো পাত্রো (যা একটি জ্যোতিষ, ক্যালেন্ডার ও সংবাদ অ্যাপ) এবং ইউটিউবকেও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। নিবন্ধন করলে প্ল্যাটফর্মগুলোকে এই সব সীমাবদ্ধ শর্ত মানতে বাধ্য করা হবে। কিন্তু এর ফলে প্রান্তিক জনগোষ্ঠী, যারা গোপনীয়তা, নিরাপত্তা ও রাজনৈতিক প্রকাশের জন্য ছদ্মনাম/বেনামী একাউন্ট ব্যবহার করে, তারা মারাত্মকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে।
নেপাল সরকার সোশ্যাল নেটওয়ার্ক বিল পাস করার চেষ্টা করছে, যা নির্দেশিকার ধারাগুলোকেই আরও কঠোরভাবে প্রতিফলিত করে। বিলটিতে “অশোভন” ছবি/ভিডিও বা “মিথ্যা”/“ভ্রান্তিকর” তথ্য শেয়ার করলে সর্বোচ্চ ২ বছরের কারাদণ্ড, ২ লাখ রুপি জরিমানা, বা উভয় শাস্তির বিধান রাখা হয়েছে। বিলটি সংশোধন ছাড়া পাস হলে এটি নজরদারি, দমন ও অতিরিক্ত অপরাধীকরণের ভিত্তিতে একটি ডিজিটাল পরিসর তৈরি করবে—যা মতপ্রকাশের স্বাধীনতাকে ভয়াবহভাবে হুমকির মুখে ফেলবে, নাগরিক নিরাপত্তা বিপন্ন করবে এবং নাগরিক পরিসর সংকুচিত করবে।
সরকারের দায়িত্ব অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহারের সুষ্ঠু নীতি প্রণয়ন ও মানবাধিকারভিত্তিক সুরক্ষা নিশ্চিত করা। কিন্তু নিবন্ধন চাপিয়ে দিতে সার্বজনীন নিষেধাজ্ঞার মতো পদক্ষেপ আন্তর্জাতিক ও সাংবিধানিক নীতিমালা লঙ্ঘন করে। এই ধরনের দমনমূলক পদক্ষেপ নারীদের, কুইয়ার মানুষদের এবং প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর ওপর বৈষম্যমূলক প্রভাব ফেলবে, যারা অনলাইন প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে সংহতির নেটওয়ার্ক তৈরি করে, দমনমূলক ব্যবস্থার বিরুদ্ধে সোচ্চার হয় এবং মূলধারার বাইরে থাকা বাস্তবতাকে দৃশ্যমান করে।
তাছাড়া এই হঠাৎ নিষেধাজ্ঞা পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন প্রবাসী শ্রমিকদের আত্মীয়স্বজন, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমনির্ভর ক্ষুদ্র ব্যবসা, আউটসোর্সিং কোম্পানি, ফ্রিল্যান্সার এবং যেসব প্রতিষ্ঠান দৈনন্দিন কাজকর্মে এসব প্ল্যাটফর্ম ব্যবহার করে তাদের ওপর ভয়াবহ প্রভাব ফেলবে। এই প্ল্যাটফর্মগুলো বন্ধ করে সরকার কেবল সংযোগ ও জীবনরক্ষাকারী তথ্যের প্রবাহ থামিয়ে দিচ্ছে না—বরং পিতৃতন্ত্র, দমননীতি, অবহেলা ও একনায়কতন্ত্রকেও শক্তিশালী করছে।
নেপাল আন্তর্জাতিক মানবাধিকার আইন, বিশেষ করে আন্তর্জাতিক নাগরিক ও রাজনৈতিক অধিকার সনদ (ICCPR)-এর অঙ্গীকারবদ্ধ। সরকারের এই সেন্সরশিপ ও ডিজিটাল মতপ্রকাশকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করার পদক্ষেপ এসব অঙ্গীকারের লঙ্ঘন এবং গণতন্ত্রের ভিত্তিকে দুর্বল করে।
আমাদের দাবি:
আমরা নেপাল সরকারকে আহ্বান জানাই—
অবিলম্বে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের ওপর থেকে নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করতে এবং ডিজিটাল পরিসরে সেন্সরশিপ বন্ধ করতে।
নাগরিক সমাজ, ডিজিটাল অধিকার সংগঠন, নারীবাদী নেটওয়ার্ক ও প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে উন্মুক্ত, অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অংশগ্রহণমূলক পরামর্শ চালু করতে।
বিদ্যমান নির্দেশিকা ও সংশ্লিষ্ট নীতিগুলো সংশোধন করতে, যাতে মানবাধিকারভিত্তিক ডিজিটাল নীতি গৃহীত হয় এবং ইন্টারনেট খোলা, নিরাপদ, ন্যায়সংগত ও সবার জন্য প্রবেশযোগ্য থাকে।
ইন্টারনেটের নিরাপদ ব্যবহারকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা এবং বিকল্প প্ল্যাটফর্মগুলোকে (যাদের বড় প্রযুক্তি কোম্পানির মতো সম্পদ নেই) কঠিন শাস্তির আওতায় আনা থেকে বিরত থাকতে।
আন্তর্জাতিক মানদণ্ড অনুসারে সহ-নিয়ন্ত্রণ ও স্ব-নিয়ন্ত্রণের মডেল নিয়ে প্ল্যাটফর্মগুলোর সঙ্গে সংলাপ শুরু করতে।
আমরা প্ল্যাটফর্মগুলোকে আহ্বান জানাই—
জাতীয় সরকারের সঙ্গে সহযোগিতা করতে, তবে জনগণের রক্ষক হিসেবে কাজ করার শর্তে।
আন্তর্জাতিক মানবাধিকার মানদণ্ড, বিশেষ করে গোপনীয়তা ও মতপ্রকাশের স্বাধীনতা, মেনে চলতে। সরকার ও কর্পোরেট স্বার্থে অবারিত প্রবেশাধিকার দেওয়ার মতো চুক্তি না করতে।
পরিশেষে, সরকার ও প্রযুক্তি কোম্পানি উভয়কেই সর্বপ্রথম জনগণের কাছে জবাবদিহি করতে হবে।
আমরা নেপাল এবং বৈশ্বিক আন্দোলনের পাশে দাঁড়াচ্ছি, যারা সেন্সরশিপের বিরুদ্ধে লড়ছে এবং ন্যায়, সমতা ও স্বাধীনতার ভিত্তিতে নারীবাদী ইন্টারনেট প্রতিষ্ঠার সংগ্রাম চালিয়ে যাচ্ছে।
০ টি মন্তব্য