নারী নির্যাতনের নতুন হাতিয়ার সাইবার ক্রাইম
বর্তমানে আমরা এক ডিজিটাল সময়ে বসবাস করছি। আমাদের প্রতিদিনের জীবনের এক গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হলো ইন্টারনেট। ইন্টারনেট আমাদের জীবনকে সহজ করেছে, কিন্তু এর ফলে দিন দিনই বাড়ছে সাইবার অপরাধ। এই অপরাধের এক বড় ধরনের শিকার হলো নারীরা। এতে ওলট-পালট হয়ে যাচ্ছে অনেক নারীর জীবন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমের অপব্যবহারে তাদের প্রতিটি মুহূর্ত হুমকিতে ফেলে সংঘবদ্ধ চক্র। তাই সাইবার ক্রাইম প্রতিরোধে এখনই জরুরি পদক্ষেপ নেয়া না হলে অচিরেই বিষয়টি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
বন্ধু খোঁজা, কিংবা পরিচিত মানুষের সাথে ক্ষুদে বার্তার মাধ্যমে আলাপচারিতায় বেশ জনপ্রিয়, ফেসবুক, হোয়াটসআপ, ইমো, ভাইবারের মতো সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমগুলো। তবে সুবিধার সাথে কিছু সমস্যাও বয়ে আনছে ভার্চু্যয়াল এই সাইটগুলো, যা সাইবার ক্রাইম নামে চিহ্নিত। সম্প্রতি শুধু ভোলা জেলাতেই সাইবার অপরাধের দায়ে ৯৫টি মামলা নথিভুক্ত হয়েছে, যেখানে ভুক্তভোগীর তালিকায় বেশিরভাগই মেয়েরা। অভিযোগগুলোতে বলা হয়, ফেসবুক আইডি হ্যাক করে ছবি সংগ্রহ করছে একশ্রেণির প্রতারক। পরে সেই ছবি দিয়ে নতুন আইডি খুলে পোস্ট করা হচ্ছে নানা আপত্তিকর ছবি ও ভিডিও। একই সাথে করা হচ্ছে ব্লকমেইল। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬-এ এই ধরনের অপরাধের জন্য আসামিকে কারাদ-সহ অর্থদ--র বিধান রয়েছে। যদিও আইন-শৃঙ্খলা বাহিনী বলছে, সাইবার অপরাধ ঠেকাতে একটি বিশেষ টিম গঠন হয়েছে।
নির্দিষ্ট পরিসংখ্যান না থাকলেও সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ বলছে, বাংলাদেশে সাইবার অপরাধের শিকার মানুষের মধ্যে বড় অংশটি অল্পবয়সী নারী বা কিশোরী মেয়েরা। সেই কারণে সাইবার হয়রানির শিকার হওয়া ঠেকানো ও সাইবার অপরাধীর শিকার হলে করণীয় কী সেই সম্পর্কে সচেতন করার জন্য স্কুল-কলেজের ছাত্রছাত্রীদের প্রশিক্ষণ দেয়ার একটি উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। ঢাকায় গত মাস থেকে এই কর্মসূচি শুরু হওয়ার কথা রয়েছে।
এই প্রকল্পের সমন্বয়ক এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের যুগ্ম সচিব আবুল মুন্সুর মোহাম্মদ সোরাফ উদ্দিন বলেন, তথ্য মন্ত্রণালয় ও পুলিশ নিয়ে এই কর্মকা- শুরুর আগে তারা একটা আলোচনা সভা করে। সেই সভার আলোচনাতে উঠে আসে সাইবার ক্রাইমে কিশোরী মেয়ে অথবা ছেলেরাই বেশি শিকার হয়। এ কারণেই সরকার এই ধরনের কর্মকা--র সিদ্ধান্ত নেয়। তার মতে, এখনই যদি এই ব্যবস্থাটা না নেয়া হয়, তাহলে এটা মহামারী আকার ধারণ করতে পারে। তাই সতর্কতামূলক ব্যবস্থার জন্যই এই প্রোগ্রাম হাতে নেয়া হয়েছে।
এই কর্মকা--র আওতায় এইরকম সমস্যায় পড়লে আইনে কী সমাধান আছে, সেই বিষয়টা হাতে-কলমে বলা হবে। এই জন্য ৯৯৯ নম্বরের মাধ্যমে একটি ব্যবস্থা ইতোমধ্যে আইসিটি বিভাগ থেকে চালু করা হয়েছে। যার মাধ্যমে জরুরি সেবা দেয়ার পাশাপাশি সাইবার ক্রাইম সংক্রান্ত যেসব হয়রানির শিকার হয়ে থাকে আমাদের ছেলেমেয়েরা, তারা ফোন করে সরকারের মাধ্যমে সহযোগিতা নিতে পারে।
সরকারের ইচ্ছা আছে এই বিষয়টা বাংলাদেশের সব স্কুলে পৌঁছে দিতে। কিন্তু এই মুহূর্তে সব স্কুলে এই প্রশিক্ষণটি শুরু হচ্ছে না। এটি প্রথমত ৪০টি স্কুলে শুরু হবে। এর মধ্যে ঢাকায় ১৭টি, খুলনায় ৪টি, চট্টগ্রামে ৪টি, কক্সবাজারে ৩টি, সিলেটে ২টি, রংপুরে ২টি, রাজশাহীতে ২টি, বরিশালে ২টিসহ সারাদেশে মোট ৪০টি স্কুলকে এর আওতায় আনা হয়েছে। এসব স্কুলে প্রতিদিন এক দিন করে প্রশিক্ষণ দেয়া হবে।
এই প্রশিক্ষণ প্রোগ্রাম ছাড়াও সরকার আরও অনেক ধরনের কর্মসূচি গ্রহণ করেছে। মহিলা বিষয়ক অধিদফতরের হলরুমে নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে ন্যাশনাল হেল্পলাইন (১০৯২১ নম্বর) চালু করা হয়েছে। আশা করা হচ্ছে, নারী ও শিশু নির্যাতন প্রতিরোধে এই হেল্পলাইন ভূমিকা রাখবে। এক সূত্র মতে, ডিসেম্বর ২০১৬ পর্যন্ত হেল্পলাইনের মাধ্যমে মোট ২ লাখ ৫১ হাজার ৬২৩ জন নারী ও শিশুকে প্রয়োজনীয় সহায়তা দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া নারী ও শিশুকে তাৎক্ষণিক সহায়তা দেয়ার জন্য প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অ্যাক্সেস টু ইনফরমেশন প্রোগ্রামের সহায়তায় স্মার্টফোনে ব্যবহারযোগ্য মোবাইল অ্যাপস ‘জয়’ তৈরি করা হয়েছে।
সাইবার হামলা হলে তাৎক্ষণিক ব্যবস্থা নিতে নতুন আইনের অধীনে সৃষ্টি করা হচ্ছে ‘বাংলাদেশ সাইবার ইমার্জেন্সি রেসপন্স টিম’ নামে বিশেষ টিম। প্রস্তাবিত আইন অনুযায়ী কমপিউটার নেটওয়ার্ক ব্যবহার করে বিদেশে বসেও অপরাধ করলে এ দেশে বিচার করা যাবে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন ২০০৬ ছাড়াও দেশে রয়েছে পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইন। পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণ আইনের ৮ ধারায় পর্নোগ্রাফি সংক্রান্ত বিভিন্ন অপরাধের শাস্তির বিধান বর্ণিত হয়েছে। এই শাস্তির পরিমাণ সর্বনিম্ন দুই বছর থেকে সর্বোচ্চ ১০ বছরের সশ্রম কারাদ- এবং এর অতিরিক্ত ১ থেকে প্রায় ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদ-। আইনের ১৩ ধারায় মিথ্যা মামলা দায়ের করার অপরাধের শাস্তিরও বিধান রয়েছে। পর্নোগ্রাফির উৎপাদন, সংরক্ষণ, বিতরণ ও প্রদর্শনের অপরাধের জন্য সাত বছরের সশ্রম কারাদ- ও ২ লাখ টাকার অর্থদ--র বিধান রয়েছে। পর্নোগ্রাফির মাধ্যমে সামাজিক বা ব্যক্তি মর্যাদার হানি করা হলে বা কাউকে মানসিকভাবে নির্যাতন করা কিংবা ইন্টারনেট, মোবাইল ফোন বা অন্য কোনো মাধ্যমে পর্নোগ্রাফি প্রচার করা হলে পাঁচ বছর পর্যন্ত সশ্রম কারাদ- ও ২ লাখ টাকা পর্যন্ত অর্থদ--র বিধান রয়েছে। পর্নোগ্রাফি প্রদর্শনের মাধ্যমে গণউপদ্রব সৃষ্টি করা হলে বা পর্নোগ্রাফির বিজ্ঞাপন প্রচার, ভাড়া প্রদান, বিতরণ ইত্যাকার অপরাধের জন্য দুই বছরের সশ্রম কারাদ-সহ ১ লাখ টাকার জরিমানার বিধান রয়েছে।
বর্তমানে দেশে পর্নোগ্রাফি নিয়ন্ত্রণের জন্য পর্যাপ্ত আইন আছে বললে অত্যুক্তি হবে না। তবে এই আইনের প্রয়োগের সক্ষমতাই হলো সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়। পুলিশের কেন্দ্রীয় পর্যায়ে ও সিআইডিতে সাইবার ক্রাইম অনুসন্ধানের জন্য যথোপযুক্ত প্রযুক্তি থাকলেও পুলিশের স্থানীয় পর্যায়ে এই অপরাধ নিয়ন্ত্রণের জন্য পর্যাপ্ত সক্ষমতা তৈরি হয়নি। তাই এই বিষয়ে থানা পুলিশের কাছে কোনো অভিযোগ এলে তারা বিব্রতবোধ করে। কারণ, সাইবার ক্রাইম সংক্রান্ত তথ্য-প্রমাণ ও আলামত সংগ্রহের জন্য থানা পুলিশের পর্যাপ্ত কারিগরি জ্ঞান, প্রশিক্ষণ, দক্ষতা ও প্রযু্ক্তি নেই। এমনকি এই বিষয়ে সংসদে পাস করা হাল আমলের আইন ও তাদের সবশেষ সংশোধনী সম্পর্কেও থানা পর্যায়ের অনেক পুলিশ কর্মকর্তা ওয়াকিফহাল নন। এমতাবস্থায় তারা প্রায়ই এই জাতীয় অপরাধের অভিযোগ এড়িয়ে যেতে চান। থানা পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা গ্রহণ না করার চিরাচরিত অভিযোগটিতে সাইবার ক্রাইম একটি নতুন মাত্রা যোগ করেছে।
সাইবার ক্রাইম হিসেবে পর্নোগ্রাফি একটি বহুল আলোচিত অপরাধ। তবে এই অপরাধের বহিঃপ্রকাশ অনেক ক্ষেত্রেই সহজে হয় না। নারী ও শিশুদের বিরুদ্ধেই এই অপরাধ বেশি সংঘটিত হয়ে থাকে। ব্যক্তিগত মান-সম্মান, পারিবারিক সম্পর্ক বিচ্ছেদের ভয় ইত্যাদি কারণে অনেক ক্ষেত্রে পর্নোগ্রাফির অপরাধ থানা পুলিশ পর্যন্ত আসে না। প্রতারণা, বস্ন্যাকমেইলিং ইত্যাদির মাধ্যমে চাঁদাবাজিসহ অনেক অপরাধ ধামাচাপা দেয়ার চেষ্টা করা হয়। কিন্তু অপরাধ গোপন করে তা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হয় না।
এমতাবস্থায় ভুক্তভোগীদের উচিত ঘটনা ঘটার পর যত দ্রুত সম্ভব পুলিশের সহায়তা নেয়া। অন্যদিকে থানা পুলিশকে এই বিষয়ে আরও সংবেদনশীল হতে হবে। স্থানীয় পর্যায়ে সাইবার ক্রাইম তথা পর্নোগ্রাফির মামলাসমূহ তদন্ত করা সম্ভব না হলে মামলা রুজু করে তা দ্রুত সিআইডিতে পাঠিয়ে দেয়া উচিত। অন্যদিকে পুলিশ হেডকোয়ার্টার্সের উচিত সারাদেশে রুজু করা সাইবার ক্রাইম সংক্রান্ত মামলাগুলোকে সহজেই সিআইডিতে স্থানান্তরের ব্যবস্থা করা। অধিকন্তু সাইবার ক্রাইম তদন্তে স্থানীয় থানা পুলিশকে সক্ষম করে তোলার জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ, কারিগরি ও প্রযুক্তিগত সুবিধাদি দেয়া
০ টি মন্তব্য