ইন্টারনেট প্রজন্মের জন্য বিজ্ঞান
ইগনাইট (ignite) শব্দটির অর্থ প্রজ্বলিত করা। বিজ্ঞান বিষয়ে পড়াশোনা কিংবা বিজ্ঞান সম্পর্কে জানার ব্যাপারে আমাদের শিক্ষার্থীদের মধ্যে আগ্রহ কমে গেছে। জাতির জন্য এটি একটি দুঃখজনক প্রবণতা, জাতিকে পিছিয়ে রাখার প্রবণতা। তাই স্বাভাবিক তাগিদ হচ্ছে, তাদের মধ্যে বিজ্ঞান নিয়ে আগ্রহ বাড়িয়ে দিতে হবে। তাদের ভেতরের জ্ঞানের আলো প্রজ্বলিত করে দিতে হবে। এ উদ্দেশ্যকে সামনে রেখেই শুরু হচ্ছে বিজ্ঞানবিষয়ক প্রতিযোগিতা ‘ইগনাইট’। যৌথভাবে এ প্রতিযোগিতার আয়োজন করছে ডেইলি স্টার ও গ্রামীণফোন।
এ দুটি প্রতিষ্ঠানের প্রতিনিধিদের উপস্থিতিতে গত ২৮ ডিসেম্বর এক সংবাদ সম্মেলনে এ প্রতিযোগিতার আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন ঘোষণা করা হয়। ‘ইন্টারনেট প্রজন্মের জন্য বিজ্ঞান’-স্লোগানকে সামনে রেখে এ প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত হবে। ঢাকা, চট্টগ্রাম ও সিলেট বিভাগের ৭৫টি স্কুলের ষষ্ঠ থেকে দশম শ্রেণীর দুই লাখ শিক্ষার্থী এ প্রতিযোগিতায় অংশ নেবে। আমরা মনে করি, আমাদের শিক্ষার্থীদের বিজ্ঞান নিয়ে আগ্রহী করে তুলতে এ প্রতিযোগিতা এক গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। এ প্রতিযোগিতার সার্বিক সাফল্য কামনা করি ও আন্তরিক মোবারকবাদ জানাই এর আয়োজক দুই প্রতিষ্ঠানকে।
বিজ্ঞানকে যদি বলি মা, তবে প্রযুক্তিকে বলতে হবে সে মায়ের সমত্মান। বিজ্ঞানের প্রায়োগিক দিক হচ্ছে প্রযুক্তি। কারণ, বিজ্ঞানের ওপর ভিত্তি করেই প্রযুক্তির উদ্ভাবন। প্রযুক্তি হচ্ছে বিজ্ঞানের কমার্শিয়াল আর্ম, তথা বাণিজ্যিক শাখা। তাই যদি হয়, তবে বিজ্ঞানকে এড়িয়ে প্রযুক্তিকে সামনে এগিয়ে নেয়া যায় না। কিন্তু আমরা দুঃখের সাথে লক্ষও করেছি, আমাদের জাতীয় ও সামাজিক জীবনে বিজ্ঞানের প্রতি চরম অবহেলা করে প্রযুক্তিতে সমৃদ্ধি অর্জনের ব্যর্থ চেষ্টার এক আত্তঘাতী প্রবণতায় আমরা ডুবে আছি। ফলে বিজ্ঞান কিংবা প্রযুক্তিতে, আরও স্পষ্ট করে বললে বলতে হয় আইসিটিতে কার্যকর বা অর্থবহ অগ্রগতি নেই। বর্তমান সরকারি দল পাঁচ বছর আগে ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার নির্বাচনী প্রতিশ্রুতি দিয়ে ক্ষমতায় আসে। এর লক্ষ্য তথ্যপ্রযুক্তিকে হাতিয়ার করে সমৃদ্ধতর দেশে রূপ দিয়ে দেশকে সার্বিকভাবে শক্ত অবস্থানে নিয়ে যাওয়া। কিন্তু মোবাইল ডিভাইসের কতিপয় প্রয়োগ ছাড়া প্রযুক্তির উদ্ভাবনা তেমন ঘটেছে বলে মনে হয় না। বাস্তবতা হচ্ছে, আইসিটির ক্ষেত্রে আমরা এখনও থেকে গেছি প্রধানত একটি ভেন্ডর জাতি। হতে পারিনি উদ্ভাবক জাতি। ফলে বাইরে থেকে আমরা প্রযুক্তি কিনে এনে তা ব্যবহার করেই তৃপ্ত হচ্ছি। এভাবে কোনো জাতি কখনই তথ্যপ্রযুক্তিসমৃদ্ধ একটি জাতি হিসেবে প্রতিষ্ঠা পেতে পারে না। সে পর্যায়ে পৌঁছাতে হলে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির গবেষণাকর্মে আমাদের বিনিয়োগ বাড়াতে হবে বহুগুণে। আর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি অবকাঠামো খাতের প্রতিও সমধিক মনোযোগী হতে হবে। অথচ আমাদের বছরের পর বছর শুনতে হয়-তহবিলের অভাবে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো গড়ে উঠছে না, বাস্তবতা হচ্ছে না কালিয়াকৈর আইটি পার্কসহ বহুল আলোচিত অনেক আইসিটি প্রকল্প।
সবচেয়ে দুঃখজনক বিষয়, আজ আমরা বিশুদ্ধ বিজ্ঞান (পদার্থ, রসায়ন, গণিত ইত্যাদি) বিষয়ে পড়াশোনা করার ব্যাপারে আমাদের সমত্মানদের আগ্রহী করে তোলার ব্যাপারে চরম অনীহ হয়ে পড়েছি। এসব ক্ষেত্রে শিক্ষার্থীদের আগ্রহ ফিরিয়ে আনার ব্যাপারে যেসব প্রণোদনা দেয়া দরকার, সে ব্যাপারে মনোযোগ নেই। এসব পড়লে কর্মসংস্থানের সুযোগ সীমিত হয়ে পড়ে বলে আজ এসব বিষয়ে পড়তে চায় না শিক্ষার্থীরা। অতএব বিশেষ প্রণোদনা না দিলে এবং বিশুদ্ধ বিজ্ঞানের ওপর গবেষণার সুযোগ সৃষ্টি না করলে বিজ্ঞান বিষয়ে শিক্ষার্থীদের আগ্রহী করে তোলা যাবে না। আবিষ্কার-উদ্ভাবনায় তখন আমাদের উপস্থিতিও ঘটবে না। আমরা এ ক্ষেত্রে থেকে যাব অন্যদের ওপর নির্ভরশীল। তখন ভিনদেশের আবিষ্কৃত-উদ্ভাবিত যন্ত্র ও পণ্য কিনেই আমাদের চলতে হবে বরাবর। এ পথে বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিতে কোনো দিন আমাদের সমৃদ্ধি আসবে না।
আমরা বর্তমান সরকারের প্রতিশ্রুতি ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ আর ‘রূপকল্প ২০২১’ বিষয়যুগল বহুল আলোচিত হতে দেখেছি। সম্প্রতি দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে সামনে রেখে আওয়ামী লীগের ঘোষিত নির্বাচনী ইশতেহারে ‘রূপকল্প ২০২১’-কে ২০৪১ সালে সম্প্রসারিত করার কথা বলা হয়েছে। দেয়া হয়েছে উন্নয়নের নানা বায়বীয় প্রতিশ্রুতি। এসব উন্নয়ন উদ্যোগে অর্থ কোথা থেকে আসবে, তার কোনো দিকনির্দেশনা নেই। তবে সার কথা হচ্ছে- আমরা যত কথাই বলি, বিশুদ্ধ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ওপর যতদিন আমরা মৌলিক নজর না দেব, ততদিন আমাদের সমৃদ্ধি আসবে না। কাটবে না পরনির্ভরতা।
বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ক্ষেত্রে আবিষ্কার-উদ্ভাবনের কাজটি যখন কার্যত আমরা শুরুও করতে পারিনি, তখন অন্য দেশের মানুষ তৈরি হচ্ছে মঙ্গলে গিয়ে বসবাসের জন্য। মঙ্গলের ডাক পেয়েছে মানুষ। যে দুটি মহাকাশযানে মানুষ মঙ্গলে যাবে, সেগুলোর পরীক্ষামূলক ব্যবহার শুরু হতে যাচ্ছে আগামী বছরের শুরুতেই। অভিযান হবে একমুখী। এসব যান আর পৃথিবীতে ফিরে আসবে না। অভিযাত্রীদের সারাজীবন থাকতে হবে মঙ্গলেই। দুটি অভিযানের একটি হচ্ছে সরকারিভাবে, অপরটি বেসরকারি অর্থায়নে। তবে এসব অভিযানের লক্ষ্য একটাই- মঙ্গলের মাটিতে মানুষের বসবাস। অন্য দেশের মানুষ যখন এই পর্যায়ে, তখন আমরা একটি সর্বসম্মত নির্বাচনী প্রক্রিয়া উদ্ভাবনে ব্যর্থ। বিজ্ঞান আর প্রযুক্তি উদ্ভাবনা সে তো অনেক দূরের কথা।
সময়ের রথে চড়ে আমরা আরেকটি নতুন ইংরেজি বছরে। আমাদের প্রত্যাশা- নতুন এ বছরটি আমাদের সবার মধ্যে নিয়ে আসুক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তিমুখিন এক নতুন উপলব্ধি। সে উপলব্ধি আমাদেরকে আগ্রহী করে তুলুক বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি সম্পর্কে। ‘ইগনাইট’ প্রতিযোগিতা এ ক্ষেত্রে ইতিবাচক ভূমিকাই পালন করবে। তাই আবারও ধন্যবাদ জানাই ডেইলি স্টার ও গ্রামীণফোনকে। শিক্ষার্থীদের মধ্যে বিজ্ঞানের প্রতি আগ্রহ সৃষ্টি করে তাদের ভেতরের আগুন জ্বালিয়ে তোলার লক্ষ্য বিজ্ঞানবিষয়ক প্রতিযোগিতামূলক অনুষ্ঠান ‘ইগনাইট’ চালু করার জন্য, যা চলবে ‘ইন্টারনেট প্রজন্মের জন্য বিজ্ঞান’ স্লোগানকে সামনে রেখে।
০ টি মন্তব্য