https://www.brandellaltd.com/

ইন্টারনেট

প্রযুক্তির আসক্তিতে ধ্বংসের মুখে তরুণ প্রজন্ম

প্রযুক্তির আসক্তিতে ধ্বংসের মুখে তরুণ প্রজন্ম প্রযুক্তির আসক্তিতে ধ্বংসের মুখে তরুণ প্রজন্ম
 

প্রযুক্তির আসক্তিতে ধ্বংসের মুখে তরুণ প্রজন্ম


প্রযুক্তির আশীর্বাদে সভ্যতা হয়ে উঠেছে উন্নত থেকে উন্নততর, যোগাযোগমাধ্যমে ঘটেছে এক অবিস্মরণীয় বিপ্লব। ইন্টারনেট, কমপিউটার, ল্যাপটপ, স্মার্টফোন, আকাশ, ডিসলাইন, ভিডিও প্রভৃতির কারণে পৃথিবী এখন মানুষের হাতের মুঠোয়। তবে খুবই কম বাজেটে সবচেয়ে বেশি সুবিধা দিতে পারে মোবাইল ফোন, যার মূল্যটা সবার সাধ্যের মধ্যেই থাকে। মোবাইল এখন শুধু কথা বলার যন্ত্র হিসেবে সীমাবদ্ধ নেই বরং ইন্টারনেট ব্রাউজিং, চ্যাটিং, অডিও, ভিডিও, গেমিংসহ প্রায় সকল প্রকার সুবিধার কারণে তরুণ-তরুণীদের অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। বিশেষ করে বিশ্ববিদ্যালয় ও স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের ঝোঁকটা একটু বেশিই। যুগের সাথে তাল মেলাতে গিয়ে প্রয়োজনে বা অপ্রয়োজনে একপ্রকার বাধ্য হয়েই অভিভাবকরা অপ্রাপ্তবয়স্ক সন্তানদের হাতে তুলে দিচ্ছে এই মোবাইল নামক যন্ত্র, আর সন্তানরা এই ছোট্ট যন্ত্রের অপব্যবহারে ধ্বংস করে ফেলেছে নিজেদের নৈতিকতা এবং হয়ে উঠছে বেপরোয়া।


গবেষণায় দেখা গেছে বয়ঃসন্ধিকালে তরুণ-তরুণীরা প্রেম নামক প্রতারণার ফাঁদে পা দিচ্ছে, কেউ কেউ মোবাইলে কথা বলে ঘণ্টার পর ঘণ্টা এমনকি সারা রাত পার করে দিচ্ছে, কেউ পড়াশোনা ফাঁকি দিয়ে চ্যাটিং করছে অথবা ক্লাসে শেষ বেঞ্চে বসে শিক্ষকের চোখ ফাঁকি দিয়ে মোবাইলের অপব্যবহার করছে।


তবে যুবসমাজ ধ্বংসের সবচেয়ে ভয়ংকর ফাঁদ হলো পর্নোগ্রাফি। ১৪-২২ বছরের কিশোর-কিশোরী বা স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থীদের বড় একটা অংশ জড়িয়ে পড়ছে এই মোবাইল পর্নোগ্রাফি বা ব্লু ফিল্মের আসক্তিতে। ইন্টারনেটের সুবাদে এবং বিভিন্ন অলিতে-গলিতে গড়ে ওঠা মোবাইল সার্ভিসের দোকান থেকে মেমোরিতে গান লোড করার নামে খুবই সহজে এবং অল্প টাকায় লোড করে নিচ্ছে এসব অশ্লীল ভিডিও। আর এসব নগ্ন ভিডিও একসাথে দল বেঁধে দেখছে তরুণরা এবং ব্লুটুথের মাধ্যমে একে অপরকে শেয়ার করছে ত্রাণসামগ্রীর মতো, যা একপর্যায়ে ছড়িয়ে পড়ছে সমাজের প্রতিটি কোনায় কোনায়।


তবে এটি শুধু ছেলেদের মাঝে সীমাবদ্ধ থাকছে তা নয় বরং মেয়েদের একটা বড় অংশ জড়িয়ে পড়ছে এই আসক্তিতে। ২০১৭ সালে ‘মানুষের জন্য ফাউন্ডেশন’ নামক এক সংস্থার জরিপে দেখা গেছে অষ্টম-দ্বাদশ শ্রেণিতে পড়ুয়াদের মধ্যে ৭৭ শতাংশ শিক্ষার্থী পর্নোগ্রাফিতে আসক্ত, তারা পর্নোগ্রাফি ছবি, অডিও, ভিডিও এবং টেক্সট আকারে ব্যবহার করে। অন্য একটা জরিপের ফলোআপে দেখা যায়, নিয়মিত পর্নোগ্রাফি দেখে ৯০ শতাংশ। এসব কাজ করতে গিয়ে যেমন কথা বলা, মেমোরি লোড দেওয়া, অথবা ডাটা প্যাক কেনার টাকা জোগাতে তরুণ প্রজন্ম পা বাড়াচ্ছে অবৈধপথে। ফলে খুব অল্প বয়সেই ছেলেমেয়েদের মধ্যে বৃদ্ধি পাচ্ছে যৌন চাহিদা এবং বাড়ছে ধর্ষণ, যৌন হয়রানি, ব্ল্যাকমেইল, অপহরণসহ বিভিন্ন অসামাজিক কার্যকলাপ। বর্তমান সময়ে আরেকটি অভিশাপ তরুণ প্রজন্মকে ধ্বংস করে দিচ্ছে, যার নাম অনলাইন গেমিং ও টিকটক আসক্তি। এই আসক্তি যুবসমাজকে এমনভাবে টানছে, যেন তাদের খাদ্য না দিলেও থাকতে পারবে কিন্তু মোবাইল আর ইন্টারনেট ছাড়া বাঁচতেই পারবে না। অভিভাবকদের সহায়তায় যুক্তরাষ্ট্রের কমনসেন্স মিডিয়া নামক সংস্থা একাধিক কিশোর-কিশোরীর ওপর গবেষণা করে দেখে প্রায় ৫৯ শতাংশ কিশোর-কিশোরী ইন্টারনেটে আসক্ত। নেটে আসক্তির শিকার ২২ বছরের অষবী বলেন এটি মাদকাসক্তির মতো স্পষ্ট নয় কিন্তু তার থেকেও ভয়ংকর।


এ ছাড়া বিশেষ করে ইন্টারনেট ও গেমিংয়ে আসক্ত স্কুল-কলেজের শিক্ষার্থী ও যুব সম্প্রদায়, পাবজি-ফ্রি ফায়ার, ফেসবুক, ইন্টারনেট, মেসেঞ্জার, টিকটকেই এখন তাদের ব্যস্ত সময় কাটে। বিভিন্ন দোকান, মোড় ও শহরের অলিগলিতে ব্রডব্যান্ড লাইন, ফ্রি ওয়াই-ফাই, বিভিন্ন ইন্টারনেট প্যাকেজ কিনে নাওয়া-খাওয়া বাদ দিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ে ছাত্র ও যুবসম্প্রদায়। অভিভাবক, এলাকার মুরব্বি, শিক্ষক, বড় ভাই কারও কথায় তারা কর্ণপাত করে না। সেই সকাল থেকে শুরু করে গভীর রাত পর্যন্ত চলে তাদের এ ব্যস্ততা। দুপুরে কোনোরকম গোসল করে, কেউ খেয়ে আবার কেউ না খেয়েই বসে পড়ে গেম আসরে।


বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থা এই অনলাইন গেম, মোবাইল ফোন, কমপিউটার বা ভিডিও গেমের ক্ষতিকর ব্যবহারকে রোগ হিসেবে চিহ্নিত করেছে। এর আগে ২০১৩ সালে (ডিএসএম-৫) বিষয়টিকে ‘ইন্টারনেট গেমিং ডিজঅর্ডার’ হিসেবে উল্লেখ করেছে।


বিশ্বজুড়ে প্রকাশিত ১৬টি গবেষণায় দেখা গেছে তরুণ প্রজন্মের ৪.৬ শতাংশ গেমিংয়ে আসক্ত, যার মধ্যে ৬.৮ শতাংশ কিশোর এবং ১.৩ শতাংশ কিশোরী। (জেওয়াই ফ্যাম ২০১৮)


অন্যদিকে ভাইরাল হওয়ার প্রবণতায় ঝুঁকে পড়ছে তরুণ সমাজ। রাতারাতি জনপ্রিয় হতে টিকটক, লাইকি বেছে নিচ্ছে অনেকেই। টিকটককে কেন্দ্র করে সংসার ভাঙছে, আত্মহত্যার ঘটনা ঘটছে অহরহ, এমনকি ঘটেছে হত্যাকাণ্ডও। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এই টিকটক ভিডিও এক ধরনের নেশা। এই নেশা কোনো কোনো ক্ষেত্রে মাদকের চেয়ে ভয়াবহ। ভার্চুয়াল এই নেশায় আক্রান্ত হয়ে অনেকেই নানা অপরাধমূলক কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে যাচ্ছে। তবে এক্ষেত্রে বিপথে যাচ্ছে তরুণ-তরুণীদের সিংহভাগ। তাদের কেউ কেউ বিশেষ মুহূর্ত ধারণ করে আপলোড করছে না বুঝেই, ফলে ছড়িয়ে পড়ছে নেতিবাচক প্রভাব।


তরুণ বয়সে যেখানে আত্মবিশ্বাস, সুচিন্তা, নৈতিকতা, পরিশীল ও গবেষণামূলক মনমানসিকতা গড়ে তোলা দরকার, সেখানে এসব পর্নোগ্রাফি, ইন্টারনেট, গেমিং, টিকটক আসক্তির মাধ্যমে শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হয়ে পড়ছে যুবসমাজ, পড়াশোনা ও সুন্দর ক্যারিয়ার থেকে বিচ্যুত হয়ে জড়িয়ে পড়ছে মাদকসেবীদের দলে, বিকৃত রুচির চর্চা, সামাজিক লাজলজ্জা পরিহার করে তরুণ-তরুণীরা অবাধ মেলামেশার উগ্র আধুনিকতায় মিশে দূষিত করে তুলেছে এই সুশীল সমাজটাকে। অতিরঞ্জিত আধুনিকতা ও কু-সংস্কৃতির চক্রে পড়ে রাত-বিরাতে জনসম্মুখ কিংবা নাইট ক্লাবে তারা অবাধে মেলামেশাটাকে বৈধ মনে করছে। মোবাইল, ল্যাপটপ, ট্যাব, ইন্টারনেট আসক্তির মাত্রা দিন দিন বেড়েই চলেছে, যার প্রভাবে তরুণ প্রজন্ম অনিদ্রা, অপুষ্টি, খর্বদেহ, মেধাশূন্যতাসহ নানা রকম জটিল রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। তাদের মেধা বিকাশ ও চিন্তার পরিধি সঙ্কুচিত হয়ে আসছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে রুচিশীল চিন্তার বিপরীতে জৈবিক চাহিদাগত চিন্তার মাত্রা ও বাস্তবায়ন কৌশল নির্ণয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়েছে বেশি। চিকিৎসক ও মনোবিজ্ঞানীদের মতে এসব আসক্তির কারণে তরুণরা শারীরিক ও মানসিক অবসাদগ্রস্ত হয়ে পড়ে, একপর্যায়ে অতি আক্রমণাত্মক, বদমেজাজি ও খিটখিটে করে তোলে। মা-বাবা, আত্মীয়স্বজন, শিক্ষকদের সাথে তৈরি হয় দূরত্ব, হতাশায় ডুবে গিয়ে মেধাশূন্য হয়ে পড়ে, তারুণ্যসম্পদ একপর্যায়ে হয়ে ওঠে হুমকিস্বরূপ। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাজকল্যাণ ও গবেষণা ইনস্টিটিউটের সহকারী অধ্যাপক ও সমাজ অপরাধ গবেষক তৌহিদুল হক বলেন, এই ডিজিটাল আসক্তির কারণে আগামী দিনে দেশ নেতৃত্বশূন্যতায় ভুগতে পারে। তাই ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে নেতিবাচক প্রভাবগুলো থেকে শিক্ষা নিয়ে এসব আসক্তি থেকে দূরে থাকার জন্য পরিবারের সচেতনতা তৈরি করতে হবে, তথ্যপ্রযুক্তি ডিজিটাল সিকিউরিটি আইন সম্পর্কে সচেতনতা তৈরি করতে হবে এবং আধুনিকতার নামে প্রযুক্তির অপব্যবহার না করে ধর্মীয় দিকগুলোর প্রতি আগ্রহ বাড়াতে পারলেই মিলবে মুক্তির মঞ্জিল।








০ টি মন্তব্য



মতামত দিন

আপনি লগ ইন অবস্থায় নেই।
আপনার মতামতটি দেওয়ার জন্য লগ ইন করুন। যদি রেজিষ্ট্রেশন করা না থাকে প্রথমে রেজিষ্ট্রেশন করুন।







পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন? পুনরায় রিসেট করুন






রিভিউ

আপনি লগ ইন অবস্থায় নেই।
আপনার রিভিউ দেওয়ার জন্য লগ ইন করুন। যদি রেজিষ্ট্রেশন করা না থাকে প্রথমে রেজিষ্ট্রেশন করুন।