মানুষের চিন্তাও এখন নিয়ন্ত্রণ করা যাবে
কেমন হতো আপনি যদি আপনার মেন্টাল অ্যাপটিচ্যুড (অর্জিত স্বাভাবিক মানসিক ক্ষমতা) ও মেন্টাল পারফরম্যান্স (মানসিক কর্মসাফল্য) বাড়িয়ে নিতে পারতেন। অন্য কথায় বাড়িয়ে নিতে পারতেন আপনার মানসিক বা চিন্তাভাবনার ক্ষমতা। এর জন্য প্রয়োজন মস্তিষ্কের সুনির্দিষ্ট কিছু অংশের স্টিমুলেশন বা উদ্দীপ্ত করে তোলা। সে কাজটি করা সম্ভব হলে মানুষের চিন্তাভাবনা নিয়ন্ত্রণ করা সম্ভব হবে। আর বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল গবেষক তাদের গবেষণার মাধ্যমে জানতে চেয়েছিলেন, ব্রেন স্টিমুলেশনের সে কাজটি কীভাবে করা যায়। আর সে কাজে এরা সফলতা পেয়েছেন। এরা পরীক্ষামূলক একটি পদ্ধতি বের করতে সক্ষম হয়েছেন। এই পদ্ধতি কাজে লাগিয়ে আপনার-আমার মস্তিষ্কের অংশবিশেষ স্টিমুলেশন করে আমাদের চিন্তাভাবনা কিংবা চিন্তাভাবনার ধরন এরা পাল্টে দিতে পারবেন। পাল্টে দিতে পারবেন আপনার আচরণও।
গবেষণার মাধ্যমে বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের এই গবেষক দলের গবেষকেরা মানুেষর মানসিক চিন্তার ক্ষমতা বাড়িয়ে তোলার সম্ভাবনা উদঘাটন করেছেন। বাড়িয়ে তুলতে পারবেন শেখার ক্ষমতাও। সেই সাথে এরা বলছেন, এর মাধ্যমে এরা মানুেষর আচরণ নিয়ন্ত্রন করতেও সক্ষম হবেন। এই গবেষক দলের একজন হচ্ছেন রবার্ট রিনহার্ট। তিনি এই কাজটি করতে গিয়ে মস্তিষ্কের দুটি অংশে ‘টারবুচাজর্’ করতে ব্যবহার করেছেন এক নতুন ধরনের বেন্র স্টিমুেলটর। এর নাম high-definition transcranial alternating current stimulation (HD-tACS)। মস্তিষ্কের এই দুিট অংশের প্রভাব রয়েছে আমরা কীভাবে শিখি, তার ওপর। রিনহার্ট বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের রিসার্চ প্রেস রিলিজে উল্লেখ্য করেন ‘আমরা যদি কোনো ভুল করি, তখন এই ব্রেন এরিয়া উজ্জীবিত হয়। আমি যখন আপনাকে বলি, আপনি ভুল করেছেন, তখনও এটি উজ্জীবিত হয়। যদি কোনো কিছু আপনাকে অবাক করে, সে সময়ও এই অংশটি উজ্জীবিত হয়।’ রবার্ট রিনহার্ট মস্তিষ্কেরও ‘মেডিয়াল করটেক্স’ অংশটির কথা উল্লেখ্য করে এটিকে ‘ব্রেন নর অ্যালার্ম বেল’ নামে অভিহিত করেছেন।
রিনহার্ট ও তার সহকর্মীরা জানতে পেরেছেন, মস্তিষ্কের এই রিজিয়ন বা এলাকাটি এবং একই সাথে লেটারাল প্রিফ্রন্টাল করটেক্স অংশটি স্টিমুলেট করে মানুষের শেখার ধরন পরিবর্তন করা যায়। তিনি বলেন, মস্তিষ্কের এই দুটি অংশ সংশ্লিষ্ট রয়েছে মানুষের এক্সিকিউটিভ ফাঙ্কশন ও সেলফ-কন্ট্রোলের সাথে। Proceedings of the National Academy of Sciences (PNAS)-এর জার্নালে প্রকাশিত এক সমীক্ষায় রবার্ট রিনহার্টের গবেষক দল বর্ণনা দিয়েছে, কী করে HD-tACS ব্যবহার করে ইলেকট্রিক্যাল স্টিমুলেশন প্রয়োগ করে দ্রুত ও বারবার বাড়ানো বা কমানো যাবে একজন সুস্থ মানুষের এক্সিকিউটিভ ফাঙ্কশন, যার ফলে একজন মানুষের আচরণ বদলে যাবে।
স্মার্ট চেঞ্জ
রবার্ট রিনহার্টের টিম পরীক্ষা চালিয়েছে ৩০ জন সুস্থ মানুষের ওপর। এরা প্রত্যেকেই মাথায় পরিধান করেছেন ইলেকট্রোডসহ একটি সফট ক্যাপ, যা স্টিমুলেশন সৃষ্টি করে। তাদের টেস্টটি ছিল সরল প্রত্যেক ব্যক্তিকে একটি বোতাম চাপতে হয়েছে প্রতি ১.৭ সেকেন্ড পরপর। এই টেস্টে প্রথম তিন রাউন্ডে গবেষকেরা হয় ক্র্যাঙ্ক ঘুরিয়ে দুটি লোবের মধ্যে সিনক্রোসিটি স্টার্ট দিয়েছেন, অথবা কিছুই করেননি। এ সময় সমীক্ষায় অংশ নেয়া ব্যক্তিদের মস্তিষ্কের কর্মকান্ড মনিটর করা হয়েছে electroenic epha logr am (EEG) দিয়ে। এতে ধরা পড়ে পরিসংখ্যানগত উল্লেখযোগ্য ফলাফল। যখন মস্তিষ্ক তরঙ্গ বাড়ানো হয়, তখন সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি শিখতে পারেন দ্রুত এবং ভুল করেন কম। আর তাদের করা ভুল এরা আচমকা বা অপ্রত্যাশিতভাবে সংশোধন করে নেন। যখন মস্তিষ্কের তরঙ্গ বাধাগ্রস্ত করা হয়, তখন এরা ভুল করেন বেশি এবং শেখেন ধীরগতিতে।
তারচেয়েও বেশি অবাক করা ব্যাপার হলো, সমীক্ষায় অংশ নেয়া নতুন ৩০ জন অংশ নেন একটি সাযুজ্যকৃত সংস্করণের টেস্টে। শুরুতে এই গ্রুপটির লোকদের মস্তিষ্কের কর্মকান্ড বাধার মুখে পড়ে। এরপর তাদের কর্মকান্ডের মাঝখানে ব্রেন স্টিমুলেশন দেয়া হয়। তখন দ্রুত এরা ফিরে পান তাদের আসল মস্তিষ্ক সিনক্রোসিটি লেভেল ও লার্নিং বিহেভিয়ার। গবেষকেরা অবাক হলেন, কত দ্রুত মস্তিষ্কে স্টিমুলেশনের প্রভাব ফিরিয়ে আনা যায় তা দেখে।
তাদের এই সমীক্ষা থেকে আরো অনেক কিছুই জানা ও শেখার এখনও বাকি। আসলে বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ের এই গবেষক দল হচ্ছে প্রথম গবেষক দল, যারা চিহ্নিত করেছে ও টেস্ট করেছে কী করে মেডিয়াল ফ্রন্টাল করটেক্স ও লেটারেল প্রিফ্রন্টাল করটেক্সের লাখ লাখ সেল পরস্পরের সাথে যোগাযোগ গড়ে তোলে লো ফ্রিকুয়েন্সির ব্রেন ওয়েভের মাধ্যমে। ‘এই বিজ্ঞানটি আগের জানা বিজ্ঞানের চেয়ে আরো নির্ভুল ও যথাযথ’ এ মন্তব্য বোস্টন বিশ্ববিদ্যালয়ে মস্তিষ্ক ও মনস্তত্ত¡বিজ্ঞানের অধ্যাপক ডেভিড সোনার্সের, যিনি এই সমীক্ষায় সংশ্লিষ্ট ছিলেন না।
সবচেয়ে বড় প্রশ্নটির কথা উল্লেখ করেছেন ডেভিড সোনার্স। তার প্রশ্ন হচ্ছে, মানুষ এই ধরনের একটি প্রযুক্তি নিয়ে কতদূর এগিয়ে যেতে পারবে তাদের ক্ষেত্রে, যারা চাইবে না তাদের ব্রেনকে অধিকতর সচেতন করে তুলতে? এটি একই ধরনের প্রভাব ফেলতে পারে, যেমনটি ফেলেছিল nootropics বা smart drugs। কিন্তু তাদের উদ্ভাবিত এই ব্রেন স্টিমুলেশন পদ্ধতি এই ওষুধের চেয়ে কম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া সৃষ্টি করবে। কারণ, এখানে ব্রেন স্টিমুলেশনের কাজটি চলে সরাসরি। এ ধরনের প্রযুক্তিতে প্রবেশ কাজ করতে পারে একটি গেম চেঞ্জার হিসেবে। কিন্তু যেখানে রয়েছে স্মার্ট ড্রাগ, সেখানে প্রশ্ন হচ্ছে, কারা আগ্রহী হবে এই প্রযুক্তিতে প্রবেশের।
০ টি মন্তব্য