একবিংশ শতাব্দীর এ পৃথিবীতে মাথা উঁচু করে বিশ্বদরবারে দাঁড়াতে চাইলে জ্ঞানভিত্তিক সমাজ গঠন তথা জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতির কোনো বিকল্প নেই। বাংলাদেশের মতো একটি জনবহুল দেশের জন্য এটি আরও গুরুত্বপূর্ণ। বর্তমান এ তথ্যপ্রযুক্তির যুগে জ্ঞানের ভিত্তিতেই কেবল এই বিপুল জনগোষ্ঠীকে একটি উৎপাদনশীল জনশক্তিতে রূপান্তর করা সম্ভব। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দেখানো পথ দিয়ে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনার রাষ্ট্র পরিচালনা, নেতৃত্বের দক্ষতা, মানবিকতায় শুধু বাংলাদেশ নয়, সারা বিশ্বেই প্রতিষ্ঠিত। ডিজিটাল বাংলাদেশ ছিলো প্রধানমন্ত্রীর একটি স্বপ্নের নাম; বঙ্গবন্ধুর স্বপ্নের সোনার বাংলার আধুনিক রূপ।
তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি ব্যবহার করে সব সুবিধা আজ আমাদের হাতের নাগালে। তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তিতে আমাদের এ অবস্থানে পৌঁছানোর পথ খুব সহজ ছিল না। ২০০৮ সালের ১২ ডিসেম্বর প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা যখন রূপকল্প ২০২১ তথা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ার প্রত্যয় ব্যক্ত করেন, ঘোষণা দেন রূপকল্প ২০২১—এর, সে সময় তথ্যপ্রযুক্তিতে আমাদের দেশের অবস্থান ছিল পেছনের সারিতে। ওই সময়ে ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার এ প্রস্তাবনা ছিল এক যুগান্তকারী পদক্ষেপ।
ডিজিটাল বাংলাদেশ মূলত জ্ঞানভিত্তিক সমাজ প্রতিষ্ঠার প্রথম সোপান। ডিজিটাল প্রযুক্তির বহুমাত্রিক ব্যবহারের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ ইতোমধ্যে অন্তর্ভুক্তিমূলক উন্নয়ন সূচকে শক্ত অবস্থানে পৌঁছেছে। একাত্তরে মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের জন্য যে সমৃদ্ধ ও উন্নত জীবন প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছিলেন, ডিজিটাল বাংলাদেশ তার সেই স্বপ্ন পূরণ করেছে।
সারা বিশ্ব এ মুহূর্তে একটি প্রযুক্তিগত এক বিপ্লবের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে, যাকে আমরা বলছি চতুর্থ শিল্পবিপ্লব। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের উদ্দেশ্যই হচ্ছে মানুষের জীবনমানকে আরও সহজতর করা। এর ফলে আমাদের জীবনযাত্রা এবং পরস্পরের সঙ্গে যোগাযোগের পথ ও পদ্ধতিগুলো মৌলিকভাবে পরিবর্তিত হচ্ছে। ধীরে ধীরে আমাদের দৈনন্দিন জীবনযাত্রার সবকিছুই ইন্টারনেট ও ইন্টারনেটকেন্দ্রিক স্মার্ট ডিভাইসের সঙ্গে যুক্ত হচ্ছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের ছোঁয়া শুধুমাত্র প্রযুক্তি ক্ষেত্রে নয়, আমাদের জীবনধারণের সব ক্ষেত্রকেই পরিবর্তন করে দিচ্ছে।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি ও উদ্ভাবনী বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে বর্তমান সরকারের আর একটি সময়োপযোগী পরিকল্পনা হলো ‘স্মার্ট বাংলাদেশ ২০৪১’ রূপকল্প। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার সভাপতিত্বে অনুষ্ঠিত ডিজিটাল বাংলাদেশ টাস্কফোর্সের সভায় ‘স্মার্ট বাংলাদেশ ২০৪১’ রূপকল্পের সিদ্ধান্ত গৃহীত হয়। একই বছরের ১২ ডিসেম্বর ডিজিটাল বাংলাদেশ দিবসে মাননীয় প্রধানমন্ত্রী ঘোষণা দেন, ২০৪১ সালের মধ্যে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ বিনির্মাণের, যার মূল স্তম্ভ হবে চারটি— স্মার্ট নাগরিক, স্মার্ট সরকার, স্মার্ট অর্থনীতি ও স্মার্ট সমাজ।
চতুর্থ শিল্পবিপ্লব ও স্মার্ট বাংলাদেশবান্ধব পরিকল্পনা, নীতি ও কৌশল গ্রহণে ডিজিটাল বাংলাদেশের উদ্যোগগুলোকে স্মার্ট বাংলাদেশের উদ্যোগের সঙ্গে সমন্বিত করা হচ্ছে। ‘স্মার্ট বাংলাদেশ : আইসিটি মাস্টারপ্ল্যান ২০৪১’ তৈরির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে, যেখানে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, রোবটিকস, মেশিন লার্নিং, ইন্টারনেট অব থিংস, ব্লকচেইন, ন্যানোটেকনোলজি, থ্রিডি প্রিন্টিংয়ের মতো আধুনিক ও নতুন নতুন প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে জ্বালানি, স্বাস্থ্যসেবা, যোগাযোগ, কৃষি, শিক্ষা, বাণিজ্য, পরিবহন, পরিবেশ, অর্থনীতি, গভন্যর্ান্সসহ বিভিন্ন খাত অধিকতর দক্ষতার সঙ্গে পরিচালনা করা হবে। স্মার্ট বাংলাদেশ ২০৪১ রূপকল্পের কর্মপরিকল্পনায় স্থান পাচ্ছে তারুণ্যের মেধা, উদ্ভাবন ও সৃজনশীলতার বিকাশ এবং আধুনিক প্রযুক্তিতে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির মাধ্যমে জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি গড়ে তোলা এবং উদ্ভাবনী জাতি গঠন। চারটি মূল ভিত্তির ওপর নির্ভর করে ২০৪১ সাল নাগাদ আমরা একটি সাশ্রয়ী, টেকসই, বুদ্ধিদীপ্ত, জ্ঞানভিত্তিক, উদ্ভাবনী স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সক্ষম হব।
স্মার্ট বাংলাদেশের রূপরেখা সর্বত্র প্রযুক্তিনির্ভর। স্মার্ট বাংলাদেশ ২০৪১ বাস্তবায়নে সরকার ইতোমধ্যে বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত গ্রহণ করেছে, যার মধ্যে অন্যতম সিদ্ধান্ত হলো— ডিজিটাল ইনক্লুশন ফর ভালনারেবল এক্সেপশন (ডাইভ)—এর আওতায় আত্মকর্মসংস্থান ভিত্তিক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম গ্রহণ; ‘ওয়ান স্টুডেন্ট, ওয়ান ল্যাপটপ, ওয়ান ড্রিম’—এর আওতায় শিক্ষার্থীদের অনলাইন শিক্ষাকার্যক্রম নিশ্চিত করা; স্মার্ট সরকার গড়ে তুলতে ডিজিটাল লিডারশিপ একাডেমি স্থাপন। রোবটিক্স ও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার এ যুগে আমাদের সামনে অনেক বড় চ্যালেঞ্জ রয়েছে, এতে কোনো সন্দেহ নেই।
শ্রমনির্ভর আমাদের যে অর্থনীতি, তাতে প্রযুক্তিতে উন্নত দেশগুলোর সঙ্গে পাল্লা দিয়ে প্রতিযোগিতায় টিকে থাকতে হলে তার বিকল্প উপায় আমাদের খুঁজে বের করতে হবে। ধীরে ধীরে বিশ্বজুড়ে শ্রমনির্ভর কাজে যন্ত্রের ব্যবহার বাড়ছে এবং বাড়তে থাকবে। এই প্রযুক্তির বিশ্বব্যবস্থায় টিকে থাকার জন্য, মধ্যম থেকে উন্নত বাংলাদেশ বিনির্মাণে মেধা ও জ্ঞাননির্ভর অর্থনীতি কতটা কাক্সিক্ষত হয়ে উঠেছে, তা বলার অপেক্ষা রাখে না। এ জন্য প্রয়োজন দক্ষ ও কর্মঠ জনশক্তি। জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতি দ্রুত পরিবর্তনশীল। বিশ্বব্যাংকের মতে, জ্ঞাননির্ভর অর্থনীতির চারটি মূল স্তম্ভ রয়েছে। তা হলো— প্রতিষ্ঠান বিশ্ববিদ্যালয়, ল্যাবরেটরিজ, ইনকিউবেটরস ইত্যাদি, উদ্ভাবনী ইকোসিস্টেম, মানসম্মত শিক্ষা এবং পর্যাপ্ত ও আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি অবকাঠামো।
এই চারটি স্তম্ভ ব্যাপক পরিসরে দক্ষ জনবল তৈরিতে, উদ্যোক্তাদের পণ্য ও সেবার মানোন্নয়নে কাঠামোগত সুবিধা দেবে। পরিবর্তিত এই অর্থনীতিতে দেশের শ্রমবাজারে সমন্বয় ও পুনর্বিন্যাস ঘটবে। সেই পরিবর্তিত শ্রমবাজারে টিকে থাকতে হলে দেশের জনগণকেও হতে হবে ‘স্মার্ট’ ও দক্ষ। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে দক্ষ জনশক্তি তৈরিতে তাই সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দিতে হবে। প্রচলিত ধারার শিক্ষায় নিয়োজিত জনগোষ্ঠীকে দক্ষ জ্ঞানকর্মী বানাতে হলে প্রথমে প্রচলিত শিক্ষার ধারাকে বদলাতে হবে। আমাদের বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে প্রাকৃতিক সম্পদের ওপর নির্ভরশীলতা ও কায়িক শ্রম কমিয়ে ডিজিটাল প্রযুক্তিতে দক্ষ তথা জ্ঞানকর্মীতে রূপান্তর করতে হবে।
এই জ্ঞানভিত্তিক অর্থনীতিতে জ্ঞানচর্চার কোনো বিকল্প নেই। আগামী বছরগুলোয় সারা বিশ্বে কোন ধরনের কাজের চাহিদা বাড়তে পারে, কোন ধরনের কাজের চাহিদা কমতে পারে, সে বিষয়টি মাথায় রেখে দেশের অর্থনীতির কাঠামোগত ও শিক্ষাগত রূপান্তরও করতে হবে। আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান ওকলার জুলাই ২০২৩—এর রিপোর্ট অনুযায়ী, বিশ্বের ১৪৩টি দেশের মধ্যে মোবাইল ইন্টারনেটের গতিতে বাংলাদেশের অবস্থান ১২০তম। আর ফিক্সড ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেটের গতিতে বাংলাদেশের অবস্থান ১০৬তম। রূপকল্প ২০৪১ বাস্তবায়ন আমাদের প্রয়োজন উচ্চগতিসম্পন্ন, সাশ্রয়ী এবং নিরবচ্ছিন্ন ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট সংযোগ, যা দেশজুড়ে বিস্তৃৃত থাকবে। সেই সঙ্গে সারা দেশে নিরবচ্ছিন্ন বিদ্যুৎ সংযোগ নিশ্চিত করা প্রয়োজন।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) আইসিটি জরিপ ২০২২—এর রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ৩৮ দশমিক ৯ শতাংশ। জিএসএমএ, লন্ডন কর্তৃক প্রকাশিত দ্য মোবাইল জেন্ডার গ্যাপ রিপোর্ট ২০২০ অনুযায়ী, বাংলাদেশে শতকরা ৮৬ শতাংশ পুরুষের মোবাইল ফোন আছে, যেখানে নারী মোবাইল ব্যবহারকারীর সংখ্যা ৬১ শতাংশ; অর্থাৎ ২৯ শতাংশ লিঙ্গবৈষম্য এখানে বিদ্যমান রয়েছে। মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর ক্ষেত্রে লিঙ্গবৈষম্য আরও প্রকট; যা প্রায় ৫১.৫ শতাংশ। স্মার্ট বাংলাদেশের লক্ষ্য অর্জনে এ লিঙ্গবৈষম্য দূর করার জন্য পদক্ষেপ নিতে হবে। দেশের নারী সমাজকে পেছনে রেখে কোনোভাবেই কাক্সিক্ষত লক্ষ্যে পৌঁছানো সম্ভব হবে না।
ইতোমধ্যে রূপকল্প ২০২১ বাস্তবায়ন করেছেন। সামনে লক্ষ্য— স্মার্ট বাংলাদেশ রূপকল্প ২০৪১। দেশের ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ডকে সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে ২০৪১ সাল নাগাদ সাশ্রয়ী, টেকসই, জ্ঞানভিত্তিক, উদ্ভাবনী স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলতে সক্ষম হব বলে আমরা আশাবাদী।
একটি দক্ষ ও ডিজিটাল—প্রস্তুত কর্মীবাহিনী এবং প্রযুক্তি—সমর্থিত কৃষি—শিল্প ও ব্যবসা—বাণিজ্যের পরিবেশ তৈরি করে একটি স্মার্ট অর্থনীতি গড়ে তোলার জন্য সরকার বহুমুখী উদ্যোগ গ্রহণ করেছে। প্রতিবছর পাঁচ লাখেরও বেশি স্নাতক তৈরি হচ্ছে, যার মধ্যে প্রায় পঁচাত্তর হাজার তথ্য প্রযুক্তি—সক্ষম পরিষেবা (আইটিইএস) প্রাপ্ত পেশাদার জনশক্তি হিসেবে প্রশিক্ষিত। অক্সফোর্ড ইন্টারনেট ইনস্টিটিউটের মতে, বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম অনলাইন কর্মীর পুল রয়েছে বাংলাদেশে। প্রায় ৬ লাখ ৮০ হাজার ফ্রিল্যান্সার আউটসোর্সিং সেক্টও থেকেপ্রায় ৫৫০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় করছে। এক হাজার পাঁচশত কোটি টাকা বিনিয়োগে সারা দেশে নির্মিত ৩৯টি হাই—টেক বা আইটি পার্কের মধ্যে ৯টিতে ১৬৬টি দেশি—বিদেশি কোম্পানি ব্যবসায়িক কার্যক্রম শুরু করেছে। ২০ হাজারেরও বেশি মানুষ সবেতন কর্মসংস্থানে এবং ৩২ হাজার দক্ষ কর্মী জনশক্তির পুলে অন্তর্ভুক্ত হয়েছে।
এ ছাড়া আইসিটি খাতে ২০ লাখ নতুন কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে এবং নারীর ক্ষমতায়ন প্রকল্পের মাধ্যমে ১১ হাজার নারী প্রশিক্ষণ গ্রহণ করেছে। দ্রুত বর্ধনশীল আইসিটি শিল্প মানুষকে আর্থিক, টেলিযোগাযোগ এবং স্বাস্থ্যসেবা প্রদান করছে। বর্তমানে বাংলাদেশে ১২০টিরও বেশি কোম্পানি ৩৫টি দেশে প্রায় ১.৩ বিলিয়ন ডলার মূল্যের আইসিটি পণ্য রপ্তানি করছে এবং ২০২৫ সাল নাগাদ এটি ৫ বিলিয়নে উন্নীত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। ভবিষ্যতে আরও ৩০০টি স্কুল, ১ লাখ ৯০ হাজার ওয়াই—ফাই সংযোগ, এবং ২৫০০টি ডিজিটাল ল্যাব প্রতিষ্ঠা করার মাধ্যমে শতভাগ অনলাইন পরিষেবা প্রদানের লক্ষ্যে একটি বড় মাপের আইসিটিনির্ভর কর্মসংস্থানের ৩ কোটি জন্য সরকার বদ্ধপরিকর। আইসিটি শিল্পের টেকসই প্রবৃদ্ধি ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশের একটি স্মার্ট অর্থনীতিতে রূপান্তরের ক্ষেত্রে যথেষ্ট অবদান রাখবে।
স্মার্ট বাংলাদেশের চতুর্থ স্তম্ভ হলো একটি স্মার্ট সোসাইটি গঠন, যার অর্থ তথ্য—সমাজ থেকে জ্ঞান—সমাজে রূপান্তর। ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে আমরা একটি তথ্য সমাজের মৌলিক গুণাবলি অর্জন করেছি। এখন সময় এসেছে জীবনব্যাপী শিক্ষণ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে মানব উন্নয়নের জন্য জ্ঞান তৈরি এবং প্রয়োগের নিমিত্তে তথ্য শনাক্তকরণ, উৎপাদন, প্রক্রিয়াকরণ, রূপান্তর, প্রচার এবং ব্যবহার করার স্থায়ী দক্ষতা অর্জনের। সে জন্য দরকার একটি শক্তিশালী সামাজিক দর্শন, যেখানে সাংস্কৃতিক বহুত্ববাদ, সামাজিক ও রাজনৈতিক সংহতি এবং নাগরিক অংশীদারত্বের সুসমন্বয় থাকে। এগুলোই একটি স্মার্ট সমাজের বৈশিষ্ট্য এবং বাংলাদেশ সেদিকেই এগোচ্ছে।
২০৪১ সালের মধ্যে স্মার্ট বাংলাদেশ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে সরকার ১৪টি কর্মপরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের রূপকল্প যেমন ডিজিটাল শিক্ষা, ডিজিটাল স্বাস্থ্যসেবা, ডিজিটাল কৃষি ইত্যাদি নিশ্চিত করেছে, তেমনি স্মার্ট বাংলাদেশের অপরিহার্য উপাদান হবে স্মার্ট শিক্ষা, স্মার্ট স্বাস্থ্যসেবা, স্মার্ট কৃষি, স্মার্ট ট্রেড, স্মার্ট পরিবহন এবং স্মার্ট ব্যবস্থাপনা নীতি। ডিজিটাল বাংলাদেশের সফল সমাপ্তির মাধ্যমে প্রযুক্তিভিত্তিক উন্নয়নের ঐতিহ্য ও ধারাবাহিকতা স্মার্ট বাংলাদেশের অগ্রযাত্রাকে পথ দেখাবে, যা বাংলাদেশের উন্নয়নের মাঠে একটি বড় উল্লম্ফন। আমরা যদি চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা এবং আমাদেও ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্টের সর্বোত্তম ব্যবহারের মাধ্যমে একটি বর্ধিষ্ণু অর্থনীতি ও অপ্রতিরোধ্য দেশ গড়তে চাই, তাহলে শেখ হাসিনার
জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান দেশের সাধারণ মানুষকে স্নেহ—ভালোবাসায় সচেতন করে তোলার চেষ্টা করেছেন। প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা তার পিতার মতোই বাংলার মানুষকে ভালোবাসেন, বাংলার মানুষের মুক্তি ও উন্নয়ন কামনা করেন। তবে শেখ হাসিনার পক্ষে একা বাংলার মানুষের দ্বারে দ্বারে গিয়ে তাদের সচেতন করে তোলা কঠিন। তাই আমরা যারা মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় বিশ্বাসী সকল মানুষের উচিত এখন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার পক্ষে জনমত গড়ে তোলা।
স্মার্ট বাংলাদেশ ও বঙ্গবন্ধুর সবুজ বিপ্লব কর্মসূচি
স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বঙ্গবন্ধুর সবুজ বিপ্লব বাস্তবায়নে সবাইকে নিজ নিজ জায়গা থেকে এগিয়ে আসতে হবে এবং কাজকরতে হবে। বাংলাদেশকে স্বপ্নের সোনার বাংলা রূপে গড়ে তুলতে নিরলস পরিশ্রম করেন বঙ্গবন্ধু। স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে বঙ্গবন্ধুর সবুজ বিপ্লব বাস্তবায়ন এখন সবার আলোচনার বিষয়। বঙ্গবন্ধু ক্ষুধা, দুর্নীতি, দারিদ্র্যমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক স্বনির্ভর এক উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার দৃঢ় প্রত্যয়ে কাজ করার জন্য ডাক দিয়েছিলেন ‘সবুজ বিপ্লব—এর। তাঁর সেই সবুজ বিপ্লবের স্বপ্ন এখন কৃষি খাতে ব্যাপক উন্নয়ন ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়েছে।
বাংলাদেশের কৃষকরা ঝড় জলোচ্ছ্বাস, বন্যা ও খরাসহ সব ধরনের প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবেলা করেও দ্বিগুণ দৃঢ়তা ও শক্তি দিয়ে কৃষির অগ্রগতি বজায় রেখেছে। বর্তমানে বাংলাদেশের মোট শ্রমশক্তির ৪৭ শতাংশের বেশি কৃষিকাজে নিয়োজিত। উন্নত বীজ, সার, কীটনাশকসহ সব ধরনের কৃষি উপকরণ ব্যবহার করে তারা জমি ক্ষয়ের পরও কয়েকগুণ বেশি ফসল উৎপাদন করতে সক্ষম হয়েছে। স্বাধীনতার পর দেশের ১০ শতাংশ জমি উচ্চ ফলনশীল ফসলের আওতাধীন ছিল। এখন তা ৯০ শতাংশ ছাড়িয়েছে। ১০ শতাংশ জমি সেচের আওতায় ছিল, এখন তা ৮০ শতাংশ। ফলে ধানের উৎপাদন বেড়েছে তিন গুণ, গম দ্বিগুণ, সবজি পাঁচ গুণ ও ভুট্টা দশ গুণ।
বর্তমানে বাংলাদেশ ধান উৎপাদনে বিশ্বে তৃতীয়, সবজি উৎপাদনে তৃতীয়, খোলা পানিতে মিঠা পানির মাছ উৎপাদনে তৃতীয়, আম উৎপাদনে সপ্তম, আলু উৎপাদনে সপ্তম এবং পেয়ারা উৎপাদনে অষ্টম স্থানে রয়েছে। ইলিশ উৎপাদনের প্রথম। হাঁস—মুরগি এবং দুগ্ধ খাতে ঈর্ষণীয় সাফল্য। এসবই সম্ভব হয়েছে কৃষকদের কঠোর পরিশ্রমে।
যুদ্ধবিধ্বস্ত বাংলায় খাদ্য সংকট সাড়ে ৭ কোটি মানুষের হলেও মোট ফসল উৎপাদন হচ্ছে ১ কোটি টন। ৫৩ বছর পর বাংলাদেশে প্রায় ১৭ কোটি মানুষ। ফসল উৎপাদন চার কোটি টনে পৌঁছেছে। ঘাটতির বাংলাদেশ এখন খাদ্যে প্রায় স্বয়ংসম্পূর্ণ। সকল বাধা অতিক্রম করে, কঠোর পরিশ্রম ও ঘামের মাধ্যমে কৃষির প্রায় সকল উপখাতে কৃষকের মন ও আত্মার জয়জয়কার। ৫৩ বছর ধরে শ্রমজীবী মানুষ সমৃদ্ধির চাকাকে পেছন থেকে ঠেলে দেশের অর্থনীতির ভিত তৈরি করেছে। শত প্রতিকূলতার মাঝেও তারা বাংলাদেশের পোশাক খাতের অগ্রগতি করেছে অপ্রতিরোধ্য। লাল—সবুজের পতাকা বিশ্বের শীর্ষে উত্তোলন করার জন্য নিরন্তর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। এক কোটি ২০ লাখ ৫৬ হাজার অভিবাসী শ্রমিক তাদের পরিশ্রমের প্রায় পুরো আয় দেশে পাঠিয়ে বাংলাদেশকে এগিয়ে নিয়ে যাচ্ছেন উন্নয়নের পথে।
কৃষি গবেষণায় কৃষি বিজ্ঞানীদের গবেষণায় সাফল্য অনেক ভালো। বিভিন্ন কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে হাজার হাজার কৃষি বিজ্ঞানী এ দেশের মানুষকে আলোর পথ দেখাচ্ছেন। বঙ্গবন্ধু সবুজ বিপ্লবের উদ্যোগ না নিলে এবং কৃষি উৎপাদনের ভিত্তিমূল তৈরি না করলে অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে আমরা আজকের এই অবস্থানে আসতে পারত না আমাদের প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশ।
১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি বঙ্গবন্ধু স্বপ্নের স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসেন শতাব্দীর মহানায়ক। এরপর তিনি দেশগঠনের অংশ হিসেবে যে সবুজ বিপ্লবের ডাক দিয়েছিলেন তা বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি জমির মলিকানার সীমা নির্ধারণ করে সমবায়ভিত্তিক কৃষি ব্যবস্থাপনা গড়ে তোলেন। আমাদের কৃষি জমি যেভাবে কমছে, সেক্ষেত্রে তার সবুজ বিপ্লবনীতি এখনো প্রাসঙ্গিক। যুদ্ধবিধ্বস্ত স্বাধীন বাংলাদেশকে পুনর্গঠন করে স্বপ্নের সোনার বাংলায় রূপান্তরিত করার জন্য মাত্র সাড়ে তিন বছর সময় পেয়েছিলেন বঙ্গবন্ধু। সময়ের হিসেবে এই সামান্য কয়েকটি বছরে বঙ্গবন্ধুর যে অসাধারণ কর্মতত্পরতার পরিচয় দিয়েছেন, তাতে তার অনন্যসাধারণ রাষ্ট্রনায়কসুলভ প্রতিভা এবং অসাধারণ কর্মদক্ষতার পরস্ফুটন আমরা দেখতে পাই।
যুদ্ধবিধ্বস্ত ধ্বংসস্তূপ থেকে বাংলাদেশকে স্বপ্নের সোনার বাংলা রূপে গড়ে তুলতে নিরলস পরিশ্রম করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। ক্ষুধা, দুর্নীতি, দারিদ্র্যমুক্ত, অসাম্প্রদায়িক স্বনির্ভর এক উন্নত সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গড়ার দৃঢ় প্রত্যয়ে ডাক দিয়েছিলেন ‘সবুজ বিপ্লব’—এর। তার সেই সবুজ বিপ্লবের স্বপ্ন এখন কৃষি খাতে ব্যাপক উন্নয়ন ও খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার মাধ্যমে প্রতিফলিত হয়েছে। কৃষি গবেষণায় কৃষি বিজ্ঞানীদের গবেষণায় সাফল্য তারই অনুপ্রেরণার ফসল। ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট স্বাধীনতাবিরোধী চক্রের কতিপয় উচ্চাভিলাষী, পথভ্রষ্ট সামরিক কর্মকর্তার নির্মম হত্যাযজ্ঞের মধ্য দিয়ে তার এই অগ্রযাত্রা রুদ্ধ হলেও বাংলাদেশ গত দেড় যুগে কৃষিসহ বিভিন্ন খাতে উন্নয়নের মাধ্যমে আবার ঘুরে দাঁড়িয়েছে।
১৯৮১ সালের ১৭ মে দেশে ফিরে আসার পর শেখ হাসিনা শোককে শক্তিতে পরিণত করে দেশের মানুষের জন্য কাজ করে যাচ্ছেন। দেশি—বিদেশি সব ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে তিনি তার পিতার অসমাপ্ত কাজে নিজেকে নিয়োজিত করেছেন। আজ তাঁরই নেতৃত্বে বাংলাদেশ এখন বিশ্বদরবারে ক্ষুধা—দারিদ্র্যমুক্ত, সুখী সমৃদ্ধশালী দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করেছে। ভবিষ্যতে তারই হাতে পিতা বঙ্গবন্ধুর অসমাপ্ত স্বপ্ন সফল হবে, ডিজিটাল বাংলাদেশের বাসস্তবায়নের পর সুখী সমৃদ্ধ ও উন্নত ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ পৃথিবীর মানচিত্রে মাথা উঁচু করে দাঁড়াচ্ছে। বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান ছিলেন কৃষি অন্তপ্রাণ ও কৃষিবান্ধব।
কৃষিতে ডিজিটাল প্রযুক্তির ছোঁয়া লেগেছে। এসব প্রযুক্তিগত সুফল সম্প্রতি কৃষিতে জাগরণ সৃষ্টি করেছে। ধীরে ধীরে আরও বিস্তৃত হচ্ছে। বর্তমানে অনলাইন পরিষেবা বাড়ছে। কৃষি প্রধান বাংলাদেশে প্রযুক্তির ছোঁয়া বদলে দিয়েছে কৃষকের জীবন। কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর তথ্যপ্রযুক্তিগত সেবা ‘কৃষি বাতায়ন’ এবং ‘কৃষক বন্ধু কল সেন্টার’ চালু করেছে। বিভিন্ন কৃষি বিষয়ক সেবাগুলোর জন্য কল সেন্টার হিসেবে কাজ করছে ‘কৃষক বন্ধু’ (৩৩৩১ কল সেন্টার)। 'কৃষি বাতায়ন' প্রযুক্তি সেবার মাধ্যমে কৃষকরা এখন তাদের চাষের ফসল সম্পর্কে সঠিক তথ্য জানতে পারছেন, বিশেষজ্ঞদের কাছ থেকে নিতে পারছেন পরামর্শ। সরকারের বিভিন্ন কৃষি—সম্পর্কিত সেবাও পেয়ে থাকেন এই অ্যাপস ব্যবহার করে। তাছাড়াও রয়েছে ই—বালাইনাশক প্রেসক্রিপশন, কৃষি বায়োস্কোপ। ফলে কৃষকরা সহজেই ঘরে বসে বিভিন্ন সেবা গ্রহণ করতে পারছেন। ‘কৃষকের জানালা’ নামে একটি উদ্ভাবনী অ্যাপসের সহযোগিতায় ফসলের ছবি দেখেই কৃষক ও কৃষি কর্মকর্তাগণ তাৎক্ষণিকভাবে শস্যের রোগ বালাই শনাক্ত করতে পারেন।
এসবের প্রভাবে কৃষি নির্ভর অর্থনীতিতে ব্যাপক পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। অনেক তরুণ শিক্ষিত যুবক—যুবতীরা আধুনিক কৃষি উদ্যোক্তা হিসেবে সম্পৃক্ত হচ্ছেন। ফলে ডিজিটাল কৃষির বাস্তবায়নে ও চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের লক্ষ্য পূরণে অন্যতম একটি অনুষঙ্গ হয়ে উঠেছে ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) ও ক্লাউড বেইজড অটোমেটেড এগ্রিকালচারাল সিস্টেম।
বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব নিউক্লিয়ার এগ্রিকালচার ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে বাংলাদেশ সরকারের প্রতিশ্রম্নত স্মার্ট বাংলাদেশ বিনির্মাণে ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) গবেষণাগারে প্রয়োগ করে ‘স্মার্ট বাংলাদেশ’ গড়ার অন্যতম ভিত্তি স্মার্ট কৃষি বাস্তবায়নের পথে এগোচ্ছে। স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ার অন্যতম ভিত্তি স্মার্ট কৃষির বাস্তবায়নের ধারাবাহিকতায় আইওটি ব্যবহার করে এগ্রিকালচারাল গ্রোথ মনিটরিং সম্পর্কিত নতুন উদ্ভাবন কৃষি খাতে ম্যানুয়াল পদ্ধতিতে কাজ করা জটিল ও সময় সাপেক্ষ বিষয়গুলো অনেক সহজ করে দেবে। এই তথ্যপ্রযুক্তি নির্ভর স্মার্ট কৃষি প্রযুক্তি উন্নত কৃষি পরিচর্যার পাশাপাশি অধিক উৎপাদনশীলতা বিষয়ক তথ্য প্রদান করতে সক্ষম হবে।
স্মার্ট কৃষি ব্যবস্থাপনায় মাটির তথ্য যেমন: মাটির আদ্রর্তা, তাপমাত্রা, পিএইচ লেভেল, মাটির ইলেকট্রিক্যাল কনডাকটিভিটি, মাটির মাইক্রো ও ম্যাক্রো পুষ্টিমান (যেমন: নাইট্রোজেন, পটাশিয়াম, ফসফরাস, সালফার ইত্যাদি) পরিমাপ ও বিশ্লেষণের মাধ্যমে ফসলের স্বাস্থ্য নির্ণয় করা সম্ভব হবে। সেন্সরের মাধ্যমে মাটির স্বাস্থ্য এবং পুষ্টির তথ্য সংগ্রহ করে উন্নত কৃষি প্রযুক্তির সাহায্যে প্রাপ্ত তথ্যের উপর ভিত্তি করে, উপযুক্ত পুষ্টি প্রদান করার জন্য পরামর্শ প্রদান করা সম্ভব হবে। আইওটি সেন্সর এবং স্মার্ট সেন্সরবেইজড ক্যামেরা ব্যবহার করে মাটি সম্পর্কিত তথ্য ও স্মার্ট সেচ ব্যবস্থাপনা সিস্টেম ব্যবহার করে কৃষকরা সঠিক সময়ে প্রয়োজন অনুযায়ী পানির প্রবাহ বা সেচ ব্যবস্থাপনা প্রথাগত ম্যানুয়াল সিস্টেম থেকে অটোমেটেড সিস্টেমে রূপান্তরিত করতে পারবে। এসব ব্যবস্থায় কৃষকরা খামার ব্যবস্থাপনা বিষয়ক সিদ্ধান্ত দ্রুত নিতে পারবে ও খামারের উৎপাদনশীলতা বেড়ে যাবে বহুগুণে।
বঙ্গবন্ধু তাঁর শাসনামলে এ দেশের কৃষক ও কৃষির উন্নয়নে যে সব পদক্ষেপ নিয়েছিলেন তার মধ্যে উল্লেখযোগ্য হলো— ১৯৭২—৭৩ অর্থবছরের উন্নয়ন বাজেটের ৫০০ কোটি টাকার মধ্যে ১০১ কোটি টাকা কৃষি উন্নয়নের জন্য বরাদ্দ, ২৫ বিঘা পর্যন্ত জমির খাজনা মওকুফ, কৃষকদের জন্য সুদমুক্ত ঋণের প্রবর্তন, স্বাধীনতা পরবর্তীতে ২২ লাখ কৃষকের পুনর্বাসনের ব্যবস্থা গ্রহণ, ১৯৭২ সালে কৃষকদের মাঝে ধান, গম ও পাটবীজ বিতরণ, বৃক্ষ রোপণ অভিযান চালুকরণ, কৃষিতে ভর্তুকির ব্যবস্থা গ্রহণ, সার, কীটনাশক ও সেচযন্ত্র সরবরাহ এবং গ্রামভিত্তিক সবুজ বিপ্লবের কর্মসূচি গ্রহণ ইত্যাদি।
জাতির পিতা অনুভব করেছিলেন কৃষি গবেষণা ও কৃষি প্রযুক্তির প্রসার ছাড়া কৃষি উন্নয়ন সম্ভব নয়। তাই মহান স্বাধীনতা অর্জনের পরপরই কৃষির উৎপাদনশীলতা, গবেষণা ও প্রযুক্তি সম্প্রসারণে গতিশীলতা আনয়নের জন্য কৃষি ও কৃষির বিভিন্ন উপখাত সংক্রান্ত গবেষণা প্রতিষ্ঠান তৈরি ও পুনর্গঠন করার জন্য বিশেষ উদ্যোগ গ্রহণ করেছিলেন। পুনর্গঠন করেন হর্টিকালচার বোর্ড। প্রতিষ্ঠা করা হয় পাট মন্ত্রণালয় এবং ১৯৭৪ সালে অ্যাক্টের মাধ্যমে প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট। ১৯৭৩ সালের রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ বলে কৃষি গবেষণার উন্নয়ন ও সমন্বিত কার্যক্রমের সুযোগ তৈরি করা হয় এবং পুনর্গঠন করা হয় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইন্সটিটিউট। রাষ্ট্রপতির অধ্যাদেশ বলে ১৯৭৩ সালে কৃষি গবেষণা সমন্বয়, গবেষণা পরিকল্পনা, বাস্তবায়ন ও মূল্যায়নের জন্য প্রতিষ্ঠা করা হয় বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা কাউন্সিল। পুনর্গঠন করা হয় বাংলাদেশ ধান গবেষণা ইনস্টিটিউট।
বাংলাদেশ আজ কৃষি উন্নয়নে বিশ্বপরিমণ্ডলে এক রোল মডেল। সরকারের কৃষিবান্ধব নীতি, অব্যাহত প্রণোদনা বাংলাদেশের কৃষি খাতকে নিয়ে গিয়েছে এক অনন্য উচ্চতায়। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে স্মার্ট হচ্ছে প্রযুক্তিনির্ভর কৃষি। কৃষিতে জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর দর্শন ও ভাবনা বাস্তবায়নের জন্য প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রয়োজনের নিরিখে কৃষি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা, গবেষণাগার তৈরি, গবেষণার কাজে বর্ধিত অর্থ বরাদ্দ দিয়ে যাচ্ছেন। নতুন নতুন জাত, কলাকৌশল মাঠে ছড়িয়ে দিতে কৃষি বিজ্ঞানীরা নিরলসভাবে পরিশ্রম করছেন। কৃষিভিত্তিক শিল্প ও প্রক্রিয়াজাত শিল্পের বিকাশ, উন্নত জাতের ফসল উৎপাদন, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ, কৃষিপণ্যের মূল্য সংযোজন, উন্নত বাজারজাতকরণ ব্যবস্থা ইত্যাদির মাধ্যমে বাংলাদেশের জীবননির্বাহ কৃষি আজ বাণিজ্যিক কৃষিতে রূপান্তরিত হয়েছে। সরকারের নানামুখী উন্নয়ন কর্মকাণ্ড যেমন উচ্চ ফলনশীল জাতের উদ্ভাবন এবং সম্প্রসারণ, সেচ ব্যবস্থা উন্নয়ন, সার ও কৃষি যান্ত্রিকীকরণে ভর্তুকি প্রদান, সহজশর্তে কৃষিঋণ বিতরণ ইত্যাদির জন্য দেশের শস্য নিবিড়তা অনেক বৃদ্ধি পেয়েছে।
আগামী দিনের জলবায়ু পরিবর্তন ও বৈশ্বিক চ্যালে মোকাবিলায় স্মার্ট কৃষি হতে হবে আরও টেকসই। এ জন্য বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট থেকে পাওয়া তথ্য ও বিশ্বব্যাপী উদ্ভাবনী জনকে একযোগে কাজে লাগানো যেতে পারে। বায়োটেকনোলজি ও ন্যানোটেকনোলজির মাধ্যমে কম আবাদযোগ্য জমিতে বেশি ফসল উৎপাদন করা সম্ভব। এ ছাড়া জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবেলায় ভাসমান পদ্ধতিতে চাষের মতো কৃষিতে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রযুক্তি সম্বলিত ড্রোন ব্যবহার করার মাধ্যমে এলাকাভিত্তিক কৃষি জমির আগাম সার্বিক অবস্থা যেমন ফসলের মাঠের আর্দ্রতা, ফসলে ক্ষতিকর উপাদানের উপস্থিতি নির্ধারণ, শস্য চারা রোপণ ডিজাইন করা, বীজ রোপণ করা, পোকার আক্রমণ জানা, কীটনাশক স্প্রে করা, ফসলের উৎপাদন জানা, ফসলের সার্বিক মনিটরিং করা, মাটির পুষ্টি, তাপমাত্রা, পিএইচ, লবনাক্ততা জানা, ফসলের রোগ ও পোকামাকড় এর উপস্থিতি জানা, আবহাওয়ার পূর্বাভাস এবং আগাম এলার্মিং, ফসলের আগাম সম্ভাব্য ফলনের পূর্বাভাস দেয়া যেতে পারে।
বাংলাদেশের রপ্তানি নীতি ২০২১—২৪ এ কৃষি ও কৃষিজাত খাদ্য প্রক্রিয়াকরণকে সর্বাধিক অগ্রাধিকারের জন্য অন্যতম জাত হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে। এছাড়াও সরকার ৮ম পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা ২০২১—২০২৫—এ খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে বৈচিত্র্যময় কৃষিপণ্য এবং প্রক্রিয়াজাত খাদ্য উৎপাদনের ওপর জোর দিয়েছে। প্রক্রিয়াজাত খাদ্যপণ্য উৎপাদনে গবেষণা ও বাজারজাতকরণে আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহার যেমন ব্লকচেইন কিংবা ট্রেসেবিলিটির ব্যবহার রপ্তানি খাতের বহুমুখীকরণ করে বৈদেশিক মুদ্রা আহরণ করার মাধ্যমে কৃষিভিত্তিক অর্থনীতির ভিতকে করবে আরও মজবুত।
দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের পূর্বে বাংলাদেশ আওয়ামীলীগ প্রণীত ইশতেহারে প্রধানমন্ত্রী জননেত্রী শেখ হাসিনা স্মার্ট কৃষি লক্ষ্য স্থির করেছিলেন। স্মার্ট কৃষি কার্যক্রমের মূল উদ্দেশ্য হচ্ছে পুষ্টিসম্মত ও নিরাপদ খাদ্যের নিশ্চয়তা প্রদান। অধিকন্তু স্বল্প সম্পদ বিনিয়োগে প্রযুক্তির সর্বোত্তম ব্যবহার করে সর্বাধিক উৎপাদন করা। অল্প পানি, অল্প সার, অল্প কীটনাশক দিয়ে যদি বেশী পরিমাণ ফসল ফলানো যায় তাহলে কৃষিতে খরচ কমবে এবং উৎপাদন বাড়বে। এতে সময়ের পরিবর্তনে বর্ধিত চাহিদার সাথে সামঞ্জস্য রেখে এ দেশের জনসাধারণের খাদ্য ও পুষ্টির চাহিদা মেটানো সম্ভব। বাংলাদেশও গত ৫৩ বছরে ফসিল শক্তিনির্ভর কৃষি অনুসরণ করেছে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়, কৃষিজমিতে ফসলের বৃদ্ধি ও উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন ১৭টি খাদ্য উপাদান।
এর মধ্যে তিনটি উপাদানসমৃদ্ধ ফসিল শক্তিনির্ভর কৃত্রিম রাসায়নিক সার তৈরির কারখানা স্থাপন করা হয়েছে বা যেসব দেশে ফসিল শক্তি দিয়ে সার উৎপাদন হয়, সেখান থেকে উচ্চমূল্যে বৈদেশিক মুদ্রা খরচ করে আমদানি করা হচ্ছে। আবার যেহেতু এসব রাসায়নিক সারের উৎপাদন খরচ বেশি, পুঁজিবিহীন গরিব কৃষকদের পক্ষে উচ্চমূল্যে তা কিনে জমিতে প্রয়োগ সম্ভব নয়, সেজন্য জনগণের করের টাকায় ভর্তুকি দিয়ে কৃষকদের জন্য সার কেনা সহজ করা হয়েছে। কৃষকরাও তা ইচ্ছামতো জমিতে প্রয়োগ করে চলেছেন। কারণ প্রশিক্ষণ দিয়ে ও প্রদর্শনী স্থাপন করে শেখানো হচ্ছে, জমিতে যত বেশি রাসায়নিক সার দেয়া হবে তত বেশি ফলন।
দেশের গবেষণা প্রতিষ্ঠান দানাদার ফসল বিশেষ করে ধানের শত শত আধুনিক জাত আবিষ্কার করে যাচ্ছে এবং এগুলো মাঠে নেয়ার সহজ উপায়ও সৃষ্টি করা হয়েছে। জাতগুলো এমনভাবে প্রজনন করা হয়েছে, যাতে জমিতে যত বেশি সার বা কৃত্রিম উপকরণ প্রয়োগ করা হবে তত বেশি ফলন পাওয়া যাবে। এতে অন্য দানাদার খাদ্যে সরবরাহ করে এমন প্রজাত আর চাষই হচ্ছে না। আবার ধানের মাত্র কয়েকটি জাত চাষ হচ্ছে। ফলে দেশ একক ফসল চাষের চূড়ান্ত ধাপে অবস্থান করছে। বিজ্ঞানীরা ভূগর্ভস্থ পানি ব্যবহারের সহজ পথ আবিষ্কার করেছেন, এতে শীত মৌসুমে সেচনির্ভর ধান চাষ বেশি হচ্ছে। সবুজ বিপ্লব বাস্তবায়নে শক্তি আশ্রয়ী রাসায়নিক সার ও পানিকে সহজলভ্য করা হয়েছে। কারণ নতুন উদ্ভাবিত জাতগুলো উৎপাদনে আগের সনাতন জাতগুলোর তুলনায় যথেষ্ট বেশি পরিমাণে খাদ্যোৎপাদান ও পানির প্রয়োজন হয়, আবার মুষ্টিমেয় কয়েকটি জাত জনপ্রিয় করা হচ্ছে।
আমাদের কৃষি শুধু ফসলনির্ভর নয়। কৃষিতে স্থায়িত্বশীলতা আনতে প্রাণিসম্পদ, মৎস্যম্পদকে একত্রে বিবেচনায় আনতে হবে। দেশের বদ্বীপ পরিকল্পনা বা ডেল্টা প্ল্যান প্রণয়ন করা হয়েছে, সে আলোকে এখনই একটি সমন্বিত নীতি প্রণয়ন করতে হবে। তার সঙ্গে একটি কম্প্রিহেন্সিভ কর্মপরিকল্পনা গ্রহণের এখনই সময়। যুদ্ধোত্তর দেশে বাজেটের ১৩ ভাগ রাখা হয়েছিল এখন তা নেমে শতকরা ৩ ভাগের মতো, ফলে কৃষির উৎকর্ষের জন্য কৃষিতে বিনিয়োগ বাড়াতে হবে এবং বর্ধিত বিনিয়োগ ব্যবহারের সক্ষমতা বাড়ানো দরকার হবে। সরকারের কৃষিনীতির অন্যতম লক্ষ্য কৃষি বাস্তুসংস্থানকে রক্ষা করা। মাটির ওপর ও নিচের জীববৈচিত্র্য বাড়ানো।
বাংলাদেশের কৃষিকে আলাদা হিসাবে দেখার সুযোগ নেই। বিশ্বের সঙ্গে তাল রেখেই আমাদের চলতে হবে। আগামীর কৃষি যে যান্ত্রিক ও প্রযুক্তির কৃষি সে কথা মাথায় রেখেই সরকার কাজ করছে। আমাদের কৃষি যান্ত্রিকীকরণে বড় সাফল্যটি হিসাব করা হয় জমি কর্ষণে। কৃষি যান্ত্রিকীকরণে আমাদের প্রতিষ্ঠানগুলো কিছুটা পথ হাঁটলেও কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাসম্পন্ন কিংবা স্মার্ট কৃষির পথে আমাদের কোনোরকম অগ্রগতি নেই।
বাংলাদেশে কৃষি বলতে আমরা যা বুঝি তার মধ্যে রয়েছে মাঠ ফসল, সবজি, ফলমূল, ডেইরি, মাংস, মৎস্য ও পোলট্রি। এগুলো নিয়েই আমাদের কৃষি। আমাদের দেশের কৃষিতে প্রচুর মানুষ জড়িত। আগে কৃষিকাজ হতো শুধু উৎপাদনের তাগিদে। তবে ইদানীং উৎপাদনের পাশাপাশি প্রক্রিয়াকরণসহ বিভিন্নভাবে মূল্য সংযোজন করে উন্নয়নের কাজও হচ্ছে। এখন আমাদের দেশে তরুণরা কৃষিতে যুক্ত হচ্ছে। যান্ত্রিকীকরণ হচ্ছে। অর্থাৎ বলা যায় আমরা কৃষির যান্ত্রিকীকরণ ও বাণিজ্যিক কৃষির দিকে এগোচ্ছি। আমাদের দেশের অর্ধেকের বেশি মানুষ গ্রামে বাস করে। যারা গ্রামে বাস করে, তাদের অর্থনীতির মূল ভিত্তি কৃষি। আবার করোনার কারণে অনেক তরুণ চাকরি হারিয়েছে। অনেকে বিদেশ থেকে ফেরত এসেছে। তারা কৃষিতে যুক্ত হয়েছে। তারাও যান্ত্রিকীকরণের মাধ্যমে কৃষির উন্নয়নে ভূমিকা রাখছে। ভবিষ্যতে যান্ত্রিকীকরণ আরো বাড়বে।
আমাদের দেশে কৃষিতে ফুড ভ্যালু চেইনের সম্পূরক ভ্যালু চেইন নেই, যার কারণে এ অসামঞ্জস্যতা দেখা যাচ্ছে। ৫৩ বছর ধরে সরকারি—বেসরকারি খাত শুধু উৎপাদনে জোর দিয়েছে। এতে উৎপাদন বেড়েছে। কিন্তু উৎপাদনের পর যে প্রক্রিয়াকরণ করা প্রয়োজন, সে সক্ষমতা আমাদের দেশে নেই। প্রক্রিয়াকরণের সক্ষমতা সেভাবে তৈরি হয়নি। ফলে কখনো দাম বেড়ে যায় আবার কখনো তা কমে যায়। ভ্যালু চেইন প্রতিষ্ঠা করা গেলে কৃষকও ভালো দাম পাবেন এবং ভোক্তাও পণ্য কিনে সন্তুষ্ট থাকবেন।
বাংলাদেশ গত বছর ভালো রফতানি করেছে কৃষি খাতে। আমাদের যে হারে জনসংখ্যা ও ভূমি রয়েছে, তাতে আমাদের আরো অনেক বেশি পরিমাণে রফতানি করা উচিত। সমস্যা হচ্ছে আমরা এখন যা রফতানি করছি, তা মূলত যেসব স্থানে বাঙালি রয়েছে সেখানে। এটিকে মূলধারার বাজারে নিয়ে যেতে হবে। তাহলে আমরা কৃষি থেকে ব্যাপক হারে বৈদেশিক মুদ্রা অর্জন করতে পারব। বিশ্বের বিভিন্ন সংস্থা খাদ্য সংকট নিয়ে পূর্বাভাস দিচ্ছে। সুতরাং আমাদের আরো মজুদের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। খাদ্যপণ্য পরিবহনের সক্ষমতা বাড়াতে হবে। প্রক্রিয়াকরণে উন্নত হতে হবে। আমরা যা উৎপাদন করছি তা যদি প্রক্রিয়াকরণের মাধ্যমে মেয়াদ বাড়িয়ে দেয়া যায়, তাহলে তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে।
প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষি বিপ্লব ও খাদ্যনিরাপত্তায় ন্যানো প্রযুক্তির ব্যবহার
কৃষির উৎপাদনশীলতা বাড়াতে ও খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে ন্যানো প্রযুক্তি একটি কার্যকর ও সম্ভাবনাময় কৌশল। ন্যানো কণার ব্যবহার নাটকীয়ভাবে উদ্ভিদ পুষ্টি উন্নয়ন, সার ব্যবহারের দক্ষতা বৃদ্ধি, ফসলের উৎপাদন বৃদ্ধি, খাদ্য প্রক্রিয়াজাত, পানি ব্যবস্থাপনা, রোগ নির্ণয়, বালাই দমন, খাদ্য মোড়কীকরণ, অজীবীয় অভিঘাত সহনশীলতা বৃদ্ধি এবং নিখুঁত বা প্রিসিশন কৃষি উন্নয়নে অবদান রাখতে সক্ষম। উদাহরণস্বরূপ, নতুন ন্যানো কণা কার্যকরভাবে শস্য সংরক্ষণের জন্য বালাইনাশকের কার্যকারিতা এবং নিরাপদ ব্যবহারে উন্নয়ন ঘটাতে পারে। অনুরূপভাবে, ন্যানো সার স্লো রিলিজ বা ধীরে ধীরে উদ্ভিদের গ্রহণ উপযোগী হওয়া ও ধীর অবক্ষয়ের মাধ্যমে কার্যকরভাবে সার ব্যবহারের দক্ষতার প্রভূত উন্নয়ন করতে পারে। ন্যানো কণার ব্যবহার অথবা ন্যানো বাহকের ভেতরে সারের উপাদান ব্যবহার শস্যের বৃদ্ধি ও উৎপাদনশীলতার উন্নয়ন নিশ্চিত করতে পারে।
কৃষি ক্রমেই অলাভজনক শিল্পে পরিণত হচ্ছে। ফলে বর্তমান কৃষি একদিকে জলবায়ু পরিবর্তনের কুফল এবং অধিকতর উপকরণ ব্যবহারে উল্লেখযোগ্য সাড়া না দেয়ায় এক সংকটাপন্ন অবস্থার দিকে অগ্রসর হচ্ছে। উচ্চ উৎপাদন খরচ এবং পরিবেশের ওপর কৃষিতে ব্যবহৃত ক্ষতিকর রাসায়নিকের কুপ্রভাবের ফলে সবুজ বিপ্লবের উচ্চ উপকরণনির্ভর শস্য উৎপাদন প্রযুক্তিগুলো ক্রমবর্ধমান জনসংখ্যার চাহিদা মেটাতে কার্যত টেকসই হিসেবে প্রতীয়মান হচ্ছে না। অন্যদিকে বিশ্বের জনসংখ্যা ২০৫০ সাল পর্যন্ত আট বিলিয়ন থেকে বেড়ে ৯ দশমিক ৭ বিলিয়ন হবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। পরিবর্তিত জলবায়ুতে রোগবালাইয়ের প্রাদুর্ভাব এবং অজীবীয় অভিঘাতের কারণে ভবিষ্যৎ ফসল উৎপাদন খুবই ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে বিবেচিত হচ্ছে।
প্রয়োজনমাফিক নির্দিষ্ট আকার—আকৃতির বিশিষ্ট ন্যানো কণাগুলো তৈরির সুদক্ষ পরিচালনা ও এর ব্যবহারকে একত্রে ন্যানো প্রযুক্তি বলা হয়। ন্যানো কণা হলো ১ হতে ১০০ ন্যানো মিটার আকারের অতিসূক্ষ বস্তু যা, অণু এবং পরমাণুর সমন্বয়ে গঠিত। ন্যানো মিটার হচ্ছে, এক মিটারের এক কোটি ভাগের এক ভাগ। সেজন্য ন্যানো কণাগুলো আমরা খালি চোখে দেখতে পাই না। এমনকি সাধারণ মাইক্রোস্কোপ দিয়েও ন্যানো কণাগুলোকে দেখা যায় না। ন্যানো প্রযুক্তি গবেষণায় তাই ইলেকট্রন মাইক্রোস্কোপ আবশ্যক।
প্রকৃতিতেও রয়েছে ন্যানো প্রযুক্তির অনেক বিস্ময়কর উদাহরণ। যেমন শুধু কাঠামোগত পার্থক্য থাকার কারণে কয়লা নরম, কাল এবং সস্তা, কিন্তু হীরক শক্ত এবং নানা বর্ণের। কয়লা ও হীরক উভয়ই কার্বন দিয়ে গঠিত। শুধু কার্বন অণু সজ্জিত হওয়ার ভিন্নতার জন্য পদার্থ দু’টির এ বিস্ময়কর পার্থক্য। প্রতিটি জীবের ডিএনএতে চারটি অণু তথা এডেনিন, গুয়ানিন, সাইটোসিন এবং থায়মিন বৈচিত্র্যময় অনুক্রমে সজ্জিত থাকে। ডিএনএ অণু একটি ন্যানো পদার্থ। ডিএনএ অণু বৈচিত্র্যময় অণুক্রমে সজ্জিত হওয়ার ফলে প্রতিটি জীব অনন্য বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। প্রাকৃতিক ন্যানো পদার্থ ডিএনএ অণুর অনুক্রমে পার্থক্য থাকায় এ পৃথিবীর ৮০০ কোটি মানুষের প্রত্যেকেই স্বাতন্ত্র্য বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন। বিশ্বে করোনা মহামারী রোগের জীবাণু ভাইরাসও একটি ন্যানো কণা।
ন্যানো প্রযুক্তিকে চলমান শিল্প বিপ্লবের সবচেয়ে শক্তিশালী চালিকাশক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হয়। এ প্রযুক্তি গত অর্ধ শতাব্দীব্যাপী বিশ্বে ইলেকট্রনিকস এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির (আইসিটি) বিকাশে বিশাল অবদান রেখে আসছে। নানা ইলেকট্রনিক প্রযুক্তি, ডিসপ্লে প্রযুক্তি, ইমেজিং এবং অনুঘটক হিসেবে প্রাণরাসায়নিক এবং রাসায়নিক বিক্রিয়ায় বহুল ব্যবহৃত হয়। শুধু কি ইলেকট্রনিকস ও আইটি, ন্যানো প্রযুক্তির ব্যবহার কৃষি ও জীববিজ্ঞানের প্রসারে এক শক্তিশালী চালিকাশক্তি হিসেবে আবির্ভূত হচ্ছে।
ন্যানো মিটার স্কেল বিস্তৃৃত সব প্রযুক্তিকে সাধারণভাবে ন্যানো প্রযুক্তি বলা হয়। ১৯৬৫ সালে পদার্থবিজ্ঞানে নোবেল পুরস্কারে ভূষিত যুক্তরাষ্টে্রর তাত্ত্বিক পদার্থবিদ রিচার্ড ফিলিপস ফাইনম্যানকে ন্যানো প্রযুক্তির জনক বিবেচনা করা হয়। তিনি ১৯৫৯ সালের ২৯ জানুয়ারি ক্যালিফোর্নিয়া ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজিতে অনুষ্ঠিত আমেরিকান ফিজিক্যাল সোসাইটির এক সভায় ন্যানো প্রযুক্তির ধারণা পাওয়া যায়। তারপর ন্যানো প্রযুক্তি নিয়ে গবেষণার যাত্রা শুরু হয়। বিজ্ঞানী কমি এরিক ড্রেক্সলার ‘ন্যানোটেকনোলজি’ শব্দটি সর্বপ্রথম ব্যবহার করেন। ন্যানো প্রযুক্তিকে সংক্ষেপে ন্যানোটেক বলা হয়। এটি পদার্থকে আণবিক পর্যায়ে পরিবর্তন ও নিয়ন্ত্রণ করার বিদ্যা।
ন্যানো প্রযুক্তিকে একবিংশ শতকের একটি সর্বাপেক্ষা কার্যকর প্রযুক্তি বলা হয়। কারণ এ প্রযুক্তি শিল্পে যেমন বৈদ্যুতিক সরঞ্জাম, বস্তু বিজ্ঞান, জ্বালানি ক্ষেত্র, ওষুধ শিল্প, জীবপ্রযুক্তি এবং কৃষি ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতামূলক এবং টেকসই উন্নয়নে চমকপ্রদ অবদান রাখতে সক্ষম। আধুনিক সব ইলেকট্রনিকসের সার্কিট ন্যানো কণাগুলো দিয়ে তৈরি। শুধু ইলেকট্রনিকস শিল্পেই নয়, ক্যান্সারসহ জটিল রোগ নির্ণয় ও নিরাময়, যথাস্থানে ওষুধ প্রয়োগ এবং চিকিৎসা ও জীববিজ্ঞানে ন্যানো প্রযুক্তি এক নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করেছে।
গত শতাব্দীতে সবুজ বিপ্লবে যে প্রযুক্তিগুলো ব্যবহৃত হয়েছিল, তা শতকোটি মানুষের খাদ্যের জোগান দিয়েছে। সবুজ বিপ্লব এশিয়া ও আফ্রিকা মহাদেশকে দুর্ভিক্ষের হাত থেকে রক্ষা করেছে। তবে এ বিপ্লবে ব্যবহৃত অত্যধিক মাত্রায় বাসায়নিক (সার ও বালাইনাশক), পানি সেচ ও অন্যান্য কৃষি উপকরণ পরিবেশ দূষণের মাধ্যমে পরিবেশকে বিপন্ন করে তুলছে। এছাড়া এটি স্পষ্ট যে, সবুজ বিপ্লবের হাতিয়ার কৃষি উপকরণহুলো অত্যধিক মাত্রায় প্রয়োগেও কৃষিতে ফলন বৃদ্ধি অতীতের তুলনায় কম হারে হচ্ছে।
জনসংখ্যা বাড়ার সঙ্গে তাল মিলিয়ে সব মানুষের খাদ্যেও জোগান নিশ্চিত করতে ২০৫০ সাল পর্যন্ত শস্য উৎপাদন বর্তমানের তুলনায় ৭০—১০০ শতাংশ বাড়াতে হবে। কৃষিতে নতুন চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করে খাদ্য ও পুষ্টিনিরাপত্তা নিশ্চিত করতে হলে চাহিদার ভিত্তিতে নতুন ও অধিকতর কার্যকর প্রযুক্তির ব্যবহার করা প্রয়োজন। ন্যানো প্রযুক্তি তেমনি একটি ধারালোতম প্রযুক্তি।
কৃষি উন্নয়ন ন্যানো প্রযুক্তি ব্যবহারের ক্ষেত্রগুলো হলো ফসলের রোগ নির্ণয়, জাতভিত্তিক পুষ্টিচাহিদা নির্ণয়, পুষ্টি আহরণ ক্ষমতা বৃদ্ধি; ন্যানো সেন্সর প্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে ভূমির গুণাগুণ পর্যবেক্ষণ ও উৎপাদন বৃদ্ধির কার্যক্রম গ্রহণ এবং কৃষিতে ও কৃষি পরিবেশে ভারী ধাতুর উপস্থিতি শনাক্তকরণ ও শোধনসহ ন্যানো প্রযুক্তির সার, বালাইনাশক উদ্ভাবন ও ব্যবহারের মাধ্যমে উপকরণ দক্ষতা অর্জনের উদ্যোগ গ্রহণ। কৃষি গবেষণায় দেখা যায়, বর্তমানে ব্যবহৃত রাসায়নিক সারের ৫০ শতাংশের বেশি ও বালাইনাশকের ৯৮ শতাংশের বেশি নানাভাবে নন—টার্গেটেড জীব ও প্রতিবেশে অপচয় হয়। বর্তমানে এক কেজি চাল উৎপাদনে কয়েক হাজার লিটার পানি ব্যবহার হয়। অস্বাভাবিক হারে অদক্ষ কৃষি উপকরণের ক্রমবর্ধমান ব্যবহারে শুধু যে ফসল উৎপাদন খরচ ভয়ানকভাবে বাড়ছে তা নয়, সেচকাজে ভূগর্ভস্থ পানি উত্তোলন ও অব্যবহৃত রাসায়নিক পদার্থ পরিবেশ ও প্রতিবেশকে ক্রমে বিপন্ন করে তুলছে।
জাতীয় কৃষি নীতিতে ন্যানো প্রযুক্তিকে অন্তর্ভুক্ত করায় দেশে কৃষি শিক্ষা এবং গবেষণায় ন্যানো প্রযুক্তি অগ্রাধিকার পায়। উল্লেখ্য বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতক এবং স্নাতকোত্তর পর্যায়ে ন্যানো বায়োটেকনোলজি পড়ানো হয়। ইনস্টিটিউট অব বায়োটেকনোলজি অ্যান্ড জেনেটিক ইঞ্জিনিয়ারিং (আইবিজিই)—এর বিজ্ঞানীরা পৃথিবীতে প্রথম দিনের আলোতে রিচার্জেবল টাইটেনিয়াম ডাই—অক্সাইড ন্যানো ক্যাটালিস্ট আবিষ্কার করেছেন, যা গমের ব্লাস্ট রোগ দমনে কার্যকরী। বুয়েট ও বশেমুরকৃবির যৌথ গবেষণায় ন্যানো প্রযুক্তির মাধ্যমে আমাদের দৈনন্দিন জীবনে বহুলভাবে ব্যবহৃত সেলুলোজ দিয়ে তৈরি কাগজে জীবাণুরোধী গুণাবলি আরোপ করার কৌশল উদ্ভাবন করা হয়েছে।
এ উদ্ভাবন আমেরিকান কেমিক্যাল সোসাইটির বিখ্যাত জার্নাল এসিএস সাসটেইনেবল কেমিস্টি্র অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং—এ প্রকাশ হয়েছে। উদ্ভাবিত ন্যানো সিলভার কণা সংযোজিত কাগজ, কৃষিতে গুরুত্বপূর্ণ নানারকম ব্যাকটেরিয়া ও ক্ষতিকারক ছত্রাক দমনে এটি খুবই কার্যকর হতে পারে। উদ্ভাবিত জীবাণুরোধী এ কাগজ মূল্যবান পণ্য, ওষুধ, খাদ্য ও কৃষিজ পচনশীল উৎপাদন যেমন মাছ, ফলমূল এবং সবজি পরিবহন ও সংরক্ষণে ব্যবহার করা যাবে।
ন্যানো কার্বন কণা প্রযুক্তিভিত্তিক শিল্প স্থাপনের মাধ্যমে দেশের অর্থনীতিকে আরো চাঙ্গা করা সম্ভব। এছাড়া আমাদের বিজ্ঞানীরা পাট থেকে অত্যন্ত মূল্যবান সুগার মনোমার তৈরির কৌশল আবিষ্কার করতে সক্ষম হয়েছেন। ন্যানো প্রযুক্তিবিষয়ক আমাদের গবেষণার ফলাফল বিশ্বখ্যাত নেচারস সায়েন্টিফিক রিপোর্টস, মাইক্রোপোরাস ও মেসোপোরাস ম্যাটেরিয়ালস, ম্যাটেরিয়াল কেমিস্টি্র অ্যান্ড ফিজিকস, সাসটেইনেবল এনার্জি ফুয়েলস, জার্নাল অব ভিজুয়ালাইজড এক্সপেরিমেন্টস, জার্নাল অব ন্যানো সায়েন্স অ্যান্ড ন্যানো টেকনোলজি, জার্নাল অব ফিজিক্যাল
কৃষিতে ন্যানো প্রযুক্তির ব্যবহারে কিছু চ্যালেঞ্জ রয়েছে, যা সমাধানের জন্য গবেষণা করা প্রয়োজন। যেমন অধিকাংশ ন্যানো কণার বাণিজ্যিক উৎপাদন কষ্টসাধ্য ও ব্যয়বহুল। কৃষিতে ন্যানো কণা বাণিজ্যিকীকরণের আগে এর সম্ভাব্য ক্ষতিকারক দিকগুলোর পুঙ্খানুপুঙ্খ মূল্যায়ন করা প্রয়োজন। উদাহরণস্বরূপ, শর্করাভিত্তিক ন্যানো কণার ন্যানোটক্সিক কার্যকারিতা নেই এবং ফলে তা সার, বালাইনাশক ও জৈব অনুঘটক ও ওষুধ ডেলিভারি প্রক্রিয়ায় বাণিজ্যিকভাবে ব্যবহার করা সম্ভব।
০ টি মন্তব্য