সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা জরুরি
অন্ন-বস্ত্র-শিক্ষা-চিকিৎসা ও স্বাস্থ্য মানুষের মৌলিক অধিকার। কিন্তু প্রতিটিই প্রায় নাগালের বাইরে চলে যাচ্ছে। বিশেষ করে, দরিদ্র ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের কাছে। স্বাস্থ্য এখনো অনেক ব্যয়বহুল।
সরকারি হিসাবের তথ্য বলছে, আমাদের স্বাস্থ্যের পেছনে যত খরচ হয়, তার ৬৭ শতাংশই মানুষ নিজের পকেট থেকে খরচ করছে। অথচ বৈশ্বিক মান অনুযায়ী ৩৪ শতাংশের মতো খরচ হয়। তার প্রায় দ্বিগুণ আমরা খরচ করছি। আমাদের কাছে স্বাস্থ্য খাতে খরচ একটা বড় বোঝা। স্বাস্থ্যসেবার খরচের বিষয়টি আমরা ঠিকমতো স্বীকার করি না। স্বাস্থ্য খাতে খরচ নির্বাহ করতে গিয়ে শুধু দরিদ্র নয়, অনেক মধ্যবিত্ত পরিবারও নিঃস্ব হয়ে যায়। কারণ, এখন অসুখের ধরনও পালটে গেছে। ক্যানসার অথবা ক্রনিক অসুখের কারণে অনেককে ওষুধ খেয়ে যেতে হয় নিয়মিত। বেশ কিছু উদ্যোগ অবশ্য সরকারের আছে। অতি প্রয়োজনীয় ওষুধ বিলি করার বড় ধরনের প্রোগ্রাম আছে। তার পরও সমস্যা রয়েছে এখনো। কীভাবে এই সমস্যার সমাধান করা যায়, সেটি নিয়ে ভাবতে হবে। নিম্নবিত্ত, প্রান্তিক, দলিত ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের স্বাস্থ্যসেবায় প্রবেশাধিকারে বিড়ম্বনার বিষয়টি সামনে এসেছে।
স্বাস্থ্যসেবায় প্রান্তিক ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষের অর্থপূর্ণ প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করা জরুরি। সরকারের স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে সরকারি হাসপাতাল রয়েছে ৬৫৪টি এবং এসব হাসপাতালে মোট শয্যার সংখ্যা ৫১ হাজার ৩১৬টি। আর বেসরকারি হাসপাতাল রয়েছে ৫ হাজার ৫৫টি, যেখানে মোট শয্যার সংখ্যা ৯০ হাজার ৫৮৭টি। বাংলাদেশে স্বাস্থ্য খাতে কিছু অর্জন আছে, যা চোখে পড়ার মতো। এর মধ্যে রয়েছে মাতৃ ও শিশুমৃত্যু কমানো।
সারা দেশে প্রায় ১৪ হাজার ৫০০ কমিউনিটি ক্লিনিক ও সরকারি বিভিন্ন স্তরের হাসপাতালে বিনা মূল্যে চিকিৎসাসেবা এবং জাতীয় টিকাদান কার্যক্রমের মাধ্যমে বিনা মূল্যে টিকা দেওয়ার মাধ্যমে দেশ ইতিমধ্যেই সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা কার্যক্রমে বা ইউনিভার্সাল হেলথ কভারেজ বাস্তবায়নে এগিয়ে যাচ্ছে। এছাড়া কিছু এলাকায় পাইলট আকারে হেলথ স্কিমের মাধ্যমেও ইউনিভার্সাল হেলথ কভারেজ কার্যক্রম সরাসরি চলছে। পর্যায়ক্রমে তা সারা দেশে চালুর পরিকল্পনাও রয়েছে। যদিও দেশে এখনো সর্বজনীন স্বাস্থ্য সুরক্ষা কার্যক্রমে চ্যালেঞ্জ রয়ে গেছে। তবে এখনো দলিত, প্রান্তিক জনগোষ্ঠী ও সুবিধাবঞ্চিত মানুষ বিশেষ করে দিনমজুর, হিজড়া সম্প্রদায়, নরসুন্দর, যৌনকর্মী, জেলে, মুচি, মেথর, আদিবাসী সম্প্রদায়সহ অনেককে তাদের সাংবিধানিক অধিকার থাকা সত্ত্বেও স্বাস্থ্যসেবা নিতে অনেক বিড়ম্বনার সম্মুখীন হতে হয় আমাদের মন-মানসিকতার কারণে। এসব জনগোষ্ঠী তাদের প্রবেশাধিকারের বিড়ম্বনার কারণে সরকারি হাসপাতালগুলোতে বিনা মূল্যে স্বাস্হ্যসেবাগুলো থেকে বঞ্চিত হয়।
বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার এক জরিপ অনুযায়ী, আমাদের দেশের প্রায় ৫২ লাখ মানুষ প্রতি বছর নিজ পকেট থেকে স্বাস্থ্যসেবার ব্যয় নির্বাহ করতে গিয়ে দরিদ্র হচ্ছে। আর বড় ধরনের আকস্মিক স্বাস্থ্য ব্যয়ের মুখোমুখি হচ্ছে সোয়া ২ কোটি মানুষ। দিন দিন বাড়ছে ডাক্তারি পরামর্শের ফি, চিকিৎসা ও ওষুধের খরচ। কিন্তু স্বাস্থ্য খাতে সেই তুলনায় বরাদ্দ হয়েছে অনেক কম। স্বাস্থ্য খাতে বরাদ্দ বাড়ানোর দাবি দীর্ঘদিনের হলেও তা যেন উপেক্ষিত। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার (ডব্লিওএইচও) মতে, বাংলাদেশের স্বাস্থ্য বাজেটের ৬০ শতাংশ অর্থ ব্যয় হয় মূলত ভৌত অবকাঠামো নির্মাণ, পরিচালনা খাত ও বেতনভাতা প্রদানে। উল্লিখিত ধারাবাহিকতার বাস্তবতায় সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে গিয়ে দেখা যায় প্রয়োজনের তুলনায় বরাদ্দ খুবই অপ্রতুল। বরাদ্দ বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তথ্যের সঙ্গে বাস্তবতার মিল নেই—এরকম বিষয়ও পরিলক্ষিত হয়।
ইতিমধ্যে বাংলাদেশে সরকারি স্বাস্থ্যসেবা ও অবকাঠামো প্রশংসনীয়ভাবে উন্নত হয়েছে। তবে ওষুধ সরবরাহে অপর্যাপ্ততা, চিকিৎসকসংকট, অন্যান্য জনবলের অভাব, যন্ত্রপাতি ও স্বাস্থ্যকেন্দ্রের স্থাপনায় রক্ষণাবেক্ষণের দুর্বলতা, প্রশাসনিক জটিলতা এবং সুসংগঠিত রেফারেল পদ্ধতি না থাকায় স্বাস্থ্যকাঠামো পরিপূর্ণতা পাচ্ছে না। বেসরকারি স্বাস্থ্যসেবা গ্রহণের সক্ষমতা যাদের আছে তাদের জন্য এটি হয়তো কোনো সমস্যা নয়; কিন্তু স্বাস্থ্যচাহিদা মেটাতে এই অর্থের সংকুলান করাটা জনসংখ্যার বৃহত্তর অংশের জন্য বেশ কঠিন।
এখন আমরা আছি এসডিজির যুগে। আগে আমাদের প্রত্যাশা ছিল সবার জন্য স্বাস্থ্য। এখন বলা হচ্ছে, সবার জন্য সহজলভ্য ও মানসম্মত স্বাস্থ্য। সবার জন্য স্বাস্থ্য বলতে যে প্রত্যাশার কথা আমরা বলি, তা এখনো নিশ্চিত হয়নি। তবে দিনবদলের কারণে প্রত্যাশাকেও এখন আমাদের নতুন করে সাজাতে হচ্ছে। কোভিড-১৯-এর মতো নতুন নতুন রোগ মহামারির আকার নিচ্ছে। এখন মহামারি হচ্ছে ক্যানসার, হার্ট অ্যাটাক এবং ডায়াবেটিস। এগুলো হচ্ছে নতুন যুগের, মানে এসডিজি যুগের মহামারি। অধিকারভিত্তিক একটি স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা গড়ে তুলতে স্থানীয় সরকার একটি গুরুত্বপূর্ণ প্রতিষ্ঠান হিসেবে অবদান রাখতে পারে। স্বাস্থ্য নিয়ে আমাদের যে কোনো আলোচনাতেই প্রাধান্য পায় কোথায় ডাক্তার নেই, ওষুধ নেই, হাসপাতাল নেই, সিট নেই, হাসপাতালের দুরবস্থা, দুর্নীতি, অনিয়ম, বাজেটে বরাদ্দ কম, দালালদের উপদ্রব ইত্যাদি অনেক বিষয়। এর প্রতিটি বিষয়ই চিকিৎসাকেন্দ্রিক। এ বিষয়গুলোরও আলোচনা ও সমাধান প্রয়োজন। কিন্তু এসব আলোচনার ভিড়ে হারিয়ে যায় আমরা কীভাবে রোগ হ্রাস বা প্রতিরোধ করতে পারি।
বাংলাদেশ সংবিধানের মৌলিক চাহিদা বা প্রয়োজন হিসেবে চিকিৎসাকে স্বীকৃতি প্রদান করা হয়েছে এবং জনস্বাস্থ্যের উন্নয়নকে রাষ্ট্রের অন্যতম প্রাথমিক কর্তব্য হিসেবে শনাক্ত করা হয়েছে। কিন্তু সংবিধানের তৃতীয় ভাগে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টি উল্লেখ না থাকায় তা বলবত্যোগ্য অধিকার হিসেবে দাবি করা যাচ্ছে না। দেশের মানুষের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হলে, স্বাস্থ্যকে বলবত্যোগ্য মৌলিক মানবাধিকার হিসেবে সাংবিধানিক স্বীকৃতি দেওয়া দরকার এবং রোগপ্রতিরোধকেও অগ্রাধিকার দিতে হবে। স্বাস্থ্যসেবা পাওয়া মানুষের অধিকার, এটাও সাধারণ মানুষকে ব্যাপকভাবে বোঝানো এবং সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে যারা সেবা প্রদানকারীর ভূমিকায় আছেন তাদের জবাবদিহিতার সংস্কৃতি তৈরির জন্য সচেষ্ট হতে হবে।
০ টি মন্তব্য