মুখভঙ্গি পরিণত হবে কথায়
ধরুন আপনার চারদিকে হাজার হাজার মানুষ। চিৎকার, চেঁচামচি, হৈচৈ। অথচ এরই মধ্যে জরুরি হয়ে পড়েছে কারো সাথে ফোনে কথা বলার। এই ধরনের কোলাহলে যা প্রায় অসম্ভব। এ অবস্থায় এমন কোনো প্রযুক্তি যদি আপনার হাতে থাকতো যা ব্যবহার করে কোনো শব্দ উচ্চারণ না করেই আপনি কথা বলতে পারতেন নির্দিষ্ট কারো সাথে, তাহলে কি অসাধারণ ঘটনাই না হতো। প্রযুক্তিবিদরা এখন সেই ঘটনা ঘটানোর চেষ্টাটাই করছেন। তারা এমন প্রযুক্তি উদ্ভাবনে কাজ করছেন, যা বাস্তবে রূপ নিলে মুখে উচ্চারণ করে কথা বলার প্রয়োজন হবে না। মুখভঙ্গি করলেই তা কথা হিসেবে পৌঁছে যাবে অন্যের কাছে। দেখে মনে হবে একজন লোক হয়তো দাঁড়িয়ে আছে নীরবে, কিন্তু বাস্তবে হয়তো তা নয়। তিনি কথা বলে চলেছেন কোনো প্রিয়জনের সাথে। অথচ ভোকাল কর্ড বা স্বরতন্ত্রী দিয়ে বেরিয়ে আসছে না কোনো শব্দ।
প্রযুক্তিবিদরা বলছেন, আমাদের অফিস-আদালতগুলো প্রচ কোলাহলপূর্ণ। হাজার হাজার মানুষ সেখানে কাজ করছে। ফলে চারদিক থেকে ভেসে আসে রাশি রাশি শব্দ, যা জট পাকিয়ে যায়। এর মধ্যে কিছু শব্দ আমরা সাধারণ জ্ঞান দিয়ে ধরে ফেলতে পারি যে কে শব্দটি করেছে বা কোন নির্দেশনা কে দিয়েছে। তবে বেশিরভাগ ক্ষেত্রে তুমুল শব্দজটের কারণে নিজের কথা কাউকে পৌঁছে দেয়া কঠিন হয়ে দাঁড়ায়। চিৎকার করে দিতে হয় কোনো নির্দেশনা, যা অনেক সময় বিপত্তির কারণ হয়। রাস্তায় গাড়ির হর্ন আর গিজগিজে মানুষের মধ্যে থেকে যদি জরুরি প্রয়োজনে বাড়িতে ফোন করা দরকার হয় সেটাও সম্ভব হয় না। কারণ কোলাহলের কারণে বাসায় যিনি ফোন ধরবেন তিনি কিছুই শুনতে পারবেন না। এই অবস্থা থেকে উত্তরণের জন্যই এমন প্রযুক্তি উদ্ভাবন নিয়ে কাজ শুরু হয়, যা কোনো শব্দ উচ্চারণ ছাড়াই শান্তিপূর্ণ পরিবেশে যেকাউকে কথা বলার সুযোগ এনে দেবে।
চলতি বছর ডিজিটাল আইটি এবং টেলিকমিউনিকেশন্স সলিউশন নিয়ে বিশ্বের সবচেয়ে বড় বাণিজ্যমেলা সিবিটে এ প্রযুক্তিই প্রদর্শন করা হয়েছে। একে বলা হচ্ছে সাইলেন্ট সাউন্ড টেকনোলজি। বাংলা হতে পারে নীরব ধ্বনিপ্রযুক্তি। নাম থেকেই বোঝা যায়, এই প্রযুক্তি ভোকাল কর্ড বা স্বরতন্ত্রী ব্যবহার না করেই তথ্য স্থানান্তরে সহায়তা করে। বিষয়টি নিশ্চয়ই চাঞ্চল্যকর।
এই প্রযুক্তিতে কেবল মুখভঙ্গি বা ঠোঁট নাড়ালেই চলবে। ওই ঠোঁট নাড়া পরিণত হবে কমপিউটার নিয়ন্ত্রিত শব্দে, তারপর সেটি টেলিফোনে চলে যাবে নির্দিষ্ট কারো কাছে। যিনি টেলিফোন ধরবেন তিনি অডিও আকারে কথা শুনতে পারবেন।
জার্মানির কার্লশ্রু ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি তথা কেআইটির বিজ্ঞানী ও গবেষকরা এই প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছেন। তারা মনে করছেন, টেলিযোগাযোগের ক্ষেত্রে এটাই হবে ভবিষ্যৎ প্রযুক্তি।
আমরা যখন জোরে কথা বলি তখন জিহবা এবং বাকযন্ত্র দিয়ে বাতাস প্রবাহিত হয়। মুখের শব্দ উৎপাদন পেশী এবং চোয়াল এলাকা দিয়ে তখন তৈরি হয় শব্দ। যদিও শব্দ উৎপাদন পেশী বা আর্টিকুলেটর মাসলের ভূমিকা নিয়ে ইদানীং প্রশ্ন উঠেছে। অনেকে বলছেন, ধ্বনি ছাড়াও সেখানে শব্দ তৈরি হতে পারে। আসলে মস্তিষ্ক থেকে দুর্বল ইলেকট্রিক কারেন্ট যায় বাকযন্ত্রের পেশীতে। এই ইলেকট্রিক্যাল সিগনাল ইলেকট্রোমায়োগ্রামস নামে পরিচিত। পুরো বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করেই বিজ্ঞানীরা তাদের কৌশল উদ্ভাবনে কাজ করেছেন। এরই পরিপ্রেক্ষিতে কেআইটিতে সাইলেন্ট সাউন্ড টেকনোলজির জন্য যন্ত্র বা সেন্সরের উন্নয়ন ঘটানো হয়েছে। এই সেন্সরই পেশীর নড়াচড়া পর্যবেক্ষণ করে তা ধ্বনিতে পরিণত করবে এবং এসময় কোনো শব্দ তৈরি হবে না।
এই ইলেকট্রোমায়োগ্রাফিক সেন্সর সংযুক্ত থাকবে মুখের বিভিন্ন অংশে এবং গলায়। মুখের পেশীর ভঙ্গি পরিবর্তনে সৃষ্ট ইলেকট্রিক্যাল সিগনাল রেকর্ড করবে ওই সেন্সর এবং কথা বলার সময় মুখের যে ভাব হয় তা আগে থেকে রেকর্ড করা থাকবে ও সেই রেকর্ডের সাথে সেন্সরের রেকর্ড মিলিয়ে দেখা হবে। যখন দুই রেকর্ড ম্যাচ করবে বা মিলে যাবে তখন ধ্বনি টেলিফোন লাইনের মাধ্যমে অপর প্রান্তে থাকা ব্যক্তির কাছে কথা হিসেবে পৌঁছে যাবে।
গোপনে বার্তা পাঠানোর ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তি হতে পারে অত্যন্ত কার্যকর মাধ্যম। এই প্রক্রিয়ায় বহু মানুষের মধ্য থেকে প্রয়োজনীয় কথা সেরে নেয়া যাবে, কাউকে কিছু জানতে না দিয়ে। বিজ্ঞানীরা মনে করছেন, ভবিষ্যতে এই প্রযুক্তির বিপুল চাহিদা সৃষ্টি হবে। নীরবে কথা চালিয়ে যাওয়ার প্রযুক্তি নিয়ে তারা অনেক বেশি আশাবাদী। এটি হাতে এসে গেলে, যেকোনো কর্মপরিবেশ বা পরিস্থিতিতে ‘নীরব কথা’ চালিয়ে যাওয়া সম্ভব হবে।
যেসব স্থানে শব্দ উচ্চারণ করে কথা বলা অসম্ভব সেসব ক্ষেত্রে এই প্রযুক্তি হতে পারে আশীর্বাদ। যেহেতু বাতাস ছাড়া শব্দ চলতে পারে না তাই নভোচারীরা কথা বলার সময় নানা সমস্যায় পড়েন। এই প্রযুক্তি তাদের এ অবস্থা থেকে উত্তরণে সহায়ক হতে পারে। পানির নিচে যারা কাজ করেন অর্থাৎ ডুবুরিরা মুখে অক্সিজেন মাস্ক নিয়ে কাজ করেন বলে পানির নিচে তারা কথা বলতে পারেন না। অথচ অনেক সময় পানির উপরে থাকা কাউকে হয়তো তাৎক্ষণিক জরুরি বার্তা দেয়া প্রয়োজন হয়। তখন তাকে পানির নিচ থেকে ফের উপরে উঠে কথা বলে আবার পানির নিচে যেতে হয়। এটা সময় ও ব্যয়সাপেক্ষ। তাই নতুন প্রযুক্তি তার জন্য হতে পারে আশীর্বাদ।
এমনকি বাকাপ্রতিবন্ধীরাও এই প্রযুক্তির সুবিধা নিয়ে মনের ভাব প্রকাশের জন্য টেলিফোনে ‘নীরব কথা’ বলতে পারবে। যাদের কথায় জড়তা বা তোতলামি ভাব রয়েছে, কিংবা যেকোনো কারণেই হোক কথা বলতে অসুবিধা হয় বা বলতে পারে না তারা এই প্রযুক্তির সর্বোচ্চ সুবিধা পাবে।
যেহেতু এই প্রযুক্তিতে কথা বললে শুধু নির্দিষ্ট ব্যক্তির কাছে চলে যাবে কথা, তাই কথা অন্য কেউ শুনে ফেলার ভয় নেই। ফলে তথ্যের বা কথার গোপনীয়তা যথাযথভাবেই বজায় থাকছে। কথার মধ্যে কারো নাক গলানোরও অবকাশ নেই। ওই নীরব যান্ত্রিক কথাও অনুবাদ হতে পারে বিভিন্ন ভাষায়। এখন পর্যন্ত জার্মান, ইংলিশ এবং ফরাসী ভাষায় কথা অনুবাদের ব্যবস্থা রয়েছে। ভবিষ্যতে এই সংখ্যা আরো বাড়বে বলে জানিয়েছেন গবেষকরা। ফলে বিশ্বের যেকোনো দেশের মানুষ অন্য যেকোনো দেশের মানুষের সাথে ভাব বা কথা বিনিময় করতে পারবে নির্দিষ্ট ভাষা না জেনেও।
এক্ষেত্রে কিছুটা সমস্যা অবশ্য এখনো রয়েছে। যেমন চীনা ভাষার ক্ষেত্রে। এই ভাষায় ধ্বনির ভিন্নতা কথার বিভিন্ন অর্থ তৈরি করে। যদিও মুখের ভঙ্গি থাকে একই রকমের। এই প্রযুক্তি প্রয়োগ এই জায়গায় জটিল পরিস্থিতি সৃষ্টি করে। আর একটি বড় সমস্যা হচ্ছে কে কথা বলছেন তা চিহ্নিত করা যায় না। মানুষের কণ্ঠস্বরের ভিন্নতা দেখে যেমন আমরা তাকে শনাক্ত করতে পারি, এক্ষেত্রে তেমনটি সম্ভব নয়। এখানে যান্ত্রিক কথা হওয়ার কারণে সবার কথাই একই রকমের মনে হবে। এই যন্ত্রটি এখন ব্যবহার করতে মুখে লাগাতে হয় ৯টি তারের হুক। তাই এটা ব্যবহার সহজসাধ্য তো নয়ই, কেউ কেউ বলছেন অবাস্তব।
তারপরও গবেষণা অব্যাহত আছে। একটা পর্যায়ে এসে হয়তো এটি ব্যবহার অত্যন্ত সহজ ও ব্যয়সাশ্রয়ী হবে। সব কিছু মিলিয়ে এই ‘নীবর ধ্বনি’ প্রযুক্তি নিয়ে সবাই আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। এখন যেসব তারের হুক মুখে লাগানো হচ্ছে এক সময় হয়তো তার আর প্রয়োজন হবে না। সেন্সরটি হয়তো সংযুক্ত করা যাবে মোবাইল ফোনের ভেতরে, যা হবে ব্যবহারবান্ধব।
প্রকৌশলীরা দাবি করেছেন, তাদের এই প্রযুক্তি ৯৯ শতাংশ দক্ষতায় কাজ করছে। এর অর্থ ১০০ শব্দের মধ্যে ৯৯ শব্দ সঠিক হচ্ছে, একটি মাত্র ভুল হচ্ছে। তারা আশা করছেন, আগামী ৫ থেকে ১০ বছরের মধ্যে ঘরে ঘরে ব্যবহার হবে এই প্রযুক্তি।
০ টি মন্তব্য