ডিজিটাল পদ্ধতিতে ব্রেইল সহায়ক যন্ত্রের উদ্ভাবন
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধকতা মানুষের জন্য অভিশাপ। দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা এই বাধা কাটিয়ে উঠেছে নানা সহায়ক প্রযুক্তির মাধ্যমে।
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীরা সাধারণত ব্রেইল পদ্ধতিতে লেখাপড়া করে, যেখানে স্লেট অ্যান্ড স্টাইলাসের সাহায্যে এরা লিখে থাকে। স্লেট অ্যান্ড স্টাইলাসে স্লেট হচ্ছে দু’টি কাঠ বা প্লাস্টিকের বোর্ড উপর-নিচ করে সংযুক্ত থাকে। উপরের বোর্ডটিতে কিছু আয়তাকার ছক থাকে এবং নিচের বোর্ডটিতে উপরের বোর্ডের আয়তাকার ছকগুলো ঠিক নিচে ৬টি ডট থাকে। শিক্ষার্থী এই দুই বোর্ডের মাঝখানে একটি পুরু কাগজ রেখে স্টাইলাসের (একটি পিন যার সাহায্যে কাগজ ছিদ্র করা হয়) মাধ্যমে লেখে। লেখা শেষ হয়ে গেলে পৃষ্ঠাটিকে স্লেট থেকে বের করে পৃষ্ঠাটির অপর পিঠে পড়তে হয়।
এই ব্রেইল পদ্ধতির প্রধান বাধা হলো ব্রেইলে যে ৬টি ডট আছে তা নিয়ে শিক্ষার্থীরা বিভ্রান্ত হয়ে পড়েন। বিশেষ করে নতুন শিক্ষার্থীরা এ অসুবিধায় পড়েন। আর এই বিভ্রান্তি দূর করতেই ব্রেইল লিখন সহায়ক যন্ত্রের উদ্ভাবন। এই যন্ত্রটি কমপিউটারের সাথে সংযুক্ত করে চালাতে হয়। যন্ত্রটিতে রয়েছে অডিও সিস্টেম, যার মাধ্যমে শিক্ষার্থীকে সব ধরনের নির্দেশনা দেয়া হয়।
বাংলাদেশে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের কাছে এই যন্ত্রটি পৌঁছে দেয়ার লক্ষ্যে ১০ সপ্তাহে একটি প্রকল্প হাতে নেয়া হয়েছে। প্রকল্পে কার্নেগি মেলন ইউনিভার্সিটির (সিএমইউ) অধীনে টেকব্রিজ ওয়ার্ল্ড নামের গবেষণা কেন্দ্রের ৫ জন শিক্ষার্থী এবং এ প্রকল্পের সাথে জড়িত এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইম্যানের (এইউডবিউ) ১০ জন শিক্ষানবিসের মধ্যে দু’জন ভারতীয় এবং বাকি সব বাংলাদেশী। যন্ত্রটি সফল ব্যবহারে লক্ষ্যে এইউডবিউ স্থানীয় এনজিও ইয়ং পাওয়ার ইন স্যোসাল অ্যাকশন (ইপসা)-এর সাথে সিএমইউর যোগসূত্র স্থাপন করেছে। এ দলের মূল লক্ষ্য উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যকার প্রযুক্তিগত বৈষম্য (ডিজিটাল ডিভাইড) দূর করা। টেকব্রিজওয়ার্ল্ডের নির্দেশনায় গবেষণা করছেন আইস্টেপের (ইনভেটিভ স্টুডেন্ট টেকনোলজি এক্সপেরিয়েন্স) শিক্ষানবিসেরা। আইস্টেপ প্রথম কাজ শুরু করে ২০০৯ সালে তানজানিয়ায়। এটি তাদের দ্বিতীয় উদ্যোগ।
দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের লেখাপড়ার বিশেষ পদ্ধতি ব্রেইল লেখা ও শেখার যন্ত্র সম্পর্কে জেন হরউয়িজ বলেন, দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী এবং নিরক্ষরদের পড়াশোনার জন্য ইপসার একটি নিজস্ব কর্মসূচি চালু রয়েছে। এতে পাঠ্যবইয়ের সাথে শ্রুতিপাঠের (অডিও রিডিং) সমন্বয় করে তাদের শেখানো হয়। কিন্তু এটি ইংরেজি মাধ্যমে। আমরা এর বাংলা সংস্করণের সফটওয়্যার তৈরি করছি, যাতে শিক্ষার্থীরা আরও সহজে সবকিছু আয়ত্ত করতে পারে।
ইপসা-আইসিটি অ্যান্ড রিসোর্স সেন্টার (আইআরসিডি) একটি প্রতিবন্ধীবান্ধব তথ্যপ্রযুক্তি কেন্দ্র। দীর্ঘদিন যাবৎ এই কেন্দ্রটি প্রতিবন্ধীসহ সব মানুষের তথ্যপ্রযুক্তির প্রবেশগম্যতায় সহযোগিতা করে আসছে। এ যাবৎ প্রায় ১০৭ জন দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী ব্যক্তি এ কেন্দ্র থেকে বিভিন্নভাবে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির ওপর প্রশিক্ষণ লাভ করে। এ ছাড়াও রয়েছে একটি ডিজিটাল টকিং লাইব্রেরি। ইপসার প্রধান নির্বাহী আরিফুল রহমান বলেন, আমরা প্রতিবন্ধী মানুষের জন্য ব্যবহারোপযোগী তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছি, যার নবতম সংস্করণ হলো এই ব্রেইল শেখার যন্ত্রটি। এর মধ্য দিয়ে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধী শিশুরা ডিজিটাল পদ্ধতিতে ব্রেইল শিখতে পারবে।
যেহেতু ইপসা বেশ কিছুদিন ধরে চট্টগ্রামে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের নিয়ে কাজ করে যাচ্ছে তাই যন্ত্রটির উন্নয়নে তাদের অভিজ্ঞতাকে নির্দেশনা হিসেবে কাজে লাগানো হচ্ছে। এতে এরা বিভিন্ন পাঠ ও গেমের মাধ্যমে ব্রেইলে লেখার অনুশীলন করতে পারবে। তা ছাড়া বর্তমানে কমপিউটার-চালিত ব্রেইল যন্ত্রটিতেও পরিবর্তন আনা হচ্ছে এবং এর ইংরেজি নির্দেশনাকে বাংলায় রূপান্তর করা হচ্ছে।
যন্ত্রটির পরীক্ষামূলক ব্যবহারের জন্য ইপসার পরামর্শে একটি দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের স্কুলে ইতোমধ্যে কার্যক্রম সম্পন্ন হয়েছে। উল্লেখ্য, যন্ত্রটি উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাভাষা ও সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণতার বিষয়টি বিবেচনা করা হয়েছে। যদিও দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের জন্য যন্ত্রটি আশার আলো জ্বালিয়েছে। কিন্তু বাংলাদেশের মতো উন্নয়নশীল দেশে অপর্যাপ্ত কমপিউটার ও বিদ্যুৎ সরবরাহ বাধা সৃষ্টি করছে। যার ফলে এখন এই যন্ত্রটিকে কমপিউটারের সাহায্য ছাড়াই ব্যবহারের উদ্দেশ্যে প্রকল্পটির মেয়াদ বাড়ানো হয়েছে। শত বাধা অতিক্রম করে দৃষ্টিপ্রতিবন্ধীদের শিক্ষিত হওয়ার প্রতিবন্ধকতাকে দূর করাই হবে প্রকল্পটির সফলতা।
টেকব্রিজওয়ার্ল্ডের অধীনে আইস্টেপ (iSTEP- Innovative Student Technology Experience) শিক্ষানবিস হিসেবে চট্টগ্রামে এই প্রথম কার্নেগি মেলন ইউনিভার্সিটির পাঁচ সদস্যের একটি দল দুটি প্রকল্পে কাজ করার জন্য এসেছে। টেকব্রিজওয়ার্ল্ড মূলত সিএমইউর রোবোটিক ইনস্টিটিউটের অধীনে একটি গবেষক দল। টেকব্রিজওয়ার্ল্ডের মূল লক্ষ্য হলো উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর মধ্যকার বিবদমান প্রযুক্তিগত বিভেদ দূর করা। তাদের অধীনে আইস্টেপের উদ্যোগটি প্রথম শুরু হয় ২০০৯ সালে, যার অন্যতম লক্ষ্য হলো সিএমইউ’র শিক্ষার্থীদের অনুন্নত ও উন্নয়নশীল দেশের উন্নয়নের জন্য তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির সৃজনশীলভাবে ব্যবহারের অভিজ্ঞতা দান। জুন থেকে আগস্ট পর্যন্ত মোট দশ সপ্তাহ উল্লিখিত দলটি এশিয়ান ইউনিভার্সিটি ফর উইমেন এবং উন্নয়ন সংস্থা ইপসা’র সাথে যৌথভাবে প্রকল্প দুটো সফল করার জন্য কাজ করছে।
প্রকল্প দু’টির একটি হলো ইংরেজি শিক্ষার একটি মোবাইল গেম উদ্ভাবন করা, যা বাংলা সংস্কৃতির সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ হবে। অন্যটি কম খরচে ব্রেইল লিখন শিক্ষার সহায়ক যন্ত্র উদ্ভাবন, যা বাংলা ব্রেইল লিখন শিক্ষায় ব্যবহার করা যাবে।
এই পাঁচ সদস্যবিশিষ্ট দলের চারজন সদস্য চট্টগ্রামে এবং একজন যুক্তরাষ্ট্রের পিটসবার্গ থেকে প্রকল্পটি সমন্বয় করছেন। চট্টগ্রামে অবস্থানরত চারজন শিক্ষানবিস, এইউডবিউর দশজন শিক্ষানবিসের সাথে চারটি দলে বিভক্ত হয়ে প্রকল্প দুটি জন্য কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন।
এইউডব্লিউ শিক্ষানবিস ফাহ্রিয়ার মতে, ‘আইস্টেপের এই দলে কাজ করার মাধ্যমে বিভিন্ন গতানুগতিক সমস্যা সৃজনশীলভাবে সমাধানের শিক্ষা ও সুযোগ পাচ্ছি, যা আমাদের নিজেদের আঞ্চলিক সমস্যার সমাধানেও আমরা পরে কাজে লাগাতে পারব।’ তিনি আরো বলেন, ‘এছাড়াও এ প্রকল্পে কাজ করতে গিয়ে বিভিন্ন দেশের ও সংস্কৃতির মানুষের সাথে কাজ করার সুযোগ পাচ্ছি এবং তাদের কাজ করার ধরন ও অভিজ্ঞতা থেকে অনেক নতুন কিছু শিখতে পারছি, যা আসলেই খুব মজার অভিজ্ঞতা।’
সিএমইউ-এইউডব্লিউর এই দলটি ইতোমধ্যে তাদের কাজের নয় সপ্তাহ পার করেছে। এ প্রসঙ্গে আইস্টেপ শিক্ষানবিস ব্রায়ান বলেন, ‘এই দলটির লক্ষ্য হলো এমন প্রযুক্তির উদ্ভাবন ও ব্যবহার করা, যা টেকসই উন্নয়নের দিকে স্থানীয় সমাজকে এগিয়ে নিয়ে যাবে। এককথায়, আমরা সবাই এখানে একটি একই লক্ষ্য নিয়ে সামনে এগিয়ে যাচ্ছি আর তা হলো মানুষের জীবনযাত্রার মানকে উন্নত করা।’
০ টি মন্তব্য