যন্ত্রের আকারে আসছে সিক্সথ সেন্স
স্পর্শ ও অঙ্গভঙ্গি পরিচালিত যন্ত্র ক্রমেই জনপ্রিয় হয়ে উঠছে। মোবাইল ফোনের আকার হচ্ছে ক্ষুদ্র থেকে ক্ষুদ্রতর। যেকোনো সময় যেকোনো স্থানে দ্রুত স্থাপিত হচ্ছে যোগাযোগ। কমপিউটারের ক্ষুদ্র আকারের কারণে সেটি এখন পকেটে নিয়ে ঘোরা সম্ভব হচ্ছে। বাহ্যিক বিশ্ব এবং ডিজিটাল যন্ত্রের মধ্যে গড়ে উঠছে চমৎকার মিথস্ক্রিয়া। এসব কিছুতে উৎসাহিত হয়ে আধুনিক যন্ত্র উদ্ভাবনায় এগিয়ে এসেছেন ম্যাসাচুসেটস ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজির মিডিয়া ল্যাবের পিএইচডির ছাত্র ভারতীয় গবেষক প্রণব মিস্ত্রি। ইতোমধ্যেই তিনি দেহভিত্তিক এমন যন্ত্র উদ্ভাবন করেছেন, যা চাঞ্চল্য ফেলে দিয়েছে।
আমরা কখনো কোথাও ফোন কল করতে চাইলে হ্যান্ডসেট নিয়ে ডায়াল করে থাকি। প্রণব তার ব্যতিক্রম। এমন প্রয়োজনে তিনি কেবল তার বাম হাতটি বুকের সামনে মেলে ধরেন এবং হাতের আঙ্গুলে থাকা কীপ্যাডে চেপে কল করেন। ডান হাতের তর্জনিতে থাকে একটি লাল টুপি। তার পকেটে থাকে এয়ারফোন ও মাইকযুক্ত সেলফোন। গুজরাটের ছোট শহর পালানপুরের প্রণব এর আগে কাজ করেছেন মাইক্রোসফট ইন্ডিয়ায় ইউজার এক্সপেরিয়েন্স (ইউএক্স) গবেষক হিসেবে। এখন তিনি নিজেকে একজন ডিজাইনার হিসেবে পরিচয় দিতে পছন্দ করেন। তিনি বলেন, ডিজাইন বা নকশার অবস্থান থেকে আমি প্রযুক্তিকে দেখতে ভালোবাসি। অন্যদিকে প্রযুক্তিকে মূল্যায়ন করতে চাই উদ্ভাবিত যন্ত্রের নকশার ভিত্তিতে। আমার সব প্রকল্প এবং গবেষণা কাজে এই মনোভাবের প্রতিফলন রয়েছে।
হাতের মধ্যেই কীপ্যাড
প্রণব এখন কাজ করছেন যে প্রকল্প নিয়ে তার নাম দেয়া হয়েছে ‘সিক্সথ সেন্স’ বা ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়। এ কাজে তার সঙ্গে রয়েছেন এমআইটি মিডিয়া ল্যাবের ফ্লুইড ইন্টারফেস গ্রুপের প্রধান প্যাটি মায়েস এবং ছাত্র লিয়ান চ্যাং। প্রকল্প প্রসঙ্গে প্রণব বলেন, আদিকাল থেকেই মানুষ প্রকৃতির সঙ্গে যুদ্ধ করে টিকে থাকতে ব্যবহার করছে তার পঞ্চ ইন্দ্রিয়। ওই ইন্দ্রিয় জ্ঞান মানুষকে পরিস্থিতিভিত্তিক সিদ্ধান্ত নিতে সহায়ক হয়েছে। কিন্তু গবেষণায় দেখা যায় পঞ্চ ইন্দ্রিয় সব সময় নির্ভুল সিদ্ধান্ত নিতে সহায়তা করে না। এজন্য প্রয়োজন হয় ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের। এই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের উন্নয়ন ঘটানোর জন্যই গত ফেব্রুয়ারিতে টেকনোলজি, এন্টারটেনমেন্ট, ডিজাইন (টিইডি) ২০০৯ এক্সপোতে এই প্রকল্প অবমুক্ত করা হয়।
২০০২ সালে মুক্তি পাওয়া স্টিভেন স্পিলবার্গের বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীভিত্তিক চলচ্চিত্র মাইনোরিটি রিপোর্ট-এ ভবিষ্যৎ প্রযুক্তির অনেক কল্পরূপ তুলে ধরা হয়েছে। ছবির নায়ক টম ক্রুজকে দেখা গেছে হাতে বিশেষ ধরনের গ্লাভস পরে কোনো স্পর্শ ছাড়াই ডিজিটাল স্ক্রিনে কাজ করছেন। তার আঙ্গুলের নড়াচড়ার ভিত্তিতে পরিবর্তিত হচ্ছে স্ক্রিনের চিত্র। স্পিলবার্গ তার বিজ্ঞান বিষয়ক উপদেষ্টা জন আন্ডারকফলারের কাছ থেকে এমন ইন্টারফেসের ধারণা পান। আন্ডারকফলার অবলং কোম্পানিতে এই ইন্টারফেসের আরো উন্নয়ন ঘটিয়েছেন। তিনি সম্প্রতি প্রায় ওই একই ধরনের কাজের প্রাথমিক সংস্করণ প্রদর্শন করেছেন, যাকে বলা হচ্ছে ‘জি-স্পিক’। এই জি-স্পিকে ব্যবহার করা হয়েছে ১০টি দ্রুতগতির ইনফ্রারেড ক্যামেরা, বহুমুখী একাধিক প্রজেক্টর এবং ব্যয়বহুল হার্ডওয়্যার সেটআপ।
প্রণব বলেছেন, ওই জি-স্পিক তার কাজে উৎসাহ যুগিয়েছে। একই সঙ্গে আরো কিছু যন্ত্র তাকে অনুপ্রাণিত করেছে, যে যন্ত্রগুলো এখনো উন্নয়ন পর্যায়ে রয়েছে। তিনি বলেন, যন্ত্রের আকার বহনযোগ্য পর্যায়ে নিয়ে আসা এবং ব্যয় সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখাটা সহজ কাজ নয়। যদিও তিনি সে কাজটিই করতে চাইছেন। তার প্রথম কাজ হবে হাতের অঙ্গভঙ্গিভিত্তিক ইন্টারফেস ব্যবহারকারীদের কাছে সহজ করে তোলা। দ্বিতীয় পর্যায়ে যন্ত্রকে বহনযোগ্য আকার দিতে এবং ব্যয় সাশ্রয় করতে হবে।
টিইডিতে দেয়া বক্তব্যে মায়েস বলেন, কোনো ফ্যান্টাসি নয়, আমরা যে যন্ত্র নিয়ে কাজ করছি তা সত্যিকার অর্থেই ষষ্ঠ ইন্দ্রিয়ের কাজ করবে। তিনি বলেন, সিক্সথ সেন্স হলো একটি পরিধানযোগ্য, অঙ্গভঙ্গিভিত্তিক ইন্টারফেস। যন্ত্রটির এখন যে প্রাথমিক সংস্করণ রয়েছে তাতে হার্ডওয়্যার হিসেবে ব্যবহার করা হয়েছে একটি পকেট প্রজেক্টর (৩ এম এমপ্রো ১১০), একটি ক্যামেরা (লজিটেক কুইক ক্যাম) এবং একটি ল্যাপটপ কমপিউটার। আর প্রণবের উদ্ভাবিত বিশেষ ধরনের অ্যালগরিদমভিত্তিক সফটওয়্যার দিয়ে যন্ত্রটি পরিচালিত হয়। ল্যাপটপ কমপিউটার ছাড়া যন্ত্রটির দাম পড়বে প্রায় সাড়ে ৩শ’ ডলার (সাড়ে ১৭ হাজার রুপি)। প্রকৌশলীরা ল্যাপটপ কমপিউটারের স্থানে এখন মোবাইল ফোন ব্যবহারের কথা ভাবছেন। এটি করা গেলে সিক্সথ সেন্সের দাম আরো অনেক কমে যাবে। মোবাইল ফোন প্রযুক্তি যেভাবে এগিয়ে যাচ্ছে তাতে ল্যাপটপের স্থান দখল করা তার জন্য সময়ের ব্যাপার মাত্র। প্রজেক্টর এবং ক্যামেরা থাকবে টুপির সঙ্গে যুক্ত। পিঠে ঝোলানো থাকবে ল্যাপটপ। এগুলো একে অপরের সঙ্গে তার দিয়ে যুক্ত থাকবে। টুপির পরিবর্তে গলায় যুক্ত থাকতে পারে ক্যামেরা ও প্রজেক্টর। মাথার চেয়ে বরং গলা কম সঞ্চরণশীল, তাই পারফরমেন্স ভালো পাওয়া যাবে। ক্যামেরার ধারণ করা ডাটা এবং আঙ্গুলে থাকা কালার মার্কারের ট্র্যাক প্রসেস করবে ওই বিশেষ সফটওয়্যার। যন্ত্রের বর্তমানে সংস্করণ কেবল ৪টি আঙ্গুল ট্র্যাক করতে পারে। পরবর্তীতে এর সংখ্যা বাড়ানো যাবে।
যন্ত্রটির কার্যক্ষমতা প্রদর্শনের জন্য যে ভিডিও তৈরি করা হয় তাতে দেখা গেছে, প্রণব একটি বইয়ের দোকানে গিয়ে একটি উপন্যাস তুলে নিলেন। তখন যন্ত্রটি বইটি চিহ্নিত করে ফেললো এবং আমাজন ডট কমের রেটিং তুলে ধরলো। যন্ত্রটি বইটির রিভিউ, পাঠকদের মন্তব্য এবং অন্যান্য তথ্যও তাৎক্ষণিকভাবে দিতে সক্ষম। সিক্সথ সেন্সের পেন টাইপ ইনপুট ব্যবস্থা রয়েছে। তর্জনি হতে পারে এর চমৎকার বিকল্প। আগেই বলা হয়েছে, এর ইন্টারফেস স্পর্শ/হাতের নড়াচড়াভিত্তিক। প্রণব বলেন, ব্যবহারকারী তার তর্জনিকে একটি কলম হিসেবে ব্যবহার করে যেকোনো চিত্রাঙ্কন করতে পারবে। বৃদ্ধাঙ্গুলিকে বের করে বা লুকিয়ে কলমটি সক্রিয় করা যাবে।
এপলের আইফোনের মধ্যদিয়ে মূলত অঙ্গভঙ্গিভিত্তিক যন্ত্রের জগতে বিপ্লব ঘটে যায়। এর পর থেকেই বাজারে আসতে থাকে স্পর্শ বা আঙ্গুলের নড়াচড়াভিত্তিক নানা যন্ত্র। সিক্সথ সেন্স তারই ধারাবাহিকতা। আঙ্গুলের নড়াচড়া দিয়েই এই যন্ত্রে জুম ইন বা জুম আউটসহ নানা কিছু করা সম্ভব। আইফোনের ক্ষেত্রে যেসব সীমাবদ্ধতা রয়েছে সিক্সথ সেন্সে তা অতিক্রমের চেষ্টা করেছেন গবেষকরা। বিভিন্ন সাইন বা চিহ্ন ব্যবহার করে বহুবিধ কাজ করা যাচ্ছে এই যন্ত্রটিতে। চলতি পথে কোনো দৃশ্য পছন্দ হলে সে দৃশ্য ধারণের জন্য আলাদা ক্যামেরার প্রয়োজন হবে না। দুই হাতের আঙ্গুলগুলো দিয়ে ফ্রেম তৈরি করলে স্বয়ংক্রিয়ভাবে ছবি তোলা হয়ে যাবে এবং তা সেভ হবে। পরে এটি দেখা যাবে। যেকোনো পণ্য কেনার ক্ষেত্রেও সিক্সথ সেন্স দিতে পারে সঠিক পরামর্শ। কোনো পণ্য স্বাস্থ্যসম্মত কিনা বা পণ্যটি সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য পাওয়া যেতে পারে এ যন্ত্রের মাধ্যমে। তখন ক্রেতা পণ্য কেনার ক্ষেত্রে সহজেই সঠিক সিদ্ধান্তটি নিতে পারবে। বিমানের টিকেট কাটার পর সিডিউল বিলম্বিত হতে পারে কিনা কিংবা যে গেট দিয়ে বিমানে যেতে বলা হয়েছিল তা পরিবর্তিত হয়েছে কিনা সেসব তথ্যও দেবে সিক্সথ সেন্স। সংবাদপত্র বা সাময়িকী পাঠকরা কোনো নিবন্ধ বা খবর পাঠের সময় ওই যন্ত্রের কাছ থেকে পাবেন ভিডিও ফুটেজ, নিউজ আপডেট, খেলার স্কোর ইত্যাদি।
প্রণব বলেন, ভারত এবং বাকি বিশ্বে যে ডিজিটাল ডিভাইড বা বৈষম্য রয়েছে সিক্সথ সেন্স তা পূরণে সহায়ক হবে। শিক্ষা, চিকিৎসা এবং অন্যান্য ক্ষেত্রে এই যন্ত্র চাঞ্চল্যকর অবদান রাখবে। প্রতিবন্ধীদের জন্য এটি হবে আশীর্বাদস্বরূপ। প্রকৌশলীরা এখন কাজ করছেন সিক্সথ সেন্সের এমন সংস্করণ তৈরি করতে যাতে এটি দৃষ্টি প্রতিবন্ধীদের জন্য চোখ, শ্রবণ প্রতিবন্ধীদের জন্য কান এবং বাক প্রতিবন্ধীদের জন্য মুখ বা স্বরযন্ত্র হিসেবে কাজ করে। খেলাধুলাতেও ওই যন্ত্রের অবদান রাখার সুযোগ রয়েছে। পুরো বিশ্বকে একটি ভার্চুয়াল মাঠে পরিণত করতে পারে যন্ত্রটি। সবকিছু মিলিয়ে শিক্ষা এবং গেমিংয়ের ক্ষেত্রে বড় ধরনের ঝাঁকুনি দেবে ওই যন্ত্র।
বাণিজ্যিকভিত্তিতে যখন যন্ত্রটি তৈরি করা হবে তখন এর দাম আজকের দিনে একটি সেলফোনের চেয়ে বেশি হবে না। ভবিষ্যতে এর আকারও ক্ষুদ্র হয়ে আসবে। দেড় থেকে ২ বছরের মধ্যেই সিক্সথ সেন্স বাজারে পৌঁছে যাবে বলে মনে করছেন প্রণব। তবে যন্ত্রটি নিয়ে আরো কাজ করতে হবে বলে জানিয়েছেন মায়েস। গবেষণার মধ্য দিয়ে এমন দিন হয়তো আসবে যখন মস্তিষ্কে প্রতিস্থাপন করা হবে ওই ‘সিক্সথ সেন্স’ যন্ত্র।
০ টি মন্তব্য