তথ্যভান্ডারের কার্যকারিতা
তথ্যভান্ডারের কার্যকারিতা যাচাই সংক্রান্ত এই ‘গণগবেষণা’টি পরিচালিত হয় ২০০৮-এর মে-জুন মাসে বাংলাদেশের দু’টি ইউনিয়নে। এর একটি সিরাজগঞ্জ জেলার তাড়াশ উপজেলার মাধাইনগর ইউনিয়ন এবং অন্যটি দিনাজপুর জেলার সেতাবগঞ্জ উপজেলার মুশিদহাট ইউনিয়ন। এই দুই ইউনিয়নে ইউনিয়ন পরিষদ এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর নেতৃত্বে ‘কমিউনিটি ই-সেন্টার’ গড়ে তোলা হয়েছিল। গবেষণার অর্থায়ন করে ইউএনডিপি। গণগবেষণার প্রধান উদ্দেশ্য ছিল দু’টি। এক. টেলিসেন্টারে যে তথ্যভান্ডার ব্যবহার করা হয়, যাচাই করে দেখা তা কতখানি কার্যকর হচ্ছে এবং এই তথ্যভান্ডারকে আরো অধিক কার্যকর করে তুলতে হলে কোথায় কী পরিবর্তন ঘটানো দরকার। দুই. একটি ‘সাধারণ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি’ তৈরি করা- যা ব্যবহার করে তথ্যভান্ডার প্রণেতা এবং টেলিসেন্টার পরিচালনাকারীরা লাভবান হতে পারেন।
এই গণগবেষণায় প্রধান গবেষকের ভূমিকা পালন করে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে তিন ধরনের মানুষ। এক. স্থানীয় জনগোষ্ঠী যারা সংলাপের তথা যৌথ আলোচনার মাধ্যমে তথ্যভান্ডারের কার্যকারিতার মান নির্ণয় এবং ‘সাধারণ বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি’ তৈরির ক্ষেত্রে প্রধান ভূমিকা পালন করে। দুই. স্থানীয় একদল স্বেচ্ছাব্রতী তথ্যকর্মী, যারা এই সংলাপ পরিচালনায় সহায়কের ভূমিকা পালন করে এবং তিন. বাইরের (ইউএনডিপি) গবেষক যারা স্বেচ্ছাব্রতী তথ্যকর্মীদের সংলাপ-সহায়ক হয়ে উঠতে এবং গবেষণার ফলাফল তথ্যায়ন করতে দক্ষতা অর্জনে ভূমিকা রাখেন।
গণগবেষণায় মাধাইনগর ও মুশিদহাট ইউনিয়নের ২৫টি গ্রামের ৬০টি পাড়া বা মহল্লায় সংলাপ পরিচালনা করা হয়। এতে কৃষক নারী ও পুরুষ, ছাত্র-ছাত্রী, শিক্ষক, সরকারি-বেসরকারি স্বাস্থ্যকর্মী, ক্ষুদ্র ব্যবসায়ী/উদ্যোক্তা, গৃহিণী, সাংবাদিকসহ মোট ১০ ধরনের পেশার ছয় শতাধিক মানুষ অংশ নেয়। সংলাপে কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, বাজার মূল্য, আইন প্রভৃতি বিষয়ের ওপর মোট ৪৮ ধরনের তথ্য উপস্থাপন ও ব্যাখ্যা করা হয়।
তথ্যভান্ডারের কার্যকারিতা যাচাই
তথ্যভান্ডার যাচাই করা হয় সংলাপ বা যৌথ আলোচনার মাধ্যমে। মানুষ সংলাপে বসে বিভিন্ন স্থানে- কারো ঘরে, উঠানে, খোলা মাঠে, ক্লাব/স্কুল ঘরে, ইউনিয়ন পরিষদ ভবনে। প্রতিটি সংলাপে ন্যূনতম ১০ জন এবং সর্বোচ্চ ২৫ জন মানুষ অংশ নেন। সংলাপ আরম্ভ হয় সাধারণত সন্ধ্যায়, চলে রাত নয়টা-দশটা পর্যন্ত। সংলাপ সমন্বয় করেন একজন স্বেচ্ছাব্রতী, যার দায়িত্ব যৌথ আলোচনায় সবার গভীর অংশ নেয়া নিশ্চিত করা এবং আলোচনার মাঝে প্রয়োজনীয় তথ্য ও সূত্র হাজির করা, যার ফলে আলোচনা আরো গভীরে যেতে পারে। সংলাপে তথ্যসম্পর্কিত বিভিন্ন ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ প্রধান পাঁচটি ধাপে অসংখ্য প্রশ্নের মধ্য দিয়ে উপস্থাপন করা হয়। তথ্য উপস্থাপনের জন্য একটি ল্যাপটপ ব্যবহার করা হয়।
তথ্য উপস্থাপনের পাঁচটি ধাপ
০১.
গ্রাম বা পাড়াভিত্তিক যৌথ আলোচনা আয়োজন করা। এতে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর প্রধান প্রধান সমস্যা কী, তা চিহ্নিত করা এবং তা কিভাবে তারা সমাধান করেন তার ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ ও অভিজ্ঞতা শোনা।
০২.
বিষয়বস্ত্ত নির্বাচন এবং তা উপস্থাপন করা। বিষয়স্ত্ত নির্বাচন করা হয় যৌথ আলোচনায় উত্থাপিত সমস্যা/সমাধানকে কেন্দ্র করে।
০৩.
তথ্যভান্ডারের কার্যকারিতা নির্ণয়। উপস্থাপিত তথ্য সবাই বিশ্লেষণ করে খুঁজে বের করেন এটি কতখানি সেলফ এক্সপ্লানেটরি, কতখানি মিথষ্ক্রিয় এবং চিহ্নিত করেন কোথায় কতটুকু পরিবর্তন করলে তা আরো কার্যকর হবে।
০৪.
টেলিসেন্টার ব্যবস্থাপনায় বন্ধুসুলভ পরিবেশ নিশ্চিত করার উপায় খুঁজে বের করা। যেকোনো মানুষ যাতে করে স্বাধীনভাবে তথ্য সংগ্রহ করতে পারে, সে জন্য টেলিসেন্টারে কেমন ব্যবস্থাপনা দরকার এবং তা নিশ্চিত করতে ইউনিয়ন পরিষদ, স্থানীয় সিইসি কমিটি এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কার কী ভূমিকা ও দায়িত্ব হওয়া উচিত তা চিহ্নিত করা।
০৫.
স্থানীয় জ্ঞানভান্ডার গড়ে তোলা। আলোচনা হয় সিইসিকে স্থানীয় জ্ঞানভান্ডার হিসেবে গড়ে তুলতে হলে তার তথ্যভান্ডারকে আরো সমৃদ্ধ করতে হবে। এর একটি সহজ পথ হলো স্থানীয় সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের তথ্যভান্ডার এবং স্থানীয় লোকজ জ্ঞান তথ্যায়ন করে তা সিইসির তথ্যভান্ডারের সাথে জরুরিভিত্তিতে সংযুক্ত করা। একই সাথে আলোচনা হয় সরকারি-বেসরকারি এসব প্রতিষ্ঠানের সেবা মানুষ সিইসির মাধ্যমে কী করে আরো সহজে পেতে পারে। কী করে সিইসিকে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে টেকসই করে তোলা সম্ভব হবে এবং এক্ষেত্রে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ভূমিকা কী হওয়া দরকার তাও চিহ্নিত করা।
তথ্যভান্ডারের কার্যকারিতা যাচাই এবং উল্লেখযোগ্য ফলাফল
দেখা যায়, তথ্যভান্ডারের বেশিরভাগ তথ্যই তৃণমূল মানুষের কাছে সহজে বোধগম্য নয়। কারণ তথ্যের, বিশেষ করে সবাক চিত্রের বিষয়বস্ত্তর বাক্য বিন্যাসে পাঠ্য বইয়ের ভাষা এবং প্রায়ই ইংরেজি শব্দের ব্যবহার। কৃষকরা ব্যাখ্যা-বিশ্লেষণ করে মতামত দেন- ‘আমাদের জন্য তথ্য বানালে তাতে ইংরেজি আর কঠিন (কারিগরি) শব্দ ব্যবহার করবেন না’।
একাধিকবার উপস্থাপনের পর বোঝা যায়, সিইসিতে অনেক কনটেন্ট আছে যেগুলো সেলফ এক্সপ্লানেটরি নয়। এসব বিষয়বস্ত্ত একবার দেখে কৃষকের পক্ষে আয়ত্তে আনা সম্ভব হয় না। এমনকি অন্যের সাহায্য নিয়েও নয়। এর ওপর বিষয়বস্ত্ত যদি টেকনিক্যাল বিষয়ে হয় তাহলে তো আরো জটিলতা সৃষ্টি করে। এমন কনটেন্ট মানুষ অর্থ ও সময় ব্যয় করে দেখবে কেন? সিইসি ম্যানেজার ও স্বেচ্ছাব্রতী তথ্যকর্মীদের অভিজ্ঞতা হলো, এ ধরনের বিষয়বস্ত্ত বিনামূল্যে হবার পরও, এমনকি বিষয়বস্ত্ত প্রয়োজনীয় জেনেও, মানুষ আগ্রহ দেখায় না।
তথ্য ব্যবহারকারীরা চিহ্নিত করেন তথ্যভান্ডারে একাধিক বিষয়ে তথ্য রয়েছে, যা স্থানীয় মানুষের কাছে অপ্রয়োজনীয় অর্থাৎ তাদের কাছে এর চেয়েও উন্নত সমাধান রয়েছে, যা তারা পূর্বপুরুষদের কাছ থেকে অর্জন করেছে। এই সঙ্কট বিদ্যমান তথ্যভান্ডারের ওপর মানুষের আস্থাহীনতা তৈরি করতে পারে। এই সঙ্কট দ্রুত কাটিয়ে ওঠার সুযোগ নেই, তবে তথ্য ব্যবহারকারীরা মতামত দেন, এ সমস্যা সমাধানের একমাত্র পথ হলো তথ্যভান্ডার তৈরির আগে নির্বাচিত বিষয়ে স্থানীয় মানুষের সাথে খোলামেলা আলোচনা করা। শুধু প্রশ্নপত্র পূরণ করে এ চাহিদা নির্ণয় অসম্ভব।
একজন সেন্টার ম্যানেজার ও স্বেচ্ছাব্রতী তথ্যকর্মীর দায়িত্ব শুধু তথ্য সরবরাহ করা নয়, বরং তথ্য সংগ্রহকারীর চাহিদা যথাযথভাবে পূরণ হলো কি-না, তা যাচাই করা এবং তথ্য ব্যবহারকারীর সাথে এমন আচরণ করা, যাতে করে তার মধ্যে আরো নতুন তথ্য সংগ্রহের আগ্রহ সৃষ্টি হয় এবং এভাবে ‘উন্নয়ন চাহিদা’ (Development needs) সৃষ্টির একটি সৃষ্টিশীল সংস্কৃতি গড়ে তোলা।
যৌথ আলোচনা থেকে বেরিয়ে আসে, গ্রামে খুব কমসংখ্যক মানুষই আছে যারা কমপিউটারের সামনে বসে সাবলীলভাবে প্রশ্ন করে তথ্য জানার চেষ্টা করে। এটা ঘটে না তার কারণ লজ্জা আর অজানা এক প্রযুক্তিভীতি। নারীদের ক্ষেত্রে এটা মারাত্মক পর্যায়ে বিদ্যমান। অনেক মানুষ তথ্য জানতে আসে কিন্তু লজ্জায় বা ভয়ে তথ্য না বুঝলেও, কিংবা কোনো প্রশ্ন থাকলেও, তা না করেই ফিরে আসে। এর সমাধান না হলে তথ্যভান্ডারের ওপর মানুষের আস্থা গড়ে উঠবে না, বরং দূরত্ব বাড়তে থাকবে।
সিইসিতে দরকার বন্ধুসুলভ পরিবেশ- যাতে করে কোনো তথ্য ব্যবহারকারী যদি দেখেন যে সংগৃহীত তথ্য যথাযথভাবে কাজ করেনি, অর্থাৎ তথ্য সঠিকভাবে বানানো হয়নি, এটা যেন নির্ভয়ে ও অনায়াসেই জানাতে পারেন এবং কী পরিবর্তন করলে এ তথ্য কাজ করবে, সে পরামর্শও যেন দিতে পারেন। পরামর্শ বাস্তবায়নে সিইসি কর্তৃপক্ষ আন্তরিকভাবে উদ্যোগ না নিলে কেন তা করা হলো না তার কারণ জানতেও যাতে করে যেকেউ প্রশ্ন করতে পারেন, তেমন বন্ধুসুলভ সহায়ক পরিবেশ জরুরি। অন্যথায় শুধু তথ্যভান্ডার নয়, সিইসির সামাজিকভাবে টেকসই হয়ে ওঠার প্রক্রিয়াই দুর্বল হয়ে পড়বে।
তথ্যের বিনিময়ে স্থানীয় মানুষের আর্থিক অংশগ্রহণ থাকতে হবে- সবসময়ই সংলাপের একটি তুমুল উত্তেজনাকর আলোচ্য বিষয় ছিল- তথ্য চাহিদা বাড়াতে হলে, উন্নয়ন চাহিদা সৃষ্টি করতে হলে এবং সিইসির ওপর মানুষের মালিকানা বাড়াতে হলে, তথ্যের বিনিময়ে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর যত অল্পই হোক একটি অর্থনৈতিক অংশ নেয়া অনিবার্য। তবে এই অংশ নেয়া অবশ্যই বেচাকেনার মতো হলে চলবে না, হতে হবে এমনভাবে যাতে মানুষ মনে করতে থাকে তথ্য চাহিদা, উন্নয়ন চাহিদা বাড়ার সাথে তাদের সার্বিক জীবনমান উন্নয়নের গভীর সম্পর্ক রয়েছে এবং এ প্রক্রিয়াকে টিকিয়ে রাখা তাদের একটি সামাজিক দায়িত্ব। উল্লেখ্য, এই আলোচনার সূত্র ধরে পরে ‘পারিবারিক তথ্যসেবা কার্ড’-এর ধারণা বেরিয়ে আসে, যা টেলিসেন্টারের ইতিহাসে একটি নতুন ঘটনা।
সিইসি তখনই গ্রামের একজন কৃষক কিংবা নারীর কাছে বেশি আকর্ষণীয় হয়ে উঠবে যখন তাদের সময়মতো যাওয়া-আসার স্বাধীনতা ও সুযোগ থাকবে। ইউনিয়ন পরিষদ এই বাস্তবতা বিবেচনায় নিলেও তাদের পক্ষে সবসময় ভোরবেলা বা সন্ধ্যার পর সিইসি খোলা রাখা কঠিন। বাণিজ্যিক দৃষ্টিভঙ্গি ছাড়া এই সমস্যার সমাধান অসম্ভব।
কেসস্টাডি
প্রথম সংলাপ। উত্তর মথুরাপুর গ্রাম, মাধাইনগর ইউনিয়ন, তাড়াশ উপজেলা, সিরাজগঞ্জ। ১২ মে ২০০৮, সন্ধ্যা ৬.৩০ থেকে পরবর্তী সাড়ে তিন ঘণ্টা। সংলাপ অনুষ্ঠিত হয় কৃষক আব্দুল আজিজের বাড়িতে। সংলাপে অংশগ্রহণকারী ১৪ জনেরই প্রধান পেশা কৃষি, দু’জন ছিলেন যাদের কৃষির পাশাপাশি ক্ষুদ্র ব্যবসায় আছে এবং দু’জন ছিলেন কবিরাজ। সবাই পুরুষ ছিলেন।
ভূমিকা শেষ হলে প্রথম প্রশ্ন ছিল- কৃষিতে প্রধানত কী কী সমস্যা আপনাদের মোকাবেলা করতে হয়? উত্তর এলো- সময়মতো পর্যাপ্ত পরিমাণ সার পাওয়া যায় না, পোকা মারার বিষ তথা কীটনাশক পাওয়া যায় না, ভালো বীজ নেই, বন্যা আমাদের জন্য বড় সমস্যা, গরু কমে গেছে, শ্রমিকের মূল্য বেশি, বাজারে ন্যায্য মূল্য পাই না, বিভিন্ন জাতের ফল হয় না এ এলাকায়। সবাই একবাক্যে বলেন, ‘তবে এক নম্বর সমস্যা হলো সময়মতো পর্যাপ্ত পরিমাণ সার ও কীটনাশক না পাওয়া।’ জানতে চাওয়া হয়- এই সমস্যা সমাধানের জন্য কী ধরনের উদ্যোগ নেন? সরল উত্তর- ‘মেম্বার-চেয়ারম্যানের কাছে যাই, ব্লক সুপারভাইজার বা বিএস-এর পেছনে ঘুরি, উপজেলায় যাই। ঘোরাঘুরি করে অবশ্য লাভ হয় না। পরিমাণমতো কেউই সার-কীটনাশক পায় না। গরিব যারা, যাদের জমি কম, তারা আরো পায় না। কিন্তু সারের পেছনে ঘোরাঘুরি করতে অনেক সময় ব্যয় হয়, খরচও হয়।’ সংলাপ-সহায়ক প্রশ্ন তোলেন, ফলন বাড়াতে বা পোকা দমন করতে জমিতে ঠিক কী পরিমাণ সার, কীটনাশক দরকার তা কি কারো জানা আছে? উত্তর এলো- ‘আমরা মাটি পরীক্ষা করব কী করে?’ সিইসিতে অনেকবার গেছি। কিন্তু মাটি পরীক্ষা করার চিন্তা কারো মাথাতেই কখনো আসেনি।
এই আলোচনার সূত্র ধরে এবং সবার মতামতের ভিত্তিতে মাটি পরীক্ষার কনটেন্ট (এনিমেশন) উপস্থাপন করা হয়। পাঁচ মিনিটের কনটেন্ট। সবাই বিস্ময় নিয়ে দেখলেন। উপস্থাপন শেষ হলে যখন জানতে চাওয়া হয় এখন কি আপনারা নিজেরা মাটি পরীক্ষা করতে পারবেন? সবাই নিরুত্তর থাকেন। একজন বলেন, আর একবার দেখান, বোঝা যায়নি। আবার শুরু করা হলো। মিনিট দু’য়েক চলার পর কাঁচুমাচু কণ্ঠে কৃষক আজিজ বলে ওঠেন, ভাই থামান, বুঝতে পারতেছি না। উপস্থাপন থামানো হলে অনেকে গড়গড় করে বলতে শুরু করলেন, জিনিস ভালো, খুবই ভালো। কিন্তু আমরা এটা করতে পারব না, শিক্ষিত মানুষ লাগবে। প্রশ্ন করা হয়, উপজেলা কৃষি বিভাগ কি এ ব্যাপারে কিছু করতে পারবে? উত্তর এলো- ওই ব্লক সুপারভাইজার তথা বিএস (বর্তমানে উপ-সহকারী কৃষি অফিসার) তো কোনো কাজ করে না। প্রস্তাব আসে- মাটি পরীক্ষার বিষয়টি নিয়ে বিএসদের দেখান। এ পর্যায়ে মাটি পরীক্ষার আলাপ আপাতত এখানেই শেষ করতে হয়। আলোচনার ধারাবাহিকতা রক্ষা করতে বীজ সংরক্ষণের কনটেন্ট উপস্থাপন করা হয়। উপস্থাপন শেষ হওয়া মাত্রই প্রায় সবাই বলে ওঠেন ‘ঠিকই আছে’। প্রশ্ন করা হয়- ঠিক আছে মানে কী? উত্তর এলো- এটা আমাদের জানা। একজনের অনুরোধে ‘ডাবের মুকুল ঝরে পড়া রোধ’ কনটেন্ট দেখানো হয়। একই উত্তর- ঠিকই আছে।
অষ্টম সংলাপ। গ্রাম বেহাগা, মুশিদহাট ইউনিয়ন পরিষদ, সেতাবগঞ্জ, দিনাজপুর। ২৪ মে ২০০৮। বেহাগা ছাত্র কল্যাণ সমিতি চাতাল। বিকেল সাড়ে চারটা থেকে সাড়ে ছ’টা। উপস্থিত ১২ জনই নারী এবং বেহাগা মহিলা সমবায় সমিতির সদস্য। তাদের প্রধান সমস্যা আয় বাড়ানোর পথ না জানা। ‘নকশি কাঁথা’ বিষয়বস্ত্ত উপস্থাপন করা হয়। প্রশ্ন করা হয়- সমাধান মিলেছে? সবাই আনন্দের সাথে বলেছে- হ্যাঁ, মিলেছে। প্রশ্ন করা হয়- যা বুঝলেন, তা এখন অন্যদের ব্যাখ্যা করে বোঝাতে পারবেন? এবার উত্তর এলো- না, এতো ভদ্র ভাষায় বলতে পারব না। পরামর্শ দেন- আয় বাড়লে সংসারে কি প্রভাব পড়ে, মহিলার কেমন লাগে, সেসব বিষয়েও একই কনটেন্টে বর্ণনা থাকা উচিত। প্রশ্ন করা হয়- এমন অনেক তথ্য সিইসিতে আছে, তা কিভাবে সংগ্রহ করতে চান? এর জন্য ব্যয় করবেন কি-না? উত্তর আসে- অবশ্যই সিইসিতে যাব, টাকা লাগলে খরচ করব, এতে তো আমাদের উপকার হবে। প্রশ্ন করা হয়- আর কী তথ্য জানতে চান? লাইলী বেগম বলেন, জমি রেজিস্ট্রেশন করার নিয়ম জানতে চাই। তবে ইউনিয়ন পরিষদে যারা থাকেন তাদেরকে আমাদের একটু ভালো করে বুঝিয়ে দিতে হবে। এই ফিডব্যাক এবং পরে আলোচনার ভিত্তিতে বিভিন্ন সংগঠনের সদস্যরা দলবেঁধে সিইসিতে আসতে শুরু করে। স্বেচ্ছাব্রতী তথ্যকর্মীরা বড় রুমে তাদের জন্য আলাদাভাবে আয়োজন করে কনটেন্ট দেখায় এবং চাহিদা অনুযায়ী ব্যাখ্যা করে।
একটি সরকারি সেবা নিশ্চিত হলো
মাধাইনগর ইউনিয়নের মথুরাপুর গ্রামের আলোচনার সূত্র ধরে পরের দিন উপ-সহকারী কৃষি অফিসারদের সামনে মাটি পরীক্ষার কনটেন্ট দেখানো হয়। তাদের বক্তব্য- উপজেলায় মাটি পরীক্ষার সব ব্যবস্থা আছে। কৃষকরা আসে না। উপস্থিত কৃষকরা প্রতিবাদ করে বললেন, মাটি পরীক্ষার যে ব্যবস্থা আছে এটাই তো আজ প্রথম জানলাম। প্রশ্ন করা হলো, এ সমস্যার সমাধান করা যায় কিভাবে? সমবেত সিদ্ধান্ত হলো, কৃষি অফিস প্রতি মাসে কমপক্ষে একদিন ইউনিয়ন পরিষদে কৃষকদের হাতেকলমে মাটি পরীক্ষা করে দেখাবে। এ সিদ্ধান্তের আলোকে এর ১৪ দিন পরে মাটি পরীক্ষার আয়োজন করা হয়, তাতে শতাধিক কৃষক উপস্থিত হয় এবং এখন তা প্রতি মাসে একবার করে নিয়মিত চলছে। মতামত আসে, মাটি পরীক্ষার কনটেন্টে উপজেলা পর্যায়ে মাটি পরীক্ষার উপকরণ আছে এবং মাটি পরীক্ষা করে দেখানোটা যে তাদের দায়িত্ব এই তথ্য সংযুক্ত করা দরকার। এর পাশাপাশি মাটি পরীক্ষা করতে গিয়ে বেরিয়ে আসে মাটি পরীক্ষা করতে হলে তা ১৫ দিন আগে থেকে প্রক্রিয়াজাত করতে হয়। এই তথ্যও কনটেন্টে ছিল না।
০ টি মন্তব্য