https://gocon.live/

প্রযুক্তির খবর

টেকসই টেলিসেন্টার

টেকসই টেলিসেন্টার টেকসই টেলিসেন্টার
 

টেকসই টেলিসেন্টার


বাংলাদেশে টেলিসেন্টার নেটওয়ার্ক তথা বিটিএন-এর তথ্য অনুযায়ী দেশে বর্তমানে টেলিসেন্টারের সংখ্যা প্রায় ১২শ। কয়েকটি মডেলের আওতায় এসব টেলিসেন্টার পরিচালিত হচ্ছে। যেমন- উদ্যোক্তা মডেল, এনজিও মডেল এবং কমিউনিটি মডেল। হাল আমলে অবশ্য এই কমিউনিটি মডেলের হাত ধরে শুরু হতে যাচ্ছে পিপিপিপি অর্থাৎ পাবলিক প্রাইভেট পিপলস পার্টনারশিপ মডেল।


উদ্যোক্তা মডেল মূলত স্থানীয় কোনো উদ্যোক্তার নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। যেমন- গ্রামীণফোন সিইআইসি। এটা মূলত ব্যবসায় উদ্যোগ। এনজিও মডেলে ডোনার এনজিওর দিকনির্দেশনাতেই টেলিসেন্টার পরিচালিত হয়। স্থানীয় কিছু লোক এ মডেলে বিচ্ছিন্নভাবে যুক্ত থাকে বটে, তবে এ মডেলের সার্বিক ঝুঁকি প্রধানত ডোনার এনজিওই বহন করে। কমিউনিটি মডেল ভিন্নভাবে গড়ে ওঠে। এখন পর্যন্ত এ মডেলের যতটুকু অভিজ্ঞতা হয়েছে তাতে দেখা যাচ্ছে, এই মডেলে টেলিসেন্টার প্রধানত সরকারি প্রতিষ্ঠান এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর যৌথ নেতৃত্বে পরিচালিত হয়। এই মডেলে টেলিসেন্টার স্থাপিত হয় ইউনিয়ন পরিষদে। এর ব্যবস্থাপনা পরিচালিত হয় স্থানীয় জনগোষ্ঠীর প্রতিনিধি ও ইউনিয়ন পরিষদের সমন্বয়ে গঠিত কমিটির নেতৃত্বে। অর্থাৎ কমিউনিটি মডেলে টেলিসেন্টার কিভাবে পরিচালিত হবে, সেখানে কী থাকবে আর থাকবে না, ব্যবসায় কৌশল কী হবে, তা নির্ধারিত হয় ইউনিয়ন পরিষদ এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর যৌথ আলোচনার ভিত্তিতে। সম্প্রতি ইউএনডিপির পাইলট প্রজেক্ট কমিউনিটি ই-সেন্টারের সূত্র ধরে গড়ে উঠছে পিপিপিপি মডেল। এই মডেলে টেলিসেন্টার স্থাপিত হবে ইউনিয়ন পরিষদে, তবে এর ব্যবস্থাপনা পরিচালিত হবে স্থানীয় কোনো উদ্যোক্তার নেতৃত্বে এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর থাকবে পূর্ণ সম্পৃক্ততা। এই মডেলে টেলিসেন্টারের জন্য প্রয়োজনীয় হার্ডওয়্যার ও স্থাপন ব্যয় আসবে ইউনিয়ন পরিষদ এবং স্থানীয় উদ্যোক্তার বিনিয়োগ থেকে। স্থানীয় জনগোষ্ঠীরও থাকবে অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ। কমিউনিটি ই-সেন্টারের সফল অভিজ্ঞতার আলোকে পিপিপিপি মডেল গড়ে উঠেছে এবছর থেকে। ইতোমধ্যে স্থানীয় সরকার বিভাগ সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইউনিয়ন ইনফরমেশন সেন্টার তথা ইউআইসি নামে সারাদেশে এ মডেলের আওতায় টেলিসেন্টার গড়ে তুলবে।


উদ্যোক্তা মডেলে তথ্যভান্ডার থাকে প্রধানত অনলাইনে। বাণিজ্যিক সেবাই সেখানে মুখ্য, জীবিকাভিত্তিক তথ্যসেবা গৌণ। এনজিও মডেলে তথ্যভান্ডার অফলাইন-অনলাইন দুটিই থাকে। এখানে জীবিকাভিত্তিক তথ্য- কৃষি, স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কর্মসংস্থান, বাজার, আইন, মানবাধিকার ইত্যাদি বিষয়ে বিভিন্ন তথ্য থাকে। কমিউনিটি মডেলেও এনজিও মডেলের মতো তথ্যভান্ডার থাকে। তবে এখানে অফলাইন তথ্যভান্ডারের গুরুত্ব অনেক বেশি। কমিউনিটি মডেলের একটি উল্লেখযোগ্য দিক হলো স্থানীয় সরকারি ও বেসরকারি তথ্যভান্ডারের সমন্বয় ঘটানো। গবেষণায় দেখা যায়, কমিউনিটি মডেলগুলোতে স্থানীয় সরকারি কৃষি, স্বাস্থ্য বিভাগের এবং একাধিক এনজিও যারা ওই ইউনিয়নকে কেন্দ্র করে কাজ করে তাদের সব তথ্য টেলিসেন্টারে সংরক্ষণ করা আছে। এর ফলে কমিউনিটি মডেলে তথ্যভান্ডারের পরিমাণ যেকোনো টেলিসেন্টারের তুলনায় বেশি। একাধিক এনজিও মডেলে দেখা যায় স্থানীয় ডাটাবেজ তৈরি করেছে। যেমন- আমাদের গ্রাম। কমিউনিটি মডেলে (মুশিদহাটে) দেখা যায়, স্থানীয় মানুষের চাহিদার ভিত্তিতে স্থানীয় ডাক্তাররা ডাটাবেজ তৈরি করেছেন। এটা তারা করেছেন নিজেদের অর্থে ও দক্ষতায়। এনজিও মডেলের সাথে কমিউনিটি মডেলের পার্থক্য হলো এমন উদ্যোগ হয়তো এনজিও মডেলেও হয়, তবে তা ঘটে সংশ্লিষ্ট এনজিওর দিকনির্দেশনায়, স্থানীয় জনগোষ্ঠীর সম্পৃক্ততা সেখানে একেবারেই থাকে না।


টেলিসেন্টারের আয় আসে প্রধানত বাণিজ্যিক সেবা থেকে এবং ব্যয় হয় কর্মীর বেতন, উপকরণ এবং বিল প্রভৃতি খাতে। উদ্যোক্তা মডেলে আয় আসে প্রধানত বাণিজ্যিক সেবা থেকে। বাণিজ্যিক সেবা বলতে ফোন, ফ্ল্যাক্সি, এক্সেসরিজ বিক্রি এবং ইন্টারনেট ব্যবহার। ব্যয় হয় উপকরণ ক্রয়, বিভিন্ন বিল ও ভাড়ার জন্য। এই মডেলে টেলিসেন্টার জেলা-উপজেলা শহরে হওয়ায় এসব বাণিজ্যিক সার্ভিস বিক্রির পরিমাণ বেশি। এনজিও মডেলে টেলিসেন্টার হয় তুলনামূলক পল্লী এলাকায়। সেখানে মানুষের ফোন, ফ্ল্যাক্সি, ইন্টারনেট ব্যবহারের হার তুলনামূলক কম। এখানে কমপিউটার কম্পোজ, ফটোতোলা এসবের পরিমাণ বেশি। এসব কাজ যাতে করে বেশি আসে সেজন্য তাদের স্থানীয় বিভিন্ন সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে উদ্বুদ্ধ করতে হয়। আয় বাড়াতে এনজিও মডেলে প্রশিক্ষণের গুরুত্ব অনেক বেশি। বিশেষ করে কমপিউটার প্রশিক্ষণ। এখানে সবচেয়ে বেশি ব্যয় হয় একদল কর্মীর বেতন, উপকরণ, বিল ও ভাড়ার জন্য। প্রাপ্ত তথ্যমতে, ডি.নেটের একটি সেন্টারের মাসিক ব্যয় বিশ হাজার টাকার মতো। সেখানে গড়ে ৫-৬ জন কর্মী কাজ করে যারা বেতনভুক্ত। কমিউনিটি মডেলের চিত্র এনজিও মডেল এবং উদ্যোক্তা মডেল থেকে বেশ ভিন্ন। এই মডেলে আয় আসে বাণিজ্যিক সেবা যেমন- মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর ভাড়া, ফটোতোলা, কম্পোজ, ইন্টারনেট ব্যবহার থেকে। আয়ের একটি দীর্ঘ ও স্থায়ী পথ হলো ইউনিয়ন পরিষদের বাজেট থেকে টেলিসেন্টারের জন্য থোক বরাদ্দ ঘোষণার দৃষ্টান্ত এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অর্থনৈতিক অংশগ্রহণ বাড়াবার লক্ষ্যে পারিবারিক তথ্যসেবা কার্ড তৈরি।


উদ্যোক্তা মডেলে পর্যাপ্ত আয় হয় বেশিরভাগ সেন্টারে। কোনো কোনো সেন্টারে খরচের তুলনায় আয় বেশিই হচ্ছে। কিন্তু তা হলেও টেলিসেন্টারের যে উদ্দেশ্য- মানুষের দোরগোড়ায় তথ্যসেবা পৌঁছে দেয়া তা হচ্ছে না। ফলে এই মডেলে টেলিসেন্টার কার্যত একটি বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠান হিসেবেই প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। এনজিও মডেলে এখনো পর্যন্ত ভর্তুকি দিতে হচ্ছে। কমিউনিটি মডেলে দেখা যাচ্ছে নতুন এক সম্ভাবনাময় চিত্র। এখানে বাণিজ্যিক খাত থেকে আয় দিনে দিনে বাড়ছে। মাল্টিমিডিয়া প্রজেক্টর সরকারি ও বেসরকারি অফিস ছাড়াও গ্রামের মানুষ তা ভাড়া নিয়ে ব্যবহার শুরু করেছে। গ্রামে সাধারণত বিয়ে কিংবা বিনোদনের জন্য ব্যবহার হয়। একদিনে এর ভাড়া ৮০০ থেকে ১০০০ টাকা পর্যন্ত। সে হিসেবে মাস দুইবার ভাড়া দিতে পারলেই কিন্তু সেন্টারের পুরো খরচ উঠে আসে। আর এর বাইরে ইউনিয়ন পরিষদের থোক বরাদ্দ একটি বিরাট সাপোর্ট। তাতে করে এই দুই খাত থেকে যে অর্থ আসে তাতে সেন্টার পরিচালনার খরচ নির্বাহ করতে আর অসুবিধা হবার কথা নয়। কমিউনিটি মডেলে কর্মীর বেতন কম। সর্বোচ্চ দুইজন কর্মী, যাদের বেতন ১০০০ টাকা করে ২০০০ টাকার বেশি নয়। তবে তাদের বেতনের সাথে যুক্ত হয় চুক্তি অনুযায়ী নিট আয়ের ২৫% কমিশন। এই কমিশন পাবার কারণে কর্মী কেবল বেতনভুক্ত কর্মীর মতো নয়, আচরণ করে উদ্যোক্তার মতো। এর বাইরে কমিউনিটি মডেলের সবচেয়ে উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো পারিবারিক তথ্যসেবা কার্ডের প্রচলন। মাধাইনগর (কমিউনিটি মডেল) ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান জানান, আমার ইউনিয়নে সাড়ে পাঁচ হাজার পরিবারের বাস। আমরা এমনভাবে গ্রামবাসীর সাথে আলোচনা করেছি সবাই একটি করে কার্ড সংগ্রহ করবে অর্থের বিনিময়ে। যার মূল্য ১০০ টাকা করে এক বছরের জন্য। অর্থাৎ এক বছরে আমরা অর্থ সংগ্রহ করব সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা। যদি সাড়ে পাঁচ লাখ টাকা নাও আসে, যদি এর অর্ধেকও আসে তা হলেও ওই টেলিসেন্টারে শুধু আয়-ব্যয় সমান সমান হবে তাই নয়, উদ্বৃত্ত হবে। আর এটা ঘটলে তা হবে বাংলাদেশে এমনকি দুনিয়ায় এটাই প্রথম ঘটনা। কিন্তু কিভাবে ঘটছে এসব?


টেলিসেন্টারের জন্য ইউনিয়ন পরিষদের থোক বরাদ্দ এবং পারিবারিক তথ্যসেবা কার্ডের ধারণা আসে গণগবেষণা অর্থাৎ ইউনিয়ন পরিষদ ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ধারাবাহিক যৌথ আলোচনা থেকে। সবাই মিলে সিদ্ধান্ত নেয়ার কারণে তা বাস্তবায়ন করা তুলনামূলক সহজ হয়। কারণ কাজটি তখন আর একক থাকে না হয়ে ওঠে সবার। অসংখ্যবার ছোট ছোট আকারে ইউনিয়ন পরিষদ এবং স্থানীয় জনগোষ্ঠী নিজেদের মধ্যে পাড়ায় পাড়ায় গ্রামে গ্রামে আলোচনা অর্থাৎ যৌথ চিন্তার ফলে টেলিসেন্টারের প্রতি সবার সমবেত মালিকানা নিশ্চিত করা সম্ভব হয়েছে। এটা খুবই স্পষ্ট ছিল যে, টেলিসেন্টারকে সামাজিক ও অর্থনৈতিকভাবে টেকসই করতে হলে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মালিকানা প্রতিষ্ঠার কোনো বিকল্প নেই। সবার অংশ নেয়ার কারণে এই মডেলে টেলিসেন্টার সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা পায় দ্রুত। এনজিও মডেলে এবং উদ্যোক্তা মডেলে এমন গ্রহণযোগ্যতা অকল্পনীয়। সামাজিকভাবে গ্রহণযোগ্যতা তৈরি হয় একটি শক্তিশালী মবিলাইজেশন প্রক্রিয়ার কারণে। মবিলাইজেশনের প্রভাবে যে সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি হয়, তার ফলে ইউনিয়ন পরিষদের পক্ষেও সহজ হয়ে ওঠে টেলিসেন্টারকে টেকসই করে তোলার দায়িত্ব কাঁধে তুলে নেয়া। একই কারণে ইউনিয়ন পরিষদের নেতৃত্বে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মালিকানাও প্রতিষ্ঠা হতে থাকে সহজে। এর প্রভাবে স্থানীয় যুব সম্প্রদায় আইসিটি প্রতিনিধি হয়ে ওঠে। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর নেতৃত্বে তথ্যচাহিদা নির্ণয় করার সুযোগ এবং টেলিসেন্টারের সাথে স্থানীয় সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সম্পৃক্ততা এই সামাজিক গ্রহণযোগ্যতাকে আরো বলিষ্ঠতা দেয়।


মবিলাইজেশন প্রক্রিয়ায় সবচেয়ে বেশি গুরুত্ব দেয়া হয় স্থানীয় জনগোষ্ঠীর তথ্যচাহিদা নির্ণয়ে তাদের অংশ নেয়া। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর নেতৃত্বে একটি স্বেচ্ছা তথ্যকর্মী গড়ে তোলা এবং টেলিসেন্টার অর্থনৈতিকভাবে কী করে টেকসই হবে তার পথ খুঁজে বের করাও আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ কাজ। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর তথ্যসচেতনতা ও তথ্যচাহিদাবোধ সৃষ্টির লক্ষ্যে ধারাবাহিকভাবে কর্মশালা, প্রচারাভিযান এবং ডায়ালগ পরিচালনার জন্য ইউনিয়নভিত্তিক একটি টিম গঠন করা হয়। এর নেতৃত্ব দেয় ইউনিয়ন পরিষদ এবং এতে অংশ নেয় প্রধানত ছাত্রছাত্রী, শিক্ষক, ইউপি সদস্য, সরকারি-বেসরকারি মাঠকর্মী- যাদের প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে দক্ষ করে তোলা হয়। তথ্যচাহিদা সৃষ্টির প্রক্রিয়ার সাথে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মালিকানাবোধ গড়ে ওঠার সম্পর্ক রয়েছে। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন পেশার মানুষের মধ্যে যেসব ধারাবাহিক সংলাপ হয়, সেখানে আলোচনা করা হয়- তথ্য কী, তথ্যের প্রয়োজনীয়তা, টেলিসেন্টারে কী ধরনের তথ্য থাকা দরকার, তথ্যসচেতনতা সৃষ্টি ও তথ্যচাহিদা নির্ণয় হবে কিভাবে, তথ্যভান্ডারের কার্যকারিতা যাচাই হবে কিভাবে, টেলিসেন্টার কিভাবে পরিচালিত হলে ইউনিয়নবাসীর ব্যবহার করা সহজ হবে, এজন্য ইউনিয়ন পরিষদ ও স্থানীয় জনগোষ্ঠীর ভূমিকা কী, নতুন আর কী করা দরকার, কোথায় পরিবর্তন আনা দরকার প্রভৃতি বিষয়ে। সবচেয়ে বেশি এবং গভীরভাবে আলোচনা হয় টেলিসেন্টারকে টেকসই এবং সুষ্ঠুভাবে পরিচালনা করতে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর কার কী ভূমিকা। অংশগ্রহণমূলক এসব আলোচনার মধ্য দিয়ে তাদের মধ্যে উপলব্ধি গভীর হতে থাকে- এটা তাদের সম্পদ এবং একে রক্ষা করার দায়িত্বও তাদের। এই উপলব্ধি তাদের চিন্তায় ও আচরণে ব্যাপক গুণগত পরিবর্তন আনে- যার পরিবর্তন দেখা যায় প্রচলিত মানসিকতার রূপান্তরে। যেমন- এলাকার অনেক প্রবীণ ব্যক্তি টেলিসেন্টার থেকে তথ্য সংগ্রহ করা ছাড়াও এসে বসে থাকেন, পর্যবেক্ষণ করেন। কেন এসেছেন জানতে চাইলে বলেন, দেখতে এসেছি- কেমন চলছে। অংশগ্রহণমূলক আলোচনার ফলে আরো সহায়ক পরিবেশ সৃষ্টি হয় তথ্য ব্যবহারকারীদের মধ্যে আরো বেশি যৌথচিন্তা করার, যৌথ উদ্যোগ গ্রহণের- যার প্রত্যক্ষ একটি ফল হলো বিভিন্ন পেশাজীবী সংগঠন সৃষ্টি। যেমন- কৃষকদের সংগঠন, নারীদের সংগঠন, শ্রমিকদের সংগঠন প্রভৃতি।


এভাবে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর অংশগ্রহণের ফলে এই মডেলে একটি ভিন্ন ধাঁচের ভলান্টিয়ারিজম সংস্কৃতি গড়ে ওঠে। এতে স্থানীয় তরুণরা আইসিটি প্রতিনিধি হিসেবে ভূমিকা পালনে উৎসাহিত হয়। স্থানীয় জনগোষ্ঠীর তথ্যসচেতনতা ও তথ্যচাহিদাবোধ সৃষ্টির ক্ষেত্রে সবচেয়ে তাৎপর্যপূর্ণ ভূমিকা পালন করে তথ্যসচেতন এবং অনুপ্রাণিত স্থানীয় এইসব তরুণ নেতৃত্ব। ব্যাপক তথ্যসচেতনতা সৃষ্টির লক্ষ্যে এই তরুণরা বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে, হাটে, গ্রামে-পাড়ায়-মহল্লায় কর্মশালা ও ক্যাম্পেইন পরিচালনা করে। তরুণরা এই দায়িত্ব পালন করে স্বেচ্ছাব্রতী হিসেবে এবং স্বতঃস্ফূর্তভাবে-যার ভিত্তি গভীর দেশপ্রেম ও সামাজিক দায়বদ্ধতাবোধ। তরুণদের পাশাপাশি স্থানীয় স্কুল-কলেজের শিক্ষক এবং সরকারি-বেসরকারি মাঠকর্মীরাও টেলিসেন্টারে ভলান্টিয়ার তথ্যকর্মীর ভূমিকা পালন করতে শুরু করে, যা টেলিসেন্টার প্র্যাকটিসে একেবারেই নতুন। কোন শিক্ষক, কোন কৃষিকর্মী, কোন স্বাস্থ্যকর্মী কবে আসবে, কখন আসবে, কে কতক্ষণ থাকবে- টেলিসেন্টার কমিটির সাথে আলোচনা করে তার একটি তালিকা করে ইউনিয়ন পরিষদের নোটিস বোর্ডে লাগিয়েও দিয়েছে এই শিক্ষক ও মাঠকর্মীরা। এর ফলে স্থানীয় জনগোষ্ঠীর মধ্যে টেলিসেন্টারের ওপর আরো গ্রহণযোগ্যতা ও বিশ্বাস তৈরি হয়েছে। শুধু তাই নয়, বেতনভুক্ত কর্মীর মধ্যেও এক ধরনের পরিবর্তন এসেছে এ চর্চার ফলে। ভলান্টিয়াররা যখন টেলিসেন্টারে সক্রিয় তথ্যকর্মীর দায়িত্ব পালন করে, তখন তার পক্ষে কোনোভাবেই দায়িত্বে অবহেলা করার আর সুযোগ থাকে না।


টেলিসেন্টারের অর্থনৈতিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের জন্য দরকার একটি সুষ্ঠু ব্যবসায় পরিকল্পনা। কমিউনিটি মডেলে টেলিসেন্টারের জন্য আলাদা আলাদা ব্যবসায় পরিকল্পনা তৈরি করে। এই ব্যবসায় পরিকল্পনার আলোকেই তাদের অর্থনৈতিক স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জনের প্রক্রিয়া অগ্রসর হতে থাকে।


কমিউনিটি মডেলে সত্যিকারভাবে কমিউনিটির সম্পৃক্ততা হয়েছে বলেই সেখানে মানুষের সার্বিক জীবনমানে এর প্রভাব দেখা যায় লক্ষ্যণীয়ভাবে। এক জরিপে দেখা যায়, ইউনিয়ন পরিষদের নেতৃত্বে পরিচালিত এসব টেলিসেন্টারে মানুষের মধ্যে তথ্য ব্যবহার করার হার বেড়েছে। এ হার জানুয়ারি মাসের তুলনায় আগস্ট মাসে (মাধাইনগরে) ছয় গুণের বেশি। মাধাইনগর ইউনিয়নের তথ্য বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, সবচেয়ে বেশি তথ্য নিতে আসে কৃষক যা ৪৬%। তরুণরা আসে ২৭.৫%, নারী আসে ২১.২১% এবং অন্যান্য পেশার মানুষ আসে ৫.৫%। নারী ও তরুণদের মধ্যে একটি বড় অংশ আছে যারা স্বাস্থ্য ও শিক্ষা তথ্যের পাশাপাশি কৃষিতথ্যও সংগ্রহ করে। Livelihood তথ্য সংগৃহীত হয় ৬৭.৫৮% এবং Ancillary তথ্য সংগৃহীত হয় ৩২.৪১%।


গুণগত পরিবর্তনও এসেছে মানুষের মধ্যে। যেমন- স্থানীয় মানুষের মধ্যে প্রযুক্তিভীতি কমতে শুরু করেছে। শুরুর দিকে অনেক মানুষ, বিশেষ করে প্রবীণরা আইসিটির প্রতি অনাগ্রহ দেখাতো। তারা বলতো, এসবের দরকার নেই। এখন তারাই অন্যদের উৎসাহিত করতে শুরু করেছে। শুরুর দিকে স্থানীয় মানুষ সিইসিতে এসে বিভিন্ন সমস্যার সমাধান খুঁজতো। পর্যাপ্ত তথ্যসচেতনতার কারণে তা কমছে, এখন সুনির্দিষ্টভাবে প্রশ্ন করে করে তথ্য জানার দক্ষতা অনেক বেড়েছে। শিক্ষক, সরকারি-বেসরকারি পেশাজীবীদের মধ্যে তথ্যচাহিদা বেড়েছে।


মানুষ তথ্য কিনতেও উৎসাহ দেখাচ্ছে। কারণ তথ্য ব্যবহার করে তারা বাড়তি আয় করতে সক্ষম হচ্ছে। স্থানীয় মানুষের একটি চাপ ছিল টেলিসেন্টারে ধানের মৌসুমে স্থানীয় হাটের বাজার মূল্য রাখা। সেই চাহিদা অনুযায়ী ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান ধান বিক্রির সময় প্রতিদিন আড়ত থেকে সকালে বাজার মূল্য সংগ্রহ করে হাটভিত্তিক বাজার মূল্য তালিকা করে নোটিস বোর্ডে লাগিয়ে রাখতেন। এই তথ্য সংগ্রহ করে কৃষকরা সিদ্ধান্ত নিতো কোন হাটে ধান বিক্রি করবে। দেখা যায়, প্রতিদিন কৃষকরা আগের যেকোনো সময়ের তুলনায় মণপ্রতি ২০ থেকে ৫০ টাকা বেশি লাভে ধান বিক্রি করতে পারতো।


কমিউনিটি মডেলের টেকসই হয়ে ওঠার একটি দিক হলো অর্থনৈতিক স্থায়িত্ব কৌশল। কৌশলটি হলো সুযোগ থাকলেও প্রশিক্ষণের মাধ্যমে টেলিসেন্টারের আয় বাড়াতে হবে দ্বিতীয় পর্যায়ে গিয়ে। কারণ, মানুষের জীবিকাভিত্তিক তথ্য নিশ্চিত করা প্রথম ও প্রধান দায়িত্ব। শুরু থেকেই এই সুযোগ ছিল যে, কমপিউটার প্রশিক্ষণ এবং দক্ষতাবৃদ্ধিমূলক প্রশিক্ষণ থেকেও আয় করা সম্ভব। কমপিউটার প্রশিক্ষণের ক্ষেত্রে সতর্কতার বিষয় ছিল এই যে-এর চাহিদা ব্যাপক থাকলেও তা করা উচিত সীমিত পরিসরে, ধাপে ধাপে। কারণ, কোনো টেলিসেন্টারে শুরুতেই প্রশিক্ষণ আকর্ষণীয় হয়ে উঠলে সেখানে মানুষের জন্য তথ্যসেবা নিশ্চিত করা কঠিন হয়ে উঠতে পারে। কিন্তু তথ্যসেবার একটি সংস্কৃতি দাঁড়িয়ে গেলে তখন প্রশিক্ষণ যুক্ত করলে আর অসুবিধা হয় না।


টেলিসেন্টারকে অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণ করার নতুন ধারণা হলো সর্বশেষ মডেল অর্থাৎ পাবলিক পিপলস প্রাইভেট পার্টনারশিপ মডেল। এই মডেলের আকর্ষণীয় দিক হলো এখানে উদ্যোক্তা টেলিসেন্টারকে বাণিজ্যিকভাবে লাভজনক করে তুলতে সক্রিয় থাকবে। আর ইউনিয়ন পরিষদ জনগণের কাছের সরকার হিসেবে মানুষের তথ্যসেবা যাতে করে নিশ্চিত হয় সেজন্য সতর্ক থাকবে। কোনো টেলিসেন্টারকে সামাজিকভাবে এবং অর্থনৈতিকভাবে টেকসই করে তোলার ক্ষেত্রে এখনো পর্যন্ত কমিউনিটি মডেল হলো সবচেয়ে কার্যকর অভিজ্ঞতা এবং পিপিপিপি মডেল সবচেয়ে গণমুখী ধারণা।








০ টি মন্তব্য



মতামত দিন

আপনি লগ ইন অবস্থায় নেই।
আপনার মতামতটি দেওয়ার জন্য লগ ইন করুন। যদি রেজিষ্ট্রেশন করা না থাকে প্রথমে রেজিষ্ট্রেশন করুন।







পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন? পুনরায় রিসেট করুন






রিভিউ

আপনি লগ ইন অবস্থায় নেই।
আপনার রিভিউ দেওয়ার জন্য লগ ইন করুন। যদি রেজিষ্ট্রেশন করা না থাকে প্রথমে রেজিষ্ট্রেশন করুন।