৯–১১ জুলাই ২০২৫, আমি বাংলাদেশ এনজিওস নেটওয়ার্ক ফর রেডিও অ্যান্ড কমিউনিকেশন (BNNRC)-এর প্রতিনিধি হিসেবে তথ্য সমাজ সম্পর্কিত বিশ্ব সম্মেলন WSIS+20 হাই-লেভেল মিটিং-এ অংশগ্রহণের সুযোগ পেয়েছিলাম।
আন্তর্জাতিক টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়ন (ITU) এবং সুইস কনফেডারেশন যৌথভাবে আয়োজিত WSIS+20 হাই-লেভেল ইভেন্ট ২০২৫ ছিল ২০০৩ সালের জেনেভা প্ল্যান অব অ্যাকশনের সূচনা থেকে এখন পর্যন্ত অগ্রগতি, অর্জন, চ্যালেঞ্জ এবং সম্ভাবনা পর্যালোচনার একটি গুরুত্বপূর্ণ মঞ্চ।
এটি মূলত তথ্য সমাজ সম্পর্কিত বিশ্ব সম্মেলনের দুই দশক পূর্তিকে চিহ্নিত করেছে। আমরা যখন অতীত প্রতিশ্রুতিগুলো পুনর্বিবেচনা করছিলাম, তখন সামনে এগিয়ে যাওয়ার পথ নিয়ে গভীর আলোচনা হচ্ছিল।
WSIS+20: শুধু পুনর্বিবেচনা নয়, পুনঃকল্পনার মুহূর্ত
সম্মেলনের সাথে আয়োজিত জেনেভার সভা ও প্রদর্শনী শুধুমাত্র আমরা কতদূর এগিয়েছি তা হিসাব করার জন্য ছিল না—বরং একটি ডিজিটাল ভবিষ্যৎ পুনরুদ্ধারের জন্যও ছিল, যা সত্যিকার অর্থে বৈশ্বিক জনগোষ্ঠীর কাজে আসবে।
আমি প্রথম যে সেশনে বক্তা হিসেবে যোগ দিই, তখনই স্পষ্ট হলো—সংযোগের পুরনো সূচক আর মডেল যথেষ্ট নয়। এখন প্রশ্ন হওয়া উচিত: “মানুষ কি সংযুক্ত?” নয়, বরং “মানুষ কি সেই সংযোগ থেকে অর্থবহ ক্ষমতায়ন পাচ্ছে?”
BNNRC শুরু থেকেই “অর্থবহ সংযোগ” ধারণাটি সামনে এনেছে—যা শুধু ইন্টারনেটে প্রবেশাধিকার নয়, বরং নিয়মিত, নির্ভরযোগ্য, সাশ্রয়ী এবং নিরাপদ প্রবেশাধিকার। এই বার্তাটি আমি অংশ নেওয়া প্রায় সব সেশনেই প্রতিধ্বনিত হয়েছিল, বিশেষ করে ডিজিটাল পাবলিক গুডস এবং উদীয়মান প্রযুক্তি যেমন কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (AI)-এর শাসন নিয়ে আলোচনায়। আমি জোর দিয়ে বলেছি—ডিজিটাল পাবলিক গুডস অবশ্যই মানুষকেন্দ্রিক হতে হবে। এগুলো সম্প্রদায়ের সাথে তৈরি হতে হবে, শুধু সম্প্রদায়ের জন্য নয়। এগুলোতে স্থানীয় ভাষা, সংস্কৃতি ও অন্তর্ভুক্তিমূলক শাসন কাঠামোর প্রতিফলন থাকতে হবে। নইলে, আমরা যেসব বৈষম্য দূর করতে চাই, তা আরও গভীর হতে পারে।
সংযোগ ঘাটতি পূরণ শুধু প্রযুক্তিগত নয়—এটি রাজনৈতিক
আমার জন্য অন্যতম শক্তিশালী মুহূর্ত ছিল “বঞ্চিত সম্প্রদায়ের জন্য সংযোগ ঘাটতি পূরণ” শীর্ষক প্যানেলে বক্তব্য প্রদান। আমি আবারও বলেছি—সংযোগ কোনো বিশেষ সুবিধা নয়, এটি একটি মানবাধিকার। যদি আমরা সত্যিকার অর্থে কাউকে পিছিয়ে না রাখতে চাই, তবে ইউনিভার্সাল সার্ভিস ফান্ড-এর ব্যবহার নতুনভাবে ভাবতে হবে—যাতে শুধু অবকাঠামো নয়, সেই অবকাঠামো ব্যবহারকারী মানুষের উপরও বিনিয়োগ হয়।
আমরা বহুদিন ধরে সম্প্রদায়ভিত্তিক নেটওয়ার্ক, ডিজিটাল দক্ষতা উন্নয়ন, এবং স্থানীয় কন্টেন্ট সৃষ্টিতে সম্পদের প্রবাহ নিশ্চিত করার পক্ষে সওয়াল করছি। স্থানীয় ইকোসিস্টেমকে শক্তিশালী করতে হবে, প্রযুক্তি রাজধানী থেকে টুকরো টুকরো সুবিধা নামার অপেক্ষায় থাকা যাবে না।
এ আলোচনাটি আরও জরুরি হয়ে ওঠে যখন আমরা AI সহ উদীয়মান প্রযুক্তির দ্রুত বিস্তার দেখি। আমরা পক্ষপাত দূর করা এবং AI অবকাঠামোকে উপনিবেশমুক্ত করার প্রয়োজনীয়তা নিয়ে আলোচনা করেছি।
এআই শাসনব্যবস্থা: ন্যায্যতা ও জবাবদিহিতা কেন্দ্রিক হতে হবে
এআই ফর গুড প্রদর্শনীতে রোবট প্রদর্শনের মধ্যে WSIS+20-এর অনেক আলোচনাই এআইকে ঘিরে ছিল। আমি সতর্ক করেছি—AI কোনোভাবেই নিরপেক্ষ নয়। এটি নির্মাতাদের পক্ষপাত এবং তথ্যভান্ডারের বর্জনের প্রতিফলন। যদি আমরা সচেতনভাবে ন্যায্যতা ও জবাবদিহিতা অন্তর্ভুক্ত না করি, তবে বিদ্যমান বৈষম্য আরও বাড়বে।
এআই ফর গুড (AI for Good)
“এআই ফর গুড” বলতে বোঝায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (Artificial Intelligence – AI) এমনভাবে ব্যবহার করা, যা মানবকল্যাণ, সামাজিক উন্নয়ন এবং জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (SDGs) অর্জনে সহায়ক হয়। এটি একটি বৈশ্বিক উদ্যোগ, যেখানে জাতিসংঘ, সরকার, গবেষক, প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এবং সিভিল সোসাইটি একত্রে কাজ করছে যেন এআই প্রযুক্তি সবার জন্য উপকার বয়ে আনে, বৈষম্য না বাড়িয়ে অন্তর্ভুক্তি ও ন্যায় নিশ্চিত করে।
রেজা সেলিম : বাংলাদেশ ওয়ার্কিং গ্রুপ অন WSIS
এই সম্মেলনের আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ দিক ছিল দীর্ঘদিন পর শ্রদ্ধেয় রেজা সেলিম ভাইর সাথে পুনর্মিলন। আমি ২০০২ সাল থেকে বাংলাদেশ ওয়ার্কিং গ্রুপ অন WSIS-এর সহ-প্রতিষ্ঠাতা হিসেবে কাজ করছি, যেখানে বাংলাদেশ সরকার ও BTRC-এর সাথে নিবিড়ভাবে কাজ করেছি। রেজা সেলিম ভাই আমাদের কার্যকরী সদস্যসচিব হিসেবে WSIS প্রক্রিয়াকে এগিয়ে নিতে বিশাল ভূমিকা রেখেছেন। তাঁর পথপ্রদর্শক প্রচেষ্টা আজকের অগ্রযাত্রার শক্ত ভিত্তি তৈরি করেছে।
WSIS+20-এর বাইরে: আমাদের করণীয়
জেনেভার আলোচনার বাইরে তাকিয়ে, আমি নতুন উদ্দীপনা অনুভব করছি। বৈশ্বিক ডিজিটাল অন্তর্ভুক্তি ও ন্যায়বিচারের সম্প্রদায়কে আরও শক্তিশালী, সোচ্চার এবং ন্যায়, সমতা ও মর্যাদা ভিত্তিক হতে হবে। তবে আমরা এমন এক সিস্টেমের মুখোমুখি, যেটি বিদ্যমান অবস্থার সুবিধা ভোগ করছে। এই প্রেক্ষাপটে আমার চারটি স্পষ্ট বিশ্বাস তৈরি হয়েছে:
1. অর্থবহ সংযোগকে মৌলিক অধিকার হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে।
2. অন্তর্ভুক্তিমূলক ও অংশগ্রহণমূলক এআই শাসনব্যবস্থা প্রয়োজন, যা গ্লোবাল সাউথের বাস্তবতাকে প্রতিফলিত করে।
3. আমাদের পরিমাপ কাঠামো অবশ্যই সমতাকেন্দ্রিক ও পৃথকীকৃত হতে হবে—কারণ যা আমরা মাপি না, তা আমরা সংশোধনও করতে পারি না।
4. ডিজিটাল রূপান্তরে বহুপক্ষীয় নেতৃত্ব প্রয়োজন, বিশেষ করে নারী ও প্রান্তিক জনগোষ্ঠীর।
শেষ কথা
WSIS+20-এ BNNRC-এর প্রতিনিধিত্ব করা শুধু পেশাগত অর্জন নয়—এটি আমার ব্যক্তিগত অঙ্গীকারও। আমি এমন একটি পৃথিবীতে বিশ্বাস করি, যেখানে বাংলাদেশের একটি গ্রামীণ মেয়েরও সেই একই ডিজিটাল সুযোগ থাকবে, যেমন সিলিকন ভ্যালির এক ছেলের থাকে। এমন এক পৃথিবী, যেখানে সংযোগ শুধু সিগন্যাল পাওয়ার মধ্যেই শেষ হয় না, বরং মর্যাদা, ক্ষমতায়ন ও কর্তৃত্ব দিয়ে শুরু হয়।
চলুন আমরা শুধু বিশ্বকে সংযুক্ত করি না—বরং নিশ্চিত করি সেই সংযোগ যেন হয় অর্থবহ। চলুন এমন একটি ডিজিটাল ভবিষ্যৎ গড়ে তুলি, যা সবার জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক, সম্প্রদায়কে ক্ষমতায়িত করে এবং আমাদের সবাইকে জবাবদিহিতার মধ্যে আনে।
এ. এইচ. এম. বজলুর রহমান | ডিজিটাল গণতন্ত্র উন্নয়নে বিশেষজ্ঞ, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা
বাংলাদেশ এনজিওস নেটওয়ার্ক ফর রেডিও অ্যান্ড কমিউনিকেশন (বিএনএনআরসি), এবং বাংলাদেশে দায়িত্বশীল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার রাষ্ট্রদূত, নীতি গবেষণা ফেলো, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে গণমাধ্যম, তথ্যের অখণ্ডতা ও সমাজ ! [email protected]
০ টি মন্তব্য