বাংলাদেশ যখন ডিজিটাল রূপান্তরের পথে এগোচ্ছে, তখন তথ্যভিত্তিক পরিবেশের অখণ্ডতা এক গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্নে পরিণত হয়েছে। ২০২৫ সালের বাংলাদেশে তথ্যের বিশ্বাসযোগ্যতা রক্ষা করা কেবল জাতীয় নিরাপত্তার বিষয় নয়, বরং গণতান্ত্রিক শাসন, স্থানীয় স্থিতিশীলতা এবং আন্তর্জাতিক সহযোগিতার অপরিহার্য অংশ।
কেন এখনই জরুরি?
ডিজিটাল জনপরিসর আজ আগের যেকোনো সময়ের চেয়ে অনেক বিস্তৃত। মোবাইলফোনে সংবাদ গ্রহণ, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সক্রিয়তা, কমিউনিটি ও অনলাইন গণমাধ্যমের বিকাশ জনঅংশগ্রহণ বাড়িয়েছে। তবে একইসঙ্গে এটি বিদেশি হস্তক্ষেপের জন্য নতুন দরজা খুলে দিয়েছে। বিদেশি তথ্য প্রভাব ও হস্তক্ষেপ—যা ইংরেজিতে Foreign Information Manipulation and Interference (FIMI)—প্রায়শই সুস্থ বিতর্ক নয়, বরং বর্ণনা বিকৃতির মাধ্যমে বিভাজন, আস্থাহানি ও নীতিনির্ধারণে প্রভাব ফেলার কৌশল।
বিশেষত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা-নির্ভর কনটেন্ট তৈরির সহজলভ্যতা এবং বৈশ্বিক ভূরাজনীতির অস্থিরতা এই ঝুঁকি বহুগুণ বাড়িয়েছে। ফলে, এখনই সমন্বিত ও গঠনমূলক পদক্ষেপ নেওয়া সময়ের দাবি।
প্রচলিত কৌশল
FIMI নানা পদ্ধতিতে সক্রিয় হয়। যেমন—
• অকৃত্রিম বিস্তার: বটনেট বা ভুয়া অ্যাকাউন্ট দিয়ে বিভাজনমূলক বক্তব্য ছড়িয়ে দেওয়া।
• বর্ণনা ধোয়া: ছোটখাটো ব্লগ থেকে শুরু হয়ে মূলধারার আলোচনায় পৌঁছানো।
• কৃত্রিম মিডিয়া: এআই-তৈরি ভিডিও বা অডিও দিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো।
• ক্রস-প্ল্যাটফর্ম বিস্তার: হোয়াটসঅ্যাপ থেকে ফেসবুক, ইউটিউব হয়ে টিকটক পর্যন্ত গুজব ছড়িয়ে যাওয়া।
• ভুয়া নথি: জাল কাগজপত্র বা ভুয়া ফাঁস দিয়ে ষড়যন্ত্রমূলক চিন্তা উসকে দেওয়া।
বাংলাদেশের দুর্বলতা
আমাদের প্রেক্ষাপটে কয়েকটি বিষয় বিশেষভাবে ঝুঁকিপূর্ণ:
• পরিবার ও কমিউনিটির বিশ্বাসের সম্পর্ক দিয়ে যাচাইহীন খবর দ্রুত ছড়িয়ে পড়া।
• জটিল বিষয়ে বাংলা ভাষায় মানসম্পন্ন কনটেন্টের অভাব।
• গণমাধ্যমের আর্থিক সীমাবদ্ধতার কারণে যাচাইবিহীন চটকদার খবরের অগ্রাধিকার।
• সমাজে রাজনৈতিক ও আদর্শিক মেরুকরণ।
FIMI-এর উদ্দেশ্য
এ ধরনের প্রচেষ্টার লক্ষ্য সাধারণত—
• মূল নীতি ইস্যু থেকে মনোযোগ সরিয়ে প্রান্তিক বিষয়কে সামনে আনা।
• সরকারি প্রতিষ্ঠানের বৈধতা প্রশ্নবিদ্ধ করা।
• আন্তর্জাতিক পরিসরে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করা।
• সামাজিক বিভাজন বাড়ানো।
প্রতিরোধের গঠনমূলক পথ
বাংলাদেশকে একটি সুষম ও অধিকারসম্মত প্রতিক্রিয়া কাঠামো গড়ে তুলতে হবে। এর মধ্যে রয়েছে
• প্রাথমিক সতর্কতা ও হুমকি বিশ্লেষণ: জাতীয় পর্যায়ে তথ্য অখণ্ডতা সেল গঠন, ঝুঁকির মানচিত্র তৈরি ও দ্রুত প্রতিক্রিয়ার ব্যবস্থা।
• প্ল্যাটফর্ম সহযোগিতা: বড় প্রযুক্তি কোম্পানির সঙ্গে প্রোটোকল স্থাপন, বাংলা ভাষায় নীতিমালা প্রয়োগের নিশ্চয়তা।
• সমাজভিত্তিক প্রতিরোধ: স্বাধীন মিডিয়াকে সহযোগিতা, কমিউনিটি রেডিও ও স্থানীয় প্রভাবশালীদের প্রি-বাংকিং (Prebunking) কনটেন্ট সরবরাহ, শিক্ষাক্ষেত্রে ডিজিটাল সাক্ষরতা বাড়ানো।
• উন্মুক্ত প্রমাণভাণ্ডার: ভুয়া খবর খণ্ডনের জন্য সহজলভ্য ডাটাবেজ তৈরি।
• আইন ও নীতি সংস্কার: বিদেশি হস্তক্ষেপ মোকাবিলায় আইন হালনাগাদ, তবে মতপ্রকাশের স্বাধীনতা বজায় রাখা।
এআই: ঝুঁকি ও সুযোগ
জেনারেটিভ এআই যেমন ভুয়া কনটেন্ট তৈরিকে সহজ করেছে, তেমনি প্রতিরোধেও এটি ব্যবহার করা যায়—স্বয়ংক্রিয় যাচাই, দ্রুত সতর্কতা, প্রমাণ সংরক্ষণ ইত্যাদিতে। বিশ্ববিদ্যালয় ও গবেষণা প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে দায়িত্বশীল এআই যাচাই ব্যবস্থা তৈরি করা যেতে পারে।
করণীয় ২০২৫ সালে
• জাতীয় ঘটনাপঞ্জি অনুযায়ী বাংলা প্রি-বাংকিং (Prebunking) ক্যালেন্ডার তৈরি।
• জেলা পর্যায়ে গুজব প্রতিক্রিয়া কেন্দ্র গঠন।
• প্ল্যাটফর্মের সঙ্গে জরুরি সহযোগিতা ও তথ্য ড্যাশবোর্ড চালু।
• ইন্টিগ্রিটি ফেলোশিপ প্রোগ্রামের মাধ্যমে গবেষক ও সাংবাদিক নিয়োগ।
• রেড-টিম মহড়ার মাধ্যমে সম্ভাব্য আক্রমণের প্রস্তুতি।
উপসংহার
তথ্যের অখণ্ডতা রক্ষা কেবল প্রযুক্তিগত কাজ নয়; এটি সামাজিক আস্থা গড়ে তোলার লড়াই। FIMI thrives যেখানে স্বচ্ছতা কম এবং আস্থা দুর্বল।
তাই বাংলাদেশের জন্য জরুরি হলো আস্থা পুনর্গঠন একটি জনপরিসর গড়ে তোলা, যেখানে নাগরিকেরা মুক্তভাবে বিতর্ক করবে, নিয়মিতভাবে যাচাই করবে এবং গোপন বিদেশি প্রভাব ছাড়াই নিজস্ব মতামত গঠন করবে।
এ. এইচ. এম. বজলুর রহমান | ডিজিটাল গণতন্ত্র উন্নয়নে বিশেষজ্ঞ, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা
বাংলাদেশ এনজিওস নেটওয়ার্ক ফর রেডিও অ্যান্ড কমিউনিকেশন (বিএনএনআরসি), এবং বাংলাদেশে দায়িত্বশীল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার রাষ্ট্রদূত, নীতি গবেষণা ফেলো, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে গণমাধ্যম, তথ্যের অখণ্ডতা ও সমাজ | [email protected]
০ টি মন্তব্য