https://powerinai.com/

সাম্প্রতিক খবর

বহুপাক্ষিকতাকে ক্ষমতায়ন: জাতিসংঘের ৮০ বছরের অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন

বহুপাক্ষিকতাকে ক্ষমতায়ন: জাতিসংঘের ৮০ বছরের অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন বহুপাক্ষিকতাকে ক্ষমতায়ন: জাতিসংঘের ৮০ বছরের অপূর্ণ আকাঙ্ক্ষার প্রতিফলন
 

গত সপ্তাহে জাতিসংঘ (UN) তার ৮০তম বার্ষিকী উদযাপন করেছে এক অভূতপূর্ব বৈশ্বিক সংকটের প্রেক্ষাপটে। ১৯৪৬ সালের পর থেকে সর্বাধিক সক্রিয় সংঘাতের সংখ্যা আজ বিদ্যমান, ফলে বহুপাক্ষিকতার প্রতি আস্থা টলমল করছে।

তবুও জাতিসংঘের প্রতিষ্ঠাকালীন দৃষ্টি—‘উই দ্য পিপলস’-এর নীতিতে ভিত্তিক—আজও সমানভাবে জরুরি; এ দৃষ্টি জানায় যে শান্তি, মানবাধিকার ও উন্নয়ন শুধুমাত্র সরকার দ্বারা অর্জিত হতে পারে না। শুরু থেকেই নাগরিক সমাজ এই দৃষ্টিভঙ্গির অবিচ্ছেদ্য অংশ, যা জাতিসংঘ সনদের ৭১ অনুচ্ছেদে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বীকৃত। এটি এনজিওগুলোর আন্তর্জাতিক এজেন্ডা নির্ধারণে অবদান রাখার গুরুত্বকে তুলে ধরে।

অনুচ্ছেদ ৭১: অর্থনৈতিক ও সামাজিক কাউন্সিল বেসরকারি সংস্থাগুলোর সাথে পরামর্শের জন্য উপযুক্ত ব্যবস্থা নিতে পারে, যেগুলো তার এখতিয়ারের বিষয়গুলোর সাথে সংশ্লিষ্ট। এই ধরনের ব্যবস্থা আন্তর্জাতিক সংগঠনের সাথে করা যেতে পারে এবং যথাযথ ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট জাতিসংঘ সদস্য রাষ্ট্রের সাথে পরামর্শের পর জাতীয় সংগঠনগুলোর সাথেও করা যেতে পারে।

কিন্তু এই গুরুত্বপূর্ণ বিধান থাকা সত্ত্বেও, বহুপাক্ষিক প্রক্রিয়াগুলো ক্রমশ রাষ্ট্রকেন্দ্রিক হয়ে উঠেছে, যা বৈশ্বিক শাসনব্যবস্থাকে এক ধরনের ঊর্ধ্বমুখী (টপ-ডাউন) কাঠামোতে রূপান্তর করেছে—যা সেই জনগণ থেকে বিচ্ছিন্ন, যাদের সেবা করার জন্য এই প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছিল।

নাগরিক সমাজ ও বৈশ্বিক জনগণকে নীতি নির্ধারণ থেকে বাদ দেওয়া শুধু স্থানীয় বাস্তবতা থেকে বিচ্ছিন্ন আইন ও নীতি তৈরি করে না, বরং সম্প্রদায়-চালিত প্রক্রিয়াগুলোকে দুর্বল করে তোলে—যারা প্রায়শই সমস্যার সঠিক চিহ্নিতকরণ ও সমাধানে সবচেয়ে উপযুক্ত। সর্বোচ্চ ক্ষেত্রে, যারা সরকারকে জবাবদিহির মুখোমুখি করে, তাদের কণ্ঠস্বর দমন করলে স্বৈরাচারী শাসনব্যবস্থা শক্তিশালী হয়, আন্তর্জাতিক আইন উপেক্ষা করে, মানবাধিকার সীমিত করে এবং নিয়মভিত্তিক আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলাকে ক্ষয় করে।

জাতীয় বাস্তবতার প্রতিফলন

এখানে ভাববার বিষয় আন্তর্জাতিক অঙ্গন কতটুকু জাতীয় বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটায়। অনেকে বহুপাক্ষিক ব্যবস্থাকে সর্বশক্তিমান প্রতিষ্ঠান মনে করে, যা মানবতাকে যুদ্ধের অভিশাপ থেকে রক্ষা করে। বাস্তবে এটি জাতীয় অভিনেতাদের পুনর্গঠন, যারা নিজের দেশেই নাগরিক সমাজের পরিসর সংকুচিত করে।

৭০ শতাংশেরও বেশি মানুষ এমন দেশে বসবাস করে যেখানে মতপ্রকাশ, সংগঠন ও সমাবেশের স্বাধীনতা কঠোরভাবে সীমিত। অনেক মানবাধিকার রক্ষাকারীর জন্য, জাতিসংঘে আওয়াজ তোলাই দেশে প্রতিশোধমূলক পদক্ষেপ—নজরদারি, গ্রেপ্তার বা কারাবাস—ডেকে আনে।

অর্থের প্রভাব

দ্বিতীয় চ্যালেঞ্জ হলো কিভাবে অর্থ অগ্রাধিকার নির্ধারণ করে। বৈশ্বিক সাহায্য খাতের পতন এ বাস্তবতাকে আবার সামনে এনেছে। জাতিসংঘের অর্থ মূলত সদস্য রাষ্ট্রগুলোর অবদান থেকে আসে। কিন্তু সময়ের সাথে সাথে চিহ্নিত তহবিল (earmarking) এবং অগ্রাধিকার পরিবর্তনের ফলে মানবাধিকারে বিনিয়োগ ক্রমশ কমে গেছে।

আজ মানবাধিকার স্তম্ভ জাতিসংঘের নিয়মিত বাজেটের মাত্র পাঁচ শতাংশ পায়। UN80 বাজেট কাটছাঁটে এ খাত আরও ঝুঁকির মুখে। যখন মানবাধিকারকে বাজেটে গুরুত্ব দেওয়া হয় না, তখন সদস্য রাষ্ট্রগুলো স্পষ্ট বার্তা পায়—এই খাতে রাজনৈতিক সদিচ্ছা বা সম্পদ ব্যয় অপ্রয়োজনীয়। ফলে নাগরিক সমাজ আরও প্রান্তিক হয়ে পড়ে।

অসম প্রবেশাধিকার

তৃতীয় চ্যালেঞ্জ হলো নাগরিক সমাজকে দেওয়া অসম প্রবেশাধিকার। বেশিরভাগ সংগঠন আলোচনার ঘরে প্রবেশ করতে পারে না। প্রস্তাবিত খসড়া প্রস্তাবনা কেবল কূটনীতিকদের ঘনিষ্ঠদের মধ্যেই ঘোরাফেরা করে, ফলে অন্যরা সময়মতো মতামত দিতে পারে না। এমনকি উচ্চপর্যায়ের সপ্তাহগুলোতেও সাইড ইভেন্ট বুক করতে সদস্য রাষ্ট্রের সহায়তা লাগে—যা ঠিক করে দেয় কে বলবে এবং কী বলা হবে।

জাতীয় পর্যায়ে সুশীল সমাজের অংশগ্রহণ ছাড়া বড় প্রক্রিয়া যেমন Summit of the Future বা Financing for Development আয়োজন করা হয় না। নাগরিক সমাজের শত শত সংগঠন মতামত দিলেও, সেগুলো কিভাবে ব্যবহৃত হলো সে বিষয়ে কোনো স্বচ্ছতা নেই। ফলে অনেকেই প্রশ্ন তোলে—এমন সময় ও শ্রম বিনিয়োগ আদৌ সার্থক কিনা।

সমাধানের পথ

তবুও জাতিসংঘ হাত গুটিয়ে বসে নেই। ইতোমধ্যে UN Guidance Note on the Promotion and Protection of Civic Space অংশগ্রহণ, সুরক্ষা ও প্রচারের (Three P’s) মাধ্যমে একটি কাঠামো দিয়েছে। এটি কাগজে সীমাবদ্ধ না রেখে বাস্তবে প্রয়োগে দ্রুত পদক্ষেপ নিতে হবে।

দ্বিতীয়ত, জবাবদিহিমূলক নেতৃত্ব অপরিহার্য। অর্থায়ন কেটে দেওয়া এবং রাজনৈতিক সদিচ্ছা হারালে জাতিসংঘ অনিচ্ছাকৃতভাবে স্বৈরশাসকদের শক্তিশালী করে তোলে। এটি বিশ্বব্যাপী নাগরিক স্বাধীনতা সংকোচন ঘটায় এবং বহুপাক্ষিক ব্যবস্থার প্রতি আস্থা হারাতে বাধ্য করে।

ভবিষ্যৎ নেতৃত্বে নাগরিক সমাজের ভূমিকা

নতুন মহাসচিব নির্বাচনের আলাপ ইতোমধ্যেই শুরু হয়েছে। প্রতিটি প্রার্থীর জন্য নাগরিক সমাজের প্রতি প্রতিশ্রুতি একটি কেন্দ্রীয় মানদণ্ড হতে হবে। প্রার্থীদের সঙ্গে টাউন হল বৈঠকে নাগরিক সমাজের অর্থবহ অংশগ্রহণ, মানবাধিকার কর্মসূচির সুরক্ষা ও টেকসই অর্থায়নের জন্য স্পষ্ট প্রতিশ্রুতি দাবি করতে হবে।

এটি কোনো প্রতীকী বিষয় নয়; নাগরিক সমাজের অর্থবহ সম্পৃক্ততা উন্নয়নের অগ্রগতি, মানবাধিকারের সুরক্ষা এবং নিয়মভিত্তিক আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলার টিকে থাকার মৌলিক শর্ত।

উপসংহার

জাতিসংঘ নবম দশকে প্রবেশ করছে। এর প্রাসঙ্গিকতা নির্ভর করবে জনগণের প্রতি জবাবদিহিতা, কেবল রাষ্ট্রের প্রতি নয়। নাগরিক সমাজকে স্বাধীন অংশীদার হিসেবে স্বীকৃতি দিতে হবে, তাদের গঠনমূলক মতামতকে সিদ্ধান্ত, অর্থায়ন ও তদারকির প্রতিটি স্তরে অন্তর্ভুক্ত করতে হবে।

মানুষ ও তাদের অধিকারের কেন্দ্রে না থাকলে জাতিসংঘ তার প্রতিষ্ঠাকালীন প্রতিশ্রুতি পূরণ করতে পারবে না। কেবল তখনই জাতিসংঘ আস্থা পুনরুদ্ধার করতে পারবে, বহুপাক্ষিকতাকে শক্তিশালী করতে পারবে, এবং সত্যিই প্রতিষ্ঠার অঙ্গীকার বাস্তবায়ন করতে পারবে—শান্তি, উন্নয়ন ও মানবাধিকারের ভিত্তিতে একটি  বিশ্ব। 

এ. এইচ. এম. বজলুর রহমান | ডিজিটাল গণতন্ত্র উন্নয়নে বিশেষজ্ঞ, প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা

বাংলাদেশ এনজিওস নেটওয়ার্ক ফর রেডিও অ্যান্ড কমিউনিকেশন (বিএনএনআরসি), এবং বাংলাদেশে দায়িত্বশীল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার রাষ্ট্রদূত, নীতি গবেষণা ফেলো, চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের যুগে গণমাধ্যম, তথ্যের অখণ্ডতা ও সমাজ | [email protected]








০ টি মন্তব্য



মতামত দিন

আপনি লগ ইন অবস্থায় নেই।
আপনার মতামতটি দেওয়ার জন্য লগ ইন করুন। যদি রেজিষ্ট্রেশন করা না থাকে প্রথমে রেজিষ্ট্রেশন করুন।







পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন? পুনরায় রিসেট করুন






রিভিউ

আপনি লগ ইন অবস্থায় নেই।
আপনার রিভিউ দেওয়ার জন্য লগ ইন করুন। যদি রেজিষ্ট্রেশন করা না থাকে প্রথমে রেজিষ্ট্রেশন করুন।