বাংলাদেশে দারিদ্র্য হ্রাস ও আর্থিক অন্তর্ভুক্তির ক্ষেত্রে ক্ষুদ্রঋণ একটি বৈপ্লবিক উদ্ভাবন। গ্রামীণ ব্যাংকসহ হাজারো এনজিও পরিচালিত মাইক্রোফাইন্যান্স ইনস্টিটিউশন (MFI) বিগত কয়েক দশক ধরে দরিদ্র নারী ও পুরুষদের ক্ষুদ্রঋণ, সঞ্চয় ও আর্থিক জ্ঞান দিয়ে ক্ষমতায়িত করেছে।
কিন্তু ডিজিটাল যুগে এসে এই মডেলটি নানা কাঠামোগত সীমাবদ্ধতার মুখে পড়েছে। ক্রমবর্ধমান পরিচালন ব্যয়, ঐতিহ্যগত ব্যবস্থাপনা, সীমিত আর্থিক পণ্য বৈচিত্র্য এবং ডিজিটাল আর্থিক ইকোসিস্টেম থেকে বিচ্ছিন্নতা — সবকিছু মিলিয়ে এটি এখন টেকসই রূপান্তরের মুখোমুখি।
এই প্রেক্ষাপটে, বাংলাদেশে এনজিও পরিচালিত এমএফআইগুলোকে নিজেদের পুনর্গঠন করে প্রযুক্তিনির্ভর ডিজিটাল ব্যাংক মডেলে রূপান্তরিত হতে হবে, যা প্রযুক্তি, সুশাসন ও অন্তর্ভুক্তিকে একত্রিত করে ভবিষ্যৎমুখী ও টেকসই আর্থিক ব্যবস্থা গড়ে তুলবে।
বাংলাদেশের বর্তমান ক্ষুদ্রঋণ বাস্তবতা
বাংলাদেশে বর্তমানে ৭০০-এরও বেশি লাইসেন্সপ্রাপ্ত মাইক্রোফাইন্যান্স প্রতিষ্ঠান রয়েছে, যারা প্রায় ৩ কোটি গ্রাহককে সেবা প্রদান করছে। এসব প্রতিষ্ঠানের মাধ্যমে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা ঋণ বিতরণ হয়।
বাংলাদেশ মাইক্রোফাইন্যান্স পরিসংখ্যান ২০২৩–২৪ অনুযায়ী
শীর্ষ ১০০টি এমএফআইয়ের মোট শাখা সংখ্যা ২০,০৬৩টি, যেখানে কাজ করছে ২,৮০,১৫০ জন ঋণ কর্মকর্তা।
এই প্রতিষ্ঠানগুলোর মোট গ্রাহক সংখ্যা ২৭,২২,১,২৮০ জন, যাদের কাছে মোট ঋণ বিতরণ হয়েছে ৯৩৭,৭৭৭,৫৯৪ টাকা।
মোট বকেয়া ঋণ ৬২১,৩৪৪,২৮৯ টাকা, সদস্যদের মোট সঞ্চয় ৬২২,৮৪৪,৭৭১ টাকা এবং প্রতিষ্ঠানগুলোর নিজস্ব তহবিল ৫৮৬,৪৯৬,৭৫২ টাকা।
তবে এই বিশাল কর্মকাণ্ড এখনো মূলত নগদ ভিত্তিক, খণ্ডিত ও শ্রমনির্ভর। মাঠকর্মীদের হাতে হাতে অর্থ সংগ্রহ, কাগজে খাতা রক্ষণাবেক্ষণ এবং গ্রামীণ লজিস্টিক ব্যবস্থাপনা পুরো ব্যবস্থাকে ব্যয়বহুল ও ধীরগতির করে তুলেছে।
অন্যদিকে, বিকাশ, নগদ, রকেটের মতো মোবাইল ফাইন্যান্সিয়াল সার্ভিস (MFS) তাৎক্ষণিক ও কম খরচে ডিজিটাল লেনদেনের সুবিধা দিচ্ছে। ফলে ক্ষুদ্রঋণভিত্তিক গ্রাহকরা ডিজিটাল আর্থিক ব্যবস্থার মূল ধারায় পিছিয়ে পড়ছে। এটি “প্রযুক্তিনির্ভর উন্নত জাতি”-এর পথে একটি বড় প্রতিবন্ধকতা।
কেন প্রয়োজন ডিজিটাল ব্যাংকভিত্তিক ক্ষুদ্রঋণ ব্যবস্থা
একটি ডিজিটাল মাইক্রোফাইন্যান্স ব্যাংক হবে বাংলাদেশের আর্থিক অন্তর্ভুক্তির পরবর্তী ধাপ এটি এনজিওর সামাজিক মিশন ও আস্থাকে ডিজিটাল ব্যাংকিংয়ের দক্ষতা ও উদ্ভাবনের সঙ্গে সংযুক্ত করবে।
এমন একটি ব্যাংক নিম্নআয়ের ও গ্রামীণ জনগোষ্ঠীর জন্য মাইক্রো-সেভিংস, মাইক্রো-ইনস্যুরেন্স, রেমিট্যান্স, ডিজিটাল স্কোরিং, নারী উদ্যোক্তা ঋণ ইত্যাদি সাশ্রয়ী পণ্য প্রদান করতে পারবে।
মূল সুবিধাগুলো হলো
ব্যয় হ্রাস: ডিজিটাল অটোমেশন ডেটা সংগ্রহ, ঋণ বিতরণ ও কিস্তি আদায়কে সহজ ও কম খরচে সম্পন্ন করবে।স্বচ্ছতা: ডিজিটাল লেজার ও ব্লকচেইন আর্থিক জবাবদিহিতা নিশ্চিত করবে।গ্রাহক ক্ষমতায়ন: স্মার্টফোনভিত্তিক অ্যাপ নারীদের নিজস্ব আর্থিক নিয়ন্ত্রণে সহায়তা করবে।
তথ্যনির্ভর সিদ্ধান্ত: ডেটা বিশ্লেষণের মাধ্যমে ঝুঁকি মূল্যায়ন ও পণ্য নকশা উন্নত করা যাবে।স্থিতিস্থাপকতা: দুর্যোগ, মহামারি বা লকডাউনের সময়ও ডিজিটাল সেবা অব্যাহত রাখা সম্ভব হবে।
এই রূপান্তর মাইক্রোফাইন্যান্সের মানবিক চরিত্রকে বিলুপ্ত করবে না; বরং প্রযুক্তির সহায়তায় এটিকে আরও টেকসই, দক্ষ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক করবে।
ডিজিটাল রূপান্তরে এনজিওগুলোর ভূমিকা
বাংলাদেশের এনজিওগুলোর রয়েছে বিশাল গ্রামীণ নেটওয়ার্ক, সামাজিক আস্থা ও অভিজ্ঞতা, যা তাদের ডিজিটাল রূপান্তরের অগ্রদূত হিসেবে অনন্য করে তুলেছে।
ডিজিটাল ব্যাংক পরিচালনার জন্য এনজিওগুলোকে নিতে হবে নিম্নলিখিত পদক্ষেপসমূহ—
প্রাতিষ্ঠানিক পুনর্গঠন: প্রশাসন, তথ্যপ্রযুক্তি ও মানবসম্পদে ডিজিটাল দক্ষতা বৃদ্ধি। কৌশলগত অংশীদারিত্ব: ফিনটেক, মোবাইল অপারেটর ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার সঙ্গে অংশীদারিত্ব গঠন। গ্রাহককেন্দ্রিক উদ্ভাবন: বাংলা ভাষা ও স্থানীয় উপভাষায় অ্যাপ উন্নয়ন, অডিও-ভিত্তিক নির্দেশনা।
তথ্য সুরক্ষা ও আস্থা: গ্রাহকের আর্থিক তথ্য সুরক্ষায় নৈতিক ও নিরাপদ তথ্যনীতি প্রণয়ন। নীতিগত সহযোগিতা: বাংলাদেশ ব্যাংক, মাইক্রোক্রেডিট রেগুলেটরি অথরিটি (MRA) ও পিকেএসএফ-এর সঙ্গে সমন্বয় করে ডিজিটাল ব্যাংকের নীতিগত কাঠামো প্রণয়ন।
চ্যালেঞ্জ ও ঝুঁকি
এই রূপান্তরের প্রধান চ্যালেঞ্জ হলো নীতি ও সক্ষমতার সীমাবদ্ধতা।
বাংলাদেশ ব্যাংকের ডিজিটাল ব্যাংক লাইসেন্সিং নির্দেশিকা ২০২৪ এখনো মূলত বৃহৎ আর্থিক প্রতিষ্ঠানের জন্য প্রণীত। এনজিও বা কমিউনিটি-ভিত্তিক সংস্থাগুলোর জন্য এখনো সুস্পষ্ট নির্দেশনা নেই।
তাছাড়া, অনেক গ্রামীণ গ্রাহকের স্মার্টফোন বা ইন্টারনেট সংযোগ নেই; ডিজিটাল শিক্ষার অভাবও রয়েছে। ফলে ডিজিটাল সেবায় প্রবেশাধিকার বৈষম্য বাড়তে পারে।
সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো মানসিকতার পরিবর্তন
বেশিরভাগ এনজিও নেতৃবৃন্দ এখনো প্রযুক্তিকে প্রশাসনিক সরঞ্জাম হিসেবে দেখেন, কৌশলগত রূপান্তরের উপাদান হিসেবে নয়। ডিজিটাল ব্যাংক গড়তে হলে এনজিওগুলোকে “উন্নয়ন সেবাদাতা” থেকে “সামাজিক উদ্ভাবক” হিসেবে নিজেদের কল্পনা করতে হবে।
*একটি টেকসই ডিজিটাল মাইক্রোফাইন্যান্স ইকোসিস্টেম
বাংলাদেশে একটি টেকসই ডিজিটাল মাইক্রোফাইন্যান্স ইকোসিস্টেম গড়ে তুলতে হবে
বহুমাত্রিক সমন্বয়ের মাধ্যমে—
নীতিমালা: বাংলাদেশ ব্যাংক, এমআরএ, পিকেএসএফ ও আইসিটি বিভাগ যৌথভাবে দায়িত্বশীল ডিজিটাল ফাইন্যান্স নীতি প্রণয়ন করবে। সরকারি-বেসরকারি অংশীদারিত্ব: টেলিকম, ফিনটেক ও এনজিওরা যৌথভাবে মাইক্রো-সেভিংস, ডিজিটাল আইডি যাচাই ও ক্রেডিট স্কোরিং প্ল্যাটফর্ম তৈরি করতে পারে।
আর্থিক সাক্ষরতা: কমিউনিটি রেডিও, সোশ্যাল মিডিয়া ও তরুণদের মাধ্যমে গ্রামীণ জনগণকে ডিজিটাল ফাইন্যান্স ও সাইবার নিরাপত্তায় সচেতন করা। সবুজ ও জেন্ডার-সংবেদনশীল অর্থায়ন: নবায়নযোগ্য শক্তি ও নারী উদ্যোক্তা উন্নয়নের জন্য বিশেষ আর্থিক পণ্য।
ডিজিটালাইজেশন কখনো মাইক্রোফাইন্যান্সের সামাজিক লক্ষ্যকে দুর্বল করবে না — বরং প্রযুক্তির মাধ্যমে তা আরও শক্তিশালী করবে; দারিদ্র্য হ্রাস, নারী ক্ষমতায়ন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক অর্থনীতিতে অবদান রাখবে।
উপসংহার
বাংলাদেশ যখন ২০২৬ সালে এলডিসি থেকে উত্তরণ ও স্মার্ট বাংলাদেশের লক্ষ্য অর্জনের পথে, তখন আর্থিক অন্তর্ভুক্তির টেকসই রূপান্তর অপরিহার্য।
এখন সময় এসেছে এনজিও পরিচালিত মাইক্রোফাইন্যান্স ব্যবস্থাকে ডিজিটাল ব্যাংকিং মডেলে পুনঃকল্পনা করার — যেখানে মানবিক আস্থা ও প্রযুক্তির দক্ষতা মিলিত হবে।
এনজিও ও এমএফআইগুলো একসাথে এই রূপান্তরের নেতৃত্ব দিলে তারা শুধু আর্থিক প্রতিষ্ঠান নয়, বরং অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রবৃদ্ধি ও সামাজিক পরিবর্তনের চালিকাশক্তি হয়ে উঠবে।
বাংলাদেশের ক্ষুদ্রঋণ এখন অতীতের ঐতিহ্য নয় — এটি হতে পারে ভবিষ্যতের ডিজিটাল প্রতিশ্রুতি।
আমি আন্তরিকভাবে সেতু (SETU)-কে অভিনন্দন জানাই একটি পরিকল্পনা সভা আয়োজনের উদ্যোগ নেওয়ার জন্য, যার লক্ষ্য একটি ডিজিটাল ব্যাংক প্রতিষ্ঠার সম্ভাবনা অনুসন্ধান করা এটি সময়োপযোগী ও দূরদর্শী একটি উদ্যোগ
এ এইচ এম বজলুর রহমান, এমএসএস [গভর্নমেন্ট অ্যান্ড পলিটিক্স ও এলএল.বি] বাংলাদেশ এনজিওস নেটওয়ার্ক ফর রেডিও অ্যান্ড কমিউনিকেশন - এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। তিনি ডিজিটাল গণতন্ত্র, তথ্যের অখণ্ডতা ও অন্তর্ভুক্তিমূলক ডিজিটাল উন্নয়নের একজন বিশেষজ্ঞ। বাংলাদেশের দায়িত্বশীল কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার রাষ্ট্রদূত হিসেবে তিনি মানবাধিকারভিত্তিক নৈতিক প্রযুক্তি ব্যবহারে কাজ করছেন। একই সঙ্গে নীতি গবেষণা ফেলো হিসেবে চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে গণমাধ্যম শক্তিশালীকরণ, তথ্যের অখণ্ডতা এবং টেকসই সমাজ গঠনে নিবেদিত
০ টি মন্তব্য