তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নের অগ্রযাত্রাকে কাজে লাগাতে হবে
প্রযুক্তির অগ্রযাত্রায় আরো পরিবেশ সৃষ্টি করতে হবে। বর্তমানে দেশে ১৮ কোটি ৩৫ লাখ মোবাইল সিম ব্যবহারকারী রয়েছেন। প্রায় ১২ কোটি মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারী ও ১ লাখ ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবহারকারী আছেন। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের একটি বড় অংশ তথা ১২ কোটি গ্রাহকই তাদের মোবাইল ফোনের মাধ্যমে এটি ব্যবহার করে থাকেন। সার্বিকভাবে তথ্যপ্রযুক্তি খাতের উন্নয়ন ও বিকাশে নেয়া উদ্যোগগুলোর ফল ইতিমধ্যে আমরা পেতে শুরু করেছি, যা ভবিষ্যতে নিঃসন্দেহে আরও বাড়বে। আশা করা হচ্ছে, দেশে ২০২২ সালে স্মার্টফোন ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়ে মোট মোবাইল ব্যবহারকারীর ৫৪ শতাংশে উন্নীত হয়েছে। এই হার ২০১৬ সালের শেষে ছিল প্রায় ২২ শতাংশ।
বর্তমানে ইন্টারনেটের মাধ্যমেই শিক্ষাসহ প্রতিষ্ঠানের ভর্তির রেজিস্ট্রেশন বা নিবন্ধন যেমন করা যায় তেমনি পরীক্ষার ফলাফলও প্রকাশ হয়। এ রকম আরও অনেক কার্যক্রম এখন ডিজিটাল প্রক্রিয়ায় অর্থাৎ অনলাইনে সম্পন্ন করা হয়। সেরকম উল্লেখযোগ্য দুটি বড় মাপের সেবা কার্যক্রম হলো মোবাইল ব্যাংকিং বা মোবাইল ফোনের মাধ্যমে লেনদেন এবং অনলাইন ব্যাংকিং। ধীরে ধীরে এই ইন্টারনেট সেবা প্রত্যেকটি খাতেই অন্তর্ভুক্ত হচ্ছে। ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে যেমন রোগের চিকিৎসা চলছে, তেমনি গ্রামাঞ্চল বা মফস্বলের প্রশাসনিক কার্যক্রমও পরিচালিত হচ্ছে। এমনকি ভিডিও কনফারেন্সের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রী বা অন্য মন্ত্রীরাও ঢাকায় বসে অনেক সময় অনেক কাজ উদ্বোধন করেন, জনসভায়ও তাদের বক্তব্য সরাসরি দেখানো হয়।
ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়ে তোলার অভিযাত্রায় সারা দেশে ৬,৬০১ ইউনিয়ন ইনফরমেশন সার্ভিস সেন্টার বা ইউনিয়ন তথ্যসেবা কেন্দ্র খোলা হয়েছে। সরকার দেশব্যাপী ৯,৫০০ গ্রামীণ ডাকঘর এবং প্রায় ৫০০ উপজেলা ডাকঘরকে ই-সেন্টারে পরিণত করেছে। এছাড়া আমাদের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) মন্ত্রণালয় ইতিমধ্যে বিশ্বব্যাংক ও অন্যান্য উন্নয়ন সহযোগীর সহায়তায় দেশব্যাপী প্রশিক্ষণ প্রদানের মাধ্যমে আইসিটি বিষয়ে দক্ষ মানবসম্পদ তৈরির জন্য সর্বাত্মক কর্মসূচি হাতে নিয়েছে। একটি পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, প্রযুক্তির ব্যবহারে অনেক গুরুত্বপূর্ণ কাজও খুব সহজেই সম্পন্ন করা সম্ভব। আরো সহজ ভাষায় বললে প্রযুক্তি আমাদের দৈনন্দিন জীবনে সহজ থেকেও সহজতর করে দিয়েছে। এই সরকার তথ্যপ্রযুক্তি নিয়ে দীর্ঘ সময় ধরে কাজ করে যাচ্ছে। আর এই দীর্ঘমেয়াদি কাজ ভবিষ্যতে আরো এমন কিছু নিয়ে আসবে যেটা আমাদেরকে সুন্দর আর সাবলীল জীবন গড়তে সাহায্য করবে। বাংলাদেশের মানুষের জীবনধারা স্বপ্নিল গতিতে আধুনিকায়ন হয়েছে। গত ১৪ বছরের ব্যবধানে প্রযুক্তির জাদুর স্পর্শ শহরের পাশাপাশি আবহমান বাংলার প্রত্যন্ত গ্রামীণ জনপথকেও রাতারাতি পরিবর্তিত করে উন্নত দেশের সমান সুযোগ-সুবিধাযুক্ত লোকালয়ে পরিণত করেছে। করোনাভাইরাসের দুর্যোগের সময়ে বাংলাদেশের আপামর জনসাধারণ তাদের নিজস্ব প্রযুক্তিগত সুবিধা কাজে লাগিয়ে জীবনধারা সচল রাখতে সক্ষম হয়েছে। বিশ্বে এ যাবৎ আবিষ্কৃত প্রযুক্তির বেশির ভাগেরই কোনো না কোনো পর্যায় বাংলাদেশে ব্যবহার হয়ে থাকে। স্মার্টফোন ও ইন্টারনেটের ব্যবহার ব্যাপক হারে বাড়ছে। থ্রিজি, ফোরজি পেরিয়ে ফাইভজি নেটওয়ার্ক চালু হয়েছে। তেমনি সর্বাধুনিক প্রযুক্তির বঙ্গবন্ধু-১ স্যাটেলাইট এখন মহাকাশে সক্রিয় থেকে দেশের মতো বিশ্বে আর কোনো উন্নয়নশীল দেশ খুঁজে পাওয়া যাবে না, যেখানে এত স্বল্প সময়ে নিজস্ব পরিকল্পনায় ডিজিটাইজ হয়েছে।
অর্থনৈতিক-সামাজিক উন্নয়নে বাংলাদেশ প্রযুক্তি ব্যবহারে ত্বরিত সুফলও পেয়েছে। দেশের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) খাতের আয় ৫০০ কোটি ডলারে উন্নীত করার চেষ্টা চলছে। দেশব্যাপী ৩৯টি হাইটেক পার্ক করা হয়েছে। চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের মোকাবিলায় বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাত দক্ষ মানবসম্পদসহ বিভিন্ন অবকাঠামোগত উন্নয়নে জোর দিয়েছে। শুধু শহরেই নয়, বরং জেলা-উপজেলা সদর ছাড়িয়ে গ্রাম এমনকি প্রত্যন্ত ও দুর্গম অঞ্চলেও তথ্যপ্রযুক্তি সেবা পৌঁছে দিয়েছে সরকার। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগ ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নে কয়েকটি অনুষঙ্গের ওপর গুরুত্বারোপ করে কাজ করে চলেছে। সেগুলো হলো কানেকটিভিটি ও আইসিটি অবকাঠামো, মানবসম্পদ উন্নয়ন, আইসিটি শিল্পের উন্নয়ন, ই-গভর্ন্যান্স প্রতিষ্ঠা এবং অন্যান্য।
বাংলাদেশ প্রযুক্তিবিশ্বে অর্জন করে নিয়েছে নিজেদের একটি সম্মানজনক স্থান। বিশেষজ্ঞরা তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক এই উন্নয়ন ও অগ্রগতিকে আখ্যায়িত করছেন ডিজিটাল নবজাগরণ হিসেবে। দেশে ডিজিটাল বাংলাদেশ ধারণার সাথে মানুষের জীবনে এর বড় প্রভাবও দেখা গেছে। সরকার মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করছে। বিচারিক কার্যক্রমের ডিজিটালাইজেশন করেছে সরকার। সাইবার হয়রানি রোধে একটি সচেতনতামূলক কর্মসূচি বাস্তবায়িত হয়েছে এবং এই কর্মসূচির আওতায় একটি হেল্পলাইনও চালু করা হয়েছে। সরকার কেন্দ্রীয় ও স্থানীয় প্রশাসনের মধ্যে তথ্য আদান-প্রদানের সংযোগ স্থাপনের মাধ্যমে সরকারি কাজে স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি নিশ্চিতকরণ, অধিকতর উন্নত জনসেবা প্রদানের জন্য প্রশাসনের সর্বস্তরে ই-গভর্ন্যান্স প্রতিষ্ঠা করেছে। করোনাকালীন স্বাস্থ্যব্যবস্থা প্রযুক্তির ব্যবহারে চরম উৎকর্ষতা দেখাতে পেরেছে আর শিক্ষাব্যবস্থার পুরোটাই প্রযুক্তির মাধ্যমে পরিচালিত হচ্ছে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলো বন্ধ রেখেই। ব্যবসা-বাণিজ্যও অনলাইনমুখী হচ্ছে। গড়ে উঠেছে এফ-কমার্স বা ফেসবুকভিত্তিক ব্যবসা। এর বাইরে বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের একটি বড় অংশ ফ্রিল্যান্সার। দেশে প্রায় সাড়ে ছয় লাখ ফ্রিল্যান্সার রয়েছেন। এর বাইরে রয়েছেন সফটওয়্যার খাতের উদ্যোক্তারা। এ খাতে ১ বিলিয়ন মার্কিন ডলারের বেশি আয় আসছে। নারীদের তথ্যপ্রযুক্তিতে যুক্ত হওয়ার বিষয়টি আরেক বড় অগ্রগতি। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে নারী উদ্যোক্তাদের উপস্থিতি বাড়ছে। দেশে প্রায় ২০ হাজার ফেসবুক পেজে কেনাকাটা চলছে। এর মধ্যে ১২ হাজার পেজ চালাচ্ছেন নারীরা। ফেসবুককে মাধ্যম হিসেবে ব্যবহার করে স্বল্প পুঁজিতেই উদ্যোক্তা হয়ে উঠছেন নারীরা। গত এক বছরে ই-কমার্স খাতে লেনদেন হয়েছে ১ হাজার ৫০০ কোটি টাকা। দেশের তথ্যপ্রযুক্তিতে অন্যতম একটি খাত বিজনেস প্রসেস আউটসোর্সিং বা বিপিও। খাতটিতে কাজ করছেন ৩৫ হাজার তরুণ-তরুণী। আমাদের দেশে প্রযুক্তির ব্যবহার ও নতুন নতুন প্রযুক্তি উদ্ভাবনের বর্তমান ধারা বজায় থাকলে আগামী এক দশকের মধ্যে বাংলাদেশ নিঃসন্দেহে উন্নত বিশ্বের কাতারে পৌঁছে যাবে।
০ টি মন্তব্য