প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষার বিকল্প নেই
কারিগরি বা প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষার বিকল্প নেই বলে জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। তিনি উল্লেখ করেন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে প্রযুক্তিগত উন্নয়ন দরকার। প্রযুক্তির এ যুগে যে পরিবর্তন আসবে সে জন্য দক্ষ জনশক্তিরও প্রয়োজন। তাই কারিগরি ও প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষার বিকল্প নেই। আগামী প্রজন্মকে কারিগরি ও প্রযুক্তিনির্ভর দক্ষ জনশক্তিতে পরিণত করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী উল্লেখ করেন বঙ্গবন্ধু বিজ্ঞান ও প্রযুক্তির ওপর গুরুত্ব দিয়েছিলেন। বঙ্গবন্ধুর সেই চিন্তার সফল বাস্তবায়ন ও পরিবর্তিত বিশ্ব পরিস্থিতিতে প্রযুক্তিতে দক্ষ জনশক্তি পেতে ২০৩০ সালের মধ্যে ৩০ এবং ২০৪০ সালের মধ্যে ৫০ শতাংশ শিক্ষার্থীকে প্রযুক্তিগত শিক্ষায় আনার কাজ চলছে। ১০০টির বেশি টেকনিক্যাল প্রতিষ্ঠান স্থাপন হচ্ছে। ৫৯৩টি প্রতিষ্ঠানে ষষ্ঠ শ্রেণি থেকে টেকনিক্যাল জ্ঞান দেওয়া হবে। এছাড়া সব শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ষষ্ঠ-অষ্টম শ্রেণির শিক্ষার্থীদের জন্য কারিগরি শিক্ষা নিশ্চিত করা হবে।
এ সময় ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারিং শিক্ষাকে চার বছর মেয়াদি করে বিশ্বমানের করা হয়েছিল উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আমিই এ সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম। এভাবেই তা থাকা দরকার বলে মনে করি। শিক্ষা মন্ত্রণালয়কে তিন বছর মেয়াদ করার সিদ্ধান্ত ভেবে দেখতে বলেন তিনি।
বিজ্ঞানের অভাবনীয় সাফল্যে এবং প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় বিজ্ঞানীদের নব নব আবিষ্কারের মাধ্যমে বিশ্ব দ্রুত এগিয়ে চলেছে। বিজ্ঞান এবং প্রযুক্তির সাথে তাল মিলিয়ে বিশ্বের নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করে এগিয়ে যেতে হলে প্রযুক্তিনির্ভর শিক্ষার বিকল্প নেই। ছাত্রদের আলোকিত মানুষ হিসেবে গড়ে উঠে পরিবার, সমাজ ও রাষ্ট্রের কল্যাণে নিজেদের নিবেদিত হয়ে কাজ করতে হবে।
দেশের প্রধান শিল্প খাতগুলোয় দক্ষ জনবল ঘাটতি ক্রমে দুশ্চিন্তার কারণ হয়ে উঠছে। উৎপাদনে এর প্রভাব পড়ছে। ২০ শতাংশ দক্ষ শ্রমিকের ঘাটতি নিয়েই চলছে দেশের রপ্তানি আয়ের প্রধান উৎস তৈরি পোশাক খাত। এ সুযোগে পোশাক খাতে কয়েক হাজার বিদেশি শ্রমিক কাজ করছে। অন্যদিকে বর্তমানে প্রায় এক কোটি বাংলাদেশি জনশক্তি বিশ্বের বিভিন্ন দেশে অবস্থান করছে। এ বিপুল মানুষের মাধ্যমে যে পরিমাণ রেমিট্যান্স আসার কথা, তা আসছে না। এর অন্যতম কারণ প্রবাসে বাংলাদেশি দক্ষ জনশক্তির অভাব। দক্ষতা বা প্রশিক্ষণের অভাবে চাকরি হচ্ছে না বিশাল বেকার জনগোষ্ঠীর। আবার দক্ষ কাজের লোক পাচ্ছেন না কারখানার মালিকরা। অর্থনৈতিক উন্নয়নের এ পর্যায়ে এসে এমন দুষ্টচক্র উন্নয়নের গতিকে স্তিমিত করছে, যা এক ধরনের ফাঁদ। এখান থেকে পরিত্রাণে দক্ষ জনশক্তি তৈরির বিকল্প নেই। সুষ্ঠু প্রশিক্ষণের মাধ্যমেই এটি অর্জন সম্ভব।
শিল্প বিকাশের জন্য যেমন নতুন শিল্প-কারখানা সৃষ্টির প্রয়োজন, তেমনিভাবে এসব কারখানায় দক্ষতা ও মুনাফা বৃদ্ধি করে লাভজনক প্রতিষ্ঠানে রূপান্তরের জন্য উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি একান্তভাবে অপরিহার্য। দেশের কল-কারখানায়, শিল্প ও সেবা প্রতিষ্ঠানে, কৃষি খামারে, কৃষিজমিতে উৎপাদনশীলতা বাড়াতে দক্ষ ও অভিজ্ঞ জনশক্তির বিকল্প নেই। আন্তর্জাতিক শ্রমবাজারেও অধিক উৎপাদনশীলতা নিশ্চিত করতে দক্ষ, কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন অভিজ্ঞ জনশক্তির বিপুল চাহিদা রয়েছে। এ কারণে বিদেশে দক্ষ, কারিগরি জ্ঞানসম্পন্ন অভিজ্ঞ জনশক্তি রফতানির তাগিদ দেয়া হচ্ছে। আধুনিক যুগে জাতীয় উন্নয়নের প্রশ্নে উৎপাদনশীলতা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখে। প্রতিযোগিতাময় বিশ্বে উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি ছাড়া কোনো শিল্পই টিকে থাকতে পারে না। শ্রমিকদের মজুরি নির্ধারণের ক্ষেত্রেও উৎপাদনশীলতা গুরুত্বপূর্ণ উপাদান হিসেবে বিবেচিত হয়। শ্রমিকরা মজুরি বাড়ানোর কিংবা অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির দাবি তুললে ব্যবস্থাপনা কর্তৃপক্ষ স্বাভাবিকভাবেই তাদের উৎপাদনশীলতা বাড়ানোর কথা বলে থাকেন। উৎপাদনশীলতা বৃদ্ধি পেলেই শ্রমিকদের মজুরি ও অন্য সুযোগ-সুবিধা বাড়ানো সম্ভব হয়। যে কারণে প্রতিষ্ঠানও সমৃদ্ধির দিকে এগিয়ে যায় এবং লাভজনক পর্যায়ে পৌঁছে। বর্তমানে যে পরিমাণ দক্ষ শ্রমিক দরকার তা মিলছে না। কৃষি প্রক্রিয়াকরণ, তৈরি পোশাক শিল্প এবং লাইট ইঞ্জিনিয়ারিং শিল্পে উচ্চপর্যায়ে দক্ষ লোকের ব্যাপক ঘাটতি রয়েছে। বিআইডিএসের গবেষণায় উঠে এসেছে, কোথাও অষ্টম শ্রেণি পাস কর্মীর দরকার হলে দরখাস্ত আসছে মাস্টার্স পাসের। আবার কোথাও বিজ্ঞানের শিক্ষার্থী দরকার হলে সেখানে পাওয়া যাচ্ছে না। বাংলাদেশের শ্রমিকদের মধ্যে কর্মক্ষমতা কম। এক্ষেত্রে সবার ওপরের অবস্থানে সিঙ্গাপুর আর বাংলাদেশের অবস্থান নিচ থেকে চতুর্থ। অর্থাৎ কম্বোডিয়া, ভিয়েতনাম ও পাকিস্তানের অবস্থান বাংলাদেশের পরে। এছাড়া ভারত, শ্রীলংকা, মঙ্গোলিয়াসহ অনেক দেশই বাংলাদেশের পরে অবস্থান করছে। গত বছর প্রাতিষ্ঠানিক প্রশিক্ষণ পেয়েছেন মাত্র ৩ দশমিক ৬ শতাংশ শ্রমিক, যা উদ্বেগজনক। অর্থাৎ ব্যক্তি উদ্যোক্তারাও শ্রমিকের দক্ষতা বাড়াতে প্রশিক্ষণের বিষয়ে আগ্রহী নয়।
দক্ষতা ও প্রযুক্তিগত দিক থেকে উন্নত দেশগুলোর কথা বলতে গেলে বেশকিছু দেশের নাম সামনে চলে আসে। এর মধ্যে আছে জাপান, যুক্তরাষ্ট্র, দক্ষিণ কোরিয়া, ইসরায়েল, জার্মানি, রাশিয়া, যুক্তরাজ্য এবং আরো অনেক দেশের নাম। কেন এ দেশগুলো এত উন্নত তা একটু ভাবলেই সবার আগে তাদের প্রযুক্তির কথাই মনে পড়বে। জাপানের বিশেষজ্ঞদের উন্নতমানের গবেষণা তাদের প্রযুক্তিতে অভাবনীয় পরিবর্তন এনে দিয়েছে। তাদের উন্নতির কারণ খুঁজলে প্রথম সামনে চলে আসবে দেশটির শিক্ষাব্যবস্থা। ১৯৫৮ সাল থেকেই জাপানে নিম্ন মাধ্যমিক লেভেলেই প্রযুক্তি শিক্ষার ব্যবস্থা বাধ্যতামূলক করা হয়েছে। পরবর্তী সময়ে উচ্চ মাধ্যমিক পর্যায়ে বৃত্তিমূলক প্রযুক্তি শিক্ষাকে ঐচ্ছিক বিষয় হিসেবে রাখা হয়। নিম্ন মাধ্যমিক পর্যায়ে প্রযুক্তি শিক্ষার উদ্দেশ্যই ছিল শিক্ষার্থীদের বাস্তবিক অভিজ্ঞতা লাভের মাধ্যমে আধুনিক প্রযুক্তি হাতে-কলমে শেখা এবং বাস্তবিক অর্থেই আধুনিক মেশিন তৈরি এবং চালনা করার মাধ্যমে জীবন এবং প্রযুক্তির মধ্যকার সম্পর্ক বোঝা এবং আধুনিক প্রযুক্তির উন্নতি সাধন করা যাতে দৈনন্দিন জীবনের মান বৃদ্ধি পায়। পেশাগত দক্ষতা উন্নয়নের বিষয়টি দেশের ২২টি মন্ত্রণালয় দেখাশোনা করছে। কিন্তু কাজের সমন্বয় নেই। এ ব্যবস্থারও পরিবর্তন জরুরি। সরকারের একার পক্ষে প্রতিটি পেশার দক্ষতা উন্নয়ন সম্ভব নয়। এখানে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের অংশগ্রহণও জরুরি। বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটে দক্ষতা বৃদ্ধির জন্য বেসরকারি খাতের সম্পদ, অভিজ্ঞতা ও মতামতকে প্রাধান্য দেয়া দরকার। অন্যথায় যেকোনো উদ্যোগ সফলতা থেকে বঞ্চিত হতে পারে। জাতিসংঘ ঘোষিত টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে কারিগরি শিক্ষার বিকল্প নেই। প্রয়োজন সরকারি ও বেসরকারি পর্যায়ে বিনিয়োগ। বিনিয়োগ ছাড়া কর্মসংস্থানের ক্ষেত্রে এসডিজির নির্ধারিত লক্ষ্য অর্জন অসম্ভব। শ্রমের চাহিদা অনুযায়ী দক্ষ শ্রমিক গড়ে তুলতে হবে। এজন্য সমন্বিত উদ্যোগ গ্রহণ করা দরকার। বাংলাদেশসহ বিশ্বের অন্যান্য উন্নয়নশীল দেশে কারিগরি শিক্ষা ও প্রশিক্ষণ অন্যতম চালিকাশক্তি। দক্ষ জনশক্তি তৈরি করতে হবে যেন বেশি উৎপাদনের মাধ্যমে দেশের উন্নয়ন ত্বরান্বিত করা যায়। এজন্য সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানকে একসাথে কাজ করতে হবে। নতুন করে সাজাতে হবে প্রশিক্ষণ কার্যক্রম।
০ টি মন্তব্য