গ্রামীণ জীবনে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি
বাংলাদেশের সাধারণ মানুষের জীবনে প্রযুক্তির প্রভাব পড়ার দৃষ্টান্ত খুব কমই আছে৷ সৃষ্টির আদি থেকে প্রাকৃতিক উপায়ে মানুষ যেভাবে বসবাস করেছে সেভাবেই শত শত বছর ধরে গ্রামগুলো বেঁচে ছিল৷ তবে যেসব প্রযুক্তি তাদের দোরগোড়ায় পৌঁচেছে তার সর্বোত্তম ব্যবহার সেখানেই হয়ে থাকে৷ গ্রামের জীবন মানেই মানবসভ্যতার আদিরূপ বা প্রাকৃতিক পরিবেশে কায়িক শ্রমনির্ভর জীবনধারণ৷ এখনো একুশ শতকে সেটিই বাংলাদেশের গ্রামজীবনের নিয়মিত চিত্র৷
আধুনিক বা সভ্য মানুষের জীবন গ্রামে পৌঁছায় শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও পোস্ট অফিসকে ঘিরে৷ বই, খাতা, কলম, পেন্সিল বা কাগজের চিঠির সাথে এক সময়ে যুক্ত হয় যান্ত্রিক টেলিগ্রাম৷ মাথার ওপরে টেলিফোন-টেলিগ্রামের তার দেখেই মানুষ জীবনের আধুনিক অধ্যায়কে চিনতে শুরু করে৷ তবে সেসব তার তাদের দুয়ারে কোনো বার্তা পৌঁছাতো না৷ বরং উপশহর বা থানা সদর থেকে হাতে লেখা টেলিগ্রাম যেতো তার হাতে৷ ফোন কাকে বলে সেটিতো বছর দশেক আগেও গ্রামের মানুষ চিনতো না৷ কোনো কোনো আধা শহরে বা আমরা যাকে মফস্বল শহর বলি তাতে টেলিফোন পৌঁছায় বাংলাদেশ স্বাধীন হবার পর৷ বিগত এক দশকে সেসব টেলিফোন এনালগ থেকে ডিজিটাল হয়েছে৷
গ্রামীণ জীবনে প্রথম গতির সঞ্চার করে সেচযন্ত্র বা শ্যালো মেশিন৷ ইরি ধানের চাষের সাথে যান্ত্রিক সেচ দেবার একটি সম্পর্ক গড়ে ওঠার পর গ্রামের মানুষ কখনো ভূগৃর্ভের পানি বা কখনো মাটির গভীরের পানি উত্তোলন করার কাজে লেগে যায়৷ বস্তুত একটি মাত্র ডিজেল ইঞ্জিন যার ক্ষমতা খুবই সীমিত (সচরাচর সর্বোচ্চ ১২/১৬ হর্স পাওয়ার) সেটিই হচ্ছে গ্রামজীবনের একমাত্র অবলম্বন৷ কিন্তু সাধারণ মানুষ ওই একটি যন্ত্রকেই তার নিজস্ব উদ্ভাবনী ক্ষমতা দিয়ে এমন বহুমুখী ব্যবহার করেছে, যার তুলনা আর কোথাও পাওয়া যাবে না৷ এই যন্ত্র তার জমিতে সেচ দেয়, ধান মাড়াই করে, তার গোলার ধান, জমির আটা ও মসলা ভাঙ্গায়, নৌকা চালায়, ভ্যানগাড়িতে বসে- এমনকি ড্রেজারের শক্তি যোগায়৷ দুর্ভাগ্যক্রমে গ্রামীণ মানুষের প্রযুক্তি ব্যবহারের এই ক্ষেত্রগুলোতে আমাদের শিক্ষিত বা প্রকৌশলীদের অবদান একেবারেই নেই৷ বরং প্রায় প্রতিদিনই শিক্ষিত শহুরে মানুষদের পত্রিকায় এমন খবর ছাপা হয় যে, নছিমন-করিমন জাতীয় গ্রামীণ যান্ত্রিক ভ্যানগাড়ি চালনা বন্ধ করা হোক৷ কেউ এটি ভাবে না যে, সাধারণ মানুষ তার নিজস্ব উদ্ভাবনী শক্তি দিয়ে যা তৈরি করেছে, তাকে আরও উন্নত করা হোক৷ বিশেষত চীনা কমদামী এ ইঞ্জিনকে গ্রাম জীবনের ‘লাইফ লাইন’ বলে কোনো অত্যুক্তি করা হবে না৷ গ্রামে শক্তিসঞ্চারে বিদ্যুতের অবদান কম নয়৷ বিগত দুই দশকে এ শক্তি গ্রামে পৌঁ চেছে৷ বলা যায়, বাংলাদেশের বৃহত্তর গ্রাম অঞ্চল এরই মাঝে বিদ্যুত নেটওয়ার্কের আওতায় এসেছে৷ কিন্তু বিদ্যুতের সবচেয়ে বড় সঙ্কট হচ্ছে, এটি এখনো নির্ভরযোগ্য নয়৷ প্রধানত শহরের মানুষদের চাহিদা মেটানোর পর উদ্বৃত্ত বিদ্যুত্ গ্রামে সরবরাহ করা হয়৷ কোনো কোনো সময় দিনের পর দিন বিদ্যুত্ সরবরাহ বন্ধ থাকে৷ ফলে এ শক্তিকে নির্ভর করে গ্রামের মানুষের ভাগ্যের পরিবর্তন তেমনভাবে করা হয়ে ওঠেনি৷ কোনো কল-কারখানা এর ওপর নির্ভর করে বেঁচে থাকতে পারে না৷ এমনকি কোনো কোনো স্থানে বরফের কল বন্ধ হয়ে যায় এর অভাবে৷ চাল ভাঙ্গানো, সেচ দেয়া ইত্যাদি কাজে এই শক্তি ব্যবহার করা যায় না৷ যদি নির্ভরতার সাথে গ্রামে বিদ্যুত্ সরবরাহ করা যায়, তবে ডিজেল ইঞ্জিনের চাইতেও হাজারগুণ বেশি লাগসই ব্যবহার এই শক্তি দিয়ে হতে পারে৷
বাংলাদেশের শতকরা মাত্র ৩ ভাগ বাড়িতে কমপিউটার রয়েছে৷ জনসংখ্যার শতকরা ৬ ভাগ কোনো এক সময়ে কমপিউটার ব্যবহার করেছে৷ মেট্রো এলাকার শতকরা ১৬ ভাগ গৃহস্থালির মানুষ কমপিউটার ব্যবহার করে৷ শহর এলাকার শতকরা ১৩ এবং গ্রামাঞ্চলের মাত্র ৩ ভাগের কম লোক কমপিউটার ব্যবহার করে৷
তথ্যপ্রযুক্তির গ্রামযাত্রা : তবে গ্রাম জীবনে পুরোটাই বদলে দিচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তির শক্তিশালী হাতিয়ার মোবাইল ফোন৷ মাত্র ১৫ বছর আগে বাংলাদেশে মোর্শেদ খানের সোয়া লাখ টাকার মোবাইল ফোন যখন শেখ হাসিনার হাতে পড়ে জনগণের যন্ত্রে পরিণত হলো সেই ৯৭ সালে, তখন গ্রামের মানুষের জীবনে এলো এক নতুন বিপ্লব৷ দেশের পাঁচ কোটি লোকের যদি মোবাইল ফোন থেকে থাকে তবে এর সিংহভাগই হলো গ্রামে৷ আমাদের যাদের গ্রামের সাথে যোগাযোগ আছে তারা জানি যে একজন দিনমজুর-জেলে-কামার-কুমার সকলেই এই মোবাইল ফোন ব্যবহার করে থাকে৷ এটি এখন আর কোনোভাবেই বিলাসসামগ্রী নয়৷ এটি একটি বড় ধরনের প্রযুক্তিগত সঙ্কট অতিক্রম করেছে৷ আমরা যখন ল্যান্ডলাইন দিয়ে দেশটিতে ফোনের সংখ্যা বাড়াতে চেয়েছিলাম, তখন দেশজুড়ে তার বসানো এবং তা রক্ষণাবেক্ষণ করা কঠিনতম চ্যালেঞ্জ ছিল৷ সেজন্য ফোনের ব্যবহার হয়ে উঠেছিল সীমিত৷ ব্যয়বহুল সে প্রযুক্তির বাধা মোবাইল প্রযুক্তিতে প্রায় নিমিষেই কেটে গেছে৷ এখন পার্বত্য চট্টগ্রামের কিছু গ্রামীণ জনপদ ছাড়া দেশের সব গ্রাম মোবাইল নেটওয়ার্কের আওতায় রয়েছে৷ আগ্রাসী ধরনের নেটওয়ার্ক সম্প্রসারণ কার্যক্রমের ফলে অতি সাধারণ হাটবাজারে এখন দেখা যায় মোবাইল ফোনের বেজ স্টেশন৷ অন্যদিকে এবারের ছবিসহ ভোটার তালিকা প্রণয়নের নামে অত্যাধুনিক ল্যাপটপ দেখেছে গ্রামের মানুষ৷ একই সাথে টেরিস্ট্রিরিয়াল ও স্যাটেলাইটনির্ভর টিভির সম্প্রচার গ্রামকে সেই সনাতনী গ্রাম আর রাখেনি৷
বাংলাদেশের গ্রামে তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি : সম্প্রতি আমেরিকান চেম্বার অব কমার্স বাংলাদেশের মিডিয়া ও কমিউনিকেশনবিষয়ক একটি জরিপ রিপোর্ট প্রকাশ করেছে৷ এই চেম্বারের জুন ২০০৮-এ প্রকাশিত নিজস্ব নিউজলেটারে (বর্ষ১, সংখ্যা ২) প্রকাশিত এই জরিপে বলা হয়েছে যে, বাংলাদেশের শতকরা ৪৫ ভাগ ঘরে এখন টিভি আছে৷ শহরাঞ্চলে এটি শতকরা ৭৭ ভাগ এবং গ্রামে সেটি শতকরা ৩১ ভাগ৷ এখন থেকে তেরো বছর আগে ১৯৯৫ সালে বাংলাদেশের গ্রামে টিভি ছিল শতকরা মাত্র ৩ ভাগ৷ এটি বিগত তেরো বছরে বেড়েছে দশগুণেরও বেশি৷ অন্যদিকে ১৯৯৫ সালে আমাদের জাতীয়ভাবে টিভির মালিক ছিল শতকরা মাত্র ৮ ভাগ গৃহস্থালি৷ তেরো বছরে সেটি পাঁচ গুণের মতো বেড়েছে৷ এ হিসাবের মাঝে আরও চমত্কারিত্ব হচ্ছে যে, মেট্রো শহর বা ঢাকা, চট্টগ্রাম এসব শহরে টিভি আছে শতকরা ৮৯ ভাগ৷ এর মাঝে শতকরা ৫৯ ভাগ পরিবারে রঙিন টিভি৷ বিগত এক দশকে রঙিন টিভির পরিমাণ বেড়েছে ব্যাপকভাবে৷ বিগত এক দশকে গ্রামাঞ্চলে টিভির মালিকানা বেড়েছে শতকরা ২৪ ভাগ থেকে ৫৯ ভাগ৷ অন্যদিকে শতকরা ৬০ ভাগ নারী এবং শতকরা ৭৩ ভাগ পুরুষ টিভির দর্শক বলে জরিপে বলা হয়েছে৷ এ হারে টিভির ব্যবহার বাড়ায় গ্রামজীবনে টিভির প্রভাব বেড়েছে ব্যাপকভাবে৷ বলা যায়, রাজনৈতিক সচেতনতা বাড়ার পেছনেও এইভাবে টিভির প্রসার ঘটার কথা স্মরণ করা যেতে পারে৷ লক্ষ করা গেছে যে, গ্রামের মানুষ টিভিতে সবচেয়ে বেশি সিনেমা দেখলেও টিভির খবর বা খেলাধুলার সম্প্রচারও ব্যাপক আগ্রহ নিয়ে দেখে থাকে৷ গ্রামাঞ্চলের সিংহভাগ মানুষ এখনো সরকারি টিভি চ্যানেল বিটিভি দেখে থাকে৷
জরিপ থেকে পাওয়া তথ্য অনুযায়ী দেশের শতকরা ৫০ ভাগ বাড়িতে মোবাইল ফোন রয়েছে৷ ২০০৬ সালে এ হার ছিল শতকরা মাত্র ২৩ ভাগ৷ তথ্যপ্রযুক্তির যেকোনো খাতের জন্য এই প্রবৃদ্ধি প্রশংসা করার মতো৷ তবে এখানেও গ্রামের প্রবৃদ্ধি শহরের তূলনায় অনেক কম৷ শহরের শতকরা ৮৩ ভাগ গৃহস্থালিতে মোবাইল রয়েছে৷
ইন্টারনেটের অবস্থা তত ভালো নয়৷ ইন্টারনেটের সচেতনতা বেড়েছে শতকরা ৩৯ ভাগ পর্যন্ত৷ এটি দু’বছর আগে ছিল শতকরা মাত্র ৩২ ভাগ৷ তবে শহরাঞ্চলে এ হার শতকরা ৫৭ ভাগ৷ গ্রামে সেটি শতকরা মাত্র ৩২ ভাগ৷ বর্তমানে শহরের শতকরা ১১ ভাগ, মেট্রোর বাসিন্দাদের শতকরা ১৩ ভাগ এবং গ্রামের শতকরা মাত্র ৩ ভাগ গৃহস্থালি ইন্টারনেট ব্যবহার করে থাকে৷
বাংলাদেশের শতকরা মাত্র ৩ ভাগ বাড়িতে কমপিউটার রয়েছে৷ জনসংখ্যার শতকরা ৬ ভাগ কোনো এক সময়ে কমপিউটার ব্যবহার করেছে৷ মেট্রো এলাকার শতকরা ১৬ ভাগ গৃহস্থালির মানুষ কমপিউটার ব্যবহার করে৷ শহর এলাকার শতকরা ১৩ এবং গ্রামাঞ্চলের মাত্র ৩ ভাগের কম লোক কমপিউটার ব্যবহার করে৷
এই সময়ে দেশের খবরের কাগজের পাঠকের হারও বেড়েছে৷ এখন দেশের শতকরা ২৪ ভাগ মানুষ সপ্তাহে অন্তত একবার খবরের কাগজ পাঠ করে৷ ২০০৬ সালে এটি শতকরা ২১ ভাগ ছিল৷ তবে মেট্রো এলাকায় এই হার শতকরা ৫৫ ভাগ৷ রেডিওর শ্রোতাও এ সময়ে বেড়েছে৷ শহরাঞ্চলে এটি শতকরা ২০ ভাগ যেটি ২০০৬ সালে মাত্র শতকরা ১২ ভাগ ছিলো৷ জরিপ অনুযায়ী রেডিওর প্রসার কমছে৷
আমরা এ জরিপ থেকে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে এটি উপলব্ধি করছি যে, গ্রামের মানুষের হাতে মোবাইল ফোন ব্যবহার বাড়লেও কমপিউটার ও ইন্টারনেটে পুরো দেশের পাশাপাশি গ্রামের অবস্থা শোচনীয়৷ ইন্টারনেট সচেতনতা, কমপিউটার ব্যবহার ও এসবের মালিক হওয়া ইত্যাদি খাতে পিছিয়ে থাকা গ্রামীণ জনপদ পুরো দেশের সূচককে দিনে দিনে নিম্নগামী করছে৷
দুনিয়ার দিকে তাকালে এটি দেখা যাবে যে, আমরা তথ্যপ্রযুক্তির কোনো কোনো ক্ষেত্রে যেমন মোবাইল ব্যবহারে এরই মধ্যে ২০০৬ সালের বিশ্বগড়কে অতিক্রম করেছি৷ এর অন্যতম কারণ হচ্ছে, আফ্রিকা বা সাব-সাহারার দেশগুলোতে বিশ্বের শতকরা ১৪ ভাগ লোক বাস করলেও সেখানে তথ্যপ্রযুক্তির প্রবেশ কম৷ কিছু তথ্য দিলেই স্পষ্ট প্রমাণ পাওয়া যাবে৷ ২০০৬ সালের হিসাব অনুযায়ী দুনিয়ায় প্রতি একশ’ জরে জন্য ১৯.৩৮টি টেলিফোন থাকলেও মধ্য আফ্রিকা অঞ্চলে ০.২৭টি, ইউরোপে ৩৯.৭০টি এবং আমেরিকায় (শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র নয়, পুরো আমেরিকা মহাদেশ) ৩২.৪২টি৷ মোবাইল ফোনের ক্ষেত্রে ২০০৬ সালে দুনিয়ার গড় হচ্ছে ৪০.৯১৷ তখন আমাদের গড় ছিলো শতকরা মাত্র ২৩ ভাগ৷ ইউরোপের গড় ৯৪.২৯ এবং আমেরিকায় সেটি ৬১.৯৫৷ পূর্ব আফ্রিকায় সেটি সর্বনিম্ন ৮.১৭টি (সূত্র ইন্টারন্যাশনাল টেলিকম ইউনিয়ন)৷ তবে তথ্যাবলী এটি প্রমাণ করে যে, আমাদের ইন্টারনেট ও ব্রডব্যান্ডসহ কমপিউটার ব্যবহারের হার কেবল দুনিয়ার নয়, এই অঞ্চলের তুলনায়ও সর্বনিম্ন৷
এক সময়ে দুনিয়াতে সভ্যতার মাপকাঠি ছিল ল্যান্ডফোনের ব্যবহার দিয়ে৷ তখন আমরা হাজারে একজন মানুষ ল্যান্ডফোন ব্যবহার করতাম না৷ মোবাইল ফোনের প্রসারের পর ফোনকে আর সূচক হিসেবে গণ্য করা হয় না৷ এমনকি ইন্টারনেট ব্যবহারকারীদের অনুপাতে দেশটির অগ্রগতি বিবেচনা করা হয় না৷ এখন কার্যত ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট কী পরিমাণ মানুষ ব্যবহার করে, তাকে সূচক হিসেবে ধরা হয়৷ দুর্ভাগ্যক্রমে ব্রডব্যান্ড ব্যবহারকারী নিয়ে কোনো জরিপ করা হয়নি৷ যদিও দেশে ব্রডব্যান্ড সেবাদাতা রয়েছে, তথাপি এখন পর্যন্ত ব্রডব্যান্ড ব্যবহারকারীর সংখ্যা খুবই সীমিত৷ ব্রডব্যান্ড সেবার মানও অত্যন্ত নিচু৷ সবচেয়ে বড় বিষয় হলো বাংলাদেশের গ্রামাঞ্চলে ব্রডব্যান্ডের সেবার অস্তিত্ব নেই৷ সম্প্রতি গ্রামাঞ্চলে মোবাইল ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বেড়েছে৷ তবে তাতে ব্রডব্যান্ড সেবা পাওয়া যায় না৷ আইএসপি প্রতিষ্ঠানগুলো ঢাকাকেন্দ্রিক হওয়ায় এই সেবাদানের সীমানাটা ঢাকাকেন্দ্রিক রয়ে গেছে৷ এসব আইএসপি প্রধানত তারের সহায়তায় ইন্টারনেট সেবা দিয়ে থাকে৷ কিন্তু গ্রামাঞ্চলের জন্য উচ্চহারে ক্যাবল চার্জ বহাল থাকায় আইএসপিগুলো ঢাকার বাইরে পা ফেলতে চায় না৷ যদিও সারাদেশেই উচ্চগতির ফাইবার অপটিক ডাটালাইন রয়েছে তবুও এই উচ্চহারের জন্য সেসব ডাটালাইন ব্যবহার হচ্ছে না৷ এই উচ্চহারের বিকল্প হলো ওয়াইম্যাক্স ও থ্রিজি৷ বিটিআরসি (বাংলাদেশটেলিযোগাযোগনিয়ন্ত্রণ কমিশন) সম্প্রতি ওয়াইম্যাক্স-এর লাইসেন্স দেয়ার সিদ্ধান্ত নিয়েছে৷ থ্রিজি নিয়ে পরীক্ষা নিরীক্ষা করার অনুমতি দেয়া হয়েছে৷ এর ফলে দেশজুড়ে ওয়াইম্যাক্স কানেকশন পাবার সম্ভাবনা রয়েছে৷ কিন্তু বাণিজ্যিকভাবে যারা ওয়াইম্যাক্স সেবা দেবেন, তারা প্রথমে শহর বা কেবল ঢাকাকেই কেন্দ্র হিসেবে ধরে নিয়ে কাজ করবে৷ গ্রামে ব্যবহারকারী তেমনভাবে না থাকায় ওয়াইম্যাক্স প্রযুক্তি প্রাথমিকভাবে গ্রামে যাবে বলে মনে হয় না৷ থ্রিজি প্রযুক্তির ক্ষেত্রেও একই কথা প্রয়োজ্য৷ এ বিষয়ে বিটিআরসি এখনো কোনো সিদ্ধান্ত নেয়নি৷ কবে নাগাদ এসব প্রযুক্তিকে বৈধ করা হবে সেটিও কেউ জানে না৷ সেজন্যই আমরা বলতে পারি, যতক্ষণ পর্যন্ত ওয়্যারলেস বা ক্যাবল উভয় ধরনের ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট প্রতিটি গ্রামে না যাবে এবং সুলভ না হবে, ততক্ষণ পর্যন্ত গ্রামীণ জনপদে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যাপক প্রসারের কোনো সম্ভাবনা তৈরি হবে না৷
তথ্যপ্রযুক্তিতে গ্রামের পশ্চাত্পদতার আরো তিনটি বড় কারণ : ওপরে উলেখিত জরিপের তথ্য থেকে গ্রামের পশ্চাত্পদতার যে চিত্রটি পাওয়া যায় সেটি অবাক হবার মতো নয়৷ কারণ, বাংলাদেশের কোনো কর্মকাণ্ডেই গ্রামকে প্রাধান্য দেয়া হয় না৷ আমরা যদি সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ তিনটি কারণকে এই পশ্চাত্পদতার কারণ হিসেবে চিহ্নিত করতে চাই, তবে লক্ষ করব যে কারণগুলো হলো :
০১. তথ্যপ্রযুক্তির সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে এর বাহন বিদেশী ভাষা৷ বরাবরই ইংরেজিতেই তথ্যপ্রযুক্তির প্রসার ঘটেছে৷ বাংলাদেশের রাষ্ট্রভাষা বাংলা হওয়া সত্ত্বেও বাংলা ভাষাকে তথ্যপ্রযুক্তিতে গুরুত্ব দেয়া হয়নি৷ কোনোভাবে ১৯৮৭ সালে কমপিউটারে বাংলা প্রকাশনার জগতের দুয়ার উন্মোচিত না হলে কখনো কমপিউটারে বাংলা প্রবেশ করতে পারত না৷ এখনো সরকারিভাবে তথ্যপ্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার গুরুত্ব অনুধাবন করা হয় না৷ সরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো ইংরেজি চর্চায় অনেক বেশি স্বাচ্ছন্দ্য বোধ করে৷ এরা প্রয়োজনে অপ্রয়োজনে ইংরেজি ব্যবহার করে৷ ক’দিন আগে বিটিআরসি মোবাইল সিম কেনার জন্য যে ফরমটি ব্যবহার করেছে তাতে বাংলা হরফই ছিলো না৷ সরকারি ওয়েবসাইট বা তথ্যগুলো শুধু ইংরেজিতেই প্রকাশ করা হয়৷
০২. তথ্যপ্রযুক্তিতে গ্রামের প্রবেশ বন্ধ হবার আরেকটি কারণ হচ্ছে, এতে গ্রামের মানুষের জন্য প্রয়োজনীয় উপাত্ত নেই৷ গ্রামের কৃষিপ্রধান রূপটির কথা বাদ দিলেও শিক্ষা, স্বাস্থ্য, উন্নয়ন বা এ ধরনের নানা বিষয় যাতে গ্রামের মানুষের আগ্রহ আছে, সেসব তথ্য ইন্টারনেটে পাওয়া যায় না৷ যা কিছু আছে তার সবই বলতে গেলে শহুরে বা তথাকথিত শহুরে শিক্ষিতদের জন্য৷
০৩. তথ্যপ্রযুক্তিতে গ্রামের প্রবেশাধিকার অনেকটাই নিষিদ্ধ৷ কারণ এটি ধারণ ও গ্রহণ করার জন্য প্রয়োজনীয় ক্রয়ক্ষমতা গ্রামের মানুষের নেই৷ একমাত্র মোবাইল ফোন ছাড়া তথ্যপ্রযুক্তির আর কোনো উপাদান গ্রামের মানুষের ক্রয়ক্ষমতায় নেই৷
গ্রামেই তথ্যপ্রযুক্তি চাই : অন্যদিকে তথ্যপ্রযুক্তিতে গ্রামের অবস্থার পরিবর্তন ছাড়া দেশের সার্বিক অবস্থার পরিবর্তন সম্ভব নয়৷ যে প্রধান কারণে তথ্যপ্রযুক্তিকে গ্রামে নিতে হবে তার বড় বিষয়টি হচ্ছে বাংলাদেশের বিপুল পরিমাণ শিক্ষিত জনগোষ্ঠীকে তথ্যপ্রযুক্তির কাজে ব্যবহার করা৷ গ্রামের মানুষের কাছে তথ্যপ্রযুক্তির সুফল পৌঁ ছে দেয়ার বিষয়টি থাকলেও জরুরি প্রয়োজন কর্মসংস্থান৷ আমাদের দেশের যত সম্পদের কথাই বলা হোক না কেনো, বিপুল মানুষকে ব্যবহার করতে না পারলে কোনো সম্পদ দিয়েই আমরা জাতীয় উন্নয়ন সাধন করতে পারব না৷ আমাদের শিক্ষিত বেকারের সংখ্যাটা এজন্য মনে রাখা দরকার৷ দেশে বেসরকারি হিসাবে শিক্ষিত বেকারের সংখ্যা প্রায় তিন কোটি৷ দেশের কোনো নীতিমালায় এই বিপুল জনগোষ্ঠীর কর্মসংস্থানের কোনো উপায় বর্ণিত হয়নি৷ সরকারের কোনো পরিকল্পনায় কোনো কৌশল এজন্য চিহ্নিত করা হয়নি৷ সরকার মনে করে হয়তো এটি সম্ভবও নয়৷ দিনে দিনে এই সংখ্যা জ্যামিতিক হারে বাড়ছে৷ জিপিএ-৫ প্রাপ্তি বা পাসের হার বাড়ার মানেই হলো এই সংখ্যার বিস্ফোরণ৷ সেই তুলনায় কাজের পরিমাণ বাড়ছে না৷ সরকারের আকার ছোট হতে থাকলে চাকরিদাতা হিসেবে সরকারের ক্ষমতাও কমতে থাকবে৷ বেসরকারি খাতেও অদক্ষ মানুষের কর্মসংস্থান সম্ভব নয়৷ এখন কেবল স্নাতক পাস করে চাকরি পাওয়া যায় না৷ চাকরির শর্ত হচ্ছে কমপিউটার শিক্ষিত হওয়া৷ কিন্তু গ্রামে কমপিউটার শিক্ষিত হবার সুযোগ নেই বললেই চলে৷ এজন্য গ্রামগুলোর পিছিয়ে পড়ার গতি আরো বাড়ছে৷
আমাদের দেশের বৈদেশিক মুদ্রা আয়ের একটি বড় উপায় জনসম্পদ রফতানি৷ কিন্তু জনসম্পদ রফতানির ক্ষেত্রে আমাদেরকে পরিবর্তন আনতে হচ্ছে৷ এখন অদক্ষ শ্রমিক রফতানির সুযোগ সীমিত হয়ে পড়েছে৷ অনেক দেশ থেকে অদক্ষ শ্রমিকরা ফেরত আসছে৷ আবার কমপিউটার জানা মানুষেরা খুব সহজেই বিদেশে যাবার সুযোগ পাচ্ছে৷ যে ব্রিটেন সহজে কাউকে ভিসা দিতে চায় না, সেই ব্রিটেন কিন্তু কমপিউটার বিজ্ঞানে স্নাতকদেরকে বিনাবাধায় ভিসা দিয়ে দিচ্ছে৷ এমনকি বৃত্তি পর্যন্ত দিচ্ছে৷ আমেরিকা, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া, জাপান ইত্যাদি দেশে কমপিউটার জানা মানুষদের ব্যাপক চাহিদা থাকায় বাংলাদেশকে এই খাতে অনেক গুরুত্ব দিতে হবে৷ সেজন্য দক্ষ মানুষ তৈরি করা দরকার৷ তথ্যপ্রযুক্তি ছাড়া কোনোভাবেই দক্ষ শ্রমিক তৈরি করা যাবে না৷
আরোও একটি বিষয় মনে রাখা দরকার, তথ্যপ্রযুক্তিই একমাত্র খাত যেখানে মানুষকে শহরে এসে কাজ করতে হয় না৷ আমাদের ত্রিশ লাখ নারী শ্রমিক গার্মেন্টস শিল্পে কাজ করছে৷ ওরা প্রধানত গ্রামের মানুষ৷ স্বল্প শিক্ষিত বা অশিক্ষিত৷ এজন্য তাদেরকে শহরে বা উপশহরে আসতে হয়েছে৷ গ্রামে কেউ গার্মেন্টস কারখানা তৈরির কথা ভাবেনি৷ হয়তো এটি সম্ভবও নয়৷ কিন্তু তথ্যপ্রযুক্তি শ্রমিকরা গ্রামে বসেই কাজ করতে পারবে৷ ব্রডব্যান্ড সংযোগ থাকলে দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে কমপিউটারের কোনো কাজ করা কঠিন কোনো কাজ নয়৷ এই একটিমাত্র খাত আছে যার বড় ধরনের শিল্পকারখানা গ্রামে হতে পারে৷ এজন্য নদীবন্দর, সমুদ্রবন্দর, বিমানবন্দর, বাণিজ্যিক কেন্দ্র, আরবান এরিয়া; এসব কোনো কিছুরই দরকার নেই৷
বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তির বিকাশের জন্য যেসব প্রচেষ্টা অব্যাহত রয়েছে তার মাঝে একটি হচ্ছে এই দেশের স্বাধীনতার ৪০ বছরে দেশে ৪০ হাজার টেলিসেন্টার স্থাপন করা৷ বিটিএন নামের একটি সংস্থা এই উদ্যোগ নিয়েছে৷ আমরা এর সফলতা কামনা করলেও এটি স্পষ্ট করে বলতে চাই, এর সফলতা অনেকটাই নির্ভর করে গ্রামের মানুষের সাথে মোবাইলের মতো কমপিউটার ও ইন্টারনেটের একটি সম্পর্ক স্থাপন করার ওপর৷ মানুষ শুধু ই-মেইল ব্রাউজিং বা টাইপিং করার জন্য টেলিসেন্টার ব্যবহার করতে আগ্রহী হবে না৷ এসব সেন্টারে বিদেশে কমমূল্যে ইন্টারনেট টেলিফোনি করার ব্যবস্থার পাশাপাশি ভিডিও কনফারেন্সিং, টিভি-সিনেমা দেখা, গান শোনা, রিং টোন ডাউনলোড করা, দূরশিক্ষণসহ লেখাপড়া করা, অনলাইন চাকরির আবেদন করতে পারা, অনলাইন পরীক্ষা দিতে পারা, ভর্তির খবরাখবর পাওয়া, গেম খেলা, কৃষি, স্বাস্থ্য, শিল্প-বাণিজ্য ইত্যাদির বাজার তথ্যসহ প্রয়োজনীয় তথ্য-উপাত্ত পাওয়া, ইন্টারনেট ব্যা িঙ্কংসহ কেনাবেচা করতে পারা, কৃষিঋণের আবেদন, ঋণের কিস্তির খবর জানাসহ সরকারের সাথে যোগাযোগ স্থাপন করতে পারা, সরকারকে প্রয়োজনীয় অভিযোগ পেশ করতে পারা, থানায় জিডি বা মামলা করতে পারা, আইনশৃঙ্খলা সংক্রান্ত দৃষ্টি আকর্ষণ করতে পারা, যোগাযোগের তথ্য জানতে পারা, খবরাখবর পাওয়া; সব ধরনের সেবা পেতে পারলে মানুষ এই ধরনের টেলিসেন্টারে আগ্রহ দেখাবে৷
এইসব সুযোগসুবিধাসহ প্রাথমিক বিদ্যালয় বা সেকেন্ডারি বিদ্যালয় বা কলেজে কমপিউটার ল্যাব স্থাপন করা গেলে তথ্যপ্রযুক্তিকে খুব সহজে গ্রামে স্থায়ী আসন দেয়া যাবে বলে আমি মনে করি৷
০ টি মন্তব্য