ডিজিটাল বাংলাদেশের সুযোগ সম্পূর্ণভাবে কাজে লাগাতে প্রযুক্তি ব্যবহারে নারী-পুরুষ বৈষম্য দূর করার আহ্বান জানিয়েছেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী। তিনি বলেন, শ্রমজীবী, কর্মজীবী ও পেশাজীবী নারীদের সুষ্ঠু কর্ম পরিবেশ সৃষ্টিতে পরিবার ও সমাজকে সচেতন হতে হবে। তিনি বলেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নারীদের এগিয়ে নিতে কার্যকর আইনগত মডেল ও পরিকল্পনা গ্রহণ করেছেন। তৃণমূল পর্যায়ের নারীরাও আজ বিভিন্ন ধরণের প্রশিক্ষণ গ্রহণের মাধ্যমে অর্থনৈতিকভাবে সাবলম্বী হচ্ছেন। অসংখ্য প্রতিভাসম্পন্ন নারী পরিবারের সার্বিক দায়িত্ব পালন করেও সমাজ এবং দেশ গঠনে প্রশংসনীয় অবদান রেখে চলেছেন। ‘নারীরা আজ উদ্যোক্তা হিসেবে সুনামের সঙ্গে কাজ করছেন। তারা কর্মসংস্থান সৃষ্টির মাধ্যমে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রাখছেন। যথাযথ সুযোগ দিলে নারীরা ২০৪১ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে স্মার্ট বাংলাদেশে পরিণত করতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করবে বলে আশা করেন স্পিকার। তিনি বৈষম্য আমাদের কাছে স্বাভাবিকভাবেই পরিচিত একটি শব্দ। আর্থিক বৈষম্য, সামাজিক বৈষম্য বা রাজনৈতিক বৈষম্য শব্দগুলো আমরা প্রতিনিয়ত শুনে থাকি। প্রযুক্তির চরম উন্নতির এই যুগে আমরা নতুন এক বৈষম্য দেখতে পাচ্ছি আর তা হলো ডিজিটাল বৈষম্য। প্রযুক্তি অগণিত মানুষের জীবনকে বদলে দিয়েছে, তা অস্বীকার করার উপায় নেই।
তবে বহু মানুষ প্রযুক্তি ব্যবহারের সুবিধা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে, সেটিও মনে রাখতে হবে। করোনাকালে বিশ্বের প্রায় প্রতিটি দেশেই স্বাভাবিক জীবনযাত্রা ব্যাহত হয়েছে। ব্যক্তিগত ও আর্থিক সুরক্ষা নিশ্চিত করতে বহু দেশ তাদের দৈনন্দিন কার্যক্রম অনলাইনভিত্তিক করেছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বা অফিস- আদালত সব ক্ষেত্রেই বিকল্প হিসেবে প্রযুক্তির সাহায্য নিতে হয়েছে। ডিজিটাল বৈষম্যের আলোচনা এখন তাই ব্যাপকভাবে হচ্ছে। বিশ্বে বহু মানুষ আছেন, যারা প্রযুক্তির নানা সুবিধা থেকে বঞ্চিত। তাদের জন্য অনলাইন ক্লাস, অফিস প্রভৃতি একটি বিভীষিকার নাম ছিলো। ডিজিটাল বৈষম্য একটি বৈশ্বিক সমস্যা। উন্নত বিশ্বের বহু দেশ এ সমস্যায় ভুগছে। আমেরিকা ও ইউরোপেও দেখা যায়, বহু মানুষ প্রযুক্তি সুবিধার ক্ষেত্রে পিছিয়ে আছে। আবার এর সঙ্গে নানা সামাজিক শ্রেণিবিভাজনও যুক্ত হয়ে যায়। অঞ্চল, লিঙ্গ, আর্থসামাজিক অবস্থাও ডিজিটাল বৈষম্যের সঙ্গে জড়িত থাকে।
আমাদের মতো উন্নয়নশীল দেশগুলোর অবস্থা যে আরও খারাপ, তা সহজেই বোঝা যায়। ডিজিটাল প্রযুক্তির চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ইন্টারনেট সাশ্রয়ী ও সহজলভ্য করার পাশাপাশি সবচেয়ে কম মূল্যে স্মার্ট ফোন সাধারণের নাগালে পৌঁছে দেয়ার উদ্যোগ নেয়া হয়েছে বলে জনিয়েছে সরকারি সূত্র। ইতোমধ্যেই ইন্টারনেটের একদেশ একরেট চালু হয়েছে। দেশে উৎপাদিত মোবাইল ফোন ইতোমধ্যেই শতকরা ৯৬ ভাগ চাহিদা মেটানোর সক্ষমতা অর্জন করেছে বলেও দাবি করা হয়েছে।
বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলা গড়ে তোলার জন্য লাগসই ডিজিটাল সংযোগ ও ডিজিটাল ডিভাইস অপরিহার্য। ইন্টারনেট ও স্মার্ট ফোন শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো। ডিজিটাল বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার ধারাবাহিকতায় ইন্টারনেট এখন মানুষের জীবনধারায় অনিবার্য একটি বিষয় হিসেবে জড়িয়ে আছে। পৃথিবীর সবচেয়ে বড় লাইব্রেরি হচ্ছে ইন্টারনেট।
কাউকে এ থেকে বঞ্চিত করা ঠিক নয়। শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল দক্ষতাসম্পন্ন মানবসম্পদ হিসেবে গড়ে তোলার প্রয়োজনীয়তা থেকেই ইতোমধ্যেই প্রাথমিক স্তরে বই ছাড়া ডিজিটাল কনটেন্টের মাধ্যমে লেখাপড়ার ব্যবস্থা হচ্ছে। শিক্ষার্থীদের ডিজিটাল দক্ষতা অর্জনের সুযোগ না দিলে আগামী পৃথিবীতে তারা টিকে থাকার জন্য অযোগ্য হয়ে পড়বে। ইন্টারনেট ব্যবহার বাড়ার পাশাপাশি মানুষ ইন্টারনেটের উচ্চগতিও এখন প্রত্যাশা। ২০০৬ সালে দেশে প্রতি এমবিপিএস ইন্টানেটের দাম ছিল ৭৮ হাজার টাকা, ২০০৮ সালে তা ২৭ হাজার টাকা এবং বর্তমানে তা ৬০ টাকায় নির্ধারিত হয়েছে। সে সময় দেশে মাত্র সাড়ে সাত জিবিপিএস ব্যান্ডউইথ ব্যবহৃত হতো তা বেড়ে বর্তমানে ৩৮ শত জিবিপিএস-এ উন্নীত হয়েছে।
প্রান্তিক জনগোষ্ঠীকে উন্নয়নের মূল ধারায় নিয়ে আসতে ডিজিটাল ইনক্লুশন ফর ভারনারেবল এক্সেপশন উদ্যোগের আওতায় আত্মকর্মসংস্থানভিত্তিক প্রশিক্ষণ কার্যক্রম বাস্তবায়নের দায়িত্বে রয়েছে তথ্যপ্রযুক্তি বিভাগ। এখন এমন কোন ক্ষেত্র নেই যেখানে ইন্টারনেট প্রযুক্তি প্রয়োগের প্রয়োজন হয় না। ইন্টারনেট প্রযুক্তি দেশে নতুন অর্থনীতির সুযোগ সৃষ্টি করেছে। কৃষক-শ্রমিক, প্রবাসী এবং গার্মেন্টেসের কর্মীরাই দেশের অর্থনীতির মূল চালিকাশক্তি হিসেবে কাজ করছেন, তাদের সঙ্গে যুক্ত হয়েছে ৬.৫০ লাখের মতো ফ্রিল্যান্সার আইটি তরুণ তরুণী। ইন্টারনেটকে অনেক দেশ মৌলিক অধিকার হিসেবে মেনে নিয়েছে আমাদের সেদিকে দৃষ্টি দেয়ার।
আমরা অনেকেই নানাভাবে শুনেছিÑকরোনাকালীন সময়ে বহু ছাত্রছাত্রীকে বাড়ি থেকে বহু দূরে গিয়ে অনলাইন ক্লাসে অংশ নিতে হয়েছে; আবার গাছের ওপর উঠেও বহু মানুষকে ক্লাস করতে হয়েছে। এগুলো ডিজিটাল বৈষম্যের কারণে তৈরি হওয়া সমস্যাগুলোর প্রতিফলন মাত্র। ডিজিটাল বৈষম্যের আরও বহু খারাপ দিক হয়তো সামনে আমরা দেখতে পাব। আমরা যদি এখনকার বড় বড় ব্যবসায় মাধ্যমগুলো দেখি, তাহলে দেখা যাবে- সেগুলোর ভালো একটা অংশ অনলাইননির্ভর হয়ে গেছে। গুগল, আমাজন, আলিবাবা, ফেসবুক প্রভৃতির কথা আমরা সবাই জানি। এসব কোম্পানি বিলিয়ন ডলারের ব্যবসা করছে অনলাইনের ওপর নির্ভর করেই।
আমাদের দেশেও অনলাইননির্ভর কেনাকাটা শুরু হয়েছে। প্রযুক্তি ব্যবহার করে বহু মানুষই এই শতকে এগিয়ে যাবে। তবে বহু মানুষ আছে, যারা প্রযুক্তি সুবিধা থেকে বঞ্চিত থাকবে। এতে নানা অর্থনৈতিক ও সামাজিক বৈষম্য আরও বৃদ্ধি পাবে, এতে সন্দেহ নেই।
ডিজিটাল বৈষম্য দূর করার পদক্ষেপ অবশ্যই নিতে হবে। একটি ন্যায়ভিত্তিক সমাজ গড়ে তুলতে হবে। ইন্টারনেট সহজলভ্য করা, প্রযুক্তি সম্পর্কিত অবকাঠামোর উন্নয়ন করা, মানুষকে প্রযুক্তি-সাক্ষর হিসেবে গড়ে তোলার মতো পদক্ষেপগুলো ডিজিটাল বৈষম্য রোধে ভালো ভূমিকা রাখবে। তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহার যেমন দারিদ্র্য বিমোচনের সহায়ক একই সঙ্গে তা সুশাসন, গুণগত শিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা নিশ্চিতের মাধ্যমে সামাজিক ন্যায্যতা তৈরিতে ভূমিকা রাখে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালায় তথ্যপ্রযুক্তির উন্নয়নে অন্যতম কৌশল হিসেবে তথ্যপ্রযুক্তিতে সামাজিক সমতা ও সর্বজনীন প্রবেশাধিকার নিশ্চিত করার কথা বলা হয়েছে; যাতে অনগ্রসর জনগোষ্ঠী, নারী ও প্রতিবন্ধী ব্যক্তি ও বিশেষ সহায়তা প্রয়োজন এমন ব্যক্তিদের তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যম সমাজের মূলস্রোতে নিয়ে আসা।
২০৪১ সালে স্মার্ট বাংলাদেশ
২০৪১ সালে স্মার্ট বাংলাদেশ নির্মাণের লক্ষ্যে কাজ চলছে সেক্ষেত্রে বেশ কিছু সীমাবদ্ধতাও সবার সামনে আসছে। মূলত দরিদ্র ও বঞ্চিত জনগোষ্ঠী, যারা গ্রাম অঞ্চলে বসবাস করে, যাদের প্রয়োজনীয় ডিজিটাল ডিভাইস বা সংযোগ নেই বা সেবা গ্রহণ করার জন্য যাদের প্রয়োজনীয় তথ্য ও দক্ষতা নেই তারা এই সেবা গ্রহণ থেকে বঞ্চিত হয়েছে বা ক্রমাগত পিছিয়ে পড়েছে।
বর্তমানে দেশের ৫৫ শতাংশ গ্রামীণ পরিবারে ইন্টারনেট ব্যবহারের সুবিধা নেই। পাশাপাশি গ্রামীণ পরিবারগুলোর ৫৯ শতাংশের স্মার্টফোন নেই এবং ৪৯ শতাংশের কম্পিউটার ব্যবহারের সুযোগ নেই। তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহারের মাধ্যমে সেবা গ্রহণে যেমন স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, ইন্টারনেট সংযোগ গুরুত্বপূর্ণ একই সঙ্গে সেবাগুলোর সহজীকরণ ও তথ্যপ্রযুক্তিতে দক্ষতাও প্রয়োজনীয়। এ দুই ক্ষেত্রেই দরিদ্র ও নিম্নআয়ের জনগোষ্ঠীর ঘাটতি রয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির প্রবেশগম্যতা নিয়ে একটা ধারণা পাওয়া যায় কিন্তু সম্পূর্ণ ধারণা এখনো পাওয়া যাচ্ছে না। কারণ পরিবারের মধ্যকার যে বিভাজন আছে, যা বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই সামনে উঠে আসে না। যেমন পরিবারের নারী ও পুরুষের মধ্যকার বিভাজন যেমন রয়েছে, তেমনি রয়েছে বয়স ভেদে ভিন্ন ভিন্ন অবস্থান।
বর্তমান সময়ে তথ্য ও প্রযুক্তিতে অংশগ্রহণ যে কোন জনগোষ্ঠীর সক্ষমতা ও ক্ষমতায়নের বহিঃপ্রকাশ। তথ্যপ্রযুক্তি শুধু যোগাযোগের মাধ্যমই না একই সঙ্গে তা নতুন নতুন ক্ষেত্র ও সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে। করোনাকালে এর কিছু প্রয়োগ আমরা দেখতে পেয়েছি, যদিও তা সার্বিকভাবে ও সামগ্রিকভাবে নয়। তথ্যপ্রযুক্তিতে অংশগ্রহণের ক্ষেত্রে অন্যান্য প্রতিবন্ধকতার পাশাপাশি ইন্টারনেট ব্যবহারের ব্যয় দরিদ্র জনগোষ্ঠীর জন্য বোঝা। পাশাপাশি বিভিন্ন ক্ষেত্রে তথ্যপ্রযুক্তির ব্যবহারে সরকারি ও বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের পক্ষ থেকে নানা সুযোগ সৃষ্টি না করাও একটি বড় প্রতিবন্ধকতা।
প্রযুক্তি ক্ষেত্রে অসমতা দেশের জনগণের মধ্যকার বর্তমান অসমতাকে আরও বাড়িয়ে দেয়। এমনিতেই আমাদেও শ্রেণীবিভক্ত সমাজে সরকারি ও বেসরকারি সেবায় সবার সমান সুযোগ না পাওয়া একটি কঠিন বাস্তবতা। সরকার প্রণীত তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি নীতিমালায় ‘সামাজিক সমতা ও সর্বজনীন প্রবেশাধিকার’ অংশে সুনির্দিষ্টভাবে উল্লেখ করা আছে। এখন এই নীতিমালা বাস্তবায়ন করা জরুরি এবং এজন্য সুনির্দিষ্ট উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। সবার আগে তথ্যপ্রযুক্তিকে সব জনগোষ্ঠীর দোরগোড়ায় নিয়ে যেতে হবে। এ জন্য সরকারি উদ্যোগে তথ্যপ্রযুক্তিতে প্রয়োজনীয় অবকাঠামো তৈরি করতে হবে, বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোকে উদ্যোগী করে তুলতে হবে।
পাশাপাশি কম খরচে বিশেষত দরিদ্র জনগোষ্ঠী ও নারীরা যাতে তথ্যপ্রযুক্তি ব্যবহার করতে পারে তার উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে।
সরকারি পরিষেবা যেখানে খাবি খাচ্ছে সেখানে বেসরকারি কুরিয়ার সার্ভিস দাপটের সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে এবং সেবা মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে দিয়ে সর্বস্তরের গ্রাহকদের মন জয় করেছে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে বিশ্বের ডাকসেবার মান যেখানে উন্নত হয়েছে সেখানে আমরা পিছিয়েছি। আগে যে সংখ্যক লোক ডাক বিভাগের সেবা গ্রহণ করত এবং এখন যে পরিমাণ লোক করে তার পার্থক্য খতিয়ে দেখলেই বিষয়টি স্পষ্ট হবে।
ডাক বিভাগের আস্থা, পৌঁছানো, প্রাসঙ্গিকতা ও সহনশীলতা এ চার সূচকের ওপর ভিত্তি করে সারা বিশ্বেও দেশগুলোর ডাক বিভাগের স্কোর ও ধাপ নির্ণয় করে জাতিসংঘের বিশেষায়িত সংস্থা ইউনিভার্সাল পোস্টাল ইউনিয়ন (ইউপিইউ)। ইউপিইউর প্রকাশিত সমন্বিত ডাক উন্নয়ন সূচক র্যাংকিংয়ের তথ্য অনুযায়ী, ২০২২ সালে ১৭২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ছিল ১৩৩তম। আর স্কোর ছিল ১৩.৯০। ২০২৩ সালে ১৭২টি দেশের মধ্যে বাংলাদেশের অবস্থান ১১৯তম। স্কোর ১৮.৩০। উন্নয়ন সূচকের র্যাংকিং অনুযায়ী অনেক দেশের পেছনে পড়েছে বাংলাদেশের ডাক বিভাগ।
প্রান্তিক ডাকঘরগুলো পরিদর্শন করলে হতাশার চিত্রই ভেসে উঠবে। সারা দেশে অনেক পোস্ট ই-সেন্টারের অবকাঠামো অযত্ন-অবহেলায় পড়ে আছে। অপ্রতুল যেমন আসবাবপত্র, তেমনি প্রয়োজনীয় ডিজিটাল সরঞ্জামেও রয়েছে সংকট। যে কারণে কেন্দ্রগুলো বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। প্রযুক্তিসংশ্লিষ্টরা বলছেন, প্রকল্পটি বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে বড় বাধা প্রচার-প্রচারণার অভাব। এ বিষয়ে সাধারণ মানুষের একটি উল্লেখযোগ্য অংশ এখনো কিছুই জানে না।
বিভিন্ন দৈনিকের প্রতিবেদনে উঠে এসেছে, ময়মনসিংহ বিভাগে ৩৯৬টি পোস্ট অফিসে পোস্ট ই-সেন্টারের কার্যক্রম শুরু হলেও এখন প্রায় ২০০ কেন্দ্র বন্ধ হয়ে গেছে। এমনকি এ জেলার অধিকাংশ ই-সেন্টারও বন্ধ রয়েছে বলে জানা গেছে।
পোস্ট ই-সেন্টার প্রকল্প বাস্তবায়নে কার্যকর অগ্রগতি না হওয়ার পেছনে পরিকল্পনার অভাব ও অব্যবস্থাপনার মতো বিষয়গুলোও উঠে এসেছে। এটি বাস্তবায়নকালে প্রয়োজনীয় সরঞ্জাম হিসেবে ল্যাপটপের সঙ্গে বিল্ট ইন ক্যামেরা সংযুক্ত থাকলেও কেনা হয় অতিরিক্ত ৮ হাজার ৫০০ ওয়েব ক্যামেরা। সেন্টারগুলোর জন্যও কেনা হয় বাড়তি ৮ হাজার ৫০০ প্রিন্টার। প্রয়োজন না থাকলেও ৫০০টি অতিরিক্ত হার্ড ডিস্ক কেনা হয়। এসব যন্ত্রপাতি কিনতে খরচ হয় ৭ কোটি ৮১ লাখ ৫০ হাজার টাকা। বাংলাদেশ মহাহিসাব নিরীক্ষক ও নিয়ন্ত্রকের (সিএজি) এক অডিট প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়, পোস্ট ই-সেন্টার প্রকল্প বাস্তবায়নে যেসব পণ্য কেনা হয়েছে, এর প্রয়োজনীয়তা ছিল না।
গারা দেশে ৯০০ পোস্ট ই-সেন্টারে নিরীক্ষা কার্যক্রম পরিচালনা করে সিএজি। অডিটকালে দেখা যায়, এসব সেন্টারের ২০ শতাংশ যন্ত্রপাতি অব্যবহৃত অবস্থায় পড়ে আছে। সেন্টারগুলোর ৭০ শতাংশ আসবাবপত্রের কোনো অস্তিত্বই পায়নি সিএজি। ওই প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, পোস্টাল সেভিংস ব্যাংক ও পোস্টাল লাইফ ইন্স্যুরেন্স কার্যক্রম প্রসারিত করা, পল্লী জনগোষ্ঠীর মধ্যে ইন্টারনেটের মাধ্যমে মোবাইল ব্যাংকিং জনপ্রিয় করা, ভাতা বিতরণ, তথ্যপ্রযুক্তিভিত্তিক উদ্যোক্তা তৈরি, পল্লী জনগোষ্ঠীর মধ্যে রেমিট্যান্স সেবা প্রসার, শিক্ষার্থীদের কম্পিউটার প্রশিক্ষণ দেয়ায় ব্যর্থ হয়েছে সেন্টারগুলো। সেন্টার স্থাপনের পর প্রকল্পের উদ্দেশ্য অর্জন যাচাই করতে মনিটরিংও করেনি ডাক বিভাগ।
চট্টগ্রামের পোস্ট ই-সেন্টারের একাধিক উদ্যোক্তা জানান, ব্যাপক প্রচার-প্রচারণা না থাকায় এখনো শতভাগ মানুষের কাছে পোস্ট ই-সেন্টারের তথ্য পৌঁছেনি। সেজন্য সরকারের এ প্রকল্পের বাস্তবায়ন হয়নি। ইকুইপমেন্টসের স্বল্পতা, স্থায়ী অফিস না থাকায় মানুষের কাছে সেবা নিয়ে যাওয়ার ক্ষেত্রে বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছে বলেও জানান এসব উদ্যোক্তা।
যুগের পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মানুষের প্রয়োজনেও পরিবর্তন এসেছে। এখন হয়তো মোবাইল ফোন কিংবা কম্পিউটারে পত্র যোগাযোগের কাজ সারা হচ্ছে কিন্তু জরুরি নথি, বিভিন্ন পণ্য ও পার্সেল পরিবহনের চাহিদা বাড়ছে। এ পরিষেবায় দেশে বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা ও প্রতিযোগিতা দু’টোই বেড়েছে। বিশেষ করে ই-কমার্সের রমরমা অবস্থার কারণে পার্সেল ও ডেলিভারি এখন প্রয়োজনীয় সেবা হয়ে দাঁড়িয়েছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো এসব সেবার ক্ষেত্রে প্রেরকের কাছ থেকে চিঠি বা পার্সেল সংগ্রহ করে প্রাপকের গন্তব্যে পৌঁছে দেয়। কারণ শহুরে জীবনে ট্রাফিক ঠেলে কেউই কোনো প্রতিষ্ঠানে গিয়ে পণ্য পাঠাতে এখন স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করে না। কিন্তু ডাক বিভাগের সে নীতি নেই। কেউ কিছু পাঠাতে চাইলে তাকে ডাকঘওে যেতে হবে। এ বিষয়ে ডাক বিভাগের কর্তারা বলেন, ডাক বিভাগের নীতি অনেক পুরনো। চাইলেই একদিনে কোনো কিছু পরিবর্তন সম্ভব নয়।
এখনো ডাক বিভাগ গ্রাহকের কাছে অনেক সেবা নিয়ে যেতে পারে। এজন্য ডাক বিভাগকে পুরোপুরি ঢেলে সাজাতে হবে এবং যুগের সঙ্গে তাল মিলিয়ে অগ্রাধিকারের ভিত্তিতে পরিষেবা নির্ধারণ করতে হবে। কাগজে-কলমে সেবা রাখাতেই দায়িত্ব সেরে ফেলার প্রয়াস থেকে বেরিয়ে আসতে হবে। বেসরকারি খাতের ব্যবস্থাপনার দিকে নজর দিলেই গ্রাহক চাহিদা ও সেবার পরিসর নিয়ে নীতিনির্ধারকরা ধারণা পেতে পারেন। যুগের প্রয়োজনে বাংলাদেশ ডাক বিভাগের জন্য সেবায় বৈচিত্র্য আনা ও নতুন নতুন সেবা চালু করা জরুরি।
অনলাইন কেনাকাটায় প্রতারণা এবং সতর্কতা
ক্রেতা ও বিক্রেতাদের সুযোগ-সুবিধা বৃদ্ধির জন্য বাজার ব্যবস্থায় যোগ হয় সুপার শপ, শপিং মল, সুপার মার্কেট, মেগা মল। বাজারে গিয়ে সরাসরি পণ্য ক্রয়ের পাশাপাশি মানুষজন বর্তমানে অনলাইনে অর্ডার করে ঘরে বসেই পণ্য পেয়ে যাচ্ছে। সরাসরি পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে ক্রেতারা বিভিন্ন পণ্য যাচাই-বাছাই করে কাক্সিক্ষত পণ্য ক্রয় করতে পারে। কিন্তু অনলাইনে পণ্য ক্রয়ের ক্ষেত্রে বিক্রেতার অনলাইনে দেওয়া তথ্যের ভিত্তিতে পণ্য অর্ডার করতে হয়। সরাসরি পণ্য যাচাই-বাছাই করার সুযোগ না থাকায় কিছু সুযোগসন্ধানী ব্যক্তি কাক্সিক্ষত পণ্য সরবরাহ না করে অর্থ আত্মসাৎ বা নিম্নমানের পণ্য সরবরাহসহ বিভিন্ন ধরনের প্রতারণার আশ্রয় নিচ্ছে। তাই অনলাইন কেনাকাটায় ঝুঁকিও বৃদ্ধি পাচ্ছে।
অনলাইন কেনাকাটায় জনপ্রিয়তার কারণ অনলাইনে ঘরে বসে কয়েক ক্লিকে সহজেই পণ্য ক্রয় করা যায়, বাইরে যাওয়া লাগে না; পণ্য বহন বা দরদামও করতে হয় না। অনলাইন মার্কেটপ্লেসে বিক্রেতার দেওয়া পণ্য সম্পর্কিত তথ্যাদি ও কাস্টমার রিভিউ দেখে পণ্যের গুণাগুণ ও মূল্য নিয়ে সহজেই ধারণা পাওয়া যায়। মোবাইল ব্যাংকিং, ক্রেডিট কার্ড, ডেবিট কার্ড বা ক্যাশ অন ডেলিভারির মাধ্যমে পণ্যের দাম পরিশোধ করা যায়; মার্কেটপ্লেসগুলোতে থাকে বিভিন্ন ধরনের অফার বা ডিসকাউন্ট। কোনো দোকান বা শোরুমের প্রয়োজন না থাকায় দেশের যেকোনো প্রান্ত থেকে পণ্য ক্রয় বা বিক্রয় করা যায়। পরিসংখ্যান অনুসারে, দেশে ই-ক্যাব নিবন্ধনকৃত ই-কমার্স প্রতিষ্ঠান রয়েছে প্রায় ২ হাজার; ফেসবুকসহ বিভিন্ন সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ব্যক্তিগত উদ্যোগে পরিচালিত ৫০ হাজারের অধিক পেজ বা প্রতিষ্ঠান রয়েছে।
কেনাকাটায় মানুষ কীভাবে প্রতারিত হয়?
দেশে অনলাইন কেনাকাটার বিস্তৃৃতির সঙ্গে সঙ্গে প্রতারণার পরিমাণও বৃদ্ধি পাচ্ছে। অনেক সময় দেখা যায়, বিভিন্ন অনলাইন মার্কেটপ্লেস বা শপে পোশাক, ইলেকট্রনিকস পণ্য, খাদ্যদ্রব্যসহ বিভিন্ন ভালোমানের পণ্যের ছবি ও বর্ণনা দিয়ে ছেঁড়া, নষ্ট, পচা বা নিম্নমানের পণ্য সরবরাহের কারণে ক্রেতারা প্রতারিত হচ্ছে। ভুয়া কাস্টমার রিভিউর কারণে গ্রাহকদের সহজেই প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা থাকে। অনেক সময় কাক্সিক্ষত সময়ের চেয়ে গ্রাহকের কাছে বিলম্বে পণ্য সরবরাহ করা হয়। মাঝে মাঝে পেমেন্টের পর কাক্সিক্ষত পণ্য ডেলিভারি না দিয়ে গ্রাহকের নম্বর বা আইডি ব্লক করে দিয়ে অর্থ আত্মসাতের অভিযোগও পাওয়া যায়। অনেক প্রতিষ্ঠানের নিজস্ব কার্যালয়, শোরুম বা কাস্টমার সার্ভিস না থাকায় ক্রেতারা কেনাকাটার পরবর্তী সময় বিক্রয়োত্তর সেবা থেকে বঞ্চিত হচ্ছে। কিছু প্রতিষ্ঠানকে বিশাল ছাড়, ক্যাশব্যাক ও বিভিন্ন ধরনের অফার দিয়ে গ্রাহকদের প্রলুব্ধ করে প্রতারণা করতে দেখা যায়। অনেক ক্ষেত্রে কিছু প্রতিষ্ঠান প্রাথমিকভাবে নির্দিষ্ট সংখ্যক ক্রেতার কাছে পণ্য সরবরাহ করে বিশ^াসযোগ্যতা অর্জনের পর বিপুল সংখ্যক ক্রেতার অর্থ হাতিয়ে প্রতিষ্ঠান বন্ধ করে দেওয়ার নজিরও রয়েছে। এমন অভিযোগের ভিত্তিতে ই-অরেঞ্জ, ধামাকা ও ইভ্যালিসহ বেশ কয়েকটি প্রতিষ্ঠানকে ইতোমধ্যেই আইনের আওতায় নিয়ে আসা হয়েছে। এ ছাড়াও বিভিন্ন অপ্রতিষ্ঠিত সাইট বা শপ র্কর্তৃক গ্রাহকের ব্যাংকিং তথ্যসহ ব্যক্তিগত তথ্য চুরি বা বিভিন্ন ফিশিং লিঙ্কের মাধ্যমে তাদের আইডি ও প্রয়োজনীয় তথ্যাদিও হ্যাক করা হচ্ছে।
প্রতারিত হলে প্রতিকার লাভের উপায়
অনলাইন কেনাকাটায় প্রতারিত হওয়ার পর আইনগত প্রতিকার প্রাপ্তি সম্পর্কিত অজ্ঞতা বা বাড়তি সময় ব্যয় এড়াতে অনেকেই কোনো অভিযোগ দায়ের করেন না। অভিযোগ না করার ফলে প্রতারকরা ধরাছোঁয়ার বাইরে থেকে বারবার প্রতারণা করে যাচ্ছে। কেনাকাটার সময় বিক্রয়কারী প্রতিষ্ঠানের ঠিকানা, মোবাইল নম্বর, ওয়েবসাইট বা পেজের ইউআরএল সংরক্ষণ করতে হবে; শপ বা পেজের স্ক্রিনশট, অর্থ পরিশোধ ও অর্ডার কনফার্মসংক্রান্ত স্ক্রিনশট, চ্যাটিংয়ের স্ক্রিনশট সংরক্ষণ করতে হবে। প্রতারণা বুঝতে পারার সঙ্গে সঙ্গে সংশ্লিষ্ট প্রমাণাদিসহ দ্রুত নিকটস্থ থানায় জিডি বা অভিযোগ করতে হবে। পাশাপাশি, জিডি বা অভিযোগের কপি নিয়ে ভুক্তভোগী আইনশৃঙ্খলা বাহিনীগুলোর সাইবার সেলেরও সহায়তা নিতে পারেন। অপরাধীকে শনাক্ত করা গেলে পরবর্তী সময় ভুক্তভোগীরা প্রতারকদের বিরুদ্ধে মামলা করার মাধ্যমে তাদের শাস্তি নিশ্চিত করতে পারবেন। এ ছাড়াও ভুক্তভোগী ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরে অভিযোগ বা আদালতে প্রতারণার মামলা দায়ের করতে পারেন।
প্রচলিত আইনে শাস্তি
ডিজিটাল কমার্স পরিচালনা নির্দেশিকা-২০২১-এ অনলাইন কেনাকাটায় কোনটি ভোক্তার অধিকার আর কোনটি প্রতারণা সে বিষয়ে বিস্তারিত রয়েছে। এ ছাড়াও গ্রাহককে পণ্য ডেলিভারি দেওয়ার সময়সীমা, অগ্রিম মূল্য পরিশোধ, মার্কেটপ্লেসে পণ্য বা সেবা উপস্থাপন সংক্রান্ত নির্দেশনা দেওয়া আছে। অভিযোগ প্রমাণিত হলে ওই আইনে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে। প্রতারিত ব্যক্তি ‘দ্য সেলস অব গুডস অ্যাক্ট-১৯৩০’ অনুযায়ী নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট বরাবর অভিযোগ দায়ের করতে পারেন। ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ আইন-২০০৯ অনুযায়ী, ভোক্তাকে প্রতিশ্রুতি পণ্য সরবরাহ না করলে বা প্রতারণার আশ্রয় নিলে অভিযুক্ত ব্যক্তিকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড ও অর্থদণ্ডে দণ্ডিত করার বিধান রয়েছে।
যেসব সতর্কতা অবলম্বন প্রয়োজন
অনলাইনে যেকোনো ধরনের কেনাকাটার ক্ষেত্রে তাড়াহুড়া করে পণ্য ক্রয় না করে যাচাই-বাছাই করে পণ্য ক্রয় করতে হবে। এক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠিত বা জনপ্রিয় মার্কেটপ্লেস বা পেজ থেকে পণ্য কেনার চেষ্টা করতে হবে। প্রতিষ্ঠানটির স্থায়ী অফিস আছে কিনা, বিক্রেতার আইডি সঠিক কিনা, ওয়েবসাইটের অথেনটিসিটি নিশ্চিতকরণে এসএসএল সিকিউর সকেট লেয়ার সার্টিফাইড কিনা তা যাচাই করতে হবে। প্রতিষ্ঠানের মালিকানা, পরিচিতি, যোগাযোগের নম্বর সংরক্ষণ এবং গ্রাহকদের রিভিউ দেখতে হবে; রিভিউগুলো ভুয়া কিনা তাও যাচাই করতে হবে। অল্প দাম, বিশাল ছাড়, ক্যাশব্যাক বা অন্য কোনো চটকদার বিজ্ঞাপন দেখে প্রলুব্ধ হওয়া যাবে না। পণ্যের বর্ণনা, ছবি, ভিডিও দেখার পাশাপাশি অন্যান্য মার্কেটপ্লেসে পণ্যটির দাম ও গুণাগুণ যাচাই করুন। ডেলিভারি টাইম, ত্রুটিপূর্ণ পণ্য ফেরত পাঠানোর প্রক্রিয়া, রিফান্ড পলিসি ও বিক্রয়োত্তর সেবা সম্পর্কিত তথ্যাদি জানতে হবে। প্রতিষ্ঠানটির চ্যাটবক্সে গিয়ে চ্যাটিং করে পণ্য সম্পর্কিত বিস্তারিত তথ্যাদি নিশ্চিত করতে হবে। ব্যক্তিগত বা সংবেদনশীল কোনো তথ্য শেয়ার না করে ক্যাশ-অন ডেলিভারিতে পণ্য ক্রয় করলে অনলাইন কেনাকাটায় প্রতারিত হওয়ার ঝুঁকি কমে যায়। প্রতারিত হলে সংশ্লিষ্ট দপ্তরে দ্রুত অভিযোগ দায়ের করতে হবে। লোভনীয় অফার সম্পর্কিত পপ-আপ বা ই-মেইলে প্রাপ্ত ফিশিং লিঙ্কে ক্লিক করা কিংবা পাবলিক ওয়াইফাই ব্যবহার করে অনলাইনে কেনাকাটা না করাই উত্তম। অনলাইনে কেনাকাটার আগে আপনি যত সতর্ক ও সচেতন থাকবেন এবং যত বেশি যাচাই-বাছাই করবেন, ততই কমবে প্রতারিত হওয়ার সম্ভাবনা। সবার সতর্কতা ও সচেতনতার মাধ্যমেই অনলাইন কেনাকাটায় গ্রাহকদের প্রাপ্র্য সেবা নিশ্চিত ও প্রতারণা নিয়ন্ত্রণ করে নিরাপদ এবং সমৃদ্ধ অনলাইন মার্কেটপ্লেস প্রতিষ্ঠা করা সম্ভব।
আমরা হব স্মার্ট বাংলাদেশের গর্বিত নাগরিক
দেশের আর্থসামাজিক ও সাংস্কৃতিক উন্নয়ন ঘটাতে হলে এখন প্রযুক্তি ব্যবহারের বিকল্প নেই। দেশকে আমরা ডিজিটাল করেছি। এবার লক্ষ্য নিয়েছি স্মার্ট নাগরিক ও স্মার্ট সরকারব্যবস্থা গড়ে তোলার, যা আমাদের স্মার্ট বাংলাদেশের স্বপ্নকে বাস্তবে রূপ দেবে। সেই লক্ষ্যেই আমরা কাজ করে যাচ্ছি। বাংলাদেশ অনেক কম সময়ের মধ্যে প্রযুক্তিকে ইতিবাচকভাবে দেখতে এবং প্রযুক্তিকে নিজের প্রয়োজনে কাজে লাগাতে শিখেছে। আমরা জানি, প্রযুক্তির সম্ভাবনা কতটা বিশাল। তাই ২০৪১ সালের কথা যদি বলি, তাহলে দেখব, আমরা এমন একটা সময়ে পৌঁছেছি, যেখানে বাংলাদেশের প্রতিটি নাগরিক প্রযুক্তিতে অভ্যস্ত ও দক্ষ। ওই সময়ে দেশের প্রতিটি নাগরিক প্রযুক্তির সর্বোচ্চ সুবিধা আদায় করে নিতে শিখবে। দেশের প্রতিটি ব্যক্তির জন্য খাদ্য, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা, আবাসনসহ সব খাতের সর্বোচ্চ মানের সেবা নিশ্চিত হবে। সেটি হবে এমন একটি সময় যখন দেশের প্রতিটি নাগরিক হবে স্মার্ট এবং তারা প্রত্যেকেই হবে স্মার্ট সরকারব্যবস্থার সক্রিয় অংশ। এভাবেই আমরা ২০৪১ সালে একটি শতভাগ ডিজিটাল ও স্মার্ট বাংলাদেশের গর্বিত নাগরিক হব।
স্মার্ট বাংলাদেশ গড়তে যে চারটি মূল ভিত্তি নির্ধারণ করা হয়েছে। সেগুলো হলো : স্মার্ট সিটিজেন, স্মার্ট সোসাইটি, স্মার্ট ইকোনমি ও স্মার্ট গভর্নমেন্ট। চারটি ক্ষেত্রেই তথ্যপ্রযুক্তি কীভাবে, কতটা অঙ্গাঙ্গীভাবে জড়িয়ে থাকবে? প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে অনেক আগেই আমরা ‘ডিজিটাল বাংলাদেশ’ গড়ার স্বপ্ন দেখেছিলাম। এ স্বপ্নের অনেকটাই আজ বাস্তবে রূপ নিয়েছে। স্বাস্থ্য, শিক্ষা, কৃষি বা অন্য সব ক্ষেত্রেই আমরা প্রযুক্তির ব্যবহারকে নিশ্চিত করেছি। প্রযুক্তি ব্যবহারের ফলে এসব ক্ষেত্রে ইতিবাচক পরিবর্তন আসতে শুরু করেছে। সব স্তরের মানুষ এখন সহজেই সরকারি-বেসরকারি নানা সেবা খুব সহজেই নিতে পারছে। প্রযুক্তির সঠিক ব্যবহার না জানলে দেশের জনগণ এসব সেবা পাওয়ার সুযোগ হারাবে। তাই এখন আমাদের লক্ষ্য হলো দেশের প্রতিটি নাগরিককে ‘স্মার্ট সিটিজেন’ হিসেবে গড়ে তোলা যেন তারা প্রযুক্তির এসব সুবিধা সঠিকভাবে কাজে লাগিয়ে জীবনমান উন্নত করতে পারে। নতুন নতুন প্রযুক্তি ও নানা ধরনের উদ্ভাবনকে কাজে লাগিয়ে আমরা নাগরিকদের প্রাপ্য সুযোগ-সুবিধাগুলোকে আরও উন্নত ও সহজলভ্য করতে চাই। ডিজিটাল বাংলাদেশে আমাদের অর্থনীতির চেহারাও বদলে গেছে; খুব সহজেই একজন ব্যক্তি এখন মোবাইল ব্যাংকিংসহ নানা ধরনের সেবা নিতে পারছে। ভূমি অফিস ডিজিটাল হয়ে গেছে। সরকারি-বেসরকারি অনেক কাজই এখন ইন্টারনেট বা হাতের স্মার্টফোনের মাধ্যমে সেরে ফেলা যাচ্ছে। এভাবে নাগরিক পর্যায় থেকে সরকারের সব স্তরে প্রযুক্তির সমন্বয় ঘটিয়ে আমরা স্মার্ট নাগরিক গড়ব, স্মার্ট বাংলাদেশ গড়ে তুলব। স্মার্ট সিটিজেন হবেন বুদ্ধিদীপ্ত ও দক্ষ, উদ্ভাবনী ও সৃজনশীল এবং প্রগতিশীল ও অসাম্প্রদায়িক চেতনায় জাগ্রত দেশপ্রেমিক। তারা হবেন সমস্যা সমাধানে উদ্ভাবনী মানসিকতাসম্পন্ন নাগরিক। স্মার্ট নাগরিক পেতে হলে প্রত্যেক নাগরিকের প্রযুক্তিতে অভিযোজন ও অভিগম্যতা নিশ্চিত করতে হবে, যা আমরা করে দেখাব।
প্রধানমন্ত্রীর তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিবিষয়ক উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয় চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় অণুপ্রক্রিয়াজাতকারক (মাইক্রোপ্রসেসর) নকশা, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স), রোবটিকস ও সাইবার নিরাপত্তা- এই চারটি প্রযুক্তির বিকাশ ও সক্ষমতা বাড়ানোর জন্য কাজ শুরু করছেন। স্মার্ট নাগরিক এসব প্রযুক্তি ব্যবহারে সুদক্ষ হবেন, তারাই গড়ে তুলবেন স্মার্ট বাংলাদেশ। বিজ্ঞান, কারিগরি ও আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভর বাংলাদেশের ভিত রচিত হয়েছিলো জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের হাত ধরে। ডিজিটাল বিপ্লবের শুরু ১৯৬৯ সালে। ইন্টারনেট উদ্ভাবনের মাধ্যমে। ইন্টারনেটের সঙ্গে যন্ত্রের যুক্ততা মানুষের দৈনন্দিন জীবন, সংস্কৃতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, উৎপাদন- সব কিছুতেই প্রভাব ফেলতে শুরু করে। বিজ্ঞান, কারিগরি ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতির ফলে বিশ্বে উন্নয়ন দারুণ গতি পায়। এর গুরুত্ব গভীরভাবে উপলব্ধি করতে পেরেছিলেন বঙ্গবন্ধু। কারণ তিনি গড়তে চেয়েছিলেন সোনার বাংলা। তার এ স্বপ্নের বাস্তবায়ন তিনি ছিলেন দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বঙ্গবন্ধু রাষ্ট্র পরিচালনার জন্য সময় পান মাত্র সাড়ে তিন বছর। এ সময় প্রজ্ঞাবান ও বিচক্ষণ রাষ্ট্রনায়ক বঙ্গবন্ধু তার স্বপ্নের সোনার বাংলা বিনির্মাণে কৃষি, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তিসহ এমন কোনো খাত নেই, যেখানে পরিকল্পিত উদ্যোগ ও কার্যক্রমের বাস্তবায়ন করেননি।
বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশ ১৯৭৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘের ১৫টি সংস্থার মধ্যে গুরুত্বত্বপূর্ণ ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের (আইটিইউ) সদস্যপদ লাভ করে। আর্থসামাজিক জরিপ, আবহাওয়ার তথ্য আদান-প্রদানে আর্থ-রিসোর্স টেকনোলজি স্যাটেলাইট প্রোগ্রামে বাস্তবায়িত হয় তারই নির্দেশে। ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন বঙ্গবন্ধু বেতবুনিয়ায় স্যাটেলাইটের আর্থ স্টেশনের উদ্বোধন করেন। বিজ্ঞান, প্রযুক্তিবিদ্যা ও কারিগরি শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে ড. মুহাম্মদ কুদরাত-এ-খুদার মতো বিজ্ঞানীর নেতৃত্বে শিক্ষা কমিশন রিপোর্ট প্রণয়ন এবং শিক্ষায় প্রযুক্তির ব্যবহার করার লক্ষ্য বাংলাদেশের প্রথম পঞ্চবার্ষিক পরিকল্পনায় অন্তর্ভুক্ত করা ছিল তার অত্যন্ত সুচিন্তিত ও দূরদর্শী উদ্যোগ।
শুধু তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সম্প্রসারণ ও বিকাশে গৃহীত নানা উদ্যোগ ও কার্যক্রমের দিকে তাকালে দেখা যাবে, বঙ্গবন্ধুর হাত ধরেই রচিত হয় একটি আধুনিক বিজ্ঞানমনস্ক প্রযুক্তিনির্ভর বাংলাদেশের ভিত্তি। সে পথ ধরেই ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নদ্রষ্টা মাননীয় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ডিজিটাল বাংলাদেশ বিনির্মাণ করে বাংলাদেশকে এক অনন্য উচ্চতায় নিয়ে গেছেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আইসিটি উপদেষ্টা সজীব ওয়াজেদ জয়ের তত্ত্ববাবধান ও নির্দেশনায় ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়ন সবার জন্য কানেকটিভিটি, দক্ষ মানবসম্পদ উন্নয়ন, ই-গভর্নমেন্ট এবং আইসিটি ইন্ডাস্ট্রি প্রমোশন- এ চারটি সুনির্দিষ্ট প্রধান স্তম্ভ¢ নির্ধারণ করে ডিজিটাল বাংলাদেশের বাস্তবায়ন হয়েছে।
এ রূপকল্প বাস্তবায়নের মাধ্যমে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির প্রসারে বাংলাদেশ বিপ্লব সাধন করেছে। যে গতিতে বিশ্বে প্রযুক্তির বিকাশ ঘটেছে, তা সত্যিই অভাবনীয়। অদম্যগতিতে আমরা চলছি তথ্যপ্রযুক্তির এক মহাসড়ক ধরে। আমাদের সাফল্য গাঁথা রয়েছে এই খাতে, যা সত্যিই গৌরব ও আনন্দের। ডিজিটাল দেশ হিসেবে সারা বিশ্বের বুকে আত্মপ্রকাশ করেছে বাংলাদেশ।
ডিজিটাল সংযোগ স্মার্ট বাংলাদেশের মূল ভিত্তি হিসেবে কাজ করবে। কেননা ডিজিটাল সংযোগই হবে পরবর্তী উন্নয়নের মহাসড়ক। ডিজিটালাইজেশনে বাংলাদেশে বিপ্লব ঘটে গেছে। বাংলাদেশ এখন ডিজিটাল দেশ। কিন্তু ২০০৯ সালের আগে বাংলাদেশে এমনকি সরকারি কোনো সেবাই ডিজিটাল পদ্ধতিতে ছিল না। বর্তমানে ওয়েবসাইটে সরকারি সব দপ্তরের প্রাথমিক সব তথ্য ও সেবা মিলছে। সেই সঙ্গে সরকারি সব তথ্য যাচাই-বাছাই ও সংরক্ষণ এবং বিভিন্ন পরিসেবা ও আবেদনের যাবতীয় কার্যক্রম অনলাইনে পরিচালিত হচ্ছে। ব্যাংকিং সেবা পৌঁছে গেছে প্রত্যেক গ্রাহকের হাতের মুঠোয়। ডিজিটাইজেশনের মাধ্যমে অনেক কর্মসংস্থানের সৃষ্টি হচ্ছে। ফ্রিল্যান্সিং থেকে আসা অর্থ আমাদের জাতীয় প্রবৃদ্ধিকে ত্বরান্বিত করছে। এসব কিছুই হচ্ছে ডিজিটাল বাংলাদেশের সুফল।
রাজধানীর যানজট নিরসন, সড়কে শৃঙ্খলা ও নিরাপত্তার প্রতিবিধান, নিরাপদ, ঝুঁকিমুক্ত, আরামদায়ক গণপরিবহন, বহুমাধ্যমভিত্তিক সুসমন্বিত যোগাযোগব্যবস্থা গড়ে তোলার পদক্ষেপ নেয় বর্তমান সরকার। ঢাকার যানজট নিরসনে আওয়ামী লীগের নির্বাচনী ইশতেহারেও বিষয়টি বেশ গুরুত্ব পায়। এরই আলোকে মেট্রো রেল এখন দৃশ্যমান। বিআরটি ও এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়েসহ নানা পদক্ষেপ বাস্তবায়িত হচ্ছে। যার নির্মাণ সম্পন্ন হলে যাত্রাপথে আর ভোগান্তিতে পড়তে হবে না মানুষকে।
বঙ্গবন্ধুর সোনার বাংলার আধুনিক রূপই ডিজিটাল বাংলাদেশ এবং তা ভবিষ্যতে হবে স্মার্ট বাংলাদেশ। প্রথমে এ সম্পর্কে মানুষের ধারণা অস্পষ্ট থাকলেও বর্তমানে মানুষের আর্থ-সামাজিক ও ব্যক্তিগত জীবনে এক অবিচ্ছেদ্য অংশ হয়ে উঠেছে। বাংলাদেশের অর্থনীতির মূল ভিত্তি ছিল কৃষি। সরকার গঠনের পর বঙ্গবন্ধু প্রযুক্তির উন্নয়নকে সামনে নিয়ে আসেন। তিনি ১৯৭২ সালে শিক্ষাব্যবস্থায় কারিগরি শিক্ষাকে অন্তর্ভুক্ত করেন। তাঁর সময়ে ১৯৭৩ সালের ৫ সেপ্টেম্বর ইন্টারন্যাশনাল টেলিকমিউনিকেশন ইউনিয়নের (আইটিইউ) সদস্য পদ লাভ করে বাংলাদেশ। ১৯৭৪ সালের ২৫ সেপ্টেম্বর জাতিসংঘে এক ভাষণে বঙ্গবন্ধু প্রযুক্তিবিদ্যার মাধ্যমে মানুষের দুঃখ-দুর্দশা লাঘব ও উন্নয়নের কথা উল্লেখ করেন। ১৯৭৫ সালের ১৪ জুন বেতবুনিয়ায় দেশের প্রথম ভূ-উপগ্রহ কেন্দ্রের উদ্বোধন করেন তিনি।
এখন বিশ্বের সপ্তম বৃহত্তম ডাটা সেন্টার বাংলাদেশে। শুধু তথ্যের সুরক্ষাই নয়, বছরে সাশ্রয় হচ্ছে ৩৫৩ কোটি টাকা। গাজীপুরের কালিয়াকৈরে জাতীয় ডাটা সেন্টার। শুধু দেশীয় তথ্যের সুরক্ষা নয়, আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানগুলোও এখন এই তথ্যভাণ্ডার ব্যবহারে আগ্রহ দেখাচ্ছে।
বাংলাদেশের এই অর্জন এক দিনে আসেনি। স্বাধীনতার ৫০ বছরে উপলব্ধি এবং দেশকে এগিয়ে নেওয়ার প্রত্যয় নিয়ে কাজ করতে হবে। ওয়াল স্ট্রিট জার্নালের এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, গত এক ১৫ বছরে রপ্তানি ব্যাপকভাবে বৃদ্ধি পাওয়ায় দক্ষিণ এশিয়ার একটি অর্থনৈতিক শক্তিতে পরিণত হয়েছে বাংলাদেশ। স্বাধীন বাংলাদেশে বিজ্ঞান, কারিগরি ও আধুনিক প্রযুক্তিনির্ভরতা শুরু হয়। ইন্টারনেটের সঙ্গে ডিভাইসের যুক্ততা মানুষের দৈনন্দিন জীবন, সংস্কৃতি, ব্যবসা-বাণিজ্য, উৎপাদনে প্রভাব ফেলতে শুরু করে।
বিজ্ঞান, কারিগরি ও প্রযুক্তিগত অগ্রগতির ফলে বিশ্বে উন্নয়ন দারুণ গতি পায়। ১৯৯৬ সালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা প্রথমবারের মতো দেশ পরিচালনায় এসে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির সম্প্রসারণ ও বিকাশে গুরুত্ব দেন।
২০১৫ সালে কম্পিউটার আমদানিতে শুল্ক হ্রাস, হার্ডওয়্যার, সফটওয়্যার শিল্প উৎ্পাদনকারীদের ভর্তুকি, প্রণোদনা প্রদানসহ বিভিন্ন কার্যকরী পদক্ষেণ গ্রহণ করেন। সরকারের বিভিন্ন নীতি সহায়তার ফলে বর্তমানে দেশে হাই-টেক পার্কসহ দেশি-বিদেশি বহু প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশে মোবাইল ফোন ও ল্যাপটপ তৈরি করে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে রপ্তানিসহ দেশের মোবাইল ফোন চাহিদার ৭০ শতাংশ পূরণ করছে।
বর্তমানে সারা দেশে আট হাজার ৮৮০টি ডিজিটাল সেন্টারের মাধ্যমে তিন শর অধিক ধরনের সরকারি-বেসরকারি সেবা জনগণ পাচ্ছে। ৫ হাজার ৫০০ ইউনিয়নে পৌঁছেছে উচ্চগতির ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট। দেশে মোবাইল সংযোগের সংখ্যা ১৮ কোটি ৬১ লাখ এর অধিক। ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা প্রায় ১৩ কোটি। তথ্য-প্রযুক্তি ব্যবহার করে আর্থিকসেবায় মানুষের অন্তর্ভুক্তি রীতিমতো বিস্ময়কর। অনলাইন ব্যাংকিং, ইলেকট্রনিক মানি ট্রান্সফার, এটিএম কার্ড ব্যবহার শুধু ক্যাশলেস সোসাইটি গড়াসহ ই-গভর্নমেন্ট প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখছে তা নয়, ই-কমার্সেরও ব্যাপক প্রসার ঘটাচ্ছে।
স্টার্টআপ সংস্কৃতির বিকাশে আইডিয়া প্রকল্প ও স্টার্টআপ বাংলাদেশ কোম্পানি লিমিটেডসহ সরকারের নানা উদ্যোগে ভালো সুফল দেখা দিচ্ছে। দেশে স্টার্টআপ ইকোসিস্টেম গড়ে উঠেছে। ই-গভর্নমেন্ট কার্যক্রম ডিজিটাইজেশন করা হয়েছে। ৫৫ হাজারেরও বেশি ওয়েবসাইট জাতীয় তথ্য বাতায়নে যুক্ত রয়েছে। ২০২৫ সাল নাগাদ যখন শতভাগ সরকারি সেবা অনলাইনে পাওয়া যাবে, তখন নাগরিকদের সময়, খরচ ও যাতায়াত সাশ্রয় হবে। বর্তমানে আইসিটি খাতে রপ্তানি ১.৩ বিলিয়ন মার্কিন ডলার। অনলাইন শ্রমশক্তিতে বাংলাদেশের অবস্থান দ্বিতীয়। প্রায় সাড়ে ছয় লাখ ফ্রিল্যান্সারের আউটসোর্সিং খাত থেকে প্রায় ৫০০ মিলিয়ন মার্কিন ডলার আয় হচ্ছে। ৩৯টি হাই-টেক ও আইটি পার্কে এরই মধ্যে নির্মিত ৯টিতে দেশি-বিদেশি ২০০ এর বেশি প্রতিষ্ঠান ব্যাবসায়িক কার্যক্রম শুরু করেছে। এতে বিনিয়োগ এক হাজার ৫০০ কোটি টাকা এবং কর্মসংস্থান হয়েছে ২৫ হাজার, মানবসম্পদ উন্নয়ন হয়েছে ৫২ হাজার। ১৫ হাজার ৫০০ নারীকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। তথ্য-প্রযুক্তিনির্ভর ২০ লাখ কর্মসংস্থান সৃষ্টি হয়েছে।
করোনা মহামারি থেকে দেশের জনগণকে সুরক্ষিত রাখতে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের উদ্যোগে টিকা কার্যক্রম, টিকার তথ্য সংরক্ষণ, ব্যবস্থাপনা এবং সনদ প্রদানের লক্ষ্যে টিকা ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম ‘সুরক্ষা’ ওয়েবসাইট চালু করা হয় এবং দেশের জনগণ এর সুবিধা পাচ্ছে। ২০২৫ সালে আইসিটি রপ্তানি পাঁচ বিলিয়ন ডলার এবং তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিনির্ভর কর্মসংস্থান ৩০ লাখে উন্নীত করা এবং সরকারি সেবার শতভাগ অনলাইনে পাওয়া নিশ্চিত করা, আরো ৩০০ স্কুল অব ফিউচার ও এক লাখ ৯ হাজার ওয়াই-ফাই কানেক্টিভিটি, ভিলেজ ডিজিটাল সেন্টার এবং ৩৫ হাজার শেখ রাসেল ডিজিটাল ল্যাব প্রতিষ্ঠা করার পরিকল্পনা রয়েছে সরকারের। ডিজিটাল বাংলাদেশ বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তির যে প্রসার ঘটেছে, তাকে পুরোপুরি কাজে লাগিয়ে ২০৪১ সালের মধ্যেই সরকার বাংলার আধুনিক রূপ জ্ঞানভিত্তিক উন্নত বাংলাদেশ গড়ে তুলতে পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে। ২০১৮ সালের ১২ মে যুক্তরাষ্ট্রেও কেনেডি স্পেস সেন্টার থেকে বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১ উৎক্ষেপণ করা হয়। নিজস্ব স্যাটেলাইট উৎক্ষেপকারী দেশ হিসেবে বিশ্বের ৫৭তম দেশ হয় বাংলাদেশ। বঙ্গবন্ধু স্যাটেলাইট-১-এ ২৬টি কে-ইউ ব্যান্ড এবং ১৪টি সি ব্যান্ড ট্রান্সপন্ডার রয়েছে। দেশের সব অঞ্চল, বঙ্গোপসাগরের জলসীমা, ভারত, নেপাল, ভুটান, শ্রীলঙ্কা, ফিলিপাইন ও ইন্দোনেশিয়া এর কাভারেজের আওতায় রয়েছে।
চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের কারণে প্রযুক্তির পরিবর্তন ঘটছে খুব দ্রুত। প্রযুক্তির এই প্রভাব সুদূরপ্রসারী। এটি সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচন করে দিতে পারে, আবার নতুন চ্যালেঞ্জ নিয়ে আসতে পারে। ধনী ও গরিব দেশের পার্থক্য বেড়ে যেতে পারে। কাজগুলো ভাগ হয়ে যাবে অদক্ষ-স্বল্প বেতন ও অতি দক্ষ-অধিক বেতন, এসব শ্রেণিবিভাগে দক্ষ ব্যক্তিরা কাজ পাবে, অদক্ষ ব্যক্তিরা বেকার হয়ে যেতে পারে।
এসব স্মার্ট যন্ত্র বাংলাদেশের জন্য দুঃসংবাদের কারণ হতে পারে, বিশেষ করে পোশাকশিল্প। প্রায় ৬০ লাখ শ্রমিক কাজ করেন এ খাতে। রোবট ও স্মার্ট যন্ত্রের ব্যবহারের মাধ্যমে এসব শ্রমিকের ওপর নির্ভরতা কমে যাবে। অনেক শ্রমিক বেকার হয়ে যেতে পারেন। শুধু পোশাকশিল্প নয়, আরো অনেক পেশার ওপর নির্ভরতা কমে আসবে, রোবট ও যন্ত্রের ব্যবহার বাড়বে। মেধাভিত্তিক পেশার প্রয়োজন বাড়বে, যেমন প্রোগ্রামার, আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স, ইন্টারনেট অব থিংস (আইওটি) ইত্যাদিতে দক্ষ লোকের চাহিদা বাড়বে। আমাদের দেশে দক্ষ প্রোগ্রামারের অনেক অভাব আছে। এটি একটি বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে সামনে আসবে। আমাদের দক্ষ প্রোগ্রামার তৈরি করতে হবে।
প্রধানমন্ত্রী চতুর্থ শিল্প বিপ্লবের গুরুত্ব অনুধাবন করে একটি টাস্কফোর্স গঠন করেন। ভবিষ্যতে শুধু বাংলাদেশেই নয়, সারা বিশ্বের জন্যই দক্ষ জনশক্তির প্রয়োজন হবে। যাঁরা বিদেশে যাবেন, তাঁদের কারিগরি বিষয়গুলোতে দক্ষ হয়ে যেতে হবে। আর সে জন্যই কারিগরি শিক্ষাকে গুরুত্ব দিয়ে আমাদের শিক্ষাব্যবস্থাও পরিবর্তন করা হয়েছে। বেসরকারি প্রতিষ্ঠান প্রযুক্তিগত প্রশিক্ষণ দিচ্ছে। ডিজিটাল বাংলাদেশের পাঁচটি উদ্যোগ আন্তর্জাতিকভাবে প্রশংসিত হয়েছে। এগুলো হলো ডিজিটাল সেন্টার, পরিষেবা উদ্ভাবন তহবিল, সহানুভূতি প্রশিক্ষণ, টিসিভি এবং এসডিজি ট্র্যাকার। তথ্য-প্রযুক্তির সাহায্যে তরুণরা ছোট-বড় আইটি ফার্ম, ই-কমার্স সাইট, অ্যাপভিত্তিক পরিষেবা এবং অন্যান্য সংস্থা তৈরি করছে। এ ছাড়া ই-কমার্স, আউটসোর্সিং, ফ্রিল্যান্সিং, ভিডিও স্ট্রিমিং, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের বর্ধিত চাহিদা পূরণ করতে টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্কের ধারণক্ষমতা ও সক্ষমতা বাড়াতে হবে। সবার সমন্বিত প্রচেষ্টায় তথ্য-প্রযুক্তির সঠিক প্রয়োগের মাধ্যমে পরিবর্তিত জীবনব্যবস্থার মধ্যে এসডিজি বাস্তবায়নে বাংলাদেশকে অগ্রগামী হতে হবে।
হীরেন পণ্ডিত: প্রাবন্ধিক ও গবেষক
ছবি-ইন্টারনেট
ফিডব্যাক-[email protected]
০ টি মন্তব্য