https://www.brandellaltd.com/

প্রচ্ছদ প্রতিবেদন

সাইবার জগৎ : আমাদের ভাবনা

সাইবার জগৎ : আমাদের ভাবনা সাইবার জগৎ : আমাদের ভাবনা
 

সাইবার জগৎ : আমাদের ভাবনা


সময়ের পরিক্রমায় আমাদের জীবনযাত্রা বাস্তবের চেয়ে অনেক বেশি ভার্চুয়াল হয়ে উঠেছে। সাইবার জগতের সাথে আমাদের সার্বক্ষণিক সম্পর্ক তৈরি হয়ছে। প্রযুক্তির সদ্ব্যবহারে মানুষ নানাভাবে উপকৃত হচ্ছেন। অপরদিকে কিছু মানুষের অশুভ প্রয়াসে অনেকেই নানামুখী সমস্যায়ও পড়ছেন। ডিজিটাল এ যুগে সারা বিশ্বে আনুপাতিক হারে সাইবার হামলার সংখ্যা বেড়ে যাচ্ছে। 


সাইবার ক্রাইমের আগে বুঝতে হবে ‘সাইবার স্পেস’। ইন্টারনেটের মাধ্যমে আমরা বিশাল এক নেটওয়ার্কের সাথে জড়িত। এ জগৎটা ঠিক ‘শূন্য’র মতো। এখানে আমরা কেউ আলাদা নই। এই সাইবার স্পেসে কমপিউটার বা মোবাইল যে ডিভাইস দিয়েই প্রবেশ করি না কেন, তা নিজ নিজ মানবিক সত্তাকেই প্রতিনিধিত্ব করে। এখন কেউ যদি আমার এই মানবিক সত্তালোয় অনুমতি ছাড়া প্রবেশ করে তখন তাকেই সাইবার ক্রাইম বা সাইবার অপরাধ বলে।


সাইবার জগৎ আমাদের জন্য কতটা নিরাপদ


প্রতিটি রাষ্ট্রের আন্তর্জাতিক আইনস্বীকৃত সার্বভৌম সীমানা রয়েছে এবং সার্বভৌমত্ব রয়েছে। ইন্টারনেট সেই সনাতনী রাষ্ট্রের সার্বভৌমত্ব বা রাষ্ট্রের সীমানা অতিক্রম করে নতুন এক বিশ্বের উদ্ভব ঘটিয়েছে এবং সারা বিশ্বকে নিয়ে এসেছে এক কাতারে, যার নাম সাইবার বিশ্ব বা সাইবার জগৎ। এর ফলে প্রতিটি রাষ্ট্র হয়েছে গ্লোবাল ভিলেজের অন্তর্ভুক্ত। ইন্টারনেটভিত্তিক এই গ্লোবাল ভিলেজের কোনো সীমানা বা অঞ্চল নেই। বিশ্বের বিভিন্ন প্রান্তের লোকজন পরস্পর সহজে যোগাযোগ, কথোপকথন, গণমাধ্যম ও ইলেকট্রনিক যোগাযোগের মাধ্যমে যুক্ত থাকে এবং ক্রমেই একটি একক কমিউনিটিতে পরিণত হয়। সাইবার জগৎ বা অনলাইন জগৎ বা গ্লোবাল ভিলেজে যা-ই বলি না কেন; মানুষের সমাজ এবং শিল্প ক্রমেই সাইবার জগতের ওপর বেশ নির্ভরশীল হয়ে পড়েছে। ফলে সাইবার জগৎ ভৌত জগতের একটি কেন্দ্রীয় এবং অন্তর্নিহিত উপাদান হয়ে উঠেছে। অনলাইন জগৎ যেন এক অদৃশ্য স্বংসম্পূর্ণ শক্তি হয়ে মানুষকে নিজেই চালাচ্ছে। তথ্য, ধারণা ও ব্যবসার জন্য মানুষ দ্বারস্থ হচ্ছে অনলাইন শক্তির কাছে।


কথা হলো, সাইবার জগতে আমরা কতটা নিরাপদ? বিশেষ করে হ্যাকিং, অর্থ ও ডাটা চুরি, প্রপাগান্ডা, সাইবার বুলিংয়ের মতো ঘটনা শুধু বাংলাদেশ নয়, তথ্যপ্রযুক্তিতে অগ্রগামী দেশগুলোর জন্যও উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। তবে উদ্বেগের মাত্রাটা আরও বেড়ে যায় তখন, যখন আমরা দেখি হ্যাকিং ও ডাটা চুরিতে রাষ্ট্রগুলো যুক্ত হচ্ছে। কোনো কোনো রাষ্ট্র সাইবার জগতে এক ধরনের অদৃশ্য যুদ্ধে লিপ্ত রয়েছে, যাকে সাইবার জগৎ বা পঞ্চম ডোমেইনের যুদ্ধক্ষেত্র বলা হয়। মানুষ এতদিন জল, স্থল, আকাশ, মহাকাশ এই চার ক্ষেত্রে যুদ্ধ দেখে আসছে। আর এখন দেখছে সাইবার জগতের যুদ্ধ। এ জগতের যুদ্ধে রাষ্ট্রগুলোর যুক্ততা নিয়ে বিশ্বখ্যাত দ্য ইকোনমিস্টের ২০১০ সালের ১ জুলাই সংখ্যায় ‘ওয়ার ইন ফিফথ ডোমেইন’ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশিত হয়। মূলত এ প্রতিবেদনের মাধ্যমে মানুষ প্রথম জানল সাইবার জগতে দেশগুলো যুদ্ধে লিপ্ত। প্রতিবেদনে বলা হয়, সোভিয়েত গুপ্তচররা কানাডার একটি ফার্ম থেকে কমপিউটার নিয়ন্ত্রণ সিস্টেম চুরি করেছিল। কিন্তু সিআইএ সিস্টেমটি একটি সফটওয়্যারের মাধ্যমে আগেই ম্যানিপুলেট করে রেখেছিল। সে কারণে সাইবেরিয়ার গ্যাস পাইপলাইনে এটি ব্যবহারের সাথে সাথে বিস্ফোরণ ঘটে। এটি ছিল একটি বড় ধরনের নন-নিউক্লিয়ার বিস্ফোরণ। আকাশ থেকেও আগুনের লেলিহান শিখা দাউ দাউ করে জ্বলতে দেখা যায়। ঘটনাটির কথা ২০১০ সালে প্রকাশ পেলেও সাম্প্রতিককালে যুক্তরাষ্ট্র এবং চীন প্রায়ই একে অপরের বিরুদ্ধে গোপনীয় ডাটা চুরির অভিযোগ আনছে।


এখন ব্যক্তি, রাষ্ট্র ও গোষ্ঠী নিজ স্বার্থ হাসিলের উদ্দেশ্যেই সাইবার জগতে অপরাধ সংঘটিত করছে। কেউ রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য, অর্থ ও প্রতিষ্ঠানের ডাটা চুরি করছে; কেউ সাম্প্রদায়িক সহিংসতা, কেউ নারীর প্রতি বিদ্বেষ ছড়াচ্ছে। আবার কেউ রাজনৈতিক স্বার্থে প্রপাগান্ডা ছড়াচ্ছে। অধিকাংশ ক্ষেত্রে হ্যাকারদের লক্ষ্য থাকে অর্থ ও ডাটা চুরি। রাষ্ট্রীয় গোপন তথ্য ফাঁস করে দেয়াও অনেক হ্যাকারের লক্ষ্য। ২০১০ সালে সাংবাদিক ও কমপিউটার হ্যাকার বলে পরিচিত জুলিয়ান অ্যাসাঞ্জ ‘উইকিলিকস’ ওয়েবসাইটের মাধ্যমে মার্কিন গোপন দলিল ফাঁস করে বিশ্বকে কাঁপিয়ে দেন। র‌্যামনসমওয়্যার ভাইরাস পাঠিয়ে কমপিউটারের ওপর নিয়ন্ত্রণ নিয়ে অর্থ দাবি করা হচ্ছে। এর নেপথ্যেও রয়েছে হ্যাকাররা। সাইবার জগতে অপরাধের কারণে ক্ষতির পরিমাণও কম নয়। মেধাস্বত্ব ও ব্যবসায়িক তথ্য চুরি, সাইবার অপরাধ, সেবা প্রদানে বাধা, হ্যাকিং ইত্যাদি কারণে বিশ্বে ক্ষতির পরিমাণ প্রায় ৩০০ বিলিয়ন ডলার। 


আমাদের সবচেয়ে উদ্বেগের জায়গাটা কোথায়, তা নিয়ে বিস্তর আলোচনা করা হচ্ছে প্রথমত, হ্যাকাররা দেশের ব্যাংকিং ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং করপোরেট হাউজগুলো তাদের আক্রমণের লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করেছে। সম্প্রতি তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি প্রতিমন্ত্রী জুনাইদ আহমেদ পলক দেশের গুরুত্বপূর্ণ সরকারি-বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলো যে কোনো মুহূর্তে হ্যাকারদের আক্রমণের শিকার হতে পারে বলে সংশ্লিষ্ট সবাইকে সতর্ক করেছেন। তার এই আশঙ্কা যে একেবারে অমূলক নয়, এর প্রমাণ বেক্সিমকোসহ কয়েকটি করপোরেট হাউজ হ্যাকারদের আক্রমণের শিকার হওয়া।


প্রতিপক্ষকে টার্গেট করে রাজনৈতিক দল বা গোষ্ঠী কর্তৃক পরিকল্পিতভাবে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে প্রপাগান্ডা চালানো হচ্ছে। রাজনৈতিক প্রতিপক্ষের বিরুদ্ধে এ ধরনের অপপ্রচারের নানা উপাদানে ভরপুর আমাদের সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম। প্রতিপক্ষ রাজনৈতিক দলের নেতানেত্রী এবং ক্ষমতাসীনদের টার্গেট করেই অপপ্রচার ও কুৎসা রটানো হচ্ছে বেশি। ইউটিউব ও ফেসবুকে অপপ্রচারের ভিডিওগুলোর অধিকাংশই বিদেশ থেকে অথবা ভুয়া আইডি ব্যবহার করে আপলোড করা হয়েছে।


সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে সাম্প্রদায়িক সহিংসতা ও নারীর প্রতি বিদ্বেষ ছড়ানোর মতো ক্ষতিকর পোস্ট সমাজে অস্থিরতা তৈরি করছে। পার্বত্য চট্টগ্রামের রামুর বৌদ্ধ মন্দির, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নাসিরনগর এবং কুমিল্লার পূজামণ্ডপে হামলার আগে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে উস্কানিমূলক পোস্ট দিয়ে মানুষের মধ্যে সেন্টিমেন্ট তৈরি করা হয়েছিল। ছেলে ধরার গুজব ছড়িয়ে রেনু বেগমকে হত্যা, নারীর ছবি ম্যানিপুলেট করে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে দেওয়ার ঘটনা অহরহ ঘটছে। 


সাইবার জগতে আলোচ্য উদ্বেগজনক ঘটনাগুলোর প্রতিকার নিয়েই এখন যত দুশ্চিন্তা। ২০১৬ সালে হ্যাকাররা ফেডারেল রিজার্ভ ব্যাংক অব নিউইয়র্কে বাংলাদেশ ব্যাংকের অ্যাকাউন্ট থেকে ৮১ মিলিয়ন ডলার চুরি করার পর অনলাইন কার্যক্রমকে নিরাপদ রাখতে বেশ কিছু উদ্যোগ গ্রহণ করা হয়েছে। এর মধ্যে রয়েছে ব্যবহারকারীকে অনলাইনে নিরাপত্তা প্রদান করা, রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা তথা  কেপিআইর নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, সেবা প্রদান নিরাপদ করা, তথ্য ও ডাটার নিরাপত্তা নিশ্চিত করা এবং গুণগত মানের সফটওয়্যার ব্যবহার। গড়ে তোলা হয়েছে সাইবার ইনসিডেন্ট রেসপন্স টিম-সার্ট। এসব উদ্যোগের সুফল মিলছে। সার্টের দক্ষতার কারণেই ২০২১ সালের জুনে জাতিসংঘের বিশেষায়িত সংস্থা আন্তর্জাতিক টেলিযোগাযোগ ইউনিয়নের (আইটিইউ) সাইবার নিরাপত্তা সূচক-২০২০ এ বাংলাদেশের অবস্থান ৫৩তম। এর আগে ছিল ৭৮। অর্থাৎ বৈশ্বিক সাইবার নিরাপত্তা সূচকে বাংলাদেশ ২৫ ধাপ এগিয়েছে। সাইবার নিরাপত্তা সম্পর্কে প্রশিক্ষণ ও দেশব্যাপী সাইবার সচেতনতা তৈরির কার্যক্রম শুরু করতে যাচ্ছে বিশ্বব্যাংকের অর্থায়নে আইসিটি বিভাগের অধীন বাংলাদেশ কমপিউটার কাউন্সিলের ‘এনহান্সিং ডিজিটাল গভর্নমেন্ট অ্যান্ড ইকোনমি’ প্রকল্প।


দেশে ২০ সেকেন্ডে একটি সাইবার অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে


সাইবার জগতের নিরাপত্তা, অনলাইনে অর্থ লেনদেন এবং সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যম ব্যবহারে মানুষ কতটা নিরাপদ? সাইবার জগতে আমি নিরাপদ, এটা যদি কেউ ভেবে থাকেন তাহলে সেটা সবচেয়ে বড় বোকামি হবে। কারণ, সাইবার জগতে আমরা কেউই নিরাপদ নই। এর পেছনের কারণ যদি বলতে হয়, তাহলে বলব আপনি নিরাপদ ভেবে যে ডিভাইস ব্যবহার করছেন, যে সফটওয়্যার, ইন্টারনেট, ওয়াইফাই ব্যবহার করছেন, তার পূর্ণাঙ্গ নিয়ন্ত্রণ কিন্তু আপনার হাতে নেই। কেন, সেটা এভাবে বলা যায়, ধরেন আপনি বাসায় সিসি ক্যামেরা লাগিয়েছেন কী হচ্ছে সেটা দেখার জন্য। কিন্তু আপনি কোনো দিনই যদি সেটা চেক না করেন, ওটা নিয়মিত পর্যবেক্ষণ না করেন, কে এলো, কে গেল তা জেনেই যদি আপনি ভাবেন যে আমার সিসিটিভি ক্যামেরা আছে আমি নিরাপদ। তাহলে সেটা ভুল। কারণ, আপনার উচিত প্রতিদিন অন্তত একবার ফুটেজগুলো চেক করা। অ্যাডমিন প্যানেলের পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করা উচিত। খেয়াল করা, আপনার আঙ্গিনায় কার কার যাতায়াত হচ্ছে তবেই না আপনি নিজেকে নিরাপদ রাখতে পারবেন।


আমাদের দেশে গড়ে প্রতি ২০ সেকেন্ডে একটি সাইবার অপরাধ সংঘটিত হচ্ছে। যার বেশিরভাগ শিকার নারীরা, আর তার পরের অবস্থানেই অর্থলগ্নী, স্বনামধন্য প্রতিষ্ঠান ও ব্যক্তির নাম থাকে। কিন্তু আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অপর্যাপ্ত দক্ষতা ও ডিজিটাল ফরেনসিকের (ডিজিটাল তথ্য-উপাত্ত) অভাবে এসব অপরাধের মূল হোতারা ধরা ছোঁয়ার বাইরে থেকে যাচ্ছেন। অনেকেই ধরা পড়লেও জামিনে বের হয়ে যাচ্ছেন। আমরা দেখেছি বাংলাদেশে সাইবার ক্রাইমের ওপর ২০১৩ থেকে ২০১৬ সাল পর্যন্ত প্রায় লক্ষাধিক মামলা ও জিডি রয়েছে। ৬০ শতাংশ মামলাতেই আসামিরা খালাস পেয়ে যাচ্ছে শুধুমাত্র ডিজিটাল আলামতের অভাবে।


আমাদের দেশে সাইবার অপরাধের মধ্যে সাইবার বুলিংটা সবচেয়ে বেশি হয়। আর এই ক্ষেত্রে ১২ থেকে ১৬ বছর বয়সী উঠতি কিশোরীরা মারাত্মক ঝুঁকিতে থাকে। অনলাইনের সাইবার বুলিংয়ের জন্য সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুককে ৯০ শতাংশ ব্যবহার করে অপরাধীরা। শুধু কিশোরীরা নয়, সম্প্রতি এক জরিপে দেখা গেছে ১০ থেকে ১৬ বছর বয়সী কিশোরীরা ৭০ শতাংশ, ১৮ থেকে ২৪ বছর বয়সী তরুণীরা ৬০ শতাংশ এবং ২৮ থেকে ৪০ বছর বয়স পর্যন্ত নারীরা এই সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে। শুধু তাই নয়, পুরুষরাও এই তালিকার বাইরে নয়। ২৮ থেকে ৩৫ বছর বয়সী পুরুষদের মধ্যে ২৫ শতাংশই এই সাইবার বুলিংয়ের শিকার হচ্ছে। এর মধ্যে প্রেমে ব্যর্থ, বিবাহবহির্ভূত সম্পর্ক বা পরকীয়ার কারণেই অনেকেই হুমকির মুখে আছেন। 


অভিযোগ আছে আমাদের দেশের অনলাইন ব্যবহারকারীর মধ্যে প্রায় ২০ শতাংশ লোক কোনো না কোনোভাবে এই সাইবার ক্রাইমের সাথে জড়িত। আর ৭০ শতাংশ ব্যবহারকারী ঝুঁকিতে আছেন। যারা এই অপরাধগুলো সংঘটিত করে তারা বেশিরভাগ সময়ই নারীদের সাথে রাজনৈতিক ব্যক্তি, পরিচিত মুখ এসব বিষয়কে টার্গেটে রাখে। এদেরকে উদ্দেশ্য করেই মূলত সাইবার বুলিং করে। আর আমরা আশংকা করছি, আগামী নির্বাচনকে কেন্দ্র করে একটা বড় ধরনের সাইবার ক্রাইম হতে পারে। যেখানে সাইবার দুনিয়াকে ব্যবহার করে প্রার্থীর বিরুদ্ধে নানা ধরনের তথ্য ছড়িয়ে ভোটারকে বিভ্রান্ত করা হবে।


আমাদের দেশের ব্যাংকগুলো ইতিমধ্যেই অনলাইনে তাদের কার্যক্রম শুরু করেছে। কিন্তু তাদের নিরাপত্তা ব্যবস্থা অনেক দুর্বল। ইতোমধ্যে কয়েকটি ব্যাংক তাদের সাইবার নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করলেও দেশের অনেক পরিচিত ব্যাংকগুলোর অবস্থা অনেক খারাপ। এখান থেকে যেকোনো সময় খারাপ একটা ঘটনা ঘটে যেতে পারে। এক গবেষণায় উঠে এসেছে তিন ধরনের সমস্যার কথা। এর মধ্যে একটি হচ্ছে ব্যাংকের এটিএম বুথ। বুথগুলোতে যে কমপিউটারগুলো থাকে, সেগুলো তৃতীয় পক্ষের কোনো প্রতিষ্ঠান মেরামত করে থাকে। কিন্তু ওই কমপিউটারগুলোতে গ্রাহকদের অনেক তথ্য থাকে। কোম্পানির অগোচরে কেউ যদি অসৎ উদ্দেশ্যে ওই কমপিউটারগুলোর অ্যাক্সেস নেয়, তাহলে সেখান থেকে সহজেই গ্রাহকের তথ্য চুরি হয়ে যেতে পারে। 


আরেকটি সমস্যা রয়েছে কোর ব্যাংকিং সিস্টেমে। আমরা কিন্তু প্রায়ই অনলাইনে টিন নম্বর বা কাস্টমার ক্রেডেনশিয়ালগুলো আমরা ইমেইলের মাধ্যমে ব্যাংকে দিয়ে থাকি। আর হ্যাকাররা যখন কোন ব্যাংকে হামলা করে, তার আগে তারা ঐ ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলে কোর ব্যাংকিংয়ের সাথে যুক্ত হয় কোর ব্যাংকিংয়ে যাতে অ্যাক্সেস পায়। আর আমাদের দেশে ব্যাংকগুলোতে এগুলো যারা নিয়ন্ত্রণ করে তারা সাইবার সিকিউরিটি নিয়ে এতটা দক্ষ নয় যে হ্যাকারের ইমেইলে থাকা ম্যালওয়্যারগুলো তারা ডিটেক্ট করতে পারবে। কিছু না বুঝেই তারা যখন হ্যাকারের ইমেইল খুলে, তখন ম্যালওয়্যারগুলো নেটওয়ার্কের মধ্যে ঢুকে গিয়েই তার কার্যক্রম শুরু করে। এটা ফায়ারওয়াল বা ফিল্টার লেভেল কিংবা অ্যান্টিভাইরাসও কিন্তু এই ম্যালওয়্যারকে ডিটেক্ট করতে পারে না। যেহেতু সেখানে কোডসহ এলিমেন্টসগুলো যেই ফরম্যাটে থাকে, সাধারণত সফটওয়্যার তাকে টেক্সট ফরম্যাট হিসেবেই ধরে নেয়। 


আরেকটা বিষয় হচ্ছে কর্মীদের ব্যবহারে ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার অনেক ব্যাংকেই ব্যবহার না করা। কারণ অনেক ব্যাংকেই অনেক অসাধু কর্মকর্তা আছেন, যাদের যোগসাজশেই এসব অপকর্ম সংঘটিত ঘটে থাকে। এই কর্মীদের ব্যবহারে ম্যানেজমেন্ট সফটওয়্যার থাকলে কোনো কর্মীর যদি অসৎ উদ্দেশ্য থাকে, তাহলে তারও কীবোর্ডের বোতাম চাপা থেকেই বোঝা যাবে তার অসৎ উদ্দেশ্যের কথা। এই জায়গাতে কিন্তু আমাদের বেশ বড় একটা দুর্বলতা আছে। সবচেয়ে বড় বিষয় হচ্ছে আমাদের সবচেয়ে বড় দুর্বলতা হচ্ছে ব্যাংকগুলোতে অনেক ভেন্ডর সার্টিফাইড, যেমন সিসিএনএ, সিসা সার্টিফাইড দক্ষ কর্মীরা কাজ করেন। কিন্তু তাদেরকে ইনসিডেন্ট ম্যানেজমেন্ট নিয়ে তেমন প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় না। একটা ব্যাংকে যেকোনো সময় দুর্ঘটনা ঘটতে পারে, কিন্তু দুর্ঘটনাপরবর্তী সময়ে আপনি ডিজিটাল ফুটপ্রিন্ট বের করবেন? কীভাবে আপনি হ্যাকারকে ট্রেস আউট করবেন? কীভাবে নির্ণয় করবেন আপনার সাইটের কোন পয়েন্ট, এমন কোন জায়গায় দুর্বলতা আছে যেখান থেকে হ্যাকাররা এসে আক্রমণ করেছে, সেই জায়গাটা ট্রেস ব্যাক করার জন্য যেই অ্যাভিডেঞ্চুয়াল প্রশিক্ষণ বা জ্ঞান থাকা দরকার, সেটা ওইভাবে আমাদের কর্মকর্তাদের দেওয়া হয় না। এতে করে দুর্ঘটনাপরবর্তী সময়ে সবকিছু সামলাতে গিয়ে ব্যাংকের আইসিটি কর্মকর্তাদের হিমশিম খেতে হয়। 


ক্রাইম রিসার্চ অ্যান্ড অ্যানালাইসিস ফাউন্ডেশন (ক্রাফ) হচ্ছে এমন একটি সংগঠন যারা অপরাধসংশ্লিষ্ট বিষয়াদি নিয়ে গবেষণা করে। যেখানে সাইবার ক্রাইমের পাশাপাশি অন্যান্য অপরাধের বিষয়ে গবেষণা করে ভিকটিম ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে সহায়তা করা হবে। এখানে দেখা যাচ্ছে, তথ্য চুরি সংক্রান্ত মামলায় আমাদের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি আইন অনেক ভালো কাজ করছে। তবে এখানেও ৫৭ ধারার একটা বিরূপ প্রতিক্রিয়া আছে। এই ধারা মোতাবেক বাদী বিবাদীর বক্তব্যে অমিল ও ডিজিটাল আলামত না থাকায় এখানে অনেক সময় আইনশৃঙ্খলা বাহিনী সফল হতে পারছে না।


সাইবার ক্রাইম থেকে সুরক্ষিত থাকতে এবং এই অপরাধ প্রতিরোধ করতে হলে সবার আগে আমাদের সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমগুলো ব্যবহার জানতে হবে। সামাজিক যোগাযোগের মাধ্যমে সম্পর্কের সীমারেখা জানতে হবে। কাউকে সম্পর্কের খাতিরে ব্যক্তিগত কোনো পাসওয়ার্ড দেওয়া যাবে না। ডিজিটাল মাধ্যমে আমাদের সংবেদনশীল কোন ছবি, গোপনীয় তথ্য, তথ্যপ্রযুক্তি আইন (২০০৬ সংশোধিত ২০১৩ সম্পর্কে) বিশেষ করে ধারা ৫৪, ৫৬, ৫৭ এবং ৬১ সম্পর্কে জানতে হবে। যেকোনো সাইবার অপরাধ ঘটার সাথে সাথে নিরাপত্তা বাহিনীকে সংশ্লিষ্ট বিষয়ে জানাতে হবে। একই সাথে দেশের প্রত্যেকটি থানায় নারী নির্যাতন সেলের মতো একটি করে সাইবার ক্রাইম সেল তৈরি করতে হবে, যেখানে সাইবার ক্রাইমের ওপর বিশেষায়িত অন্তত একজন অনুসন্ধানী কর্মকর্তা (আইও) তৈরি করতে হবে। সংশ্লিষ্ট থানার ওসি এবং আইওসহ কয়েকজন সিপাহি নিয়ে সেলটি সর্বদা প্রস্তুত থাকবে।


সাইবার স্পেসে পাসওয়ার্ড ম্যানেজার হ্যাকারদের থেকে কতটা নিরাপদ


লাস্টপাস পাসওয়ার্ড ম্যানেজারে হামলার ফলে আড়াই কোটি গ্রাহকের তথ্য হুমকিতে পড়ার আশঙ্কা করছেন প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা। বিশ্বের অন্যতম বড় পাসওয়ার্ড ম্যানেজার ওয়েবসাইট হ্যাকারদের কবলে পড়েছিল বলে জানা গেছে। ‘লাস্টপাস’ নামের ওই প্রতিষ্ঠানটির কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, তাদের কোম্পানিতে হ্যাকারদের হামলা হলেও গ্রাহকরা নিরাপদে আছেন। কিছু সোর্স কোড এবং কারিগরি তথ্য চুরি হয়েছে। তবে এই হামলার ফলে প্রায় আড়াই কোটি গ্রাহকের পাসওয়ার্ড হুমকির মুখে পড়েছে বলে তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা আশঙ্কা করছেন।


আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তির যুগে ইমেইল, সামাজিক মাধ্যম, অনলাইন ব্যাংক অ্যাকাউন্ট ইত্যাদির অনেক পাসওয়ার্ড ব্যবহার করা হয়। মনে রাখা এবং সহজে ব্যবহারের উদ্দেশ্যে অনেকেই এসব পাসওয়ার্ড সংরক্ষণ করতে লাস্টপাসের মতো পাসওয়ার্ড ম্যানেজার বা ভল্ট ব্যবহার করেন। কিন্তু এগুলো কতটা নিরাপদ? হ্যাকারদের কবলে পড়লে কী করতে পারেন গ্রাহকরা? পাসওয়ার্ডকে বলা হয় ভার্চুয়াল জগতের চাবি। একসময় কমপিউটার বা ইন্টারনেটের পাসওয়ার্ড মানুষ মুখস্থ করে রাখত অথবা  নোটবুকে লিখে রাখতো। অনেকে এখনও তা করেন। কিন্তু মুখস্থ করে রাখলে সেটা যেমন ভুলে যাওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে, তেমনি নোটবুকে বা কোথাও লিখে রাখা পাসওয়ার্ড হারিয়ে যাওয়ার বা অন্য কারও চোখে পড়ে যাওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। এই সমস্যার সমাধানেই পাসওয়ার্ড ম্যানেজারের জন্ম। অনেকে ব্যবহারের সুবিধার জন্য পাসওয়ার্ড ম্যানেজারে নিজেদের অ্যাকাউন্টের তথ্য সংরক্ষণ করে রাখেন


এটি আসলে ওয়েবসাইট বা অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে বিভিন্ন অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ড সংরক্ষণ করে রাখে। নিরাপত্তা ব্যবস্থা হিসাবে এটি তথ্য এনক্রিপশন করে রাখে। ফলে গ্রাহক আর অ্যাকাউন্ট ছাড়া এসব তথ্য অন্য কেউ দেখতে পারে না। গুগল যারা ব্যবহার করেন, তারা অনেক সময় পাসওয়ার্ড মনে রাখার একটি অপশন দেখতে পান। সেখানে অনুমতি দেয়া হলে গুগল নিজে থেকে পরবর্তীতে আইডি ও পাসওয়ার্ড দিয়ে দেয়। কিন্তু ব্রাউজারে পাসওয়ার্ড সংরক্ষণ কম নিরাপদ হওয়ায় অনেক প্রতিষ্ঠান আলাদা নিরাপত্তা ব্যবস্থার মাধ্যমে পাসওয়ার্ড সংরক্ষণ সেবা দিয়ে থাকে। বিনামূল্যে বা নির্দিষ্ট ফি’র বিনিময়ে এসব সেবা নেয়া যায়। উত্তর কোরিয়ার হ্যাকাররা যেভাবে বাংলাদেশ ব্যাংকের একশো কোটি ডলার হাতিয়ে নিয়েছিল।


সাধারণত এসব পাসওয়ার্ড ম্যানেজার প্রতিষ্ঠানগুলোকে নিরাপদ বলেই ধরে নেয়া হয়। এ কারণে সারা বিশ্বেই টাকা-পয়সা দিয়ে মানুষ এসব প্রতিষ্ঠানের সেবা নিচ্ছে। এখন পর্যন্ত এসব প্রতিষ্ঠানে বড় ধরনের কোনো হ্যাকিংয়ের ঘটনা শোনা যায়নি।


পাসওয়ার্ড ম্যানেজার প্রতিষ্ঠানগুলো এনক্রিপশন প্রযুক্তি ব্যবহার করে। এর মাধ্যমে সেবাগ্রহীতা পোর্টাল বা অ্যাকাউন্টের পাসওয়ার্ডটি ব্যবহার করেন, সেটা বিশেষ কোডে সংরক্ষণ করে রাখা হয়। ফলে গ্রাহক ছাড়া আর কেউ সেটি ব্যবহার করতে বা দেখতে পারে না। তবে এ ধরনের সেবা নেওয়ার ক্ষেত্রে প্রতিষ্ঠান হিসাবে ওই পাসওয়ার্ড ম্যানেজারের রেটিং কেমন, কত বেশি গ্রাহক সেটি ব্যবহার করছেন, তাদের রিভিউ ইত্যাদি বিষয় যাচাই করে নেয়া উচিত। গ্রাহকদের দুর্বল পাসওয়ার্ড অনেক সময় হ্যাকারদের কাজ সহজ করে দেয়।


লাস্টপাস কর্তৃপক্ষ দাবি করেছে, তাদের সার্ভারের ডেভেলপমেন্ট এনভায়রনমেন্টে তৃতীয় কোনো পক্ষ ঢোকার চেষ্টা করেছে। এই সফটওয়্যার দিয়ে ওই প্রতিষ্ঠানের কর্মীরা লাস্টপাসের বিভিন্ন সেবা-পণ্য তৈরি বা রক্ষণাবেক্ষণ করে থাকে। কিন্তু কোনো গ্রাহকের পাসওয়ার্ড ক্ষতিগ্রস্ত হয়নি বলে তাদের দাবি। হ্যাকাররা সাধারণত প্রতিষ্ঠানের রক্ষণাবেক্ষণ বা মূল সার্ভারে প্রবেশ করার ক্ষমতা রয়েছে, এমন কারও অ্যাকাউন্ট বা কমপিউটারে প্রবেশের ক্ষমতা চুরি করে হ্যাকাররা। এরপর মূল সার্ভার থেকে তথ্য চুরি করে থাকে। তবে যেসব প্রতিষ্ঠানে নিরাপত্তা ব্যবস্থা বা ফায়ারওয়াল যত কঠোর, সেখানে হ্যাকারদের প্রবেশ করা তত কঠিন। নিরাপত্তার জায়গাটা কখনোই শতভাগ নিশ্চিত করা যায় না। সবাই তাদের মতো করে নিরাপত্তা নিশ্চিত করার চেষ্টা করে। যারা এ ধরনের সেবা দেয়া, পুরো প্রযুক্তিটা অনেকটা ক্রিটিক্যাল পদ্ধতিতে কাজ করে। হয়তো কোনো দুর্বলতা থেকে গেলে হ্যাকাররা সেটার সুযোগ নেয়।


হ্যাকাররা অনেক সময় শুধুমাত্র চ্যালেঞ্জ হিসাবে নিয়ে, নিজের ক্ষমতা যাচাই করার জন্য বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সাইটে হ্যাক করে। আর পাসওয়ার্ড ম্যানেজারের মতো নিরাপত্তা সেবা দেয়া প্রতিষ্ঠানে হ্যাক করতে পারা যেকোনো হ্যাকারের জন্য গর্বের বা বিজয়ের একটা ব্যাপার।


তবে অনেক সময় প্রাতিষ্ঠানিক তথ্য চুরি করে বিক্রি করা, পাসওয়ার্ড চুরি করে অপব্যবহার করা বা ব্ল্যাকমেইলিং করার মতো কাজও করে থাকে হ্যাকাররা। এখন মানুষ ইমেইল, ব্যাংক অ্যাকাউন্ট থেকে শুরু করে ক্রেডিট কার্ডের তথ্য পর্যন্ত পাসওয়ার্ড ম্যানেজারে সংরক্ষণ করে রাখে। ফলে এটা হ্যাকারদের জন্য সবসময় একটা লোভনীয় টার্গেট। কারণ কারও পাসওয়ার্ড জানা গেলে তার সবকিছুতেই প্রবেশের সুযোগ পেয়ে যায় হ্যাকাররা। তারা তখন যে কোনো অপরাধ করতে পারে। প্রযুক্তি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এক্ষেত্রে গ্রাহকদের প্রথম কাজ হওয়া উচিত পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করা। সবার আগে পাসওয়ার্ড পরিবর্তন করতে হবে। তবে পাসওয়ার্ড সবসময়ে যেমন ছোট-বড় অক্ষর এবং সংখ্যার সমন্বয়ে লম্বা হওয়া উচিত, তেমনি টু ফ্যাক্টর অথেনটিকেশন থাকা উচিত। ফলে কেউ পাসওয়ার্ড পেলেও দ্বিতীয় মাধ্যম থেকে নিশ্চয়তা না পেলে হ্যাকাররা কিছু করতে পারবে না। উন্নত দেশগুলোয় এ ধরনের সেবা নিয়ে ক্ষতির শিকার হলে ওই প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে মামলা করার সুযোগ থাকে। বাংলাদেশে সেটা তেমন দেখা যায় না।


আমাদের দায়িত্বশীলতা ও ডিজিটাল রূপান্তর 


সামাজিক ও ব্যবসায়িক ক্ষেত্রে যখনই কোনো বিঘ্নকারী শক্তি আঘাত করে, তখনই প্রভূত রূপান্তরের সুযোগ এসে যায়। করোনাকালে বিশ্বব্যাপী বাড়তে থাকা স্বাস্থ্যঝুঁকির কারণে যে ব্যবসাগুলো তাদের কার্যক্রম কমাতে বাধ্য হয়েছিল, তারা দ্রুত বুঝতে পেরেছিল যে তাদের উৎপাদনশীলতার একটি গ্রহণযোগ্য স্তর ফিরিয়ে আনতে ডিজিটাল সরঞ্জাম এবং প্রযুক্তি অপরিহার্য ভূমিকা পালন করতে পারে।


তার ফলস্বরূপ, যোগাযোগমূলক প্রযুক্তিগুলো অতিমারীর প্রথম থেকেই ব্যবসায়িক কার্যক্রম অব্যাহত রাখতে এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করতে শুরু করে। ডিজিটাল অবকাঠামোর গুরুত্বও তুলনামূলক অনেকটা বেড়ে গিয়েছে। সাথে সাথে বেড়েছে যোগাযোগমূলক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানগুলোর ব্যবসা। অন্যান্য ক্ষেত্রের ব্যবসাগুলোও ধীরে ধীরে নতুন পরিস্থিতির সাথে খাপ খাইয়ে নিতে শুরু করে এবং অতিমারী চলাকালীন কার্যকর থাকার উপায় নির্ধারণ করে নেয়। প্রয়োজনীয় ডিজিটাল অবকাঠামোর অনুপস্থিতিতে যারা উল্লেখযোগ্যভাবে পিছিয়ে ছিল, সেই সংস্থাগুলোও দ্রুত ডিজিটাল রূপান্তরের পদক্ষেপ নেয়। যে ব্যবসায়িক সংস্থাগুলো এরই মধ্যে ডিজিটাল রূপান্তরের যাত্রা শুরু করেছে, তারা এক কার্যকর স্থিতিস্থাপকতা প্রদর্শন করতে সক্ষম হয়েছে। সাথে সাথে তাদের ব্যবসায়িক সাফল্যও পরিলক্ষিত হচ্ছে। বিশেষ করে বিগটেক বা অতিবৃহৎ প্রযুক্তিশীল সংস্থাগুলোর সাফল্যে অন্যান্য প্রযুক্তিনির্ভর সংস্থার মধ্যেও এক আশার সঞ্চার হয়েছে।


ডিজিটাল রূপান্তরের বিভিন্ন পর্যায়ে সংস্থাগুলো বিভিন্ন ঝুঁকির সম্মুখীন হয়, যার মধ্যে একটি হলো সাইবার আক্রমণের ঝুঁকি। সম্প্রতি একটি সমীক্ষানুসারে পৃথিবীর বেশির ভাগ সংস্থার পরিচালকরা সাইবার আক্রমণের ক্রমবর্ধমান ঝুঁকিতে বিশেষভাবে উদ্বেগ প্রকাশ করেন। প্রসঙ্গত, এ সমীক্ষায় ১০০ দেশের ৫ হাজার ৫০ জন প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা অংশগ্রহণ করেছিলেন। প্রায় ছয় বছর আগে সংঘটিত এক সুবিশাল সাইবার হামলার পর বাংলাদেশের বিভিন্ন সংস্থাগুলোও তাদের সুরক্ষামূলক অবকাঠামো উন্নয়নের ওপর বিশেষ গুরুত্ব দিচ্ছে। বিশ্বব্যাপী স্বীকৃত নিরাপত্তা মান গ্রহণ এবং বাস্তবায়নের মাধ্যমে ব্যবসায়িক পদ্ধতির নিরাপদ উপায় অবলম্বন ও অনুশীলনের ক্ষেত্রে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি হয়েছে।


সাথে সাথে এটাও খেয়াল রাখতে হবে, অতিমারী-পরবর্তী সাইবার অপরাধীরা তাদের আক্রমণের কৌশলে উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এনেছে। তাই সাইবার নিরাপত্তা ক্ষেত্রে পেশাদার নিরাপত্তা প্রদানকারী এবং সাইবার অপরাধীরা আগামী বছরগুলোয় একে অন্যকে পরাস্ত করার প্রয়াস চালিয়ে যাবে। ব্যবসায়িক নেতাদের অবশ্যই এক দীর্ঘমেয়াদি সাইবার নিরাপত্তা পরিকল্পনা অবলম্বন করে ব্যবসা বৃদ্ধির পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে। এটি লক্ষণীয়, অতিমারীর প্রভাবে প্রবীণ নাগরিকসহ অনেক সাধারণ মানুষ অপরিহার্য পরিষেবাগুলো গ্রহণে ডিজিটাল উপায় ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছে। এটি সাধারণ মানুষের ডিজিটাল সাক্ষরতার উল্লেখযোগ্য উন্নতি সাধন ঘটিয়েছে। যদিও সাধারণ জনগণের মধ্যে সাইবার নিরাপত্তা বিষয়ে সচেতনতার আশানুরূপ বিকাশ হয়নি। এটি একটি বিশেষ উদ্বেগের কারণ। ফলে দেশের জনসংখ্যার একটি বড় অংশ এখন ডিজিটাল লেনদেনে নিয়মিত অংশগ্রহণ করে ক্রমবর্ধমান সাইবার ঝুঁকির সম্মুখীন হচ্ছে।


এক্ষেত্রে ব্যবসা প্রতিষ্ঠানগুলোর নেতাদের ডিজিটাল রূপান্তরের পথে এক দায়িত্বশীল দৃষ্টিভঙ্গি নিয়ে পথ দেখাতে হবে। ব্যবসাকে গতিশীল করার জন্য তাদের কর্মী বাহিনীকে কেবল আধুনিক ডিজিটাল দক্ষতায় প্রশিক্ষিত ও পরিশীলিত করলেই হবে না, তাদের সাইবার নিরাপত্তার বিষয়েও সচেতনতা বাড়াতে হবে, তবেই সংস্থাগুলোর সার্বিকভাবে সাইবার ঝুঁকি কমানো সম্ভব হবে। সাথে সাথে সব গ্রাহক, বিনিয়োগকারী ও নিয়ন্ত্রক সংস্থার কর্তাদের সাইবার নিরাপত্তা সচেতনতা বিকাশে কার্যকর ভূমিকা পালন করতে হবে। একই সাথে সরকারকেও দায়িত্বশীল ডিজিটাল রূপান্তরের প্রতি মনোযোগ দিতে হবে। নাগরিক সেবা প্রদানের ডিজিটাল পদ্ধতির প্রসার যখন দেশকে আরো উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাবে, তখন সাধারণ নাগরিকদের মধ্যে ডিজিটাল নিরাপত্তা এবং সাইবার নিরাপত্তা সম্পর্কে সচেতনতা গড়ে তোলার জন্য নিয়ন্ত্রক সংস্থাকে আরো বিশেষ মনোযোগ দিতে হবে।


বিশ্বব্যাপী সাংগঠনিক ডিজিটাল রূপান্তরের দ্রুত অগ্রগতি তথ্য বিকৃতির ঝুঁকিকে উল্লেখযোগ্যভাবে বাড়িয়ে দিয়েছে। ভুল তথ্যের বিস্তার ব্যবসার পাশাপাশি জনস্বাস্থ্যকে উল্লেখযোগ্যভাবে প্রভাবিত করে। এ ক্রমবর্ধমান তথ্যনির্ভরতার যুগে ডিজিটাল সামাজিক মাধ্যমগুলো এবং আনুষঙ্গিক ডিজিটাল প্রযুক্তিগুলো দ্বারা তথ্যবিকৃতি অনেক ক্ষেত্রেই গুরুতর সংকট তৈরি করতে পারে। তথ্য প্রচার কার্যক্রম পরিচালনার জন্য দায়িত্বপ্রাপ্ত নেতাদের অবশ্যই নিশ্চিত করতে হবে যে, তাদের নাগরিকরা তাদের দৈনন্দিন জীবনকে উন্নত করার জন্য সবচেয়ে কার্যকর উপায়ে বিশ্বস্ত সূত্রের মাধ্যমে অবিকৃত ও ব্যবহারযোগ্য তথ্যের জোগান পায়।


দায়িত্বশীল ডিজিটাল রূপান্তরকে জলবায়ুবান্ধব রূপান্তরে পরিণত করার দিকেও মনোনিবেশ করতে হবে। ব্যবসা ক্ষেত্রের নেতাদের খেয়াল রাখতে হবে, যাতে তাদের ডিজিটাল রূপান্তরের পরিকল্পনায় কার্বন ফুটপ্রিন্টের মতো জলবায়ুমূলক পরিমিতিগুলোর দিকে নজর রাখা হয় এবং তা কার্যকররূপে সম্পাদন করা হয়।


পরিশেষে, দায়িত্বশীল ডিজিটাল রূপান্তরের মাধ্যমে নাগরিকদের মধ্যে ডিজিটাল বিভাজন হ্রাস এবং ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক বৈষম্য মোকাবেলার দিকেও মনোযোগ দেয়া উচিত। অতিমারী-পরবর্তী অর্থনৈতিক পুনরুদ্ধার যাত্রায় প্রযুক্তি-নেতৃত্বাধীন কৌশল এক উল্লেখযোগ্য ভূমিকা পালন করছে। ক্ষেত্রবিশেষে ব্যবসায়িক ও সরকারি সংস্থাগুলোর নেতাদের তাদের নিজ নিজ ডিজিটাল রূপান্তরের পরিকল্পনা পরিচালনা করার সময় এ বিভাজন নিরসনের দিকেও মনোনিবেশ করতে হবে।


তরুণরাই সবচেয়ে বেশি সাইবার ঝুঁকিতে 


আপনার সম্পত্তি যেমন অন্য কারো ভোগদখল করার অধিকার নেই, তেমনি ভার্চুয়াল জগতে আপনার অধিকারের ওপর যেকোনো আঘাতই সাইবার অপরাধ। সাইবার স্পেস বা সাইবার জগতে অনেক ধরনের অপরাধ হয়। এর মধ্যে হ্যাকিং শব্দটার সাথে আমরা সবচেয়ে বেশি পরিচিত। এছাড়া তথ্য চুরি, অনুমতি ছাড়া ছবি কিংবা তথ্য ব্যবহার করে হেনস্তা করার চেষ্টা, ইমেইল বম্বিং অর্থাৎ অপ্রয়োজনীয় ইমেইল পাঠিয়ে অ্যাকাউন্ট ব্লক করে দেয়াও এক ধরনের অপরাধ। আরেক ধরনের অপরাধ আছে সাইবার বুলিং। ব্ল্যাকমেইল তো নিত্যদিনের ঘটনা। এছাড়া পর্নোগ্রাফি সাইবার জগতের আরেকটি বড় ধরনের অপরাধ।


সাইবার অপরাধ আদালতে প্রমাণ করা খুবই কষ্টসাধ্য। এরপরও কিছু সমস্যা আছে। যেমন বাংলাদেশ ব্যাংকের একটি আইনের দোহাই দিয়ে মোবাইল অপারেটর কোম্পানিগুলো আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে তথ্য দিতে চায় না। এছাড়া ঢাকা মহানগর পুলিশের সাইবার ক্রাইম ইউনিট ছাড়া অন্য সংস্থাগুলো এ ধরনের কাজে খুব একটা দক্ষ নয়। বিশেষ করে রাজধানীর বাইরের পুলিশ। তাদের কাছে দরকারি হার্ডওয়্যারসংশ্লিষ্ট জিনিসপত্রও থাকে না। এছাড়া অনেকেই মানসম্মানের ভয়ে কিংবা অন্য কোনো কারণে সামনে আসে না। এ কারণে অনেক অপরাধের কথা আড়ালেই থেকে যায়। সাইবার ক্রাইম মূলত তিন ধরনের প্ল্যাটফর্মে হয়ে থাকে। রাষ্ট্রীয় অর্থাৎ রাষ্ট্রের বিভিন্ন বিষয়ের ওপর আঘাত, ব্যক্তিগত এবং অর্থনৈতিক বিষয়-সংশ্লিষ্ট অপরাধ। এর মধ্যে ব্যক্তিগত বিষয়ের ওপরই অধিক আঘাত হয়। আর বাংলাদেশেও এ ধরনের অপরাধের ঝুঁকি বেশি।


আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপটে ‘ব্যক্তিগত’ পর্যায়ের সাইবার অপরাধের পরিমাণ শতকরা ৭০ ভাগ, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট তা ৬০ ভাগ। তবে আশার কথা, ২০১০ সালেও বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে এর পরিমাণ ছিল ৯০ ভাগ। অর্থাৎ সবার সহযোগিতা এবং সচেতনতায় অপরাধের সংখ্যা কমে এসেছে। এই কৃতিত্বের অন্যতম দাবিদার ঢাকা মহানগর পুলিশের ‘সাইবার ক্রাইম ইউনিট’-এর।


বাংলাদেশে ইতোমধ্যে রাষ্ট্রীয় পর্যায়ের সাইবার ক্রাইম হতে দেখা গেছে। সরকারি সংস্থার বিভিন্ন ওয়েবসাইট হ্যাক হওয়া ছাড়া আরও বড় বড় কিছু বিষয়ের কথা আমরা জানি। এসব ঘটনার পর সংশ্লিষ্ট সবাই নড়েচড়ে বসে। তবে এখনো সাইবার অপরাধ মোকাবেলায় আমাদের প্রতিরোধ ব্যবস্থা অপ্রতুল। আরও বড় ধরনের কোনো আঘাত আসার আগেই পর্যাপ্ত প্রতিরোধ ব্যবস্থা গড়ে তোলা উচিত। তবে একটা বিষয় মনে রাখতে হবে, সাইবার জগতে শতভাগ ‘ নিরাপদ ব্যবস্থা’ বলে কিছু নেই। সব ধরনের পূর্ব প্রস্তুতির পরেও আঘাত হানা সম্ভব। আমাদের যে বিষয়ে প্রস্তুত হতে হবে, তা হলো এ ধরনের কোনো হামলার শিকার পরবর্তী ব্যবস্থা নিতে যেন আমাদের সিদ্ধান্তহীনতা এবং কালক্ষেপণে ভুগতে না হয়।


শুধু ই-কমার্স সেক্টরেই নয়, অনলাইনে যেকোনো ধরনের আর্থিক লেনদেনে বাংলাদেশ খুবই ঝুঁকির মধ্যে আছে। বিশেষত, অনলাইন ব্যাংকিংয়ে আন্তঃব্যাংকিং খুবই ঝুঁকিতে আছে। যে ধরনের ‘ফায়ারওয়াল’ বা নিরাপত্তা বেষ্টনী এখন আছে, তা যথেষ্ট নয়। বিশেষ করে মোবাইল ব্যাংকিং খাতে আমরা প্রচুর ঝুঁকিতে আছি। আমরা কিন্তু মোবাইল ব্যাংকিংয়ের মাধ্যমে অনেক লেনদেন করি। পুরো ব্যবস্থাটাই কিন্তু ঝুঁকির মুখে আছে। সবচেয়ে বিপজ্জনক এবং ভয়ংকর সেক্টর এটাই।


ওয়ান টাইম পাসওয়ার্ড বা ওটিপি হচ্ছে আপনি যখন কোনো লেনদেনের জন্য অনুরোধ করেন, তখন আপনার মোবাইলে বা ইমেইলে একটি অস্থায়ী পাসওয়ার্ড আসে। ওই নির্দিষ্ট লেনদেনের জন্যই পাসওয়ার্ডটি প্রযোজ্য। খুব অল্প সময়ের জন্য পাসওয়ার্ডটি সচল থাকে। নিঃসন্দেহে এটি দ্বিস্তর নিরাপত্তা ব্যবস্থায় ভালো একটি সিস্টেম। তবে আমাদের কাছে অনেক উদাহরণ আছে, এই ব্যবস্থাটাকেও নিয়ন্ত্রণ করতে পারে হ্যাকাররা। এর কারণ হচ্ছে, যে সার্ভার থেকে এই ওটিপি  তৈরি করা হয় তা তৃতীয় পক্ষের। এ কারণে সেখানকার নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েও শঙ্কা থেকে যায়। অনেক ক্ষেত্রেই হ্যাকাররা ওই সার্ভারটিকেও হ্যাক করে থাকে।


সাইবার জগতটা খুবই বড়, আবার ছোটও। এখানে যেকোনো কিছু খুব দ্রুত ছড়িয়ে পড়ে। যে কারণে অপরাধ সংঘটনের পর ব্যবস্থা নিতে নিতে ক্ষতি যা হওয়ার হয়ে যায়। সাইবার জগতে আমরা সচেতনতার সাথে বিচরণ করি। এ বিষয়ে পর্যাপ্ত নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং সর্বোচ্চ সতর্কতা থাকা উচিত। প্রতিদিন আপনার অ্যাকাউন্টে কী কী কাজ হচ্ছে অর্থাৎ ‘অ্যাক্টিভিটি লগ’ এসবের দিকে নজর দিতে হবে। সন্দেহজনক কিছু পেলে দ্রুত ব্যবস্থা নিতে হবে। ফেসবুকের ক্ষেত্রে অনেকেই অ্যান্টিভাইরাস ব্যবহার করি না। এটা উচিত নয়। বাজারে ভালো ভালো অ্যান্টিভাইরাস পাওয়া যায়। মোবাইলে এবং কমপিউটারের জন্য এগুলো ব্যবহার করা উচিত।


অন্যদিকে আমরা এখন চারপাশে ‘ফ্রি ওয়াইফাই’ খুঁজি। ফ্রি ওয়াইফাইয়ের সুযোগ নিয়ে আমরা অনেক সংবেদনশীল কর্মকাণ্ড অনলাইনে করে থাকি। কিন্তু আমরা ভুলে যাই, এসব পাবলিক ওয়াইফাই আমাদের গোপনীয়তার জন্য মারাত্মক হুমকি। সাইবার হামলার শিকার হলে অনেকেই তা প্রকাশ করেন না। শুধু ব্যক্তিপর্যায়ে নয়; প্রাতিষ্ঠানিক পর্যায়েও অনেকেই হামলার কথা প্রকাশ বা স্বীকার করে না। কিন্তু এ কথা স্বীকার করা উচিত। সাইবার আক্রমণের কথা স্বীকার করলে আক্রান্ত প্রতিষ্ঠানের যে দুর্বলতার কারণে ঘটনাটি ঘটেছে, অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো সেই দুর্বলতার বিষয়ে আগেভাগেই সচেতন হতে পারে।


আমরা অনেকেই অসচেতনভাবে সাইবার হামলার ঝুঁকিতে পড়ছি। আমাদের প্রতিদিনের কর্মকাণ্ডের ছবি ও তথ্য ফেসবুকে দিচ্ছি। এর ফলে একজন হ্যাকার বা অপরাধীর জন্য অপরাধ সংঘটন খুবই সহজ হয়ে যাচ্ছে। আমরা নিজেদের অজান্তেই ব্যক্তিগত তথ্য শেয়ার করে থাকি। 


স্মার্টফোনের মাধ্যমে হ্যাকিং হচ্ছে আরও বেশি। এমনকি এমন অপরাধও হচ্ছে যেখানে জানেনই না আপনার স্মার্টফোনের ক্যামেরা আরেকজন ব্যবহার করছে। ফোনের মাইক্রোফোনের মাধ্যমে আপনি কাদের সাথে কী কথা বলছেন, তাও দূরে বসে কেউ একজন শুনছেন। আসলে আমরা স্মার্টফোনে কিছু থার্ড পার্টি সফটওয়্যার ব্যবহার করি। এগুলোতে অনেক সময় আপনার ফোনের গ্যালারি, মেসেজ, মাইক্রোফোন ইত্যাদিতে প্রবেশের অনুমতি দিয়ে সেই অ্যাপসটি ব্যবহার করতে হয়। আর সমস্যার শুরু হয় সেখান থেকেই। এছাড়া আমরা স্মার্টফোনে অ্যান্টিভাইরাস ব্যবহার করি না। এটা একেবারেই উচিত নয়। 


আসলে হ্যাকিং যে উদ্দেশ্যেই করা হোক না কেন, তা অবৈধ। তবে এটাও ঠিক, হ্যাকিং প্রতিরোধ সম্ভব হ্যাকার দিয়েই। অনেকটা কাঁটা দিয়ে কাঁটা তোলার মতো। এটা ঠিক যে, অনেক দেশেই রাষ্ট্রীয়ভাবে হ্যাকারদের পৃষ্ঠপোষকতা করা হয়। রাষ্ট্রীয় সাইবার কর্মকাণ্ডে হ্যাকারদের সম্পৃক্ত করা হয়। গুগল, ফেসবুকের মতো নামিদামি প্রতিষ্ঠানগুলো হ্যাকারদের নিয়ে মাঝে মাঝেই বিভিন্ন কর্মকাণ্ড করে থাকে। তবে তারা এথিক্যাল হ্যাকার। আমাদের দেশে এ প্রচলনটা এখনও সেভাবে চালু হয়নি। তবে কিছু সংস্থা এখন তাদের নিয়ে কাজ করছে। অনেকেই আবার সরকারি পৃষ্ঠপোষকতার আওতায় আসতে চান না। তবে তাদের জন্যও বন্ধুসুলভ পরিবেশ তৈরির কাজ চলছে। 


ইন্টারনেট অবশ্যই আমাদের দরকার। তবে সাধারণভাবে আমরা ইন্টারনেট সম্পর্কে যতটুকু দেখি বা জানি বাস্তবে এর চিত্র আরও ভয়াবহ। ইন্টারনেটের ‘অন্ধকার’ জগতটা আমাদের ধারণার চেয়েও বড়। প্রতিটি জিনিসের যেমন ভালো আর মন্দ আছে, ইন্টারনেটেরও তেমনি আছে। তাই ইন্টারনেট ব্যবহারে সতর্ক হোন, সচেতন হোন। আর যতটুকু প্রয়োজন আমরা যেন ততটুকুই ইন্টারনেট ব্যবহার করি। ততটুকু সময়ই যেন এর পেছনে ব্যয় করি। আমাদের উচিত অবসর সময়টুকু পরিবার-পরিজনদের দেয়া। আমরা আসলে বাস্তবিক জীবনে একাকী থাকলেই ইন্টারনেটের দিকে ঝুঁকে যাই। তাই আমাদের উচিত পরিবার-স্বজনকে পর্যাপ্ত সময় দেয়া। এতে করে যেমন সামাজিক বন্ধন দৃঢ় হবে, তেমনি সামাজিক অবক্ষয়ও কমবে।


সাইবার জগতে বিচরণ কীভাবে নিরাপদ রাখা যায়


আমরা সবাই একবিংশ শতাব্দীতে বাস করছি এই সত্যটিকে বিবেচনায় রাখলে একজন যুবক বা যুব নারী ইন্টারনেট ব্যবহার করে না, তা কারও পক্ষে বিশ্বাস করা অসম্ভব। আমাদের প্রত্যেকের অন্তত একটি সামান্য সামাজিক মিডিয়া, হোক সেটা ফেসবুক বা টুইটার বা ইমো এর উপস্থিতি আছে! যাই হোক, একটি জিনিস যা আমাদের তাড়িত করে তা হচ্ছে সাইবার জগতে কীভাবে নিরাপদ থাকা যায় তা এখানে আলোচিত হচ্ছে। আপনার নামের মতো সহজ, স্পষ্ট এবং অলসভাবে তৈরি করা পাসওয়ার্ড ব্যবহার করবেন না। চ্যালেঞ্জিং পাসওয়ার্ডগুলো ব্যবহার করুন যা শুধুমাত্র আপনি জেনে থাকতে পারেন। অনুমান করা আরও কঠিন করার লক্ষ্যে আপনার পাসওয়ার্ডে সংখ্যা, স্পেস এবং চিহ্ন যোগ করুন। আপনার পাসওয়ার্ডগুলো কখনই কাগজে লিখবেন না, কারণ কেউ সেগুলো জেনে ফেলতে পারে। এখন বেশ কিছু পাসওয়ার্ড ম্যানেজার, পাসওয়ার্ড জেনারেটর আর পাসওয়ার্ড পরামর্শদাতা সফটওয়্যার পাওয়া যায়। পাসওয়ার্ড একটি উপযুক্ত দৈর্ঘ্যরে হওয়া উচিত, খুব ছোট বা খুব দীর্ঘ নয়; বেশিরভাগ ওয়েবসাইট আপনাকে উপযুক্ত পরিসর বলে। আপনার পাসওয়ার্ড নিয়মিত পরিবর্তন করুন এবং সেগুলোকে আপডেটেড রাখুন। মনে রাখবেন যে পাসওয়ার্ডগুলো অত্যন্ত ব্যক্তিগত এবং সংবেদনশীল বিষয় এবং তাই অত্যন্ত গোপনীয় হওয়া উচিত। 


সাইনআপ করার আগে যেকোনো অজানা বা অপরিচিত ওয়েবসাইটের এই বিভাগটি মনোযোগ সহকারে পড়তে খেয়াল রাখবেন। একটি অ্যাকাউন্ট তৈরি করা বা তথ্য দেওয়া বাস্তব জীবনে একটি চুক্তির মতো, এবং আপনি যদি না দেখেই তা করতে সম্মত হন, তাহলে সম্ভাবনা বেশি যে আপনি সম্ভবত সাইটটিতে আপনার ইচ্ছের চেয়ে বেশি অধিকার এবং তথ্য প্রদান করেছেন বা করতে যাচ্ছেন। আপনার ল্যাপটপ বা অন্য কোনো ইলেকট্রনিক ডিভাইসে কোনো সফটওয়্যার ইনস্টল করার আগে শর্তাবলী পরীক্ষা করুন এবং দু’বার চেক করুন, যেগুলো সাধারণত সংক্ষিপ্ত হয়, কারণ এগুলো কখনও কখনও অনেক বেশি অনুমতি চায় এবং আমাদের অধিকাংশ মানুষই সেগুলোর অনুমতি প্রদান করে; পরবর্তীতে আমাদের মাঝে কেউ কেউ অনুশোচনা করে ভুল বুঝতে পেরে! সুতরাং, শর্টকাট নেওয়ার চেষ্টা করবেন না; মনে রাখবেন যে ইন্টারনেট শিশুদের খেলা নয়। এটা বাস্তব জীবন; এখানে একটি ছোট ভুল আপনাকে পরে হতাশ করতে পারে। ইন্টারনেটে যেটা একবার যায়, সেটা শত মুছলেও  কোথাও না কোথাও থাকবেই।


অ্যান্টিভাইরাস প্রোগ্রামগুলো ভাইরাসগুলোর জন্য আপনার কমপিউটার স্ক্যান করে এবং সেগুলো সরিয়ে দেয়। আপনার একটি ভালো অ্যান্টিভাইরাস প্রোগ্রাম ব্যবহার নিশ্চিত করুন ফোন এবং কমপিউটার সব ধরনের ডিভাইসে। ভাইরাস হলো দুষ্টু প্রোগ্রাম, যা আপনার সিস্টেমে প্রবেশ করার পরে ক্ষতি করতে পারে এবং এমনকি আপনার হার্ডডিস্কের সম্পূর্ণ বিষয়বস্তু মুছে ফেলতে পারে। যদিও এটা করা বেআইনি, অনেক মানুষ ইচ্ছাকৃতভাবে কারো সিস্টেমে ভাইরাস সংযুক্ত করতে পারে। ভাইরাসগুলো সেকেন্ডের মধ্যে আপনার সিস্টেমকে ক্র্যাকডাউন করতে পারে এবং উল্লেখযোগ্য ডাটা সংগ্রহ করতে পারে। এমনকি এটি একটি স্থানীয় ডিস্কে সংরক্ষিত আপনার প্রথম প্রেমের চিঠিও সংগ্রহ করতে পারে, আর একবার যদি খারাপ উদ্দেশ্যের মানুষের হাতে পড়ে, তাহলে কী হতে পারে বুঝতেই তো পারছেন!


বেশিরভাগ তরুণ-তরুণী জানেন না যে সবাইকে বিশ্বাস করা যায় না; এটি ইন্টারনেটের একটি প্রধান অপূর্ণতা। অনলাইনে কোনো অজানা ব্যক্তিকে কখনই পুরোপুরি বিশ্বাস করবেন না বা তাদের কাছে ব্যক্তিগত তথ্য প্রকাশ করবেন না, কারণ এটা ভয়ঙ্কর বিপজ্জনক হতে পারে। এই ধরনের অনেক লোক প্রতারক, সাইবারবুলিং এবং ইন্টারনেট অপরাধী হিসেবে বারবার প্রমাণিত হয়েছেন। এরা আপনার এবং আমার মতো নিরপরাধ লোকেদের হাতে পেতে অপেক্ষা করছে! আপনি আপনার ফোন বা কমপিউটারের ব্রাউজারে কোন ওয়েবসাইটের কোন লিংকে আছেন, এটি একটি ভ্যালিড বা যুক্তিসঙ্গত লিংক কিনা যাচাই করুন, পারলে লিংকটাতে ঢুকবার আগে যাচাই করুন। ব্রাউজার ও লিংকের ব্যবহার ভালো জানা না থাকলে জেনে নিন।


সোশ্যাল মিডিয়ার ব্যবহার দ্রুত বৃদ্ধির সাথে সাথে আপনাকে ইন্টারনেটে আপনার জীবনের সব ধরনের মানুষের সাথে নিজেকে সংযুক্ত করতে হয়। এর মানে হলো আপনার শিক্ষক এবং আপনার অফিসের বস থেকে শুরু করে আপনার বন্ধু এবং পরিবারের সবাই আপনার সাথে অনলাইনে দ্রুত যোগাযোগ করতে সক্ষম। অনেক সময় কিছু নির্দিষ্ট সোশ্যাল মিডিয়া সাইটে কিছু গোপনীয়তা সেটিংস, আপনি নির্দিষ্ট লোকেদের দেখাতে চান এমন পোস্ট এবং তথ্য বাছাই করা কঠিন হয়ে পড়ে। বিভিন্ন উদ্দেশ্যে পৃথক অ্যাকাউন্ট ব্যবহার করুন যাতে আপনার অ্যাকাউন্ট এবং ডাটা পরিচালনা করা আপনার পক্ষে সহজ হয়। 


বেশিরভাগ ওয়েবসাইট আপনাকে নির্দিষ্ট সামগ্রীতে অ্যাক্সেস বা প্রবেশাধিকার সীমাবদ্ধ করার অপশন সরবরাহ করে। এর মানে, আপনি কিছু নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা সাধারণভাবে জনসাধারণের কাছ থেকে আপনার ডিজিটাল পণ্য, পোস্ট ইত্যাদি আড়াল করতে পারেন এর মাধ্যমে। আপনার গোপনীয়তা বাড়ানোর জন্য এবং নিরাপদ থাকার জন্য আপনাকে সেই অপশনগুলোর সর্বোত্তম ব্যবহার করা উচিত। আপনার বা আপনার ভাইবোনদের একজনের সহপাঠীদের মধ্যে একজন, যে কিনা আপনাকে বা তাকে অফলাইনে বা অনলাইনে বুলিং করছে, যদি আপনার পোস্টকৃত একটি টুইট খুঁজে পায়, যা আপনি বা আপনারা চান না সে জানুক, তবে এটি খুব ভালো হবে না। 


এটা এখন অজানা নয় যে বেশিরভাগ সার্চ ইঞ্জিন বা ব্রাউজিং প্রোডাক্ট এমনকি গুগলের প্রোডাক্টগুলোও আপনাকে ট্র্যাক করে এবং আপনার তথ্য ব্যবহার করে। এমনকি এর অনুমতি আপনি নিজেই ওদেরকে দিয়ে থাকেন। কোনো কিছু জানতে হলে বা কোনো ওয়েবসাইটে যেতে হলে ডিফল্ট ব্রাউজার হিসেবে একটি নিরাপদ ব্রাউজার এবং একটি নিরাপদ সার্চ ইঞ্জিন ব্যবহার করুন। 


সাইবারে আইনই শেষ কথা নয়, নিজেদের দায়িত্ব নিতে হবে


প্রচলিত ভাবনার ক্ষেত্রে স্থান-কাল-পাত্রভেদে এথিক্স বা নৈতিকতার পরিবর্তন হতে দেখা গেলেও সাইবার স্পেস বা নেটিকেটের ক্ষেত্রে এই এথিক্স স্থান-কাল-পাত্রভেদে আলাদা হবে নাকি এক ধরনের প্যান-এথিক্যাল স্ট্যান্ডার্ড থাকবে, তা বিতর্কের বিষয়। পুরো পৃথিবীর সাথে তাল রেখে সাইবার জগতে বিচরণ বাংলাদেশের নাগরিকদের জন্যও এক নিয়মিত বাস্তবতায় পরিণত হয়েছে। তা ছাড়া চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যে দ্বারপ্রান্তে আমরা দাঁড়িয়ে আছি, উন্নত অনেক দেশই ইতিমধ্যে এই বিপ্লবকাল অতিক্রম করছে, সেই শিল্পবিপ্লবকে দ্বিতীয় তথ্যবিপ্লব হিসেবে আখ্যা দেয়ার ফলে আধুনিক তথ্যপ্রযুক্তি যে আমাদের জীবনকে অনেকাংশেই নিয়ন্ত্রণ করছে বা করবে তা একপ্রকার নিশ্চিত। এমনকি বহুদিন আগেই বিজ্ঞাপনের বাজার সরে গিয়েছে ভার্চুয়াল প্ল্যাটফর্মে, ফলে মূলধারার গণমাধ্যমগুলো বাধ্য হয়েছে অনলাইনে সরে আসতে কিংবা কোনো না কোনোভাবে প্রচলিত পদ্ধতির সাথে তাদের অনলাইন কার্যক্রমেও আসতেই হয়েছে। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে চলমান করোনা মহামারীর সময় ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা রেকর্ডসংখ্যক বৃদ্ধির তথ্য গত বছরই সংবাদে পরিণত হয়েছে।


বিবেচনায় আনা জরুরি যে বর্তমান সময়ে তথ্যকেই শক্তি হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে এবং তথ্যের দখল নিয়ে আন্তর্জাতিক পরিসরে নানা ধরনের দ্বন্দ্বের উদ্ভব শুনতে অদ্ভুত শোনালেও একেবারেই অসম্ভব নয়, বরং এরই এক সংস্করণ সাইবারযুদ্ধের সাথে আমরা নানা সময় পরিচিত হয়েছি। বর্তমান তথ্য ও এর গুরুত্ব নিয়ে এতগুলো কথা বলার মূল কারণই হলো তথ্যের প্রকৃত সম্ভাবনা ও এর সাথে আমাদের বসবাসের অবশ্যম্ভাবিতাকে উপলব্ধিতে সহায়তা করা। মজার বিষয় হলো, তথ্যের গুরুত্ব উপলব্ধি করার জন্য এখানে তথ্য সম্পর্কেই অনেকগুলো তথ্য দিতে হলো, এতেই হয়তো তথ্যের গুরুত্ব সম্পর্কে ভালো একটা ধারণা পাওয়া সম্ভব হয়ে যায়।


লেখার শুরুতেই বলা হয়েছিল, সাইবার জগতে বিচরণ আমাদের দেশের নাগরিকদের জন্যও এখন এক বাস্তবতা ও নিত্যদিনের চর্চা। মূলত, গত দশকের শেষ দিকে সরকারি পর্যায়ের নীতিগত সিদ্ধান্ত ও তার ফলে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে বিভিন্ন কার্যক্রম হাতে নেয়ায় দেশের ভেতর ইন্টারনেটের ব্যবহার ব্যাপক হারে বৃদ্ধি পায়। যদিও দেশের ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর যে সংখ্যা বিটিআরসি প্রকাশ করে তা সঠিক, তারপরও কিন্তু ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা যে উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে, তা নিশ্চিত।


অন্যদিকে এটিও সত্য, ইন্টারনেটের প্রকৃত ক্ষমতা বা সম্ভাবনা ব্যবহারের ক্ষেত্রে আমাদের দেশের মানুষ খুব এগোতে পারেনি। আপামর জনসাধারণের ইন্টারনেট ব্যবহার মূলত সামাজিক যোগাযোগের বিভিন্ন মাধ্যম ও বিনোদন মাধ্যমগুলো ব্যবহারের ভেতরই সীমাবদ্ধ। যদিও ক্রিটিক্যালি বিবেচনার ক্ষেত্রে এটিও সত্য, সারা পৃথিবীতেই সাধারণ মানুষের ইন্টারনেট ব্যবহার মোটাদাগে এসব ক্ষেত্রেই সীমাবদ্ধ। তবে ইন্টারনেট ব্যবহারের কারণ যা-ই হোক না কেন, সাইবার স্পেসে এথিক্স বা নৈতিকতার চর্চা এই সময়ে ও অদূর ভবিষ্যতের জন্য এক চিন্তার ক্ষেত্র হয়ে উঠছে নিশ্চিতভাবেই। প্রচলিত ভাবনার ক্ষেত্রে স্থান-কাল-পাত্রভেদে এথিক্স বা নৈতিকতার পরিবর্তন হতে দেখা গেলেও সাইবার স্পেস বা নেটিকেটের ক্ষেত্রে এই এথিক্স স্থান-কাল-পাত্রভেদে আলাদা হবে নাকি এক ধরনের প্যান-এথিক্যাল স্ট্যান্ডার্ড থাকবে, তা বিতর্কের বিষয়।


বাংলাদেশের সাইবার পরিসরে এই এথিক্স বা নৈতিকতার প্রয়োজনীয়তা সাম্প্রতিক সময়গুলোতে বারবার উপলব্ধি করা গিয়েছে। আমাদের দেশের নেটিজেনদের সিংহভাগের সাইবার লিটারেসির দারুণ সংকট থাকায় ব্যবহারকারীদের ভেতর নেটিকেট গড়ে ওঠার বিষয়টি একেবারেই অস্তিত্বহীন। আবার নেটিজেনদের সহনশীলতা ও পরমতসহিষ্ণুতার দারুণ অভাব পরিলক্ষিত হওয়ায় খুব সহজেই সাইবার জগতে এক ধরনের ট্রায়াল হয়ে যাচ্ছে অহরহ। তা ছাড়া সাইবার জগতে গুজব, বিভ্রান্তি, অপতথ্য ও অতথ্য ছড়িয়ে দেয়ার কাজ করে অর্থ উপার্জনকেও পেশা হিসেবে নেয়ার চল রয়েছে। তা ছাড়া সাইবার বুলিং, সাইবার স্টকিং, হ্যারেসমেন্টসহ অনেক ধরনের অনৈতিক তথা অপরাধমূলক আচরণের ঘটনাও নিয়মিতভাবে সাইবার স্পেসে সংঘটিত হচ্ছে। এসব কর্মকাণ্ডের প্রকৃত সংখ্যার বিপরীতে খুব অল্পই নথিভুক্ত হয়ে থাকে।


সাইবার জগতের এসব অন্ধকার দিকের মোকাবিলা করার ক্ষেত্রে এখন পর্যন্ত আমাদের মূল পদক্ষেপগুলো মূলত বিভিন্ন ধরনের আইন ও নজরদারির ভেতর সীমাবদ্ধ। কিন্তু একদিকে এসব অপরাধ দমনে নজরদারির মতো কার্যক্রম যেমন অনুপযোগী হিসেবে ইতিমধ্যেই বিভিন্ন দেশে প্রমাণিত হয়েছে, তেমনি বিভিন্ন আইন প্রণয়নের ফলে আইনের সুফল যে খুব বেশি পাওয়া যাচ্ছে, তাও বোধহয় আত্মবিশ্বাসের সাথে বলা যায় না।


লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক


কৃতজ্ঞতা স্বীকার : সিএনএন, বিবিসি, রয়টার্স, এসোসিয়েট প্রেস, প্রথম আলো, কালের কণ্ঠ, যুগান্তর, সমকাল, দ্য ডেইলি স্টার, বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড।


ছবি : ইন্টারনেট








০ টি মন্তব্য



মতামত দিন

আপনি লগ ইন অবস্থায় নেই।
আপনার মতামতটি দেওয়ার জন্য লগ ইন করুন। যদি রেজিষ্ট্রেশন করা না থাকে প্রথমে রেজিষ্ট্রেশন করুন।







পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন? পুনরায় রিসেট করুন






রিভিউ

আপনি লগ ইন অবস্থায় নেই।
আপনার রিভিউ দেওয়ার জন্য লগ ইন করুন। যদি রেজিষ্ট্রেশন করা না থাকে প্রথমে রেজিষ্ট্রেশন করুন।