তথ্য অধিকার দিবসের এবারের প্রতিপাদ্য ছিল ‘তথ্যপ্রযুক্তির যুগে জনগণের তথ্য অধিকার নিশ্চিত হোক’। ইউনেস্কো ঘোষিত ইন্টারন্যাশনাল ডে ফর ইউনিভার্সাল অ্যাক্সেস টু ইনফরমেশন ২০২২-এর মূল প্রতিপাদ্য ছিল ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ই-গভর্ন্যান্স এবং অ্যাক্সেস টু ইনফরমেশন’। বিশ্বব্যাপী দিবসটি উদযাপন করা হয় ২৮ সেপ্টেম্বর।
এবারের আন্তর্জাতিক অনুষ্ঠানটি ২৮ ও ২৯ সেপ্টেম্বর ২০২২ উজবেকিস্তানের তাসখন্দে অনুষ্ঠিত হয়। আন্তর্জাতিক বিশেষজ্ঞদের অংশগ্রহণের সাথে তথ্যে প্রবেশাধিকার এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারের ওপর একটি আন্তঃমন্ত্রণালয় অনুষ্ঠিত বৈঠকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা, ই-গভর্ন্যান্স এবং অ্যাক্সেস টু ইনফরমেশনের বিভিন্ন দিক আলোচনায় স্থান পেয়েছে। এই অনুষ্ঠানে বিভিন্ন প্যানেল আলোচনায় তথ্যে প্রবেশাধিকার এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পটভূমি, সুবিধা এবং ঝুঁকি বিষয় ইত্যাদি মূল আলোচনার বিষয় ছিল। সুশাসনের নীতিমালার বিষয়ে অবগত এবং ক্ষমতাপ্রাপ্ত নাগরিকদের জন্য ই-গভর্ন্যান্স এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার সুযোগ ব্যবহার করা এবং এগুলোকে কাজে লাগানো যায় কিনা সে দিকগুলো নিয়ে আলোচনা করেছেন বিশেষজ্ঞরা। তথ্য অধিকার আইন এবং এর বাস্তবায়নের অগ্রগতি সম্পর্কে পর্যালোচনা করাও ছিল বৈঠকগুলোর একটি মূল উদ্দেশ্য। কার্যকর ই-গভর্ন্যান্স এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারের ওপর বিশেষ তথ্যে প্রবেশাধিকারের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক পদ্ধতির প্রচারে ই-গভর্ন্যান্স এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভূমিকা কী হতে পারে তা নিয়েও বিস্তারিত আলোচনা করা হয়েছে।
সরকারি পাবলিক ডোমেইনে তথ্যের উন্নয়ন ও প্রচারের জন্য হালনাগাদ নীতি-নির্দেশিকা উপস্থাপন করা হয়েছে। স্বচ্ছতা, নতুন উদ্ভাবন এবং ই-গভর্ন্যান্সের সমর্থনে তথ্য উন্মুক্তকরণ এগুলো ছিল আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার লক্ষ্য হলো এমন একটি বুদ্ধিমত্তাবিশিষ্ট সিস্টেম তৈরি করা যা শেখার জন্য, যুক্তি দেখিয়ে সবকিছু সহজভাবে মানিয়ে নিয়ে, মেশিনকে মানুষের মতো কাজ করার জন্য সক্ষম হিসেবে গড়ে তোলা। তথ্যপ্রযুক্তির সিস্টেমগুলো তথ্যের একটি অংশ হিসাবে সর্বোত্তম আউটপুট নিয়ে যোগাযোগ করার জন্য ডাটা ক্যাপচার, সংরক্ষণ, বিশ্লেষণ এবং মূল্যায়নের জন্য কাজ করে।
ই-গভর্ন্যান্স অ্যাপ্লিকেশনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার হয় সাধারণত মেশিন লার্নিং এবং শিক্ষার ব্যাপক ব্যবহারের মাধ্যমে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিকাশের কাঠামোগুলোর ওপর নির্মিত মডেলগুলোর দ্রুত ডেলিভারি করার জন্য সক্ষম হিসেবে গড়ে তুলতে একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। এগুলো ডাটাচালিত অন্তর্দৃষ্টি প্রদান করতে সাহায্য করে। তথ্যে প্রবেশাধিকারের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক পদ্ধতির প্রচারে ই-গভর্ন্যান্স এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে।
প্যানেল আলোচনায় ই-গভর্ন্যান্স এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভূমিকাকে সংজ্ঞায়িত করে, সেখানে তথ্যে প্রবেশাধিকারের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক পদ্ধতির প্রচারের জন্য কীভাবে তাদের মিত্র বা সহযোগী হিসেবে গড়ে তোলা যায় সে বিষয়ে কাজ করেছে সংশ্লিষ্ট প্যানেল। সমতার ভিত্তিতে তথ্যের অধিকার নিশ্চিত করতে ই-গভর্ন্যান্স এবং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ভূমিকা কী হতে পারে তা নিয়েও আলোচনা করা হয়েছে।
জনসাধারণের তথ্য অধিকার প্রতিষ্ঠা করার জন্য বিশেষ করে নারীরা যাতে ই-গভর্ন্যান্সের পরিষেবাগুলোর সম্পূর্ণ সুবিধা নিতে পারে তা নিশ্চিত করার জন্য কী আইনী বিধান করা যায় সে বিষয়েও কাজ করা হয়। কীভাবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তাকে জনসাধারণের তথ্য পাওয়ার জন্য উপযোগী হিসেবে গড়ে তোলা যায় বিশেষ করে প্রতিবন্ধী ব্যক্তিদের ক্ষমতায়নের বিশেষ উপকরণ হিসাবে ব্যবহার করা যেতে পারে সে বিষয় নিয়েও বিস্তর আলোচনা করা হয়েছে। ই-গভর্ন্যান্স পরিষেবাগুলো আউটসোর্স করার মাধ্যমে কীভাবে নাগরিকদের অধিকার নিশ্চিত করা যায় সে বিষয়ে কাজ চলছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।
সাম্প্রতিককালে ক্রমবর্ধমান হারে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার বৃদ্ধি পাচ্ছে এবং নতুন ডোমেইনে ফলাফলগুলো অত্যাধুনিকভাবে উন্নত করেছে। তবে এটি এখনও বেশ কয়েকটি চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হচ্ছে, যা ই-গভর্ন্যান্স অ্যাপ্লিকেশনগুলোতে এই মোতাবেক ই-গভর্ন্যান্স সিস্টেম এবং ই-গভর্ন্যান্স নাগরিক সমাজের মিথষ্ক্রিয়াগুলো উন্নত করার জন্য কাজ করছে, তবে কিছু কিছু ক্ষেত্রে সমস্যা হচ্ছে। ই-গভর্ন্যান্স সিস্টেমের চ্যালেঞ্জগুলো মোকাবেলা করা এবং এর একটি কাঠামোর প্রস্তাব করা যা ই-গভর্ন্যান্স পরিষেবাগুলো স্বয়ংক্রিয় এবং সহজতর করার জন্য কৃত্রিম বৃদ্ধিমত্তার প্রযুক্তিগুলো ব্যবহার করা যায় এ নিয়ে কার্যকর আলোচনা অনুষ্ঠিত হবে। বিশেষত, প্রথমে ই-গভর্ন্যান্স তথ্যসংস্থান পরিচালনার জন্য একটি কাঠামোর রূপরেখা তৈরি করা; দ্বিতীয়ত, ডিপ লার্নিং মডেলের একটি সেট তৈরি করা; যার লক্ষ্য বেশ কয়েকটি ই-গভর্ন্যান্স সংক্রান্ত পরিষেবাগুলো স্বয়ংক্রিয় করা। তৃতীয়ত, একটি স্মার্ট ই-গভর্ন্যান্স প্ল্যাটফর্ম আর্কিটেকচারের প্রস্তাব দেয়া; যা ই-গভর্ন্যান্স কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অ্যাপ্লিকেশনের উন্নয়ন ও বাস্তবায়নকে সমর্থন করবে। প্রক্রিয়াকরণের সময় কমাতে, খরচ কমাতে এবং নাগরিকদের সন্তুষ্টি বিধানে ই-গভর্ন্যান্স পরিষেবার বর্তমান অবস্থার উন্নতিতে বিশ্বস্ত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার কৌশলগুলোকে ব্যবহার করাই এর প্রধান লক্ষ্য।
এটি এখনও স্পষ্ট যে ই-গভর্ন্যান্সের ক্ষেত্রে সরকারি অ্যাপ্লিকেশন বিভিন্ন চ্যালেঞ্জের সম্মুখীন হয়। এই প্রযুক্তির দক্ষ বিশেষজ্ঞ খুঁজে পাওয়া কঠিন বিশেষ করে দক্ষ এবং নির্ভরযোগ্য এআই অ্যাপ্লিকেশন তৈরি এআই এবং একীভূত করা ই-গভর্ন্যান্স পরিষেবাগুলোতে ডিপ লার্নিং অ্যাপ্লিকেশন প্রয়োজন। তথ্য সুরক্ষা এবং গোপনীয়তার ওপর শক্তিশালী নীতি এবং ব্যবস্থা যাই হোক, এখনও চ্যালেঞ্জ আছে যেমন নির্মাণ বাধা, ডাটা নিরাপত্তা এবং গোপনীয়তার জন্য কংক্রিট মানসহ নাগরিক ও সরকারের বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন, স্বচ্ছতা এবং অন্যান্য প্রযুক্তিগত নিরাপদ উন্নয়ন এবং বাস্তবায়ন সংক্রান্ত কিছু অসুবিধা রয়েছে।
নাগরিকদের জন্য সরকারের পরিষেবাগুলো আধুনিক করা এবং উৎপাদনশীলতা উন্নত করার লক্ষ্য নিয়ে খরচ ও সময় বাঁচানোর ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সরকার, নাগরিক এবং অর্থনীতির অগ্রগতিতে শিল্প, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশগুলোর জন্য এটি একটি বিশেষ সুবিধা দিতে পারে বলেই সবার বিশ্বাস।
তথ্য অধিকার আইন
তথ্য অধিকার (আরটিআই) আইন ২০০৯ প্রণয়ন সরকারের পক্ষ থেকে ছিল একটি যুগান্তকারী সিদ্ধান্ত ও পদক্ষেপ। এই আইন সব নাগরিকের জন্য একটি অধিকার হিসাবে সরকারি কর্তৃপক্ষের কাছ থেকে তথ্য পাওয়ার পথ প্রশস্ত করেছে। তথ্য অধিকার আইন বাংলাদেশসহ বিশ্বের ১৩২টিরও বেশি দেশ এই আইন প্রণয়ন করেছে। এই আইন তথ্যের অধিকার নিশ্চিত করে সব সরকারি, স্বায়ত্তশাসিত এবং সংবিধিবদ্ধ সংস্থা এবং সরকারি বা বিদেশি অর্থায়নে পরিচালিত বেসরকারি সংস্থাগুলোতে স্বচ্ছতা এবং জবাবদিহি নিশ্চিত করে দুর্নীতি হ্রাস করা এবং সুশাসন প্রতিষ্ঠায় ভূমিকা রাখছে।
বাংলাদেশ সংবিধানের অনুচ্ছেদ ৭ এবং ১১-এ জনগণের তথ্যের অধিকারকে স্পষ্টভাবে স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছে। অনুচ্ছেদ ৭ ঘোষণা করেছে যে প্রজাতন্ত্রের সমস্ত ক্ষমতা জনগণের। অনুচ্ছেদ ১১ প্রজাতন্ত্রকে গণতন্ত্র হিসাবে ঘোষণা করে এবং মানবাধিকার ও স্বাধীনতা নিশ্চিত করেছে। উপরন্তু, অনুচ্ছেদ ৩৯ চিন্তা, বিবেক, বাকস্বাধীনতা এবং সংবাদপত্রের স্বাধীনতাকে স্পষ্ট করেছে। তাই জনগণের সব তথ্যের অধিকার কোনোভাবেই বাধাগ্রস্ত করা যাবে না। যদি সত্যিকার অর্থে গণতন্ত্রের চর্চা করতে হয়, তাহলে সংবিধানে এই অধিকারের জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট বিধানের অনুপস্থিতি তথ্য প্রবেশাধিকারে কোনো বাধা সৃষ্টি করবে না।
গণতান্ত্রিক ও জবাবদিহিমূলক শাসনের সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ হলো গোপনীয়তা। কার্যকর বাস্তবায়নের জন্য সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ হলো তথ্যের জন্য আবেদনের প্রক্রিয়ার সুস্পষ্ট প্রচার এবং তথ্য কর্মকর্তাদের যোগাযোগের বিবরণ। বাংলাদেশের তথ্য ব্যবস্থাপনা ব্যবস্থা প্রাচীন, যার কারণে তথ্য উদ্ধার এবং প্রদানের ক্ষেত্রে ব্যবহারিক সীমাবদ্ধতাগুলোর জন্য তথ্য অনুসন্ধানকারীদের তথ্য পাওয়ার বিষয়টি অনেক সময় সহজ নয়। তাই তথ্য ব্যবস্থাপনার একটি আধুনিক ডিজিটাল সিস্টেম বিকাশের কোনো বিকল্প নেই যা সহজ, নির্ভরযোগ্য এবং নিরাপদ সংরক্ষণাগার এবং পরিষ্কার ট্র্যাকিং সূচকগুলোর সাথে তথ্য পাবার পথ প্রশস্ত করবে।
তথ্য ব্যবস্থাপনাকে অবশ্যই আধুনিক করতে হবে যা তথ্য প্রদানকারী এবং অনুসন্ধানকারী উভয়ের জন্যই সহায়ক। সব আরটিআই আইনের মতো বাংলাদেশ আইনে ছাড়ের একটি তালিকা রয়েছে, যেগুলো অবশ্যই খুব স্পষ্টভাবে সংজ্ঞায়িত এবং শ্রেণিবদ্ধ করা যাতে সংঘাত এড়াতে এবং সর্বোত্তম মানদণ্ড পূরণ করতে সক্ষম হয়।
তথ্য পাওয়ার ক্ষেত্রে প্রযুক্তির ব্যবহার কতদূর?
চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের অন্যতম প্রযুক্তি আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই), যা বিভিন্ন সেক্টরে ব্যবহার হয়। আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স সারা বিশ্বে প্রযুক্তিগত এক বৈপ্লবিক পরিবর্তন এনে দিয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, চীন এমনকি ভারতে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার ব্যাপকভাবে শুরু হলেও বাংলাদেশ প্রযুক্তির এই সর্বশেষ সংস্করণের ব্যবহারে এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে রয়েছে বলে মনে করেন প্রযুক্তিসংশ্লিষ্টরা। বাংলাদেশে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহারে সবাইকে আরো এগিয়ে আসতে হবে। তবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার নেতিবাচকতা সম্পর্কে সাবধান থেকে দেশের সবক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহারের যে অপার সম্ভাবনা রয়েছে তা কাজে লাগানো প্রয়োজন বলেও মনে করছেন সবাই। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার শঙ্কা কাটিয়ে এর সদ্ব্যবহার নিশ্চিতে সবার জন্য কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ইতিবাচক ব্যবহারের সুযোগ সৃষ্টি করা প্রয়োজন। এ জন্য সকল পর্যায়ের অংশীজনের সক্রিয় ভূমিকা প্রয়োজন রয়েছে। মেশিনকে তথ্য-উপাত্তের ভিত্তিতে বুদ্ধিমান করে তোলার ক্ষেত্রে আর্টিফিশিয়াল ইন্টেলিজেন্সের জুড়ি নেই। বাংলাদেশেও এই প্রযুক্তির গবেষণা ও ব্যবহার ছোট পরিসরে শুরু হয়েছে, তবে আরো সামনে এগিয়ে যেতে হবে।
লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক
কৃতজ্ঞতা স্বীকার : ইউনেস্কো ও তথ্য কমিশন
ছবি : ইন্টারনেট
১ টি মন্তব্য
Md Shamim Miah
২০২২-১১-০৮ ১৭:২৬:২৮Good