পেশীশক্তি বাড়াবে রোবটিক স্যুট
মানুষের শক্তি বহুগুণে বাড়িয়ে দিতে পারে এমন রোবটিক স্যুট বা পোশাক উদ্ভাবন করেছেন মার্কিন বিজ্ঞানীরা৷ এটি তৈরি করা হয়েছে অ্যালুমিনিয়াম এবং নানা ইলেকট্রনিক কলকব্জা দিয়ে৷ ওজন অনেক বেশি৷ ১৫০ পাউন্ড৷ প্রশ্ন উঠতে পারে এত ওজনের পোশাক পরে মানুষ হাঁটবে কেমন করে? কাজ তো দূরের কথা! যুক্তরাষ্ট্রের সল্টলেক সিটিতে রোবটিকস ফার্ম সারকোস ইনকর্পোরেটে বিজ্ঞানী ও প্রকৌশলীরা এই অসাধ্য সাধনেই কাজ করে চলেছেন৷ এমন একটি পোশাক তৈরির জন্য কাজ কিন্তু শুরু হয়েছে সেই ১৯৯৫ সালের দিকে৷ মার্কিন সেনাবাহিনী এর উদ্যোক্তা৷ কিন্তু যথাযথ, মানানসই বা উপযুক্ত পোশাক উদ্ভাবন করা আজো সম্ভব হয়নি৷ এখন যেটি উদ্ভাবন করা হয়েছে তারও রয়েছে নানা প্রতিবন্ধকতা৷ এসব প্রতিবন্ধকতা দূর করে পোশাকটি বাজারে আসতে বেশ সময়ের প্রয়োজন হবে৷ প্রকৌশলীরা অবশ্য আশাবাদী, শিগগিরই ওই রোবটিক স্যুট বাণিজ্যিকভিত্তিতে উত্পাদন করা সম্ভব হবে৷
এখন যে স্যুটের প্রটোটাইপ বা প্রাথমিক সংস্করণ তৈরি করা হয়েছে, সেটি সম্প্রতি পরীক্ষা করে দেখেছেন ৫ ফুট ১১ ইঞ্চি উচ্চতার সফটওয়্যার প্রকৌশলী রেক্স জেমসন৷ তিনি বলেছেন, পোশাকটি পরার পর তার শক্তি এবং সহ্যক্ষমতা অন্তত ২০ গুণ বেড়ে যায়৷ পোশাকের মধ্যে পাখির নখের মতো ধাতব যে হাত রয়েছে, তা দিয়ে তিনি একটি ওজন লাগাতার ৫০০ বার তুলতে-নামাতে সক্ষম হয়েছেন৷ জেমসন বলেন, তিনি ক্লান্ত হওয়ার আগেই ধৈর্যহারা হন তারা-যারা ওই ওজন ওঠানো-নামানো দেখছিলেন৷
সারকোস ইনকর্পোরেটে কাজ করছেন প্রকৌশলী জেমসন৷ মার্কিন সেনাবাহিনীর সাথে চুক্তির অংশ হিসেবেই ওই প্রতিষ্ঠানটি অত্যাধুনিক পোশাক উদ্ভাবন নিয়ে গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছে৷ জেমসন যে স্যুট পরে এর কার্যক্ষমতা পরীক্ষা করেছেন তা যদি সফল হয়, তাহলে হয়তো এ ধরনের পোশাকই দেখা যাবে আগামী দিনের সেনাদের শরীরে৷ এই পোশাক পরা ব্যক্তি যেভাবে চাইবে রোবট পোশাক সেভাবেই সাড়া দেবে এবং তাত্ক্ষণিকভাবে শক্তি বাড়িয়ে দেবে৷
মার্কিন সেনা কর্মকর্তারা মনে করছেন, এমন একদিন আসবে যখন যুদ্ধের ময়দানে সেনারা লড়াই করবে এই ধরনের স্যুট পরে৷ তবে এখনই যুদ্ধোপযোগী পোশাকের কথা ভাবছেন না তারা৷ তাদের ভাবনাটা এখন কেন্দ্রীভূত মাল ওঠানো-নামানো এবং ভারি যন্ত্রপাতি মেরামতের কাজে এই রোবট পোশাক ব্যবহার করা৷ ১ কোটি ডলারে দুই বছর মেয়াদী এক চুক্তির আওতায় সারকোস ইনকর্পোরেট এই স্যুট অ্যাপ্লিফাইস প্রযুক্তির উন্নয়ন ঘটাতে কাজ করে চলেছে৷ মার্কিন সেনাবাহিনীর পরিকল্পনা হলো আগামী বছর নাগাদ মাঠ পর্যায়ে পোশাকটি পরীক্ষা করে দেখা৷
প্রযুক্তিটিকে বাস্তবে রূপ দেয়ার আগে এর প্রকৌশলীদের অবশ্যই ব্যয় সাশ্রয় এবং পোশাকের ব্যাটারি লাইফ নিয়ে সৃষ্ট সমস্যার সমাধান করতে হবে৷ কেননা এখন পোশাকটিতে যে ব্যাটারি ব্যবহার করা হচ্ছে মাত্র ৩০ মিনিটেই তার চার্জ শেষ হয়ে যায়৷ যুদ্ধের ময়দানে আরো বেশি সময় ধরে চার্জ থাকবে এমন ব্যাটারির প্রয়োজন হবে৷ জেমসন যখন পোশাকটি পরে এর কার্যক্ষমতা প্রদর্শন করেন, তখন তিনি একাধিক কর্ড ব্যবহার করে পোশাকে বিদ্যুৎ থেকে চার্জ নিয়েছেন৷
রোবটিকস যে মানুষের পেশীশক্তি বাড়াতে পারে তার প্রমাণ ইতোমধ্যেই মিলেছে৷ অর্থাৎ এমন প্রযুক্তি এখন বিজ্ঞানী-প্রকৌশলীদের হাতে রয়েছে যা মানুষের শক্তি বাড়ায়৷ আগে শুধু বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীতেই এমন মানুষ দেখা যেত, যেমন নতুন মুক্তি পাওয়া চলচ্চিত্র আয়রন ম্যান৷
সারকোস স্যুটের প্রধান নকশাবিদ স্টিফেন জ্যাকবসেন বলেছেন, সবার মনেই একজন সুপার হিরো হওয়ার বাসনা থাকে৷ এই স্যুট তাকে সেই বাসনা পূরণের দিকে কিছুটা হলেও এগিয়ে নেবে৷ কারণ এই স্যুট মানুষের কার্যক্ষমতা বহুগুণে বাড়িয়ে দেবে৷ ইতোমধ্যে যথেষ্ট সাড়া ফেলতে সক্ষম হয়েছে সারকোস প্রযুক্তি৷ শুধু এই স্যুটের উন্নয়নই নয়, ইউনিভার্সেল স্টুডিওর জুরাসিক পার্ক থিম র্পাi Rb¨ GKvwaK †ivewUK WvB‡bvmiI তৈরী করেছে তারা৷
বস্টনের উপকণ্ঠ নাটিকে মার্কিন সেনাবাহিনীর সোলজার রিসার্চ ডেভেলপমেন্ট অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং সেন্টারের সাথে যুক্ত সাবেক কর্নেল জ্যাক ওবুসেক বলেছেন, সারকোসের রোবট স্যুট পরে সেনারা হেলিকপ্টার থেকে গোলাবারুদের ভারি বাক্স নামাবে, ঝুঁকিপূর্ণ স্থানে অচল হয়ে যাওয়া ট্যাঙ্ক মেরামত করবে এবং অন্যান্য ভারি কাজ করবে৷
স্টিফেন জ্যাকবসেন বলেছেন, কারখানার শ্রমিকরা একদিন এই প্রযুক্তি ব্যবহার করে কায়িক শ্রমকে আরো সহজ করে তুলতে সক্ষম হবে৷ দমকল কর্মীরা জ্বলন্ত ভবনে দ্রুত তুলে দিতে পারবে ভারি সিঁড়ি৷ প্রতিবন্ধীরাও এই প্রযুক্তির সুফল পাবে৷ তিনি বলেন, সামরিক এবং বাণিজ্যিক ভিত্তিতে যখন এই স্যুট তৈরি হওয়া শুরু হবে তখন কমে আসবে এর দাম৷ একটি ছোট গাড়ি কেনার অর্থেই হয়তো পাওয়া যাবে এই পোশাক৷ প্রাথমিক পর্যায় বলে এই পোশাক তৈরি এই সময়ে নিঃসন্দেহে ব্যয়বহুল৷
কেবল দামই যে এই পোশাকের একমাত্র বাধা তা নয়৷ ব্যাটারি লাইফেরও ব্যাপার আছে৷ মাত্র ৩০ মিনিটের চার্জসম্বলিত ব্যাটারি দিয়ে ঝুঁকিপূর্ণ বড় কাজে হাত দেয়া যে ঠিক হবে না, তা এর প্রকৌশলীরা ভালোই জানেন৷ তাই ব্যাটারি লাইফের উন্নয়নের কাজ চলছে৷ ইতোমধ্যে যা করা হয়েছে তা হলো- এই স্যুট জেনারেটর, ট্যাঙ্ক বা হেলিকপ্টার থেকে শক্তি সংগ্রহ করতে পারবে৷ এর থাকবে গ্যাস ইঞ্জিন, যা আকারে ছোট হওয়ায় সহজেই স্যুটের ব্যাকপ্যাকে রেখে দেয়া যাবে৷
জ্যাক ওবুসেক বলেন, স্যুটটি মাঠ পর্যায়ে যাওয়ার আগে সবচেয়ে প্রথম যে চ্যালেঞ্জটি মোকাবেলা করতে হবে সেটি হচ্ছে পাওয়ার বা বিদ্যুৎ সমস্যা৷ তিনি বলেন, সেন্সরযুক্ত অতি দ্রুতগতির মাইক্রো প্রসেসর ব্যবহারের মাধ্যমে সারকোস এই চ্যালেঞ্জ মোকাবেলা করতে সক্ষম হবেন৷ ওই সেন্সর দেহের সংযোগস্থলের নড়াচড়া চিহ্নিত করে স্যুটের ভেতরে থাকা কমপিউটারে ডাটা পাঠিয়ে দেবে৷ পেশী নাড়ানোর জন্য মস্তিষ্ক যেমন রগের মাধ্যমে সিগন্যাল পাঠায়, একইভাবে কমপিউটার নির্দেশনা পাঠাবে হাইড্রোলিক ভাল্বসমূহে৷ ওই ভাল্ব কাজ করবে রগের মতো৷ অর্থাৎ ভাল্বের সক্রিয়তার মাধ্যমেই নড়াচড়া করবে যান্ত্রিক অঙ্গসমূহ৷ স্যুট পরা ব্যক্তির নড়াচড়াকে অনুসরণ করে প্রায় তাত্ক্ষণিকভাবেই পেশীর শক্তি বাড়িয়ে দেবে ওই যান্ত্রিক অঙ্গ৷
এই প্রযুক্তির প্রাথমিক পর্যায়ে সমস্যা ছিল সাড়া দেয়ার সময় নিয়ে৷ মানবদেহ যত দ্রুত সাড়া দেয়, পোশাকটি তার সাথে তাল মেলাতে পারে না৷ এজন্য যেকোনো কাজে কিছুটা সময় বেশি লাগে৷ পোশাকটি ভারি এবং বিকট দর্শন৷ কেউ কেউ একে ফ্রাঙ্কেনস্টাইনের দানবের সাথে তুলনা করেছেন৷
স্যুটটি নিয়ে গবেষণা অব্যাহত রয়েছে৷ শিগগিরই বাণিজ্যিকভিত্তিতে এটি যে উত্পাদন হচ্ছে না তা নিশ্চিত৷ তাই এমন একটি স্যুট পেতে হলে অপেক্ষায় থাকতেই হবে৷
০ টি মন্তব্য