https://powerinai.com/

দশদিগন্ত

পানিতে হাঁটবে রোবট

পানিতে হাঁটবে রোবট পানিতে হাঁটবে রোবট
 

পানিতে হাঁটবে রোবট


এক ধরনের পতঙ্গ আছে যারা পানির ওপর ভেসে বেড়ায়৷ এরা জল মাকড়সা কিংবা কখনো কখনো ওয়াটার স্কেটার নামে পরিচিত৷ পানির ওপর বড় বড় পা ফেলে বিচরণকারী এই পতঙ্গরা হয়তো জীবনে কখনোই মাটিতে ওঠেনি৷ পানিতে বাস হলেও এরা সাঁতারু নয়৷ লাখ লাখ কিংবা তারও বেশি বছর ধরে এই স্কেটাররা পানির স্রোত বা টানকে ব্যবহার করে নিজের শূন্য দশমিক শূন্য ১ গ্রাম ওজনের দেহটার ভারসাম্য রক্ষা করে চলেছে৷ হ্রদ, পুকুর এবং এমনকি মহাসাগরেও এদের দেখতে পাওয়া যায়৷


কার্নেগি মেলোন বিশ্ববিদ্যালয়ের মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ের পিএইচডির ছাত্র ইয়ং সিয়ং সং এবং একই বিভাগের সহকারী অধ্যাপক মেতিন সিটি সম্প্রতি এমন একটি রোবট তৈরি করেছেন যা ওয়াটার স্কেটারের অনুরূপ৷ অর্থাত্ পানিতে স্কেটার যেভাবে বিচরণ করে, এই রোবট ঠিক একইভাবে বিচরণ করবে৷ মাকড়সার মতো এরাও লম্বা লম্বা পা ফেলে চলবে৷ স্রোত বা পানির টানে ভেঙ্গে পড়বে না৷ বিভিন্ন কৌশলে এই রোবটকে ব্যবহারের সুযোগ রয়েছে৷


সং এবং সিটির এই ক্ষুদ্র রোবট অন্যান্য ভাসমান রোবটের মতো নয়৷ এর কম ভর এবং দীর্ঘ পায়ের কারণে এটি সহজেই পানির টানকে কাজে লাগিয়ে ভেসে থাকতে সক্ষম হয়৷ গবেষকদ্বয় বলেছেন, তাদের উদ্ভাবিত এই রোবট ওয়্যারলেস কমিউনিকেশনের মাধ্যমে পরিবেশ মনিটরিং, শিক্ষা এবং বিনোদন ক্ষেত্রে কাজে লাগানো যেতে পারে৷


রোবটটির নামকরণ হয়েছে স্ট্রাইড৷ অর্থাত্ সারফেস টেনশন রোবোটিক ইনসেক্ট ডাইনামিক এক্সপ্লোরার৷ ৩/৪ মিলিমিটার গভীর পানিতেও হাঁটতে পারে এই রোবট৷ তাছাড়া অন্য ক্ষুদ্র জলযানের চেয়ে এর গতি অনেক বেশি এবং চলন কৌশলও ভিন্ন৷ পানিতে চলার উপযুক্ত অন্যান্য রোবটের তুলনায় স্ট্রাইডের পায়ের অনেক কম অংশই পানিতে ডুবে থাকে৷ গবেষক সিটি বিষয়টি ব্যাখ্যা করে বলেন, স্ট্রাইডের আকৃতি যদি বেড়ে যায় তাহলে এই সুবিধা আর পাওয়া যাবে না৷ অর্থাৎ আকৃতি বড় হলে তার পায়ের অনেক বেশি অংশ পানিতে ডুবে থাকবে৷


মডেল পর্যবেক্ষণ এবং হিসাবনিকাশ করে গবেষকরা দেখেছেন, একটি অপটিমাল রোবটের টেফলনযুক্ত হাইড্রোফোবিকওয়্যার পা থাকার প্রয়োজন হয়, যার প্রতিটির দৈর্ঘ্য হতে হবে ৫ সেন্টিমিটার৷ ১২টি পা যুক্ত থাকবে রোবটের ১ গ্রাম ওজনের দেহের সাথে৷ পানির টানে যেন ভেঙ্গে না পড়ে সে জন্য থাকবে ওয়াটার-এয়ার ইন্টারফেস, এটি ভার্টিক্যাল না হয়ে হবে হরাইজন্টাল৷


পানির ওপর গতিশীল থাকার ক্ষেত্রে জল মাকড়সারা তাদের বিশেষভাবে তৈরি পাগুলোকে নৌকার হালের মতো ব্যবহার করে৷ এর মাধ্যমেই স্রোতের মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে সে স্থির থাকে এবং প্রয়োজনে এগিয়ে যায়৷ রোবটও কাজ করবে ঠিক একই পদ্ধতিতে৷ রোবটের পাগুলোকে টি আকৃতিতে যুক্ত করবে তিনটি পিজোইলেকট্রিক অ্যাকচুয়েটর৷ এই তিনটি অ্যাকচুয়েটর ভার্টিক্যাল এবং হরাইজন্টাল মোশন বা গতি নিয়ন্ত্রণ করবে৷ একটি জল মাকড়সা যেখানে প্রতি সেকেন্ডে ১ দশমিক ৫ মিটার গতিতে চলতে পারে, সেখানে এই ধরনের প্রথম রোবট চলবে সেকেন্ডে ৩ সেন্টিমিটার গতিতে৷ এটি ডানে-বাঁ য়ে যেতে পারবে, নিজের চারদিকে ঘুরতে পারবে এবং পিছন দিকে যেতে পারবে৷ প্রযুক্তিগত উন্নয়নের মাধ্যমে স্ট্রাইডের গতি বৃদ্ধি করাও সম্ভব হবে৷


যেহেতু স্ট্রাইড এখন রয়েছে প্রাথমিক পর্যায়ে তাই এটি এখনো উত্তাল পানিতে খাপ খেয়ে চলতে সক্ষম নয়৷ গবেষকরা আশা করছেন, তারা স্ট্রাইডের বহনক্ষমতা এবং পানিতে এগিয়ে চলার ক্ষমতা বাড়াতে সক্ষম হবেন৷ এক পর্যায়ে প্রচণ্ড স্রোত এবং ঝড়ের মধ্যেও স্থির থাকতে পারবে এই স্ট্রাইড রোবট৷


গবেষক সং এবং সিটি অন্য উপায়েও রোবটটির উন্নয়ন ঘটাতে কাজ করে যাচ্ছেন৷ তারা শিগগিরই তৈরি করবেন এর ভবিষ্যত্ সংস্করণ৷ টি আকৃতির অ্যাকচুয়েটর মেকানিজম পুরো রোবটের ওজনের অর্ধেকেরও বেশি৷ তাই রোবটটি দ্রুতগতিসম্পন্ন হতে পারছে না৷ এই ওজন কমিয়ে আনতে পারলে জল মাকড়সার চেয়েও গতিশীল হবে স্ট্রাইড রোবট৷


সম্প্রতি আরেকটি প্রোটোটাইপ রোবটের ডিজাইন করেছেন গবেষকরা৷ পানিতে হাঁটার জন্য সেখানে ব্যবহার করা হয়েছে দুটি ব্যাটারিচালিত মাইক্রোমটর৷ এর ফলে রোবটের ওজন বেড়ে ৬ গ্রাম হয়েছে এবং চলার গতি দাঁড়িয়েছে সেকেন্ডে ৮ দশমিক ৭ সেন্টিমিটার৷ যেই দলটি এই ডিজাইন করেছে তারা এখন ভিন্ন উপায়ে সাফল্য পেতে গবেষণাকাজ চালিয়ে যাচ্ছে৷


গবেষক সিটি বলেছেন, জল মাকড়সার চেয়ে ১০/১৫ গুণ ধীর হলো স্ট্রাইড৷ আর ওই পতঙ্গের চেয়ে স্ট্রাইডের আকার ১০ গুণ বড়৷ তাই স্ট্রাইডের আকার আরো ছোট করতে হবে৷ নতুন প্রোটোটাইপ স্ট্রাইডে ওয়্যারলেস কমিউনিকেশন, সেন্সর এবং টেলিঅপারেটেড ও অটোনোমাস কন্ট্রোল ক্যাপাবিলিটি যুক্ত করা হচ্ছে৷ সাফল্যের সাথে এটি করা গেলে পরিবেশ পর্যবেক্ষণের জন্য শত শত রোবট ছেড়ে দেয়া যাবে পানিতে৷


সামরিক ক্ষেত্রেও ব্যবহার করা যেতে পারে এই রোবট৷ বিশেষ করে নৌপথে গোয়েন্দাগিরির কাজ সুষ্ঠু ও নিরাপদভাবে করে দিতে পারবে এই স্ট্রাইডরা৷ ওয়্যারলেস সেন্সর থাকায় তাদের আওতার মধ্যে কিছু খুঁ জে পেলেই সাথে সাথে রিপোর্ট করবে নিয়ন্ত্রকের কাছে৷ কিছুই তাদের নজর এড়াবে না৷ সবকিছুই নিয়ন্ত্রিত হবে কমপিউটারের মাধ্যমে৷ বিশেষ সফটওয়্যারের মাধ্যমে এরা নির্দেশনা পাবে এবং নির্দেশনা বাস্তবায়ন করে বিশেষ প্রক্রিয়ায় তা জানিয়েও দেবে কেন্দ্রের কাছে৷ তবে পরিবেশগত কাজেই এই রোবট ব্যবহারের কথা আপাতত বেশি করে ভাবা হচ্ছে৷ জলপৃষ্ঠের তাপমাত্রার ওঠানামা নির্ণয় করবে এরা৷ তাদের দেয়া এই পরিসংখ্যানের ওপর ভিত্তি করে দেয়া হবে আবহাওয়ার পূর্বাভাস৷ উষ্ণ ও শীতল স্রোতের গতি নির্ণয়েও সহায়ক হবে স্ট্রাইড৷ ফলে আবহাওয়া ও জলের গতিপ্রকৃতি সম্পর্কে আরো সুনির্দিষ্ট তথ্য হাতে পাবেন আবহাওয়াবিদ ও জলবায়ু গবেষকরা৷


এদিকে গত মাসের প্রথম দিকে নিউইয়র্কের ম্যানহাটনের হাডসন নদীতে ভেসে বেড়িয়েছে এক দানব রোবট মাকড়সা৷ নাম প্রোটিয়াস৷ ১০০ ফুট লম্বা ও প্রশস্ত ৫০ ফুট৷ চার পায়ের সংযোগস্থলে ঝুলে রয়েছে ক্রু কেবিন৷ ১২ জন পর্যন্ত যাত্রী বহন করা যাবে এই রোবটে৷ ইতালিতে জন্ম নেয়া প্রকৌশলী ও সমুদ্রবিজ্ঞানী উগো কনটি প্রোটিয়াসের নকশা তৈরি করেছেন৷ যুক্তরাষ্ট্রের সিলিকন ভ্যালিতে তার এবং তার স্ত্রী ইসাবেলার প্রতিষ্ঠিত মেরিন অ্যাডভান্সড রিসার্চ ইন করপোরেটেড ১৫ লাখ ডলার ব্যয় করে রোবটটি তৈরি করে৷ ধাতব ও ফেব্রিকের পন্টুনের ওপর প্রোটিয়াস স্থির থাকে৷ এর শক্তিশালী শক অ্যাবজরভার বড় বড় ঢেউয়ের মধ্যেও একে সোজা রাখে৷ জল মাকড়সার মতোই পানির ওপর দিয়ে দ্রুত ছুটে যায় প্রোটিয়াস৷ রোবটটির সর্বোচ্চ গতিবেগ ঘণ্টায় ৩৪ দশমিক ৫ মাইল৷ ঢেউ ভেঙ্গে চলার উপযোগী বহুমুখী এই জলযান সামরিক থেকে শুরু করে বৈজ্ঞানিক গবেষণা পর্যন্ত যেকোনো কাজে লাগানো সম্ভব হবে৷


যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় সামুদ্রিক প্রাণী অভয়াশ্রমের পরিচালক ড্যানিয়েল ব্যাসটা জানান, হালকা ও কম জ্বালানি ব্যবহারকারী প্রোটিয়াস বৈজ্ঞানিক ও পরিবেশগত উদ্দেশ্যের জন্য খুবই উপযোগী৷ এটি ২ হাজার গ্যালন ডিজেল ব্যবহার করে প্রায় ৫ হাজার মাইল চলতে পারে৷ এটি দিয়ে সমুদ্রের নিচে গবেষণারত স্বয়ংক্রিয় যান উদ্ধার করা যাবে৷ তাছাড়া সমুদ্রের নিচে গবেষণার জন্য যন্ত্রপাতি পাঠানো ও নানা উপাত্ত সংগ্রহে কার্যকর ভূমিকা রাখবে এই রোবট যান৷


সারা বিশ্বেই রোবটিক্স নিয়ে যেভাবে গবেষণা চলছে তাতে ভবিষ্যতে যে আমরা প্রয়োজনীয় অনেক রোবট পাবো সে ব্যাপারে সন্দেহ নেই৷ এসব রোবট অবশ্যই আমাদের উপকারের জন্য কাজে লাগানো হবে৷ তবে এদের নিয়ন্ত্রণ যেন সব সময় মানুষের হাতে থাকে তা নিশ্চিত করতে হবে৷ নইলে ঘটে যেতে পারে বিপর্যয়৷ যেমনটি দেখা যায় বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীতে৷








০ টি মন্তব্য



মতামত দিন

আপনি লগ ইন অবস্থায় নেই।
আপনার মতামতটি দেওয়ার জন্য লগ ইন করুন। যদি রেজিষ্ট্রেশন করা না থাকে প্রথমে রেজিষ্ট্রেশন করুন।







পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন? পুনরায় রিসেট করুন






রিভিউ

আপনি লগ ইন অবস্থায় নেই।
আপনার রিভিউ দেওয়ার জন্য লগ ইন করুন। যদি রেজিষ্ট্রেশন করা না থাকে প্রথমে রেজিষ্ট্রেশন করুন।