https://powerinai.com/

প্রযুক্তির খবর

মেধাসম্পদ রক্ষায় সীমাহীন অবহেলা

মেধাসম্পদ রক্ষায় সীমাহীন অবহেলা মেধাসম্পদ রক্ষায় সীমাহীন অবহেলা
 

মেধাসম্পদ রক্ষায় সীমাহীন অবহেলা


মাত্র কদিন আবে সারা দুনিয়াতে মেধাসম্পদ দিবস পালিত হলো৷ প্রতি বছর ২৬ এপ্রিল এ দিবস পালিত হয়৷ ২০০১ সাল থেকে দিবস পালনের এই পর্বটি বাংলাদেশেও শুরু হয়৷ ২০০৩ পর্যন্ত এ দিবস প্যাটেন্ট অফিস নীরবে পালন করতো৷ ২০০৪ সাল থেকে এই পালন উত্সবে ঢাকা চেম্বার অব কমার্স জড়িত হয়৷ ২০০৫ সাল থেকে এফবিসিসিআই জড়িত হয় ও আমরা কমপিউটার জগৎ-এর মানুষও স্বল্প পরিমাণে জড়িত হই৷ এরপর দিনে দিনে মেধাসম্পদ পালনের বিষয়টি সম্প্রসারিত হচ্ছে৷ অতি সম্প্রতি এটি ব্যবসায়ী মহলেও যথেষ্ট গুরুত্ব পেতে শুরু করেছে৷ বিশেষত ঢাকা চেম্বার ও এফবিসিসিআই বছরে অন্তত একদিন মেধাসম্পদ নিয়ে কিছু চিন্তাভাবনা করে৷ এবার ২০০৮ সালে ঢাকা চেম্বারের মেধাসম্পদ দিবস পালন উত্সবে বিপুলসংখ্যক গুরুত্বপূর্ণ ব্যবসায়ী অংশ নেন৷ যেভাবে এরা মেধাসম্পদের নানা দিক নিয়ে আলোচনায় অংশ নেন, তাকে অবশ্যই শুভ লক্ষ্মণ বলতে হবে৷ তবে এটি সম্ভবত দুঃখের বিষয় যে, এ বিষয়ে আমাদের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের কোনো সংগঠনের কোনো উপস্থিতি ছিল না৷ বেসিস নামের যে সংগঠনটির কাছে আমরা আমাদের মেধাসম্পদের সুরক্ষা চাই, সে সংগঠনটি এ দিবস পালনেও অংশ নেয়নি৷ কিন্তু আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় বাংলাদেশের মেধাসম্পদ পরিস্থিতকে ওভাবে দেখছে না৷ বরং অনেক গুরুত্ব দেয়া হচ্ছে একে৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট কার্যালয়ের বাণিজ্য প্রতিনিধি অফিসের দক্ষিণ এশিয়াবিষয়ক পরিচালক এডিনা রেনি এডলার কদিন আবে ঢাকা সফর করে এ বিষয়ে ব্যাপক তত্পরতা চালিয়ে গেছেন৷ তিনি সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে এই বিষয়টির গুরুত্ব তুলে ধরেন৷ কিছুদিন আগে এশিয়ান কালচারাল ইউনিয়ন এ বিষয়ে সেমিনার করেছে৷ কাছাকাছি সময়ে সিঙ্গাপুরের বিজনেস সফটওয়্যার অ্যালায়েন্স একটি সেমিনারের আয়োজন করে৷ এ সংগঠন ঢাকায় অফিস করার কথাও ভাবছে৷ এটি পাইরেসি প্রতিরোধ করে৷ এসব ব্যাপারে সরকারও যে একেবারে চুপ, তা মনে হয় না৷ এরা চারপাশ থেকে চাপ অনুভব করছে৷ এরই মাঝে সংস্কৃতি মন্ত্রণালয় কপিরাইট লঙ্ঘন প্রতিরোধের বিষয়ে একটি সভা করেছে৷ তবে সফটওয়্যারের যে দশা, সে দশাই রয়ে গেছে৷


সূচনা ও বাংলাদেশের আইন : উইকিপিডিয়া অনুসারে মেধাসম্পদ (intellectual property) এবং তার আইনী বিষয় নিয়ে আদালতে প্রথম আলোচনা হয় ১৮৪৫ সালের অক্টোবরে একটি মার্কিন আদালতে৷


তবে এর বাইরেও ১৭৯১ সালের একটি ফরাসী আইনে আবিষ্কার যে সম্পদ সেটি উল্লেখ করা হয়৷ কিন্তু ১৯৬৭ সালে ওয়ার্ল্ড ইনটেলেকচুয়াল প্রপার্টি অর্গানাইজেশন গঠিত হবার আগে পর্যন্ত মেধাসম্পদ তেমন কোনো আলোচিত বিষয় ছিল না৷ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ১৯৮০ সালের বেহ ডোল আইন প্যাটেন্ট বিষয়টিকে সমন্বিত করলে মেধাসম্পদ ব্যাপকভাবে আলোচনায় আসতে শুরু করে৷


বাংলাদেশে প্রাচীনতম মেধাবিষয়ক আইন ১৯১১ সালের৷ সেটি প্যাটেন্ট ও ডিজাইন আইন৷ এরপরের আইন ১৯৪০ সালের৷ সেটি ট্রেডমার্ক আইন৷ দেশে কপিরাইট আইন ছিলো ১৯৬৯ সালের৷ এসবের মাঝে শুধু কপিরাইট আইনের পরিবর্তন হয়েছে৷ ১৯৬৯ সালের বদলে বাংলাদেশে কপিরাইট আইন ২০০০ প্রণীত হয়, যা ২০০৫ সালে সংশোধিত হয়৷ ট্রেডমার্কস অধ্যাদেশ ২০০৮ জারি করা হয়েছে বলে প্যাটেন্ট অফিস সূত্রে জানানো হয়েছে৷ তবে প্যাটেন্ট ও ডিজাইন আইনটি আদৌ কবে নতুন করে জন্ম নেবে সেটি কেউ বলতে পারে না৷


মেধাসম্পদের পরিধি : আন্তর্জাতিক আইন অনুযায়ী মেধাসম্পদ বেশ বিস্তৃত হলেও বাংলাদেশের আইন অনুসারে এখন পর্যন্ত সীমিত পর্যায়ের কপিরাইট, অতি সীমিত ট্রেডমার্কস, সামান্য কিছু প্যাটেন্ট ও ডিজাইনকে মেধাসম্পদ হিসেবে গণ্য করা হয়৷ কপিরাইটে সম্প্রতি সফটওয়্যারের বিষয়টি অন্তর্ভুক্ত হলেও অন্য আইনগুলো অতি প্রাচীনতার দায়ে নতুন কোনো ধারণা বা প্রযুক্তিকে মোটেই সুরক্ষা করতে পারে না৷ আন্তর্জাতিকভাবে এখন উপরোলি­খিত মেধাসম্পদগুলোর শুধু বিস্তৃত বা সম্প্রসারিত সংজ্ঞাই প্রযোজ্য হচ্ছে না বরং নতুন নতুন বিষয়কে মেধাসম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে৷ নতুন বিষয়গুলোর মাঝে আছে ইউটিলিটি মডেল, ভৌগোলিক নির্দেশনা, বাণিজ্য গোপনীয়তা, ট্রেড নাম, ডোমেইন নাম, ডাটাবেজ, মাস্ক কর্ম, ব্রিডার, ইনডেজিনাস মেধাসস্পদ ইত্যাদি৷


বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক চুক্তিসমূহের স্বাক্ষরকারী হিসেবে আন্তর্জাতিকভাবে এসব মেধাসম্পদ রক্ষা করতে বাধ্য৷ তবে বাংলাদেশের জন্য মেধাসম্পদ মানার ক্ষেত্রে কিছু রেয়াতও আছে৷ বিশ্ব বাণিজ্য সংস্থার চুক্তি অনুসারে বাংলাদেশ ২০১৬ সাল পর্যন্ত ওষুধের ক্ষেত্রে প্যাটেন্ট এবং ট্রিপস চুক্তি অনুসারে কপিরাইটের ক্ষেত্রে ২০১৩ সাল পর্যন্ত ছাড় পাচ্ছে৷


প্রসঙ্গ বাংলাদেশ :


চাই বা না চাই, আমরা ডিজিটাল দুনিয়াতে বাস করছি এবং যেভাবেই হোক আমরা ডিজিটাল বাংলাদেশ গড়বই৷ আমাদের ডিজিটাল বাংলাদেশের জাতীয় আয়েও বস্তুগত সম্পদের অবদানের চাইতে দিনে দিনে মেধাসম্পদজাত আয়ের পরিমাণ বাড়াতে হবে৷ কিন্তু বাংলাদেশের মেধাস্বত্ব্বের অবস্থাটি খারাপ পর্যায়ে আছে৷


অবকাঠামোর সঙ্কট :


বাংলাদেশের মেধাসম্পদ সুরক্ষার সবচেয়ে বড় সমস্যা হলো আইনী এবং প্রাতিষ্ঠানিক অবকাঠামোর সঙ্কট৷ দেশের কপিরাইট আইনটি অপেক্ষাকৃত আধুনিক হলেও ট্রেডমার্কস এবং প্যাটেন্ট ও ডিজাইন আইন একেবারেই অকার্যকর৷ ১৯১১ সালের আইন নিয়ে এই শতকে কে আলোচনা করতে চায়৷ প্যাটেন্ট আইনটি নিয়ে সরকার আলোচনাই করতে চায় না৷ অন্যের প্যাটেন্ট রেয়াত পাবার জন্য আমি যে আমার প্যাটেন্ট পাচ্ছি না, সেটির জবাব কে দেবে? তাদের কাছে এটি বলা উচিত, আমরা আইনটি নবায়ন করেও প্যাটেন্ট অব্যাহতি পেতে পারি৷


অবকাঠামোর আরো একটি দিক হচ্ছে কপিরাইট অফিস ও ট্রেডমার্ক-প্যাটেন্ট ডিজাইন অফিসের জনবল কাঠামোতে পরিবর্তন আনা ও উপযুক্ত জনবল নিয়োগ দেয়া, অফিস দুটির আধুনিকায়ন-প্রযুক্তিনির্ভর করা ও জনগণকে যথাসময়ে সেবা দান নিশ্চিত করা৷ আমি ১৯৯২ সালে প্রথম আবেদন করে ২০০৩ সালে পুনরায় আবেদন করি এবং ২০০৭ সালে একটি প্যাটেন্ট পাই৷ ১৬ বছর মেয়াদী প্যাটেন্ট পেতে কাউকে পনেরো বছর অপেক্ষা করতে হলে সেটিকে কোনো কার্যকর বিষয় বলা যায় না৷ এর প্রধানতম কারণ হচ্ছে প্যাটেন্ট অফিসটিতে কাজ করার মতো অবস্থাই নেই৷ কপিরাইট অফিসের অবস্থা আরো নাজুক৷ এই অবস্থার পরিবর্তন করতে হবে৷


মেধাস্বত্ব সুরক্ষার অব্যবস্থা :


আইনের প্রয়োগ না থাকার ব্যাপারটি হচ্ছে হতাশাজনক৷ দেশে প্রকাশ্যে পাইরেসি হয়৷ প্যাটেন্ট কেউ মানে না৷ ট্রেডমার্ক চুরি হয়, নকল পণ্য চারপাশে ছড়িয়ে আছে৷ এসব মেধাসম্পদ চুরির ঘটনার জন্য কেউ আইনের মুখোমুখি হচ্ছে না৷ প্রকাশ্যে পাইরেটেড পণ্য বিক্রি হয়৷ নাম-ঠিকানা দিয়ে চুরি করা মেধাসম্পদ বিক্রি করা হয়৷ পৌরসভা বা সিটি কর্পোরেশন চোরাই মেধাপণ্য বিক্রির জন্য লাইসেন্স দেয়৷ চোরাই মেধাসম্পদের জন্য আইনশৃঙ্ক্ষলা রক্ষাকারী বাহিনীর পক্ষ থেকে এদের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেয়া হয় না৷ এজন্য সরকারকেই সবার আগে সক্রিয় হতে হবে৷ একই সাথে চাই সংশ্লিষ্ট বাণিজ্য সংগঠন ও স্ট্যাকহোল্ডারদের সক্রিয়তা৷ সফটওয়্যারের জন্য বেসিস, অডিওর জন্য মিউজিক অ্যাসোসিয়েশন, ভিডিও-সিনেমার জন্য প্রযোজক সমিতি-টিভি নির্মাতা সমিতি, বইপত্রের জন্য প্রকাশক সমিতি, উদ্ভাবক সমিতি, ব্যবসায়ী সমিতি ও চেম্বারসহ সংগঠনগুলো যদি কার্যকরভাবে সক্রিয় না হয়, তবে এ পরিস্থিতির পরিবর্তন হবে না৷


মেধাসম্পদ ধারণার সম্প্রসারণ : বাংলাদেশের প্রাচীনতম আইনগুলোর মতোই মেধাসম্পদের ধারণাগুলোও খুব পুরনো৷ আজকের দুনিয়াতে প্রচলিত সনাতনী মেধাসম্পদের বাইরে অনেক নতুন বিষয় সুরক্ষা করার ধারণা তৈরি হয়েছে৷ আমাদের দেশে যেসব মেধাসম্পদ এখনও আমাদের ধারণায় নেই সেগুলো হলো- শিল্প ডিজাইন অধিকার, ইউটিলিটি মডেল, ভৌগোলিক নির্দেশনা, ব্যবসায়ের গোপনীয়তা, মেধাস্বত্বসংশ্লিষ্ট অধিকার, ব্যবসায়ের নাম, ডোমেইন নাম, ডাটাবেজ, মাস্ক কর্ম উদ্ভিদ উদ্ভাবক অধিকার, আদিবাসী মেধা অধিকার এবং অস্থান্তরযোগ্য সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য৷


অতীতে মেধাসম্পদ সংক্রান্ত সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে খামখেয়ালীর জন্য খেসারত দেবার সময় আমাদের দুয়ারে এসে গেছে৷ নকশী কাঁ থা এবং ফজলি আম ভারতের, বাংলাদেশ একে তার পণ্য হিসেবে রফতানি করতে পারে না৷ এমন দাবি কবে ভারতের ব্যবসায়ীরা বাংলাদেশ সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে একটি চিঠি দিয়েছে৷ আমরা প্রায়ই শুনি, আমাদের নিম গাছের প্যাটেন্ট নিয়ে যাচ্ছে কেউ, আবার প্রায়ই শুনি আমাদের ভাটিয়ালি, বাউল গান হিন্দী ছবিতে অন্য কথায় গাওয়া হচ্ছে৷ বাংলাদেশের আদিবাসীদের জীবন-জীবিকা ও সংস্কৃতির ব্যাপারটি সব পর্যায়েই উপেক্ষিত৷ তাদের সংস্কৃতি রক্ষার কোনো প্রয়াস চোখে পড়ে না৷ এমনকি এসব যে মেধাসম্পদ সেটিও কেউ ভাবেন না৷ এসব খবরের সাথে মেধাস্বত্ব্বের ব্যাপক সম্পর্ক রয়েছে৷ আমাদেরকে শুধু প্রচলিত মেধাসম্পদ নিয়ে ভাবলে হবে না৷ পরিবর্তিত অবস্থার প্রেক্ষিতে আমাদেরকে মেধাসম্পদের সম্প্রসারিত বিষয়গুলো নিয়ে ভাবতে হবে৷


শিল্প ডিজাইন অধিকার :


নিখাদ নিত্যব্যবহার্য নয় এমন সব দৃশ্যমান ডিজাইনকে শিল্প ডিজাইন অধিকার বলা হয়৷ এটি কোনো আকৃতি হতে পারে৷ হতে পারে রং ও প্যাটার্নের কনফিগারেশন অথবা সমন্বয় বা সংযোজন৷ সচরাচর আমাদের প্যাটেন্ট ডিজাইন আইনে শুধু যন্ত্রপাতির ডিজাইনকে মেধাসম্পদ হিসেবে বিবেচনা করা হয়৷ কিন্তু এর বাইরে রয়ে গেছে আরো অনেক সৃজনশীল কাজ৷ বিশেষ করে আমাদের নকশী কাঁথাসহ অন্যান্য হস্তশিল্প এ অধিকারের আওতায় না আনা হলে সেটি হবে আত্মহত্যার শামিল৷


ইউটিলিটি মডেল :


বিশ্বের অনেক দেশে ইউটিলিটি মডেলের মেধাস্বত্ব অধিকার রয়েছে৷ আর্জেন্টিনা, অস্ট্রিয়া, ব্রাজিল, চিলি, ফিনল্যান্ড, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, জাপান, মালয়েশিয়া, মেক্সিকো, মরক্কো, ফিলিপাইন, পোল্যান্ড, পর্তুগাল, রাশিয়া, দক্ষিণ কোরিয়া, স্পেন, তাইওয়ান এবং উজবেকিস্তানে এ অধিকার রয়েছে৷ এই অধিকারটি প্রচলিত প্যাটেন্টের সম-সময়সীমার জন্য দেয়া হয় না৷ বরং অপেক্ষাকৃত কম সময় যেমন ১০ বছরের জন্য এই প্যাটেন্ট দেয়া হয়৷ একে মিনি প্যাটেন্ট, পেটি প্যাটেন্ট, মাইনর প্যাটেন্ট বা স্মল প্যাটেন্ট নামে অভিহিত করা হয়৷


ভৌগোলিক নির্দেশনা :


যখন আমরা বলি টাঙ্গাইলের চমচম ও শাড়ি, মুক্তাগাছার মন্ডা, বগুড়ার দই, কুমিল্লার রসমালাই, ডেমরার জামদানি, সাভারের কই, পদ্মার ইলিশ, হাওরের পাঙ্গাশঁ, মানিকগঞ্জের পিয়াজ, মুন্সীগঞ্জের আলু, রুহিতপুরের লুঙ্গি; তখন আমরা একটি বিশেষ জায়গার সাথে সেই পণ্যটির বিশেষত্বকে জুড়ে দিই৷ মেধাস্বত্ব হিসেবে এটি একটি স্বীকৃত অধিকার৷


ব্যবসায়ের গোপনীয়তা :


ব্যবসায়ের গোপনীয়তাকে ট্রেডমার্কের সাথে গুলিয়ে ফেলা ঠিক হবে না৷ ট্রেডমার্ক হচ্ছে ব্যবসায়ের প্রতীক৷ অন্যদিকে ব্যবসায়ের গোপনীয়তা বা ট্রেড সিক্রেট হচ্ছে ব্যবসায়ের ফর্মুলা, অনুশীলন, প্রক্রিয়া, ডিজাইন, যন্ত্রপাতি, প্যাটার্ন কিংবা তথ্যপুঞ্জের সমাহার, যার সাহায্যে একটি ব্যবসায় তার প্রতিদ্বন্দ্বী থেকে আর্থিক সুবিধা পেতে পারে৷ কখনো কখনো এসবকে গোপনীয় তথ্য বা শ্রেণীবদ্ধ তথ্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়৷


আনুষঙ্গিক অধিকার :


এটি হচ্ছে একটি কপিরাইটের অধিকার৷ এটি প্রণেতার অধিকার নয় তবে প্রণেতার সহযোগী অধিকার৷


বাণিজ্য নাম :


ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের নাম সচরাচর নিবন্ধিত হয়ে থাকে৷ যেকোনো ব্যবসায় প্রতিষ্ঠান সেই নামে ব্যবসায় বা চুক্তি করে থাকে৷ কিন্তু সে ব্যবসায়ের জন্য অন্য নামও ব্যবহার করে থাকে৷ যেমন এসপিরিন একটি ব্যবসায়িক নাম৷ এ ধরনের নামকে ব্যবসায়িক নাম হিসেবে মেধাস্বত্ব অধিকার দেয়া হয়৷ যেমন আমার কোম্পানির নাম আনন্দ কমপিউটার্স৷ কিন্তু আমার ব্যবসায়ের নাম বিজয়৷ আমার ব্যবসায় প্রতিষ্ঠানের নাম জয়েন্ট স্টক কোম্পানি বা সিটি কর্পোরেশনের নিবন্ধন দিয়ে সংরক্ষিত হবার পাশাপাশি আইনের আওতায় আমার ব্যবসায়ের নামও সুরক্ষা পেতে পারে৷ নইলে অন্য কেউ আমার ব্যবসায়ের সুনাম ভোগদখল করতে পারে৷ মেধাস্বত্ব আইনে এসব আধিকারকে সুরক্ষা করার ব্যবস্থা করতে হবে৷


ডোমেইন নাম :


ইন্টারনেট জনপ্রিয় হবার সাথে সাথে ইন্টারনেটে ব্যবহৃত ডোমেইন নাম সংরক্ষণ করা একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হয়ে উঠেছে৷ মেধাস্বত্ব আইনে ডোমেইন নাম সংরক্ষণ করার ব্যবস্থা থাকা এখন সময়ের দাবি৷


ডাটাবেজ অধিকার :


ইউরোপীয় ইউনিয়ন ১৯৯৬ সালের একটি আইনের আওতায় ১৫ বছরের জন্য ডাটাবেজকে মেধাস্বত্ব সুরক্ষার অধিকার দিয়েছে৷ এটি বাংলাদেশের জন্যও প্রযোজ্য হওয়া উচিত৷


মাস্ক কর্মের অধিকার :


মাস্ক হচ্ছে আইসি বা ইন্টিগ্রেটেড সার্কিটের দ্বিমাত্রিক বা ত্রিমাত্রিক লেআউট বা টাইপোগ্রাফি৷ সেমিকন্ডাক্টর বা চিপ এর আওতায় পড়ে৷


আমরা হয়তো কমপিউটারের মাদারবোর্ড এখন তৈরি করি না৷ কিন্তু এমন কাজ আমরা করতেই পারি৷ সেজন্য আইনে এ ধরনের কাজের সুরক্ষা থাকতে হবে৷ আমেরিকা ছাড়াও অস্ট্রেলিয়া ও হংকং-এ এসব অধিকার রক্ষার আইন রয়েছে৷


উদ্ভিদ উদ্ভাবক অধিকার :


এই অধিকারটি তাকে দেয়া হয় যিনি উদ্ভিদের নতুন জাত তৈরি করেন বা বৈচিত্র্য আনেন৷ বাংলাদেশের মতো কৃষি প্রধান দেশে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ একটি অধিকার৷ এখন যখন আমরা হাইব্রিড বীজের যুগে পা রেখেছি তখন নতুন নতুন উদ্ভাবনকে রক্ষা করার জন্য এমন আইন আমাদের করা দরকার, যার সাহায্যে এসব আবিষ্কারকে সুরক্ষা করা যায়৷


আদিবাসী সংস্কৃতির সুরক্ষা : বাংলাদেশের জন্য এটি খুবই গুরুত্বপূর্ণ যে এই দেশে বসবাসকারী আদিবাসীদের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য, স্বাতন্ত্র্য ও জীবনবোধকে যেন রক্ষা করা হয়৷ আইনে এসব অধিকারকে স্বীকার করতে হবে৷ এছাড়াও এখন গণসংস্কৃতি, লোকগীতি ও অন্যান্য সামাজিক সম্পদ ও তথ্যপ্রযুক্তিসংশ্লিষ্ট মেধাসম্পদ রক্ষা করার জন্য মেধাসম্পদ আইনসমূহকে নতুন করে ঢেলে সাজানো দরকার৷


এমনিতেই আমরা চারিত্রিকভাবে আবিষ্কারবিমুখ জাতি৷ ঐতিহ্যগতভাবে আমরা নিজেরা পণ্য তৈরি করার চাইতে অন্যের তৈরি করা পণ্য বিক্রি করে কিছু মুনাফা করতে পারলেই খুশি হয়ে যাই৷ সেজন্য বাংলাদেশের প্যাটেন্ট অফিসে আমাদের নিজেদের আবিষ্কারের জন্য আবেদনের সংখ্যা খুবই কম৷ এই অবস্থার আমূল পরিবর্তন করতে হবে৷


প্রস্তাবনা :


আমি মনে করি প্রতি বছর নতুন নতুন প্রতিশ্র“তি দেবার চাইতে আমরা অতি সামান্য কিছু পদক্ষেপ নিয়েও মেধাসম্পদের ক্ষেত্রে অস্তিত্ব বিপন্ন হবার মতো দশা থেকে বাচার পথে যেতে পারি৷ এজন্য নিচের পদক্ষেপগুলো অবিলম্বে নিতে হবে :


০১.


কপিরাইট আইন, প্যাটেন্ট ও ডিজাইন আইন ও ট্রেডমার্ক আইন সংশোধন এবং নতুন করে প্রণয়ন করতে হবে৷ এসব আইনে নতুন প্রযুক্তি ও নতুন মেধাস্বত্ব সংরক্ষণের ধারণার প্রতিফলন ঘটাতে হবে৷ ভৌগোলিক নির্দেশনা, ইউটিলিটি মডেল, আদিবাসী সংস্কৃতির সুরক্ষা, গণসংস্কৃতি, লোকসংস্কৃতি, লোকগীতি ও অন্যান্য সামাজিক মেধাসম্পদের সুরক্ষার জন্য নতুন আইন প্রণয়ন করতে হবে৷


০২.


কপিরাইট অফিস, প্যাটেন্ট, ডিজাইন ও ট্রেডমার্ক অফিসকে একটি মন্ত্রণালয়ের অধীনে এনে ওয়ানস্টপ আইপি সার্ভিস চালু করতে হবে এবং এজন্য এসব অফিসের জন্য প্রয়োজনীয় জনবল ও অবকাঠামো গড়ে তুলতে হবে৷


০৩.


মেধাস্বত্ব লঙ্ঘনজনিত অপরাধ দমনের জন্য বিশেষ টাস্কফোর্স গঠন করতে হবে এবং আইনকে কঠোরভাবে প্রয়োগ করতে হবে৷ এজন্য এফবিসিসিআই, ডিসিসিআই, সঙ্গীত সমিতি, প্রকাশক সমিতি, সিনেমা সমিতি ও বেসিসসহ সংশ্লিষ্ট বাণিজ্য সংগঠনগুলোকে সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে৷


০৪.


বাংলাদেশের তথ্যপ্রযুক্তি খাতের সাথে মেধাসম্পদ সুরক্ষার সব শাখারই ব্যাপক সম্পর্ক রয়েছে৷ প্রচলিত কপিরাইট আইনের নতুন নতুন বিষয় অন্তর্ভুক্ত হতে হবে৷ ২০০৮ সালের ট্রেডমার্ক আইনে সেবাখাতকে ট্রেডমার্কের অধীনে আনায় এখন আমরা আইটি সেবাকেও ট্রেডমার্ক হিসেবে নিবন্ধন করতে পারবো৷ কিন্তু ডিজাইন আইনে পরিবর্তন দরকার হবে৷ মাস্ক কর্ম ডাটাবেজ এসব বিষয়ে নতুন আইন দরকার হবে৷ একই সাথে প্যাটেন্ট আইনেও পরিবর্তন প্রয়োজন হবে৷ এমবেডেড সফটওয়্যার নয়, প্রয়োজন হবে সফটওয়্যারের প্রসেসকে প্যাটেন্ট করার বিধান৷


কিন্তু সবচেয়ে বড় পরিবর্তনটি দরকার হবে সফটওয়্যার ও সেবাখাতের প্রতিনিধিত্ব, বিকাশ ও সুরক্ষার জন্য যে বাণিজ্য সংগঠনটি রয়েছে সেই বেসিসের নীতিনির্ধারকদের মানসিকতার পরিবর্তন৷ বেসিস যদি এক্ষেত্রে কার্যকর ভূমিকা না নেয়, তবে সফটওয়্যার ও সেবাখাতের মেধাসম্পদ সুরক্ষা করা এমনকি আইন দিয়েও করা যাবে না৷








০ টি মন্তব্য



মতামত দিন

আপনি লগ ইন অবস্থায় নেই।
আপনার মতামতটি দেওয়ার জন্য লগ ইন করুন। যদি রেজিষ্ট্রেশন করা না থাকে প্রথমে রেজিষ্ট্রেশন করুন।







পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন? পুনরায় রিসেট করুন






রিভিউ

আপনি লগ ইন অবস্থায় নেই।
আপনার রিভিউ দেওয়ার জন্য লগ ইন করুন। যদি রেজিষ্ট্রেশন করা না থাকে প্রথমে রেজিষ্ট্রেশন করুন।