সম্ভাবনাময় শিল্প মোবাইল ফোন কনটেন্ট
গত কয়েক বছরে বাংলাদেশে মোবাইল ফোন শিল্পে একটা নীরব বিপ্লব ঘটে গেছে৷ মোবাইল ফোন এখন আর কোনো বিলাসিতার নাম নয়৷ দৈনন্দিন জীবনের নিত্যপ্রয়োজনীয় একটি অংশ৷ বাংলাদেশে এ খাতে কারো আগ্রহের যেমনি কমতি নেই, তেমনি মোবাইল ফোনের চাহিদারও শেষ নেই৷ এ চাহিদার একটি বড় অংশজুড়ে আছে মোবাইল ফোনের কনটেন্ট৷ বর্তমানে এদেশে মোবাইল ফোন কনটেন্টের প্রায় ৩০০ কোটি টাকার বাজার আছে৷ মোবাইল ফোনকে আগে অনেকেই তথ্যপ্রযুক্তির সাথে মেলাতে চাইতেন না৷ সে ধারণার এখন পরিবর্তন হয়েছে৷ মোবাইল ফোন এখন তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তির অবিচ্ছেদ্য অংশ৷ বাংলাদেশে এর বিস্তার এবং পাঠকদের চাহিদার কথা চিন্তা করে এবারের প্রচ্ছদ প্রতিবেদন সাজানো হয়েছে মোবাইল ফোন ও এর কনটেন্ট নিয়ে৷
মোবাইল ফোন কনটেন্ট
প্রথমেই জেনে নিই মোবাইল ফোনের কনটেন্ট বলতে আমরা আসলে কি বুঝি৷ মোবাইল ফোন নামটি সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হলেও এর প্রকৃত নাম হচ্ছে সেল ফোন৷ সেল ফোন উদ্ভাবিত হয়েছিল যোগাযোগ ব্যবস্থার আধুনিকায়নের অংশ হিসেবে৷ একথা অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই, ল্যান্ডফোনের অনেক সীমাবদ্ধতা আছে৷ এই সীমাবদ্ধতা দূর করার জন্যই উদ্ভাবন করা হয়েছে সেল ফোন বা মোবাইল ফোনের৷ প্রথমদিকে সেল ফোন ব্যবহার করা হতো শুধুই কথা বলার কাজে৷ ধীরে ধীরে এর বহু ধরনের ব্যবহার বাড়তে থাকে৷ ভোক্তারা মোবাইল ফোন ব্যবহার করার পাশাপাশি এখন আরো অনেক সুবিধা চান৷ এই সুবিধাগুলোর মধ্যে আছে এসএমএস, এমএমএস, ই-মেইল, রিংটোন, ওয়াপ, গেমস, লোগো, ইন্টারনেট ইত্যাদি৷ এগুলো সবই গ্রাহকভিত্তিক বিভিন্ন সুবিধা৷ গ্রাহকভিত্তিক এ সুবিধাগুলোকেই বলা হয় মোবাইল ফোন কনটেন্ট৷
বাংলাদেশের প্রেক্ষাপট
বাংলাদেশে মোবাইল ফোন কনটেন্ট নিয়ে গড়ে উঠছে বিশাল বাজার৷ মোবাইল ফোন ব্যবহার করার পাশাপাশি এখন অনেকেই বিভিন্ন মোবাইল ফোনের কনটেন্টের দিকে ঝুঁ কে পড়ছে৷ অনেক নামীদামী কোম্পানিও এখন মোবাইল কনটেন্টের ব্যবসায়ে আগ্রহ দেখাচ্ছে৷ এই সেক্টরের মাধ্যমে আইসিটির অনেকেরই কর্মসংস্থান হবে৷ বর্তমানে এটি একটি ব্যাপক সম্ভাবনাময় শিল্প৷ পৃথিবীর বেশিরভাগ দেশেই মোবাইল ফোন কনটেন্টের কোটি কোটি ডলারের বাণিজ্য হয়৷ বেশ কয়েক বছর হলো বাংলাদেশে এর বিকাশ শুরু হয়েছে৷ পত্রপত্রিকা খুললেই আমরা দেখতে পাই রিংটোন, ওয়ালপেপার প্রভৃতির চটকদার বিজ্ঞাপন৷ এগুলো সবই মোবাইল ফোন কনটেন্টের বিজ্ঞাপন৷ শুধু পত্রপত্রিকাই নয় মোবাইল ফোনের ওয়েবসাইটসহ অনেক ওয়েবসাইটেও এদের সদর্প পদচারণা লক্ষ করা যায়৷
লোগো ও রিংটোন
মোবাইল ফোন কনটেন্টের প্রথম ব্যবহার শুরু হয় মোবাইল ফোন অপারেটরদের লোগো সরবরাহ করার মধ্য দিয়ে৷ শুরুর দিকে ফোন অপারেটরদের এই সাদাকালো লোগোই বেশ জনপ্রিয়তা পায়৷ ফোন সেট চালু করলে সেটে এই লোগো স্বয়ংক্রিয়ভাবে প্রদর্শিত হতো৷ ধীরে ধীরে ভোক্তারা তাদের ইচ্ছে অনুযায়ী লোগো ব্যবহার করতে চাইলেন৷ তাদের চাহিদা অনুযায়ী ফোন অপারেটরদের পাশাপাশি আরো অনেক প্রতিষ্ঠান এসব কনটেন্ট পুঁজি করে বাণিজ্য করতে শুরু করে৷ ফোন সেট নির্মাতারাও এসব লোগো এবং চিত্রভিত্তিক বিভিন্ন কনটেন্ট ফোন সেটে ডাউনলোড করার সুবিধাসম্বলিত ফোন তৈরি করতে থাকে৷ পরে শুধু লোগো ও চিত্রভিত্তিক কনটেন্টই এই ব্যবসায় থেমে থাকেনি৷ লোগো ও চিত্রভিত্তিক কনটেন্টের পর রিংটোন থেকে শুরু করে এখন এর বহুমাত্রিক চাহিদা সৃষ্টি হয়েছে৷ ২০০৭ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে স্পেনের বার্সিলোনাতে থ্রিজিএসএম ওয়ার্ল্ড কংগ্রেস শীর্ষক সম্মেলনে মোবাইল ফোনের বিজ্ঞাপন মূল আলোচনার স্থান দখল করে নেয়৷ এ সম্মেলনে মোবাইলের মাধ্যমে বিনোদন এবং মোবাইল কনটেন্টের ব্যবসায়ের বিভিন্ন দিক ও সম্ভাবনা নিয়ে আলোচনা করা হয়েছিল৷
মোবাইল ফোনের কনটেন্ট হচ্ছে বর্তমান সময়ের একটি শক্তিশালী মাধ্যম৷ এর অনেক বিভাগ রয়েছে৷ আমাদের দেশে মোবাইল ফোনের লোগো ও রিংটোন মোবাইল ফোন কনটেন্টের মধ্যে সবচেয়ে জনপ্রিয়তা পেয়েছে৷ কিন্তু মোবাইল ফোন কনটেন্ট শুধু লোগো ও রিংটোনের মধ্যে সীমাবদ্ধ নেই৷ মোবাইল কনটেন্টগুলোর মধ্যে এখন পর্যন্ত মানুষের মধ্যে সবচেয়ে বেশি আলোড়ন তুলতে পেরেছে মোবাইলে মিউজিক৷ মোবাইল ফোনে যেকোনো অডিও ফাইল চালানোই মোবাইল মিউজিকের আওতায় পড়ে৷ মোবাইল ফোনের মিউজিক বলতে এক সময় শুধু এএসি তথা অ্যাডভান্সড অডিও কোডিং ফাইল ফরমেটকেই বুঝাতো৷ অডিওর জগতে এমপিথ্রি ফাইল ফরমেটের ব্যাপক জনপ্রিয়তা ধীরে ধীরে মোবাইল ফোন নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোকে বাধ্য করে মোবাইল ফোনে এর সাপোর্ট দিতে৷ মোবাইল ফোনে অডিও কয়েক ধরনের হয়৷ এগুলোর মধ্যে রিংটোন, ওয়েলকাম টিউন, মিডিয়া প্লেয়ারের জন্য অডিও প্রভৃতি৷ রিংটোন কী তা নতুন করে বলার কিছু নেই৷ কোনো নম্বরে কল করলে কল ধারার জন্য মিউজিক দিয়ে যে অ্যালার্ট ব্যবস্থা ফোন সেটে রাখা হয় তাকেই রিংটোন বলে৷ আর ওয়েলকাম টিউন হচ্ছে কাউকে কল করলে রিং হবার যে অ্যালার্ট দেয় সেটি৷ বর্তমানে মোবাইল ফোন কনটেন্টের ব্যবহার এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, বেশিরভাগ মোবাইল ফোন ক্রেতা এই ফোন কিনতে গিয়ে প্রথমেই জানতে চান ফোন সেটে এমপিথ্রি ফাইল ফরমেট সাপোর্ট করে কি না৷ অবশ্য এখনকার অনেক আধুনিক মোবাইল ফোন সেট এএসি বা এমপিথ্রি ছাড়াও নানা রকমের ফাইল ফরমেটের অডিও চালাতে পারে৷ শুরুর দিকে মোবাইল ফোনগুলোর সম্বল বলতে ছিল নানারকমের মনোফোনিক রিংটোন৷ এই রিংটোনগুলো একই টোনে বাজতো৷ ধীরে ধীরে মনোফোনিক রিংটোনের জায়গা দখল করে নেয় পলিফোনিক রিংটোন৷ পলিফোনিক রিংটোন একাধিক টোনে বাজতো৷ আমাদের দেশে পলিফোনিক রিংটোন অনেকের কাছেই ডিজিটাল সাউন্ড নামে পরিচিত৷ পলিফোনিক রিংটোনের পর এখন রিংটোন হিসেবে সরাসরি এমপিথ্রি ব্যবহার করা যাচ্ছে৷
অনেক ক্ষেত্রেই মূল গানের অংশ বা গানের ডাবিং করা অংশ রিংটোন হিসেবে ব্যবহার লক্ষ করা যাচ্ছে৷ তবে এই কালচার শুধুই যে বাংলাদেশে তা নয়৷ পুরো বিশ্বেই এমন কালচার এখন অতি সাধারণ ঘটনা৷ আরেক ধরনের টোন ইদানীং জনপ্রিয়তা পেয়েছে৷ এটি হচ্ছে কোনো গান বা মিউজিকের বদলে সরাসরি কণ্ঠস্বর ব্যবহার করা৷ একে ভয়েসটোন বা রিয়েলটোন বলা হয়৷ ২০০৬ সালের এক সমীক্ষায় দেখা যায়, যুক্তরাষ্ট্রের সব মোবাইল কনটেন্টের বাজারে রিংটোনের মধ্যে শতকরা ৭৬.৪ ভাগ দখল করে আছে এসব রিয়েলটোন৷ বাকি অংশের মধ্যে শতকরা ১২ ভাগ মনোফোনিক রিংটোন এবং শতকরা ১১.৫ ভাগ পলিফোনিক রিংটোন৷
এ তো গেল মোবাইল ফোন কনটেন্ট রিংটোন হিসেবে মিউজিকের ব্যবহার৷ রিংটোন ছাড়াও মোবাইল ফোনে এখন গান শোনা যায়৷ সঙ্গীত পিপাসুদের সঙ্গীতের তৃষ্ণা মেটাতে মোবাইল ফোন এখন কার্যকর ভূমিকা রাখছে৷ অনেক ক্ষেত্রে মোবাইল ফোন সেবাদানকারী অপারেটররাও ভোক্তাদের গান শোনার ব্যবস্থা করে দিচ্ছে৷ এটাও মোবাইল ফোন কনটেন্টের মধ্যেই পড়ে৷ তাছাড়াও ব্লুটুথ বা ইনফ্রারেড বেতারের মাধ্যমে আমরা হরহামেশাই গান বিনিময় করে চলেছি৷ ২০০৫ সালের দ্বিতীয়ার্ধ থেকে মোবাইল কনটেন্টের মাধ্যমে সঙ্গীতের ব্যবহার এত বেড়ে গেছে যে, আজ পুরো বিশ্বের সঙ্গীত শিল্প হুমকির মুখে পড়ে গেছে৷ যারা গান শোনার জন্য বিভিন্ন মিউজিক প্লেয়ার, সিডি, অডিও সিস্টেম, কমপিউটার প্রভৃতির ওপর নির্ভরশীল ছিল, তারা আজ সব বাদ দিয়ে মোবাইল ফোনেই নিজেদের চাহিদা মিটিয়ে নিচ্ছে৷ তাহলে অডিও সিস্টেম নির্মাতারা মোবাইল ফোন কনটেন্টের কাছে মার খাবে না কেন?
সবখানে পরিবর্তনের হাওয়া
এক সময় মোবাইল ফোনের সাদাকালো মনোক্রম লোগো ডাউনলোড করার জন্য মানুষ পাগল ছিল৷ খুব বেশিদিন আগের কথা নয়৷ আজ থেকে বছর চারেক আগেও এসব লোগো ডাউনলোড করার জন্য মানুষ প্রতিযোগিতায় নামতো৷ কার সংগ্রহে কত বেশি ও কত দুর্লভ লোগো বা আইকন আছে, এটি ছিল প্রতিযোগিতার বিষয়৷ এ অবস্থার আজ পরিবর্তন হয়েছে৷ রিংটোনের পাশাপাশি মোবাইল ফোনের লোগো, আইকন ওয়ালপেপার ইত্যাদি ও মোবাইল ফোন কনটেন্টের বাজার দাপিয়ে বেড়াচ্ছে৷ মোবাইল ফোনের ক্ষেত্রে লোগো বলতে মোবাইল ফোন সেট চালু করলে স্ক্রিনে ভেসে ওঠা আইকন বা মনোগ্রামকে বুঝায়৷ ভোক্তারা মনে করে, লোগোতে মানুষের ব্যক্তিত্বের বহিঃপ্রকাশ ঘটে৷ তাই এখনো অনেকেই লোগো নিয়ে খুব আগ্রহ দেখায়৷ প্রথম প্রথম ফোন অপারেটররাই এই লোগো দিয়ে ফোন ব্যবহারকারীদের আকৃষ্ট করলেও এখন লোগোর বাণিজ্য শুধু অপারেটরদের হাতে নেই৷ শুধু লোগোর বাণিজ্য করার জন্য অনেক নামীদামী প্রতিষ্ঠান নিবন্ধন করে৷ অনেক ব্যবহারকারী আছেন, যারা নিজেরাই নানারকম লোগো তৈরি করে থাকেন৷ লোগোর ব্যবসায়ীরা তাদের কাছ থেকে প্রয়োজনে লোগো কিনে নিয়ে হলেও এখন বাণিজ্য করছে৷
ওয়ালপেপার
মানুষের চাহিদা কখনো থেমে থাকে না৷ সাদাকালো মনোক্রম ডিসপ্লের মোবাইল ফোন সেট থেকে এখন রঙিন ডিসপ্লেসহ মোবাইল ফোনের চাহিদাই বেশি৷ রঙিন ডিসপ্লেসহ মোবাইল ফোনে লোগোর পাশাপাশি ব্যাকগ্রাউন্ড ইমেজ হিসেবে ওয়ালপেপার রাখার সুবিধা থাকায় দিন দিন লোগোর চাহিদা কমছে৷ লোগোর বদলে এখন সবাই ব্যাকগ্রাউন্ড ইমেজ হিসেবে ওয়ালপেপার ডাউনলোড করতে চান৷ মোবাইল ফোনে ওয়ালপেপার হচ্ছে ফোন সেটের স্ক্রিনের ব্যাকগ্রাউন্ডে যে ছবি সেট করে দেয়া হয় তা৷ সাধারণত এসব ওয়ালপেপারের মধ্যে সিনেমা, প্রিয় কোনো চরিত্র, প্রিয় বই, প্রিয় কোম্পানি ইত্যাদি বেশি৷ অনেকে নিজের বা প্রিয়জনের ছবি ওয়ালপেপার হিসেবে রাখতে পছন্দ করেন৷ এ কারণে মোবাইল ফোন সেটে নির্মাতা প্রতিষ্ঠানগুলোও ফোনের মধ্যে ওয়ালপেপার ডাউনলোডের সুবিধা রাখে৷ ফোন সেটের ক্রেতারাও সেট কেনার সময় দেখে থাকেন, সেটে ডাউনলোডের অপশন আছে কিনা৷
স্ক্রিন সেভার
সাদাকালো মনোক্রম ডিসপ্লের সেটগুলোতে একটা সাধারণ সমস্যা ছিল৷ ডিসপ্লের অংশে বেশি সময় ধরে লেখা ভেসে থাকতো এবং সে অংশ ধীরে ধীরে ফিকে হতো৷ অনেক ক্ষেত্রে ফিকে না হয়ে লেখার বা ডিসপ্লের গাঢ়ত্ব বেড়ে যেত৷ সে সমস্যা থেকে মুক্ত থাকার জন্য স্ক্রিন সেভার প্রযুক্তির উদ্ভব৷ স্ক্রিন সেভার ডিসপ্লের পুরো অংশ এনিমেশনের মাধ্যমে ডিসপ্লের ক্ষতি হবার হাত থেকে রক্ষা করতো৷ এই স্ক্রিন সেভারও ফ্যাশনের প্রতীক হয়ে দাঁড়ায়৷ আর সেই সুযোগে মোবাইল ফোন কনটেন্টে নতুন মাত্রা পায়৷ স্ক্রিন সেভারও এর গুরুত্বপূর্ণ অংশ হয়ে যায়৷ স্ক্রিনসেভার হচ্ছে চলমান একটি বিশেষ ধরনের এনিমেশন৷ বর্তমানে এ ধরনের স্ক্রিন সেভার বিক্রি করে অনেক কোম্পানি কোটি কোটি টাকার বাণিজ্য করছে৷ অবশ্য বর্তমান রঙিন ডিসপ্লের মোবাইল ফোন সেটের যুগেও স্ক্রিন সেভার দাপটের সাথে ব্যবহার হচ্ছে৷
ভিডিও কনটেন্ট
ভিডিও মোবাইল কনটেন্ট হচ্ছে মোবাইল ফোনে ভিডিওর সাপোর্ট৷ আজকাল আরো একটি মোবাইল ফোন কনটেন্ট বেশ জনপ্রিয় হয়ে উঠেছে৷ এটি হচ্ছে ফটো কল৷ মোবাইল ফোনে কারো কল আসলে সাধারণত এতদিন রিং বা ভাইব্রেশনের মাধ্যমে সবাই বুঝতে পারতো৷ এই ধারা ভেঙ্গে এখন ফটো কলের প্রতিও অনেকের আগ্রহ বাড়ছে৷ ফটো কল হচ্ছে সেই প্রযুক্তি যাতে কেউ কল করলে তার ছবি ভেসে উঠবে৷ এখন এটিও মোবাইল ফোন কনটেন্টের অংশ৷ চিত্রভিত্তিক মোবাইল ফোন কনটেন্টের হাত ধরে এখন ভিডিও মোবাইল কনটেন্টের জয়জয়কার৷ অনেকেই চান বিভিন্ন সিনেমা, গান, ভিডিও প্রভৃতি মোবাইলে থাকুক৷ তাহলে অবসর সময়ে সময় কাটানো নিয়ে কোনো ঝামেলা হবে না৷ এখনকার বেশিরভাগ মোবাইল ফোনেই এই সুবিধা পাওয়া যায়৷ অনেক ধরনের মোবাইল ফোন ভিডিওর ফাইল ফরমেটের মধ্যে চারটি ফরমেট খুব জনপ্রিয়৷ এগুলো হচ্ছে থ্রিজিপিপি, এমপিইজি ফোর, আরটিএসপি এবং ফ্ল্যাশ লাইট৷ অনেক প্রতিষ্ঠান এ ধরনের ভিডিও মোবাইল কনটেন্টের ব্যবসায়ে কোটি কোটি টাকা আয় করছে৷ ভিডিও মোবাইল কনটেন্টের মধ্যে অনেক ভাগ রয়েছে৷ এগুলোর মধ্যে স্ট্রিমিং ভিডিও, স্ট্রিমিং টিভি, মুভি শো ইত্যাদি জনপ্রিয়৷
স্ট্রিমিং ভিডিও
স্ট্রিমিং ভিডিও হচ্ছে স্ট্রিমিং টিভির একটি রূপ৷ স্ট্রিমিং টিভি বলতে সহজ ভাষায় টেলিভিশনের মোবাইল ফোন সংস্করণ বলা যায়৷ টেলিভিশনের ক্ষেত্রে আমরা জানি কাজের সম্প্রচার কেন্দ্র থেকে ওয়্যারলেস সিগন্যাল, ট্রান্সমিশনের মাধ্যমে সম্প্রচার করা হয়৷ আর টেলিভিশন হচ্ছে দূরবর্তী রিসিভার যন্ত্র৷ সম্প্রচার কেন্দ্র থেকে পাওয়া সিগন্যাল কাজে লাগিয়ে ছবি পর্দায় দৃশ্যমান করাই এর কাজ৷ একইভাবে স্ট্রিমিং টিভি কাছাকাছি মোবাইল ফোন বেইজ স্টেশন বা সার্ভার থেকে পাওয়া ভিডিও সিগন্যালকে কাজে লাগিয়ে মোবাইলের ডিসপ্লেতে ছবি দৃশ্যমান করে৷ এই সুবিধার ফলে মোবাইলেই টেলিভিশনের যাবতীয় কার্যক্রম সম্পাদন করা সম্ভব হবে৷ তবে সেক্ষেত্রে হ্যান্ডসেট অনেক উন্নতমানের ও আধুনিক সুবিধাসংবলিত হতে হবে৷ উন্নত নেটওয়ার্ক সুবিধার পাশাপাশি হ্যান্ডসেট কমপক্ষে ২জি, ২.৫জি বা ৩জি নেটওয়ার্ক সাপোর্টেড হতে হবে৷ ধারণা করা হচ্ছে, মোবাইলের বর্তমান ধারার পর এটাই হবে পরবর্তী ধারা৷ এধরনের স্ট্রিমিং টিভি সাধারণত তিন ধরনের প্রযুক্তিতে ব্যবহার করা হয়ে থাকে৷ এগুলো হচ্ছে DVB-H, DVB, (ডিজিটালমিডিয়া ব্রডকাস্টিং) এবং MediaFLO ৷
উন্নত বিশ্বে এই সুবিধা কিছু কিছু মোবাইল অপারেটর দিয়ে ভোক্তাদের আকর্ষণ করার প্রক্রিয়ায় রয়েছে৷ অদূর ভবিষ্যতে আমরাও এই সুবিধা বাংলাদেশে দেখতে পেলে অবাক হবো না৷
মুভি শো আর স্ট্রিমিং টিভির ভেতরের প্রযুক্তি একই ধরনের৷ দুটোতেই মোবাইলের স্ক্রিনে ভিডিও দেখা যায়৷ পার্থক্য হচ্ছে স্ট্রিমিং টিভিকে টেলিভিশনের সাথে তুলনা করা যায়৷ কিন্তু মুভি শো টেলিভিশনের মতো নয়৷ মুভি শো বিচ্ছিন্ন কোনো ভিডিও বা অনুষ্ঠান হলেও তা টেলিভিশন চ্যানেলের মতো সম্প্রচার নয়৷ মোবাইল গেম
মোবাইল ফোনে অডিও বা ভিডিও কনটেন্টের পাশাপাশি আরো একটি মোবাইল কনটেন্ট বেশ জনপ্রিয়৷ এটি হচ্ছে মোবাইল গেম৷ আমাদের দেশে ভোক্তারা সবসময় চান নিজের মোবাইল ফোনে সবচেয়ে বেশি, বাড়তি সুবিধা থাকুক৷ মোবাইল ফোন এখন আর শুধু কথা বলার মাধ্যম নয়৷ কথা বলাকে ছাপিয়ে এখন বেশিরভাগ মোবাইল ফোন ব্যবহার করা হচ্ছে বিনোদনের মাধ্যম হিসেবে৷ আর সারা বিশ্বে এই বিনোদনের অংশ হিসেবে মোবাইল ফোন গেমিংয়ের প্রচণ্ড চাহিদা রয়েছে৷ মোবাইল ফোনে যে বিশেষ ধরনের অ্যাপ্লিকেশনভিত্তিক গেমিংয়ের ব্যবস্থা থাকে তাকে মোবাইল গেম বলা হয়৷ আজকাল বাণিজ্যিকভাবে মোবাইল ফোন গেম তৈরি ও বিপণন করা হচ্ছে৷ আমাদের দেশে এই মোবাইল ফোন গেমিং কিছুটা পিছিয়ে থাকলেও কাছের দেশ ভারত সদর্পে মোবাইল ফোন গেমিং বাণিজ্য করছে৷ ইদানীং আমাদের দেশের ভোক্তারাও অনেক সচেতন হচ্ছেন৷ মোবাইল ফোন কিনতে গিয়ে অনেকেই এখন ফোন বিক্রেতাদের কাছে জানতে চান ফোন জাভা সাপোর্টেড কিনা৷ অথবা জানতে চান ফোনের অপারেটিং সিস্টেম কি ফ্লেক্স, সিম্বিয়ান নাকি লিনআক্স৷ কারণ, নির্দিষ্ট কিছু অপারেটিং সিস্টেমের জন্য গেম এবং বিভিন্ন অ্যাপ্লিকেশনের ভিন্নতা আছে৷ আর জাভা সাপোর্টেড হলে তো কথাই নেই৷ এখনকার বেশিরভাগ গেম বা অ্যাপ্লিকেশন তৈরি করা হয় জাভা দিয়ে৷ তাই জাভা সাপোর্টেড মোবাইল ফোনে এসব অ্যাপ্লিকেশন ও গেম খুব সহজেই চলে৷
এখনো পিসি বা কন্সোল গেমিংয়ের সাথে মোবাইল ফোন গেমিংয়ের পার্থক্য আছে৷ কিন্তু অদূর ভবিষ্যতে এই পার্থক্য থাকবে না৷ মোবাইল ফোন গেমিং পিসি বা কন্সোল গেমিংয়ের সমমানের পর্যায়ে চলে যাবে৷ মোবাইল ফোন গেমিংয়ের অনেকগুলো ধরন রয়েছে৷ এগুলোর মধ্যে এখন পর্যন্ত পাজল গেমগুলো সবচেয়ে বেশি এগিয়ে আছে৷ কিন্তু ধীরে ধীরে অন্যান্য ধরনের গেম\ যেমন স্ট্র্যাটেজিক, আর্কেড, অ্যাকশন, অ্যাডভেঞ্চার, কার্ড, ক্যাসিনো, স্পোর্টস, রেসিং জনপ্রিয় হয়ে উঠছে৷ মোবাইল ফোনের কিছু পরিসংখ্যানে দেখা যায়, গ্রাহক মোবাইল ফোন গেমিং সবচেয়ে পছন্দ করে মেয়েরা৷ মোবাইল ফোন গেমারদের ৬৫ শতাংশই মেয়ে৷ এদের বেশিরভাগের পছন্দ পাজল বা স্ট্র্যাটেজিক গেম৷ অপরদিকে ছেলেরা পছন্দ করে অ্যাকশন বা অ্যাডভেঞ্চার ধরনের গেম৷ আরেকটি সমীক্ষায় দেখা যায়, বিশ বছরের কম বয়সীরা অন্যদের তুলনায় তিন গুণ বেশি মোবাইল ফোন গেম খেলে থাকেন৷ তবে ধীরে ধীরে এই অবস্থার উন্নতি হচ্ছে৷ অনেকেই এখন মোবাইল ফোন গেমিংয়ের জন্য ইন্টারনেটে ঘণ্টার পর ঘণ্টা কাটিয়ে দেন৷ ইন্টারনেট খুঁজে তারা বের করেন পছন্দের সব গেম৷ নিছক সময় কাটানো নয়, এটি এখন বিনোদনের অন্যতম অংশ৷
মোবাইল কুপন
নতুন এক ধরনের মোবাইল ফোন কনটেন্ট সবার কাছে বেশ আগ্রহের সৃষ্টি করেছে৷ এর নাম হচ্ছে মোবাইল কুপন৷ কোনো পার্ক বা ট্যুরিস্ট স্পটে যেমন টিকেট বা কুপনের মাধ্যমে প্রবেশ করার অধিকার অর্জন করা যায়৷ এই কুপনে এরকম এক মোবাইল ফোন থেকে অন্য মোবাইল ফোনে প্রবেশ করার সুবিধা পাওয়া যায়৷ শুধু অন্য মোবাইল ফোনে প্রবেশের জন্যই নয়৷ বাণিজ্যিক বিভিন্ন কাজেও এ ধরনের কুপন ব্যবহার করা যায়৷ এই কুপনগুলো এসএমএস বা অ্যাপ্লিকেশনের মাধ্যমে দেয়া-নেয়া করা যেতে পারে৷ এই সুবিধাটি এখনো গবেষণাধীন রয়েছে৷ অদূর ভবিষ্যতে আমরা এর সম্পর্কে আরো বিস্তারিত জানতে পারবো৷
বাংলাদেশে বিস্তার
বাংলাদেশে মোবাইল ফোন কনটেন্টের বাজার একটি বিকাশমান শিল্পের পর্যায়ে আছে৷ এই শিল্পটি খুব দ্রুত সম্প্রসারিত হচ্ছে৷ বাংলাদেশে এর উজ্জ্বল ভবিষ্যত্ অপেক্ষা করছে৷ আনুমানিক ৩০০ কোটি টাকার এই বাজার খুব দ্রুত কয়েক হাজার কোটি টাকার বাজারে উন্নীত হতে যাচ্ছে৷ বর্তমান বিশ্বে ভয়েস কল থেকে কোনো মোবাইল ফোন অপারেটর কোম্পানিই লাভের আশা করে না৷ সবাই এখন মোবাইল ফোন কনটেন্টের দিকে ঝুঁ কে পড়েছে৷ বাংলাদেশে এই চিত্র কিছুটা ভিন্ন৷ উন্নয়নশীল দেশ বলেই হয়ত আমাদের দেশে এখনো ভ্যালু অ্যাডেড সার্ভিসের চেয়ে ভয়েস কলের প্রতি সবার আগ্রহ বেশি৷ ধীরে হলেও এই অবস্থার পরিবর্তন হচ্ছে৷ ভোক্তারাও এখন আগের চেয়ে সচেতন হচ্ছে৷ মোবাইল ফোন কনটেন্টের প্রতি এখন অনেকেই আগ্রহী হয়ে উঠছে৷
সংশ্লিষ্টরা আশা করছেন, দিন দিন এ খাতের আরো উন্নতি হবে৷ এ খাত থেকে মানুষ আরো অনেক সুবিধা পাবে৷ আর অল্প কিছুদিনের মধ্যেই আমাদের দেশের মানুষও মোবাইল ফোনে টেলিভিশন দেখতে পাবে৷ এক হিসেবে মোবাইল ফোন কনটেন্ট মিডিয়া সবচেয়ে দ্রুত হারে বেড়ে চলেছে৷ দেশের অনেক প্রত্যন্ত অঞ্চলে টেলিভিশন বা রেডিও এখনো পৌছায়নি৷ কিন্তু মোবাইল ফোন পৌছে গেছে৷ আর মোবাইল ফোন কনটেন্ট যেহেতু মোবাইল ফোন দিয়ে চালিত, তাই এ শিল্পের সম্ভাবনা সবচেয়ে বেশি৷ স্ট্রিমিং টিভি বা স্ট্রিমিং রেডিও এ খাতের মাধ্যমে আমাদের দেশে তথ্যব্যবস্থাকে অভূতপূর্ব উন্নত করতে পারে৷ এর জন্য প্রয়োজনীয় অবকাঠামো আমাদের আছে৷ শুধু প্রয়োজন একটু তদারকি এবং সুষ্ঠু ব্যবস্থাপনা৷ দুঃখজনক হলেও সত্যি, মোবাইল ফোন কনটেন্টের এই বিশাল শিল্পকে সামনে রেখে এদেশের কারো কোনো প্রস্তুতি নেই৷ সেই সাথে পুরো বাজারকে পর্যবেক্ষণ করারও কোনো প্রতিষ্ঠান নেই৷ বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে বর্তমানে কয়েকশত কোটি টাকার মোবাইল কনটেন্টের বাজার তৈরি হলেও ভবিষ্যতে এই খাতের আরো বিশাল বাজার তৈরি হবে৷ মোবাইল ফোন অপারেটরদের সাথে কনটেন্ট প্রোভাইডার প্রতিষ্ঠান নির্দিষ্ট অংকের অর্থের বিনিময়ে চুক্তি করার মাধ্যমে মোবাইল ফোন কনটেন্ট সেবা দেবার অধিকার অর্জন করে৷ এই কনটেন্ট প্রোভাইডার প্রতিষ্ঠানে সৃজনশীল ব্যক্তিবর্গ, প্রোগ্রামার, এক্সপার্ট ভালো বেতনে নিয়োজিত থাকেন৷ গ্রাফিক্স ডিজাইনার, এনিমেটর এবং সফটওয়্যার ডেভেলপারদের এইখাতে চাহিদা দিন দিন বাড়ছে৷ ধীরে ধীরে মোবাইল কনটেন্টের বাজার অনেক বিস্তৃত হচ্ছে৷ ওয়েলকাম টিউন, রিংটোন, ওয়ালপেপার ছাড়িয়ে দেশ এখন স্ট্রিমিং ভিডিওর জগতে পা রাখতে যাচ্ছে৷ বাংলাদেশের আনাচে-কানাচে মোবাইল ফোনে অল্প কিছুদিনের মধ্যে সবাই ইলেকট্রনিক মিডিয়ার সাথে সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারবে৷ বর্তমান মোবাইল ফোনের ব্যবহারের ধরনও বদলে যাবে৷ গড়ে উঠবে একই সেবাদানকারী অনেক প্রতিষ্ঠান৷ শুরু হবে নতুন যুগের সূচনা৷ পুরো বিশ্বেই এখন মোবাইল ফোন হতে যাচ্ছে যাবতীয় মিডিয়া সেন্টারের উত্স৷ এর প্রভাব বাংলাদেশে পড়তে শুরু করেছে৷ এখন এই মিডিয়া সেন্টারের ব্যবহার যাতে অপরাধ বা অন্য কোনো বাজে কাজে ব্যবহার না হয় সেদিকে সবার লক্ষ রাখতে হবে৷ নীতিমালার পাশাপাশি নীতিনির্ধারকদের যুগোপযোগী সিদ্ধান্ত দেশের জনগণের সুন্দর ভবিষ্যত্ নিশ্চিত করতে পারে৷ বাংলাদেশে মোবাইল কনটেন্ট শিল্পের বিশাল সম্ভাবনা আছে৷ সেই সম্ভাবনার অপমৃত্যু যাতে না হয় তা আমাদেরই নিশ্চিত করতে হবে৷ শেষ কথা
আমাদের সবারই মনে রাখতে হবে, বাংলাদেশে সবচেয়ে দ্রুত অগ্রগতি হয়েছে এই মোবাইল ফোন খাতের৷ এই খাতের নিয়ন্ত্রণে বিটিআরসিকে আরো কার্যকর ভূমিকা রাখতে হবে৷ সেই সাথে মোবাইল ফোন অপারেটরদের আরো যুগোপুযোগী সিদ্ধান্ত নিতে হবে৷ শুধু ব্যবসায়িক চিন্তা-ভাবনা না করে সেবার দিকটাও দেখতে হবে৷ সবচেয়ে বড় সমস্যা হচ্ছে, আমাদের দেশে মোবাইল ফোন কনটেন্টের কোনো নীতিমালা নেই৷ সেই সাথে এই শিল্প তদারকি করারও কোনো সরকারি প্রতিষ্ঠান নেই৷ সেই সুযোগে মোবাইল ফোন অপারেটরেরাও নিজেদের ইচ্ছে মতো মোবাইল ফোন কনটেন্ট সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানদের বাণিজ্য করার সুযোগ দিয়ে চলেছে৷ কিন্তু এভাবে লাগামহীনভাবে সুযোগ দেয়াটা অনুচিত, যেখানে মান যাচাইয়ের সুযোগ নেই৷ মোবাইল ফোন কনটেন্ট শিল্প খাতটি একটি সম্ভাবনাময় শিল্প৷ তাই সচেতন হবার সময় এসেছে এখনই৷
০ টি মন্তব্য