সিলিকন ভ্যালির বড় চমকের অপেক্ষায় বিশ্ব
বড় বড় আইডিয়া এবং প্রযুক্তিতে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের জন্য সিলিকন ভ্যালির খ্যাতি বিশ্বজোড়া। গত কয়েক দশকে একের পর এক চমক উপহার দিয়েছে সিলিকন ভ্যালি। কিন্তু সাম্প্রতিক বছরগুলোয় ইন্টারনেট, গুগলের মতো সার্চ ইঞ্জিন, সোশ্যাল মিডিয়ার মতো সর্বব্যাপী প্ল্যাটফর্মের মতো বড় ধরনের উদ্ভাবন দেখাতে পারছে না তারা। কোয়ান্টাম কমপিউটিং ও স্বচালিত গাড়িকে সিলিকন ভ্যালির পরবর্তী বড় পদক্ষেপ হিসেবে দেখা হলেও তার বাস্তব রূপ সবার সামনে আসেনি এখনো।
সিলিকন ভ্যালি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের ৩০০ বর্গমাইল এলাকা জুড়ে বিস্তৃত একটি জায়গা, যা উত্তর ক্যালিফোর্নিয়াতে অবস্থিত। সানফ্রান্সিসকো এবং স্যান হোসে এ দুই শহরের মাঝামাঝি এই সিলিকন ভ্যালি। ১৯৯৫ সালের পর সিলিকন ভ্যালি হয়ে ওঠে ইন্টারনেট অর্থনীতি এবং উচ্চ প্রযুক্তি সংক্রান্ত বাণিজ্যিক কেন্দ্র। এখানেই জন্মলাভ করেছে ইয়াহু, গুগল, ইবের মতো বড় ইন্টারনেট ডটকম কোম্পানিগুলো। ২০০০ সালে এখানে গড়ে ওঠা প্রায় চার হাজার উচ্চ প্রযুক্তি কোম্পানি প্রায় ২০০ বিলিয়ন ডলারের বাণিজ্য করেছে আর এর সিংহভাগ হচ্ছে তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কিত বিনিয়োগের মাধ্যমে।
সার্চ ইঞ্জিন জায়ান্ট গুগল জানায়, তারা কোয়ান্টাম কমপিউটিংয়ে বেশ বড় সফলতা পেয়েছে। এটা অনেকটা প্রথম উড়োজাহাজ কিটি হকের উড্ডয়নের সাথে তুলনা করেছেন তারা। গুগলের দাবি, কোয়ান্টাম কমপিউটারটি মাত্র ৩ মিনিট ২০ সেকেন্ডে এমন হিসাব করতে সক্ষম, যা সাধারণ
কমপিউটার ১০ হাজার বছরে শেষ করতে পারবে না। কিন্তু ঘোষণার প্রায় তিন বছর পেরিয়ে যাচ্ছে কোয়ান্টাম কমপিউটার যে কিছু করতে পারে তার বাস্তব রূপ দেখা যাচ্ছে না। আপাতদৃষ্টিতে মনে হচ্ছে কোয়ান্টাম কমপিউটার নিয়ে মানুষের অপেক্ষা আরো দীর্ঘতর হতে যাচ্ছে। একই কথা সত্য স্বচালিত গাড়ি, উড়ন্ত গাড়ি, উন্নততর কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা (এআই) ও মস্তিষ্ক প্রতিস্থাপনের ক্ষেত্রে।
সিলিকন ভ্যালিতে পৃথিবী পাল্টে দেয়ার মতো আইডিয়ার দুষ্প্রাপ্যতা দেখা দিয়েছে বলে মনে করেন অনেক বিশ্লেষক। সাম্প্রতিক বছরগুলোয় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো যে আইডিয়ার বরাতে আয় করছে তা এক দশকেরও বেশি পুরনো। যেমন আইফোন ও মোবাইল অ্যাপের আইডিয়া। প্রযুক্তি দুনিয়ার আইডিয়াবাজরা কি তাদের মোটিভেশন হারিয়ে ফেলছেন?
অবশ্য প্রযুক্তি জায়ান্টরা ভিন্ন জবাব দিচ্ছেন। তারা নতুন যে প্রকল্প নিয়ে কাজ করছেন, তা নতুন অ্যাপ তৈরি বা অন্য প্রকল্পের চেয়ে অনেক কঠিন। মহামারীর দুই বছরে আমরা দেখেছি কীভাবে হোম কমপিউটার, ভিডিও কনফারেন্সিং সেবা, ওয়াই-ফাইয়ের মতো সেবায় বৈচিত্র্য এনেছে। এমনকি গবেষকরা সবচেয়ে দ্রুততর সময়ের মধ্যে ভ্যাকসিন তৈরি করেছেন, তাতে স্পষ্ট হয়েছে প্রযুক্তির উল্লম্ফন অব্যাহত রয়েছে।
কোয়ান্টাম কমপিউটিংয়ের মতো প্রযুক্তির পরবর্তী বড় প্রকল্পকে আরো সময় দেয়া প্রয়োজন বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা। দীর্ঘদিন হোয়াইট হাউজের কোয়ান্টাম কমপিউটিং প্রচেষ্টার নেতৃত্বে থাকা জ্যাক টেইলর বলেন, কোয়ান্টাম কমপিউটার অতীতের অন্য যেকোনো প্রকল্পের চেয়ে সবচেয়ে কঠিন কাজ। বর্তমানে কোয়ান্টাম স্টার্টআপ রিভারলেনের চিফ সায়েন্টিফিক অফিসার হিসেবে দায়িত্ব পালন করা টেইলর বলেন, প্রকৃতির স্বাভাবিক প্রবণতার বিরুদ্ধে লড়াই করে কোয়ান্টাম কমপিউটার প্রকল্পকে এগোতে হচ্ছে। গত কয়েক দশকের মধ্যে প্রযুক্তি দুনিয়ার সবচেয়ে বড় উদ্ভাবন মাইক্রোচিপ, ইন্টারনেট, মাউসচালিত কমপিউটার, স্মার্টফোন কিন্তু পদার্থবিদ্যার নীতিকে উড়িয়ে দিচ্ছে না।
সিলিকন ভ্যালির ইতিহাস বিশেষজ্ঞ ও ইউনিভার্সিটি অব ওয়াশিংটনের অধ্যাপক মার্গারেট ও’মারা বলেন, হার্ডওয়্যার ও সফটওয়্যার অবকাঠামো যদি না থাকত তাহলে ভাবুন মহামারীর অর্থনৈতিক প্রভাব কেমন হতো। মোবাইল ও ক্লাউড কমপিউটিং অসংখ্য ব্যবসার নতুন সুযোগ-সুবিধা সৃষ্টি করেছে।
কোয়ান্টাম কমপিউটিংয়ের মতো অবশ্য বড় চ্যালেঞ্জের মুখে নেই স্বচালিত গাড়ি ও এআই প্রকল্প। তবে কীভাবে জুতসই কোয়ান্টাম কমপিউটার তৈরি করা যায়, তা নিয়ে গবেষকরা যেমন মাথা কুটে মরছেন, তেমনি কোন মডেলের স্বচালিত গাড়ি নিরাপদে চালানো যাবে তা নিশ্চিত করতে হিমশিম খাচ্ছেন। মানবমস্তিষ্কের বিকল্প হিসেবে কাজ করার মতো এআই উদ্ভাবনেও একই চ্যালেঞ্জ দেখছেন গবেষকরা। এমনকি অগমেন্টেড রিয়ালিটির (এআর) আইগ্লাস প্রযুক্তি যে সহজ কিছু নয়, এমনটা বলছেন সংশ্লিষ্টরা।
মেটার ভাইস প্রেসিডেন্ট অ্যান্ড্রু বসওয়ার্থ বলেন, হালকা-পাতলা এআর আইগ্লাস তৈরির বিষয়টি যেন ১৯৭০-এর দশকে মাউসচালিত ব্যক্তিগত কমপিউটার (পিসি) নিয়ে আসার মতো চ্যালেঞ্জিং বিষয়। সম্প্রতি সবচেয়ে শক্তিশালী কোয়ান্টাম কমপিউটার নিয়ে বেশ অগ্রগতির কথা জানিয়েছে মেটা। এনভিডিয়ার হাজারো প্রসেসর দিয়ে তৈরি হচ্ছে মেটার ওই কোয়ান্টাম কমপিউটার।
বিশ্লেষকরা বলছেন, গত কয়েক বছরে ফেসবুক, গুগল বা অন্যান্য কোম্পানি প্রযুক্তিতে যে পরিবর্তন এনেছে, তার বড় অংশ জুড়ে রয়েছে সফটওয়্যার। কোয়ান্টাম কমপিউটার, স্বচালিত গাড়ি ও এআইয়ে বড় ধরনের ধাক্কা দিতে হার্ডওয়্যারে বৈপ্লবিক পরিবর্তন আনতে হচ্ছে। খানিক সময় নিলেও এক্ষেত্রে শিগগিরই সিলিকন ভ্যালি সফলতার পরিচয় দেবে বলে মনে করেন সংশ্লিষ্টরা।
প্রযুক্তি বাজারের লিডিং প্রতিষ্ঠানগুলোর হেডকোয়ার্টার এই সিলিকন ভ্যালিতে অবিস্থিত। প্রযুক্তির এমন কোনো লিডিং প্রতিষ্ঠান নেই যেগুলো সিলিকন ভ্যালিকেন্দ্রিক নয়। গুগল, মাইক্রোসফট থেকে শুরু করে সেই অ্যামাজান, ই-বের মতো প্রতিষ্ঠানগুলোর বসতবাড়ি এই সিলিকন ভ্যালিতে। শুধু বসতবাড়ি, তাদের সব খাওয়া-দাওয়াও এই সিলিকন ভ্যালিতে। বিখ্যাত সব স্টার্টআপের জন্ম এই সিলিকন ভ্যালিতে। অ্যাডবি, ওরাকলের মতো বিশ্বখ্যাত প্রতিষ্ঠানের স্টার্টআপ এই সিলিকন ভ্যালি থেকে। সিলিকন ভ্যালিতে এখন পর্যন্ত যত টেক স্টার্টআপ হয়েছে তার যদি একাংশও না হতো তাহলে শত শত বছর প্রযুক্তি থেকে পিছিয়ে যেতাম।
সামাজিকভাবে তথ্যপ্রযুক্তিতে উন্নয়নের জন্য সব থেকে বেশি ভ‚মিকা রাখে সিলিকন ভ্যালি। সারা বিশ্বে সিলিকন ভ্যালি সৃষ্টি করেছে প্রযুক্তির জন্য আজব ক্ষেত্র। পৃথিবী বিখ্যাত ভেনচারগুলোর দুই-তৃতীয়াংশ আসে সিলিকন ভ্যালি থেকে। গবেষকরা মনে করেন সিলিকন ভ্যালির প্রতিষ্ঠানগুলো না আসলে বিশ্ব উদ্যোক্তারা অনেক বেশি পিছিয়ে থাকত। পৃথিবীর বিখ্যাত ডাটা সেন্টারগুলোর আবাস এই সিলিকন ভ্যালিতেই।
কমপিউটার অপারেটিং সিস্টেমের সাফল্যে মধ্যরাতেও তাদের নাচ-গান করতে দেখা গিয়েছিল। যুক্তরাষ্ট্রের ক্যালিফোর্নিয়া অঙ্গরাজ্যের সিলিকন ভ্যালি জেগে উঠছিল। সেই সিলিকন ভ্যালিই আজ যেন প্রযুক্তির দিক থেকে পুরো বিশ্বের নিয়ন্ত্রক হয়ে উঠেছে। আস্তে আস্তে দৃশ্যপটে হাজির হয় আজকের সার্চ ইঞ্জিন গুগল, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুক। এসব প্রতিষ্ঠানের ইন্টারনেটকে প্রতিষ্ঠা করা। এরপরই হাজির হয় ভিডিও দেখার ওয়েবসাইট ইউটিউব।
মেটার ফেসবুক প্রতিষ্ঠার পর মার্ক জাকারবার্গ সিলিকন ভ্যালির পালো আলটোতে তার সদর দপ্তর স্থানান্তর করেন। এরই মধ্যে সানফ্রান্সিসকোয় একদল সহকর্মী মিলে আরেক সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম নিয়ে হাজির হলেন। ১৪০ বর্ণে মনের ভাব প্রকাশের এই মাধ্যম টুইটার কোনো কোনো ক্ষেত্রে ফেসবুকের চেয়েও এগিয়ে। ওদিকে কখনই বসে ছিল না আরেক প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান অ্যাপল। স্টিভ জবসকে ফিরিয়ে এনে প্রতিষ্ঠানটি যেন নবযাত্রা শুরু করে। এরপর বিশ্ব দেখল আইপড, আইফোনসহ আরও কত কী!
ফেসবুকের যাত্রা শুরুর সময় এই বাড়িতেই ছিলেন মার্ক জাকারবার্গ। ব্রাউডার আর তার সহকর্মীরা দিনরাত খেটে যাচ্ছেন এক একটি অ্যাপ তৈরি করতে। অনেকটা রোবট আইনজীবীর মতো কাজ করছে এই অ্যাপ। এয়ারলাইনস ও হোটেল বুকিংয়ের ক্ষেত্রে ফাঁকির জায়গাগুলো খুঁজে বের করছে অ্যাপটি।
সিলিকন-চিপ উদ্ভাবন ও বাজারজাত করার কারণে এই এলাকার নাম হয়েছে সিলিকন ভ্যালি বা সিলিকন উপত্যকা। তবে এখন এখানে বিভিন্ন প্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের রাজত্ব। এসব প্রতিষ্ঠানের মধ্যে গুগল, অ্যাপল, ফেসবুক, টুইটার, ইয়াহু, অ্যাডবি, ইবে, নেটফ্লিক্স, সিসকো, পেপ্যাল, ইন্টেল, এইচপি, ইউটিউব, উবার, প্যান্ডোরা ইত্যাদি উল্লেখযোগ্য।
একসময় সিলিকন ভ্যালিতে আফ্রিকান-আমেরিকান ও লাতিন-আমেরিকানদের বসবাস ছিল। কিন্তু প্রযুক্তির বাজার যত বড় হয়েছে, তত সিলিকন ভ্যালিতে বিদেশি মুখের সংখ্যা বেড়েছে। চীন, জাপান, ভারত, কিউবাসহ নানা দেশের মানুষ এখানে বসবাস করে, কাজ করে। কমপিউটার ও গণিতের মতো ক্ষেত্রগুলোয় এখানকার মোট কর্মীগোষ্ঠীর ৬০ শতাংশই বিদেশি বংশোদ্ভ‚ত।
প্রযুক্তি আর উদ্ভাবনের হাত থাকলে বলা যেত, সিলিকন ভ্যালিতে তারা হাত ধরাধরি করে চলে। যুক্তরাষ্ট্রের অঞ্চলটিকে অনায়াসে বিশ্বের প্রযুক্তিকেন্দ্র বলা যায়। অ্যাপল, গুগল, ফেসবুক, ইন্টেল, এইচপি, ওরাকল, সিসকোসহ বিশ্বের বাঘা বাঘা সব তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠানের প্রধান কার্যালয় সিলিকন ভ্যালিতে।
ফেসবুক আগে বলেছিল তারা পণ্য বিক্রির জন্য দোকান খুলবে না। কিন্তু যখন তারা হেডসেট তৈরির পথে হাঁটতে শুরু করল, তখন থেকেই দোকান খোলার বিষয়টির আঁচ পাওয়া যাচ্ছিল। অবশেষে ফেসবুকের মূল প্রতিষ্ঠান মেটা ঘোষণা দিয়েছে, তারা হার্ডওয়্যার পণ্য বিক্রির জন্য দোকান খুলতে যাচ্ছে। অবশ্য অ্যাপলের মতো এখনই তারা দেশজুড়ে স্টোর খুলে বসতে যাচ্ছে না। বিবিসির খবরে বলা হয়েছে, আপাতত ক্যালিফোর্নিয়ায় বার্লিংগেমে মেটার ক্যাম্পাসে খোলা হচ্ছে প্রতিষ্ঠানটির প্রথম হার্ডওয়্যার স্টোর।
এই মে আনুষ্ঠানিকভাবে যাত্রা শুরু করেছে এই মেটার হার্ডওয়্যার স্টোর। এখান থেকে ক্রেতারা তাদের পছন্দমতো মেটার তৈরি পোর্টাল হেডফোন ও কোয়েস্ট ভার্চুয়াল রিয়েলিটি হেডসেট কিনতে পারবেন। এর বাইরে এই স্টোর থেকে রেব-ব্যান স্টোরিজ স্মার্টগ্লাসের ডেমো পরীক্ষা করে দেখে তা অনলাইনে ফরমাশ দিতে পারবেন।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, মেটা মূলত তাদের হার্ডওয়্যার পণ্যগুলোর অভিজ্ঞতা দিতে এই স্টোর চালু করছে। এখানে একটি ডেমোর জন্য স্থান নির্ধারিত থাকবে, যেখানে ফেসবুকের পোর্টাল ডিভাইসের মাধ্যমে ভিডিও কল করে স্টোরের কর্মকর্তাদের সাথে যোগাযোগ করা যাবে। মেটা মূলত অনলাইনে পণ্য বিক্রির জন্য তাদের ওয়েবসাইটে ‘শপ’ নামের একটি ট্যাবও যুক্ত করবে। এতে অনলাইনে পণ্যগুলো একত্রে পাওয়া যাবে।
হার্ডওয়্যারের দোকান চালুর মধ্য দিয়ে মেটা এখন গুগলের পথে হাঁটল। গত বছর গুগলের পক্ষ থেকে এ ধরনের একটি দোকান খোলা হয়। এর আগে অবশ্য ছোটখাটো কিছু দোকান পরীক্ষামূলকভাবে চালিয়েছে প্রতিষ্ঠানটি। মেটার পক্ষ থেকে এর আগে বেস্ট বাইয়ের সাথে চুক্তিতে একটি ডেমো স্টেশন তৈরি করে, সেখানে ভিআর হেডসেট ও স্মার্ট গ্লাস বিক্রি করেছিল। নতুন দোকানের মাধ্যমে এখনো অপ্রচলিত পণ্য হিসেবে এ ধরনের প্রযুক্তিপণ্য বিক্রির দিকে আরও গুরুত্ব বাড়াল মেটা।
টুইটারকে ৪৪ বিলিয়ন মার্কিন ডলারে কিনে এখন আলোচনায় বিশ্বের শীর্ষ ধনী ও প্রযুক্তি উদ্যোক্তা ইলন মাস্ক। তিনি গাড়ি নির্মাতা টেসলা ও মহাকাশ সংস্থা স্পেসএক্স নামের দুটি প্রতিষ্ঠানের প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা। এর বাইরেও তার রয়েছে অনেক উদ্যোগ। বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে বিনিয়োগও করেছেন প্রচুর। তবে এখন ইলন মাস্কের ‘দ্য বোরিং’ কোম্পানিও বেশ আলোচনায় এসেছে। বিশেষ করে প্রতিষ্ঠানটির সম্ভাবনাময় কার্যক্রমের জন্য একে আরেক ইউনিকর্ন বলে মনে করা হচ্ছে। মার্কিন গণমাধ্যম সিএনএনের এক প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়।
বর্তমান সময়ে বড় বড় শহরে বড় যন্ত্রণার নাম যানজট। ভিড় এড়াতে বিকল্প পথ তৈরির কাজ করে থাকে এ বোরিং কোম্পানি। প্রতিষ্ঠানটির মূল কাজ হচ্ছে টানেল বা সুড়ঙ্গপথ তৈরি করা। ইলন মাস্কের বোরিং কোম্পানি এ ধরনের প্রকল্পের নাম দিয়েছে ‘লুপ’ প্রকল্প। অর্থাৎ, যানজট এড়াতে পাতালপথ বা বিশেষ লুপ তৈরি করে থাকে প্রতিষ্ঠানটি। সম্প্রতি ইলন মাস্কের এ প্রতিষ্ঠান ৬৭ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলার বিনিয়োগ পেয়েছে। এর ফলে বিনিয়োগের অর্থে আরও বেশি লুপ প্রকল্প নিয়ে কাজ করতে চাইছে বোরিং কোম্পানি।
সিএনএন বলছে, লুপ হচ্ছে অধিকাংশ ভূগর্ভস্থ পরিবহন ব্যবস্থা, যাতে টেসলার গাড়িতে চড়ে নির্দিষ্ট দূরত্বের স্টেশনে ভ্রমণ করা যায়। ইতিমধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের লাস ভেগাসে একটি লুপ চালু হয়েছে।
সমালোচকেরা অবশ্য বোরিং কোম্পানির প্রকল্পগুলো নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন। তাদের যুক্তি, বোরিং মূলত পাতাল রেল ব্যবস্থা চালু করছে। কিন্তু ট্রেনের পরিবর্তে সেখানে গাড়ি ব্যবহার করছে। এ ধরনের পথ তৈরিতে প্রতি মাইলে ১০০ কোটি ডলার খরচ হবে। তবে বোরিং বলছে, তারা আরও সাশ্রয়ী টানেল তৈরির প্রযুক্তি নিয়ে কাজ করছে। তারা যে পদ্ধতি নিয়ে কাজ করবে, তা প্রচলিত সাবওয়ে পদ্ধতির চেয়ে উন্নত। কারণ, এতে কেবল নির্দিষ্ট গন্তব্যেই গাড়ি থামবে।
কেন বেঙ্গালুরুকে বলা হয় ভারতের সিলিকন ভ্যালি?
আমাদের প্রতিবেশী দেশ ভারত। এ দেশের প্রসঙ্গ উঠতেই আমাদের মানসপটে ভেসে ওঠে কলকাতা, দিল্লি কিংবা মুম্বাইয়ের মতো বহুল পরিচিত শহরগুলোর চিত্র। সে তুলনায় ভারতের দক্ষিণাঞ্চলীয় কর্ণাটক রাজ্যের রাজধানী বেঙ্গালুরুকে নিয়ে আলোচনা বা চর্চা খুব কমই হয়। অথচ দাক্ষিণাত্যের মালভ‚মির অন্তর্গত, ভারতের তৃতীয় জনবহুল এই শহরেরই কিন্তু একটি সম্মানজনক পরিচিতি গড়ে উঠেছে বহির্বিশ্বের কাছে। একসময় ‘পেনশনারস প্যারাডাইস’ কিংবা ‘গার্ডেন সিটি’ হিসেবে খ্যাত এ শহরকে এখন অভিহিত করা হচ্ছে ভারতের সিলিকন ভ্যালি হিসেবে!
যুক্তরাষ্ট্রের সানফ্রান্সিসকো, ক্যালিফোর্নিয়ায় অবস্থিত আসল সিলিকন ভ্যালিতে রয়েছে অ্যাপল, মেটা-ফেসবুক, গুগলের মতো বিশ্বসেরা তথ্যপ্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর হেডকোয়ার্টার, যে কারণে সেটিকে বিবেচনা করা হয় প্রযুক্তি কোম্পানিগুলোর আঁতুরঘর হিসেবে। ভারতের প্রেক্ষাপটে একই কথা বলা যায় বেঙ্গালুরুর ক্ষেত্রেও। তথ্যপ্রযুক্তি ক্ষেত্রে সাম্প্রতিক সময়ে ভারতের যে অগ্রযাত্রা, তার বেশিরভাগই সংগঠিত হয়েছে এই বেঙ্গালুরুকে কেন্দ্র করেই। এখানেই ভারতীয় শাখা রয়েছে অ্যামাজন, আইবিএম, মাইক্রোসফট, টেসকো, নকিয়া, সিমেন্স, অ্যাপল, ইনটেল, সিসকো, অ্যাডোবি, গুগল প্রভৃতির।
আমেরিকান কোম্পানিগুলো জোট বাঁধতে শুরু করে ভারতীয় সফটওয়্যার কোম্পানিগুলোর সাথে এবং তাদের উদ্ভাবিত নতুন নতুন সব প্রযুক্তি ও ব্যবস্থা দিয়ে সাহায্য করতে থাকে ভারতকে। স্বভাবতই এতে নতুন সম্ভাবনার দ্বার উন্মোচিত হয় ভারতীয়দের জন্য। কিন্তু এক্ষেত্রে আমেরিকানদের কী লাভ? তাদের লাভ হলো, তারা কম খরচে ভারতীয় মেধাদের যেমন কাজে লাগাতে পারছিল, তেমনই ভারতের মাটিতে সফটওয়্যার উদ্ভাবনের নতুন কেন্দ্রও গড়ে তুলতে পারছিল। আর সবচেয়ে বড় লাভ অবশ্যই এই যে, ভারতীয়দেরকে নতুন প্রযুক্তির সাথে পরিচিত করিয়ে দেয়ার মাধ্যমে ভবিষ্যতে তাদের মনে এসবের হালনাগাদ সংস্করণ প্রাপ্তির চাহিদা সৃষ্টিরও বীজ বপন করে দিচ্ছিল তারা।
স্বপ্নচারী কিছু মানুষই বর্তমানে চাকা ঘোরাচ্ছে ভারতের সফল স্টার্টআপগুলোর। উদাহরণস্বরূপ আমরা বলতে পারি ওলার কথা। ভারতে তারা পেছনে ফেলে দিয়েছে তাদের বৈশ্বিক প্রতিদ্ব›দ্বী উবারকে। আবার ভারতে অ্যামাজনের প্রতিদ্ব›দ্বী ফ্লিপকার্টের বাজারমূল্য ছাড়িয়ে গেছে সাড়ে ৫ বিলিয়ন ডলার, তারা কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে সরাসরি ৩০ হাজারেরও বেশি মানুষের।
সিলিকন ভ্যালির লোকজনই কেন শিশুদের প্রযুক্তি ব্যবহারের বিরুদ্ধে
আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের সাথে জড়িয়ে গেছে যেসব প্রযুক্তি ও অ্যাপ সেগুলো যারা তৈরি করেছেন তাদের অনেকেই এখন নিজেদের সন্তানদেরকে এসব থেকে দূরে রাখার চেষ্টা করছেন। সিলিকন ভ্যালিতে কাজ করা এসব তরুণ উদ্ভাবকের অনেকেই বিশ্বের বৃহত্তম সব প্রযুক্তি কোম্পানি প্রতিষ্ঠা করেছেন। এদের মধ্যে কেউ কেউ এখন তাদের নিজেদের সন্তানরা যাতে এসব প্রযুক্তি ও অ্যাপ ব্যবহার করতে না পারেন সে বিষয়ে সচেষ্ট থাকেন। সিলিকন ভ্যালির এক দল অভিভাবক যখন এরকমটা ভাবছেন তখন আরেক দল অভিভাবক আছেন যারা মনে করেন একুশ শতকে শিক্ষার একটি প্রয়োজনীয় উপকরণ এই প্রযুক্তি। শ্রেণিকক্ষে ভালো করার পাশাপাশি বাইরের জীবনে সাফল্যের জন্যও এই প্রযুক্তি জরুরি বলে তারা মনে করেন।
সিলিকন ভ্যালির শীর্ষ নির্বাহীর পদে কেন ভারতীয়রাই এগিয়ে
সিলিকন ভ্যালিতে একের পর এক শীর্ষ সংস্থায় ভারতীয়রা সিইও হচ্ছেন। সেই তালিকার সাম্প্রতিকতম সংযোজন পরাগ আগরওয়াল। টুইটারের প্রধান নির্বাহীর পদ থেকে সরে দাঁড়িয়েছেন এর সহপ্রতিষ্ঠাতা জ্যাক ডরসি। চলতি সপ্তাহে তার জায়গায় নতুন সিইও পরাগ আগারওয়ালের নাম ঘোষণা করেছে টুইটার। সিলিকন ভ্যালির প্রভাবশালী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমটির সর্বোচ্চ পদে আগারওয়ালের নিয়োগ ভারতীয়দের গর্ব ও উদযাপনের কারণও হয়েছে। পরাগের নিয়োগকে অভিনন্দন জানিয়ে ভারতীয়দের অনেকেই টুইট করেছেন। ভারতীয়রা কেন সিলিকন ভ্যালির মতো বৈশ্বিক তথ্যপ্রযুক্তির কেন্দ্রে নেতৃত্বে আসছেন, তা জানতে হলে একটু পেছন ফিরে দেখা দরকার।
শুরু থেকেই ভারত সরকার তথ্যপ্রযুক্তি শিক্ষাকে বেশ গুরুত্ব-সহকারে নেয়। প্রতিষ্ঠিত হয় ইন্ডিয়ান ইনস্টিটিউট অব টেকনোলজি (আইআইটি)। দেশজুড়ে এর বিভিন্ন শাখায় হাজার হাজার ছাত্র সরকারি খরচে পড়াশোনার সুযোগ পান। আইআইটির গ্র্যাজুয়েটরা উন্নত সুযোগ-সুবিধা পেতে যুক্তরাষ্ট্রে অভিবাসন শুরু করেন। তারা এখন মার্কিন ভূখন্ডে সাফল্যের নিত্যনতুন রেকর্ড গড়ছেন।
ভারতে বেড়ে ওঠা এমন বিখ্যাত কয়েকজন সিইওর মধ্যে রয়েছেন গুগল ও এর প্যারেন্ট কোম্পানি আলফাবেটের সিইও সুন্দর পিচাই; মাইক্রোসফটের সত্য নাদেলা; আইবিএমের অরবিন্দ কৃষ্ণ; অ্যাডবির শান্তনু নারায়ণ এবং ডাটা স্টোরেজ কোম্পানি নেটঅ্যাপের জর্জ কুরিয়া। অনেকে বলেন, ভারতে বেড়ে ওঠার আরেকটি দিক হলোÑ আপনি শিক্ষাজীবন থেকেই অনিশ্চিত পরিবেশের মধ্যে তাল মিলিয়ে চলার গুণটি রপ্ত করেছেন। শিখেছেন সীমিত সম্পদ কাজে লাগিয়ে বড় লক্ষ্য অর্জনের উপায়।
এখন সফল ভারতীয়রা নবাগতদের সাহায্য-সহযোগিতা করতে পারেন এমন নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে। তথ্যপ্রযুক্তি খাতে প্রথম প্রজন্মের সফল ভারতীয়রা তাদের পরবর্তী প্রজন্মের স্বদেশিদের প্রতি সাহায্যের হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন। ফলে শুধু সিলিকন ভ্যালির শীর্ষ পদগুলোতেই নয়, নিজ দেশ ভারতেও অনেক তরুণ উদ্যোক্তা আজ সফল ব্যবসায়ী হিসেবে গড়ে উঠছেন।
বাংলাদেশের সিলিকন ভ্যালি
ডিজিটাল বাংলাদেশের স্বপ্নকে বিশ্বাস করে এখন বেশ স্বতঃস্ফ‚র্ততার সাথেই সারা বছর আইসিটি এক্সপো, অ্যাপস কমপিটিশন, ডেভেলপার সম্মেলন, ডিজিটাল ওয়ার্ল্ড, সিএসসি ফেস্টগুলো আয়োজিত হচ্ছে। নিজেকে যাচাই করার জন্য নিজেদের তৈরি অ্যাপস নিয়ে এসব প্ল্যাটফর্মে অংশগ্রহণ করছেন অনেকেই। এতে নিজেদের অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা দুটোই বাড়ছে আমাদের দেশের তরুণদের। আরও বাড়ছে নেটওয়ার্কিং। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের অ্যাকসেস টু ইনফরমেশন (এটুআই) প্রোগ্রামের মাধ্যমে পরিচালিত ‘সার্ভিস ইনোভেশন ফান্ড’-এর মতো উদ্যোগের কথাও উল্লেখযোগ্য এবং প্রশংসার দাবিদার। এ রকম আয়োজন যত বেশি হবে, আমাদের তারুণ্য ততই এই সেক্টরে উদ্বুদ্ধ হয়ে দেশটাকে এগিয়ে নিয়ে যেতে পারবেন। আমাদের দেশের প্রায় সাত লাখ তরুণ-তরুণী এখন তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তিভিত্তিক কর্মসংস্থানে আছে। ২০২২ সাল নাগাদ এটি ২০ লাখ ছাড়িয়ে যেতে পারে।
গুগল প্লেস্টোর, নকিয়া স্টোর, উইন্ডোজ মার্কেট প্লাস, ব্ল্যাকবেরি ওয়ার্ল্ড, স্যামসাং স্টোর, আইফোনের অ্যাপস স্টোর ইত্যাদি বাজারের মাধ্যমে মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন ডাউনলোড করছেন এ দেশের স্মার্টফোন ব্যবহারকারীরা। তবে যে ব্যাপারটি দেখা যায় তা হচ্ছে, এসব স্টোরে বাংলা ভাষার অ্যাপ্লিকেশনের সংখ্যা কিন্তু খুব বেশি নয়। আমাদের এ বিষয়টিতে নজর দিতে হবে।
সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি হচ্ছে, এই কোম্পানিগুলো ভালো লোক খুঁজছে। এদের সাথে আরও যেসব ভালো কোম্পানি আছে, সেগুলোও ভালো প্রোগ্রামার বা টেস্টার খুঁজছে, কিন্তু পাচ্ছে না। আবার অনেক ভালো ভালো প্রোগ্রামার, টেস্টারও আছেন যারা ভালো কোম্পানি খুঁজে পাচ্ছেন না। যারা চাকরি করতে চান না, তাদের জন্যও এই সেক্টরটিতে কাজ করার জন্য বেশ ভালো সময়।
যাদের মাথায় ভালো ভালো অ্যাপের আইডিয়া আছে, তারা স্টার্টআপ করতে পারেন। সবচেয়ে আশার কথা হচ্ছে, দিন দিন এ রকম সফল স্টার্টআপের সংখ্যাটা বাড়ছে। তার থেকেও গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটি হচ্ছে, যাদের হাত ধরে বাংলাদেশ এভাবে এগিয়ে চলছে, তাদের বিশাল অংশই হচ্ছে আমাদের এই বর্তমান তারুণ্য। যারা কিনা আক্ষরিক অর্থেই স্বপ্ন দেখতে জানেন এবং সেই স্বপ্নপূরণের জন্য ঝুঁকি নিতে জানেন। তারা জানেন যে, জীবনের সবচেয়ে বড় রিস্কটি হচ্ছে কোনো রিস্ক না নেওয়া।
আমাদের বিশাল জায়গা জুড়ে থাকবে অ্যাপস ইন্ডাস্ট্রি। আর এই অপ্রতিরোধ্য গতিতে এগিয়ে চলা বাংলাদেশের কারিগর যে আসলে আমাদের এই তারুণ্য, এতে সন্দেহ প্রকাশের কোনো অবকাশই নেই। এক বিরতিহীন গতিতে এগিয়ে চলছে আমাদের বাংলাদেশ। এর ৩৯টি হাইটেক পার্ক হচ্ছে এক একটি সিলিকন ভ্যালি। আমাদের স্বপ্নবাজ তরুণ-তরুণীরাই পরিচালনা করবেন আমাদের সিলিকন ভ্যালিগুলো।
তথ্যসূত্র : রয়টার্স, ওয়াশিংটন পোস্ট, বিবিসি, সিএনএন, এএফপি, এপি, সাউথ চায়না মর্নিং পোস্ট, প্রথম আলো ও বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড (ছবি : ইন্টারনেট)
ফিডব্যাক : [email protected]
০ টি মন্তব্য