অভিভাবক গাইড জানাবে শিশুরা যেভাবে ইনটারনেট দুনিয়ায় নিরাপদে থাকবে
আজকের দিনে সন্তানদের কমপিউটার ব্যবহার করতে দেবেন কি দেবেন না সে আপনার (অভিভাবক) ব্যাপার, কিন্তু সন্তান যদি চায়, তখন কি করবেন? নিশ্চয় ভাববেন, কি আর করা যায়। আপনি ভাবতে পারেন, এটা ব্যবহার করা খারাপ, আবার এ-ও ভাবতে পারেন কমপিউটার ব্যবহার করা ভালো। ভালো-মন্দ যাই হোক, ইন্টারনেট ব্যবহার সংশ্লিষ্ট আপনার একটি দিক নির্দেশনা প্রয়োজন।
তার আগে আরো দুটো কথা। আপনার সন্তান যদি কমপিউটার, ইন্টারনেট ব্যবহার করে থাকে তাহলে আপনার দরকার ছেলে-মেয়েরা কমপিউটারে কি করছে, তারা কখনো কি দেখেছে তার ওপর নজর রাখা? হয়তো দেখেছেন, হয়তো দেখেননি। কিন্তু কখনো কি তাদের সাথে এসব নিয়ে বিশেষ করে ইনটারনেট নিয়ে কথা বলেছেন? না বলে থাকলে, তাদের সাথে কথা বলাটা জরুরি। জাতিসংঘের শিশু তহবিল বা ইউনিসেফ বলছে, শিশুদের সাথে ইনটারনেট নিয়ে কথা বলতে হবে। তবে কথা বলার পাশাপাশি কিছু কৌশলও অবলম্বন করতে হবে যা আপনার শিশু সন্তানকে ইনটারনেট ব্যবহারের একটি পরিশীলিত দিক নির্দেশনা দেবে।
শিশুদের ইনটারনেট ব্যবহার নিয়ে ইউনিসেফ, টেলিনর গ্রুপ ও মোবাইলফোন অপারেটর গ্রামীণফোন একটি অভিভাবক গাইড প্রকাশ করেছে। গাইডটিতে বলা হয়েছে, শিশুদের (সন্তান বলতে শিশুদের বোঝানো হয়েছে) সাথে কিভাবে ইনটারনেট নিয়ে কথা বলবেন। গাইডটিতে শিশুদের ইনটারনেট ব্যবহারের দিক নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।
ইউনিসেফ বলছে, আগামীতে এশিয়ার উন্নয়শীল দেশগুলোর ৫০ কোটিরও বেশি শিশু মোবাইলফোনের মাধ্যমে ইনটারনেট দুনিয়ায় প্রবেশ করবে। সেই শিশুরা কি ইনটারনেটে নিরাপদে থাকতে পারবে বা ইনটারনেট কি তাদের জীবনে কোনো পরিবর্তন বয়ে আনতে পারবে- এসব উত্তর খোঁজা হয়েছে গাইডটিতে।
কেননা ইন্টারনেটে ভালো-মনদ দুই-ই আছে। ফলে, না বুঝলে বা স্রেফ কৌতুহলের বশে শিশুরা বিপথে চলে যেতে পারে। সঠিকভাবে ইনটারনেট ব্যবহার করার উপায় হিসেবে বলা হয়েছে, জ্ঞান অর্জন ও তথ্য অনুসন্ধান, একে অন্যের সাথে যোগাযোগ, বিনোদন ও সুযোগ সৃষ্টির জন্য। তবে একই সাথে এ-ও বলা হয়েছে, কেন শিশুদের সাথে ইনটারনেট নিয়ে কথা বলতে হবে। সেই প্রসঙ্গে বলা হয়েছে, গেম খেলা, ইনটারনেটে চ্যাট করা, বন্ধুদের মেসেজ পাঠানো এসব কিছু এখন প্রায় সবার প্রতিদিনের ব্যাপার হয়ে দাঁড়িয়েছে। আজকালের শিশুরা খুব অল্প বয়স থেকেই এসব করতে শিখছে। বাবা-মায়ের উচিত হবে সন্তানের ইনটারনেট ব্যবহারের ক্ষেত্রে সঠিক ভারসাম্য তৈরি করা যাতে তাদের সন্তান বাস্তব জীবনের বিভন্ন কর্মকান্ডেও যথেষ্ট সময় ব্যয় করে।
বাবা-মায়ের কাজ হবে ইনটারনেট দুনিয়া এবং বাস্তব জীবনের মাঝে সঠিক এক সমন্বয় করা। তাদের দিনের কাজগুলোকে কয়েকটি ভাগে ভাগ করে দেওয়া। স্কুল ও হোম ওয়ার্কের জন্য একটি সময়, অনলাইনে গেম খেলা ও বিনোদনের জন্য একটি সময়, বাসার বাইরে গিয়ে খেলার জন্য একটি সময় এবং পরিবার ও বন্ধুদের সাথে সময় কাটানোর জন্য একটি সময়। গাইড পরামর্শ দিচেছ, এগুলো ঠিকঠাক করা হলে আপনার সন্তান ইনটারনেটে নিরাপদে থাকবে এবং সমাজে সবকিছুতেই তার অংশগ্রহণ থাকবে।
অভিভাবকদের সন্তানকে গেম খেলা, ডিজিটাল আসক্তি সম্পর্কে ধারণা দেওয়া এবং ভাইরাস ও ম্যালওয়ারের ঝুঁকি সম্পর্কেও সচেতন করতে হবে। বয়সের সাথে সামঞ্জস্যপূর্ণ কনটেনেটর প্রতি তাদের আগ্রহী করে তুলতে বলা হয়েছে।
গাইডে বলা হয়েছে, গেম থেকে সন্তানকে দূর রাখতে একটি সময়সীমা বেঁধে দিন এবং তাকে জানান। গেম আসক্তি ঠেকাতে একটি টাইমার বা মনিটরিং সফটওয়্যার ব্যবহার করতে পারেন, যাতে ওই নির্দিষ্ট সময় পার হওয়ার সাথে সাথে ইনটারনেট সংযোগ বা কমপিউটার বন্ধ হয়ে যায়।
সন্তান ইনটারনেটে আসক্ত হয়ে গেলে তার সাথে বসুন, আপনাদের উদ্বেগ নিয়ে তার সাথে বন্ধুভাবাপন্ন পরিবেশে খোলামেলা ও ইতিবাচক কথা বলুন এবং একটি নীতিমালা তৈরি করে দিন। তবে কখনোই আসক্তদের কাছ থেকে কমপিউটার একেবারে সরিয়ে না নেওয়ারও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বরং ধীরে ধীরে এ কাজে অগ্রসর হতে হবে। একবারে সরিয়ে নিতে গেলে তা হিতে বিপরীত হতে পারে। বরং বেশি খারাপ অবস্থা হয়ে গেলে কোনও দ্বিধা না করে দ্রুত চিকিৎসকের কাছে নেওয়ারও পরমর্শ দেওয়া হয়েছে।
অভিভাবক গাইডটিতে ফেসবুক, ইউটিউব, স্যাটেলাইট, আস্ক এফএম, ইনস্টাগ্রাম, টিনডার, ভক্সার, ইক ইয়াক, হোয়াটসঅ্যাপ, স্ন্যাপচ্যাট, ভাইন, কিক মেসেঞ্জার, শটস অব মি অ্যাপ ও ওয়েবসাইট সম্পর্কে অভিভাবকদের সচেতন (বয়সসীমা সংক্রান্ত নিয়মাবলী দৃঢ়ভাবে অনুসরণ করা) থাকারও পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।
এ বিষয়ে বলা হয়েছে, অভিবাবকরা সন্তানের সাথে কথা বলবেন এবং ইনটারনেট ব্যবহারের শিষ্টাচার সম্পর্কে জানাবেন। সব সময় ইনটারনেট ব্যবহার পর্যবেক্ষণ করা সম্ভব না হলেও তাদের জন্য ইনটারনেট ব্যবহারবিধি তৈরি করে দিতে বলা হয়েছে। তবে বিশেষ জোর দেওয়া হয়েছে পাসওয়ার্ড বিষয়ে। বলা হয়েছে, আপনার সন্তানকে বলুন- তারা অন্য কাউকে তাদের পাসওয়ার্ড যেন না দেয়।
তার আগে আপনার সন্তান কোন বয়স থেকে স্মার্টফোন, ল্যাপটপ, ট্যাব ও কমপিউটার ব্যবহার করবে তা নির্ধারণ করতে বলা হয়েছে।
আপনার সন্তান সঠিক ইনটারনেট দুনিয়ায় বিশেষ করে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে সঠিক ট্র্যাকে আছে কিনা তা-ও পর্যবেক্ষণের কথা বলা হয়েছে। তারা শুধু প্রযুক্তিই ব্যবহার করে না, প্রযুক্তি সম্পর্কে সাধারণ কোনো জ্ঞান রাখে কি না সে বিষয়েও বাবা-মাকে খোঁজ নিতে হবে। মাঝে মাঝে প্রযুক্তির সাধারণ ব্যবহার বিষয়ে তাদেরকে প্রশ্ন করা যেতে পারে। ঠিকঠাক উত্তর দিতে পারলে বোঝা যাবে ঠিক ট্র্যাকেই আছে।
অনলাইনে হয়রানি থেকে দূরে থাকার জন্যও তাদের কিছু প্রশ্ন করা যেতে পারে। গাইডে দেওয়া হয়েছে, সামাজিক মাধ্যমে কারও সাথে তর্ক করা, কোনো পোস্ট দেওয়া, সেই পোস্ট পরে ডিলিট করে দেওয়া, অনলাইনে গেম খেলার সময় কারও মৌখিক আক্রমণের শিকার হওয়া, কোনো কুৎসা রটানো, কাউকে বস্নক করা হয়েছে কি না এই ধরনের প্রশ্ন করে উত্তর বের করে নিয়ে আলোচনা করলেই বেরিয়ে আসবে আপনার সন্তান অনলাইনে হয়রানির শিকার হয়েছে কি না।
এ ছাড়াও অনলাইনে আপনার সন্তান যৌননিপিড়নের শিকার হয়েছে কিনা তা বোঝার জন্যও গাইডটিতে রয়েছে প্রশ্নমালা। কিভাবে অনলাইন সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে নিরাপদে থাকা যায় সেসব কৌশলও এতে জানানো হয়েছে।
সবশেষে বলা হয়েছে, যাদের সন্তানেরা স্মার্টফোন ব্যবহার করে তারা অ্যাপস এর মাধ্যমে তাদের সন্তানের অবস্থান জানতে পারেন। এমনই একটি অ্যাপ হলো লাইফ-থ্রি-সিক্সটি। টাইম অ্যাওয়ে নামের একটি ফ্রি টুল রয়েছে যার মাধ্যমে অভিভাবকেরা সন্তানের গতিবিধি খেয়াল করতে পারেন এবং তারা কতক্ষণ তাদের ফোন ব্যবহার করবে তা নির্ধারণ করে দিতে পারেন। এমন আরেকটি অ্যাপ হলো মামাবিয়ার। এর মাধ্যমে অভিভাবকেরা তাদের সন্তানের সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমের কার্যক্রম এবং তারা কখন কোথায় যায় বা ফিরে আসে তা জানতে পারবেন। এর মাধ্যমে আপনার সন্তান যখন কোনো কনটাক্ট অ্যাড করে এবং নিষিদ্ধ কোনো শব্দ ব্যবহার অথবা কোনো ছবি আপলোড বা ট্যাগ করে তা সাথে সাথে জানতে পারবেন।
আরও বলা হয়েছে, মাই মোবাইল ওয়াচডগ নামের এমন একটি অ্যাপ রয়েছে যার মাধ্যমে আপনার সন্তানের ফোনকল দেখতে পাবেন, মেসেজ পড়তে পারবেন, গতিবিধির ওপর নজর রাখতে পারবেন এবং কি অ্যাপ ব্যবহার করবে তাও নিয়ন্ত্রণ করতে পারবেন। এরকম আরেকটি একটি সফটওয়্যারের কথাও জানানো হয়েছে। এর নাম এম স্পাই। এটি সব ধরনের ডিভাইস এবং কমপিউটারে ব্যবহার করা যায়। বিশ্বে এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা ১০ লাখেরও বেশি বলে জানানো হয়েছে। এটি সব ধরনের তথ্যের (ওয়েব হিস্ট্রি, ছবি, ভিডিও, ই-মেইল, এসএমএস) রেকর্ড রাখতে পারে। সন্তানের ভালোর জন্য অভিভাবকদের এসব ব্যবহারের পরামর্শও দেওয়া হয়েছে।
০ টি মন্তব্য