https://powerinai.com/

কমপিউটার সফটওয়্যার

কমপিউটারে বাংলা সফটওয়্যারের সীমাবদ্ধতা দূর করা জরুরি

কমপিউটারে বাংলা সফটওয়্যারের সীমাবদ্ধতা দূর করা জরুরি কমপিউটারে বাংলা সফটওয়্যারের সীমাবদ্ধতা দূর করা জরুরি
 

কমপিউটারে বাংলা সফটওয়্যারের সীমাবদ্ধতা দূর করা জরুরি


হীরেন পণ্ডিত


বিশ্বের ৩৫ কোটি বাংলা ভাষাভাষী মানুষ রয়েছে। ডিজিটাল প্রযুক্তিতে বাংলা হবে পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম ভাষা। আগামী পঞ্চাশ বছরে বাংলা ভাষা কেবল জনসংখ্যার হিসেবেই নয়, ডিজিটাল প্রযুক্তিতে ব্যবহারের দিক থেকেও বাংলা হবে পৃথিবীর তৃতীয় বৃহত্তম ভাষা। প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার প্রয়োগ সহজতর করতে ইতোমধ্যে সরকার ১৫৯ কোটি ২ লাখ টাকা ব্যয়ে ১৬টি টুলস উন্নয়নসহ প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার উন্নয়নে কাজ করছে। বাংলা পৃথিবীর অন্য দশটা ভাষার মতো সাধারণ ভাষা নয়। বাংলা ভাষার শক্তি অনেক সুদৃঢ়। বিশ্বের কোনো ভাষারই এমন কোনো উচ্চারণ নেই যা বাংলা হরফ দিয়ে লেখা যায় না। এমনকি চীনা ভাষায় হাজার হাজার বর্ণ থাকার পরও লেখা যায় না। বিজয় বাংলা সফটওয়্যারের আগে ডিজিটাল যন্ত্রে বিজ্ঞানসম্মতভাবে বাংলা লেখার কোনো উপায়ই ছিল না। এই সফটওয়্যারে সীসার টাইপের ৪৫৪ বর্ণকে মাত্র ২৬টি বোতামে নিয়ে আসা হয়েছে। ১৯৯৩ সালের মধ্যে দেশের প্রায় সব পত্রিকা এবং বইসহ বিভিন্ন প্রকাশনা বিজয় বাংলা সফটওয়্যারের মাধ্যমে প্রকাশনা শুরু হয়, এরই ধারাবাহিকতায় দেশে প্রকাশনা ও মুদ্রণ শিল্পে বৈপ্লবিক পরিবর্তনের সূচনা হয়।


বাংলা ভাষাকে প্রযুক্তিবান্ধব করতে আরো উদ্যোগ প্রয়োজন


এই আধুনিক প্রযুক্তির যুগে বাংলা ভাষাকেও আধুনিক প্রযুক্তির ভাষা হতে হবে। নইলে বাংলাদেশ বিশ্বসভ্যতার অগ্রগতির যুগে পিছিয়ে যাবে। বাংলা ভাষাকে এগোতে হবে। একুশে ফেব্রুয়ারিই পারে বাংলা ভাষাকে এগিয়ে যাওয়ার সেই উদ্দীপনা দিতে। ভাষাকে টিকিয়ে রাখতে হলে ভাষাবিদদের পাশাপাশি রাষ্ট্র এবং প্রযুক্তিবিদদেরও সক্রিয় হতে হবে। মায়ের ভাষায় প্রযুক্তি ব্যবহার করেই দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। আমাদের ইতিবাচক দিক হচ্ছে প্রযুক্তিমনস্ক সরকার ক্ষমতায়। প্রযুক্তির ব্যবহার করে বাংলা ভাষায় লেখাপড়া ও চর্চা এবং ভাষাকে টেকসই করায় বিশেষজ্ঞ জ্ঞান থেকে উৎসারিত সরকারি কিছু উদ্যোগ নিতে হবে


ডিজিটাল জগতে বাংলা ভাষার ব্যবহার বৃদ্ধিতে কাজ করতে হবে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের বাংলা ভাষা সমৃদ্ধকরণ প্রকল্পের আওতায় সফটওয়্যার ও টুলসের ব্যবহার শুরু হলে তা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে বাংলা ভাষাকে বৈশ্বিকরণের সুযোগ সৃষ্টি করবে। ডিজিটাল ডিভাইসে আরও ভালোভাবে এবং সহজে বাংলা ভাষায় লেখাপড়া ও অনুবাদ সহজ হবে।


যেসব দেশ তথ্যপ্রযুক্তি উদ্ভাবন ও প্রয়োগে এগিয়ে আছে, তারা সবাই প্রযুক্তিতে মাতৃভাষার ব্যবহার করছে। চীন আমাদের সামনে বড় উদাহরণ হতে পারে। চীনা ভাষার অক্ষরগুলো অত্যন্ত জটিল, কিন্তু তারা থেমে থাকেনি। প্রযুক্তিতে মাতৃভাষা ব্যবহারের সুযোগ করে দেওয়ায় বর্তমানে চীনে ইন্টারনেট ব্যবহারকারীর সংখ্যা বহু আগেই ৫০ কোটি ছাড়িয়েছে। তবে আমাদের দেশে প্রযুক্তিতে বাংলা ভাষার চর্চা হলেও এ মুহূর্তে বাংলায় ভালো কনটেন্টের অভাব রয়েছে। তাই দেশের ১৮ কোটি ৩৫ লাখের বেশি মোবাইল ফোন, ১৩ কোটিরও বেশি ইন্টারনেট ব্যবহারকারী এবং ৫ কোটির বেশি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ব্যবহারকারীর কথা মাথায় রেখে মাতৃভাষায় ভালো ভালো কনটেন্ট ও মোবাইল অ্যাপ্লিকেশন তৈরি হবে। আর তা করা হলে শুধু অর্থনৈতিক কার্যক্রম ও মানুষে মানুষে যোগাযোগ বৃদ্ধি, জ্ঞানার্জন এবং তথ্য ও সেবা পাওয়া নিশ্চিত করবে না, মাতৃভাষাকে বাঙালির মাঝে চিরঞ্জীব করতে সহায়তা করবে।


ডিজিটাল দুনিয়ায় বাংলা লিপি ব্যবহারের সংকট ও সমাধান নিয়ে অংশীজনের উপস্থিতিতে বিভিন্ন সংলাপ ও নীতি সংলাপ অনুষ্ঠিত হচ্ছে। আলোচনায় বেরিয়ে আসছে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের প্রাযুক্তিক সমস্যাটার পেছনে ইউনিকোড কনসোর্টিয়ামের ভূমিকা রয়েছে। এই কনসোর্টিয়াম  আমাদের ভাষায় এমন জটিল অবস্থার সৃষ্টি করে রেখেছে এবং এটি একটি স্বতন্ত্র ভাষা হিসেবে গণ্য না করে তারা আমাদের বাংলা ভাষাকে দেবনাগরীর অনুসারী করে রেখেছে। এতে আমাদের প্রচণ্ডরকম ক্ষতি হয়েছে এবং বাঙালিদের জন্য একটি বড় চ্যালেঞ্জ ছুড়ে দিয়েছে। এই জন্যই এখনো আমাদের নোক্তা নিয়ে যুদ্ধ করে বেড়াতে হয়। অথচ বংলা বর্ণে কোন নোক্তা নেই। ইউনিকোড যদি বাংলাকে বাংলার মতো দেখে এই সমস্যাগুলো সমাধান করে ফেলতো তাহলে যে সমস্যাগুলো এখন ফেস করতে হচ্ছে তা করতে হতো না।


আসকি ও ইউনিকোডের মধ্যে যে দেয়াল আছে তা ভেঙ্গে ফেলা হয়েছে বলে নীতিনির্ধারকরা উল্লেখ করেন। দেরি করে হলেও বাংলাদেশ কমপিউটার কাউন্সিলের নেতৃত্বে বাংলাদেশ ইউনিকোড কনসোর্টিয়ামে যোগ দিয়েছে ২০১০ সালে। তারপরও ইউনিকোড কনভার্সনে যে জটিলতা হয় তার অপরাধ বাংলা ভাষাভাষীদের নয়; এই অপরাধ ইউনিকোডের। তাই এখনো আমরা ইউনিকোডের সাথে যুদ্ধ করে যাচ্ছি। বাংলাদেশের ছেলেমেয়েরাই তাদের মেধা-মনন দিয়ে এই যুদ্ধ জয় করবে বলে সংশ্লিষ্ট ও বিজ্ঞজনেরা মনে করেন।


ইউনিকোডে বাংলা লিপি ঢ-ঢ়, ড-ড়, য-য়-তে সমস্যা থাকাতে বড় তথ্য (বিগ-ডাটা) বিশ্লেষণ, সার্চ ইঞ্জিন, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তায় এবং ইন্টারনেট অব থিংসে বেশ সংকট দেখা দিচ্ছে। মুদ্রণ জগতে ইংলিশ লিপির সাথে বাংলা লিপি’র সাইজের ক্ষেত্রে তারতম্য। বিভিন্ন বাংলা সফটওয়্যার ব্যবহারে বাংলা লিপিতে চন্দ্রবিন্দুর ক্ষেত্রে তারতম্য লক্ষ করা যায়। যুক্তাক্ষরের ক্ষেত্রে সমস্যাটা প্রকট। বাংলা ডাটা মাইনিং এখনো ইন্ডাস্ট্রির সমতুল্য হয়নি। ল্যাংগুয়েজ মডেল করতে দেখা যাচ্ছে বাংলা করপাসে বেশ সমস্যা। বাংলা লিপি ব্যবহারের ক্ষেত্রে একটি মানসম্পন্ন নীতি থাকা দরকার। স্পেল চেকার, অভিধান, ওসিআর ইত্যাদিসহ বাংলা লিপি ব্যবহার বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। বাংলা লিপি নিয়ে এডহক ভিত্তিতে কাজ না করে জাতীয়, আঞ্চলিক ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে কয়টি সমস্যা তা চিহ্নিত করে দ্রুত সমাধান করতে হবে। এ বিষয়গুলোতে বাংলাদেশ কমপিউটার কাউন্সিলকে আরো সোচ্চার হতে হবে। 


বিশ্বে বাংলা ভাষা-ভাষী সংখ্যা ৩৫ কোটি। ১৯৫২ সালে রক্তের বিনিময়ে অর্জিত বাংলা ভাষা। ভাষা কোনো অবস্থাতেই বন্দি জীবনযাপন করে না। আমরা চতুর্থ শিল্পবিল্পবের মধ্য দিয়ে অতিবাহিত হচ্ছি। এই সময় যদি ডিজিটাল দুনিয়ায় বাংলা লিপি ব্যবহারে সংকট দূর করতে না পারি তাহলে ভবিষ্যৎ প্রজন্মের কাছে বাংলা ভাষা জনপ্রিয়তা হারাবে।


এই আধুনিক প্রযুক্তির যুগে বাংলা ভাষাকেও আধুনিক প্রযুক্তির ভাষা হতে হবে। নইলে বাংলাদেশ বিশ্বসভ্যতার অগ্রগতির যুগে পিছিয়ে যাবে। বাংলা ভাষাকে এগোতে হবে। একুশে ফেব্রুয়ারিই পারে বাংলা ভাষাকে এগিয়ে যাওয়ার সেই উদ্দীপনা দিতে। ভাষাকে টিকিয়ে রাখতে হলে ভাষাবিদদের পাশাপাশি রাষ্ট্র এবং প্রযুক্তিবিদদেরও সক্রিয় হতে হবে। মায়ের ভাষায় প্রযুক্তি ব্যবহার করেই দেশকে এগিয়ে নিতে হবে। আমাদের ইতিবাচক দিক হচ্ছে প্রযুক্তিমনস্ক সরকার ক্ষমতায়। প্রযুক্তির ব্যবহার করে বাংলা ভাষায় লেখাপড়া ও চর্চা এবং ভাষাকে টেকসই করায় বিশেষজ্ঞ জ্ঞান থেকে উৎসারিত সরকারি কিছু উদ্যোগ নিতে হবে


ডিজিটাল জগতে বাংলা ভাষার ব্যবহার বৃদ্ধিতে কাজ করতে হবে। তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি বিভাগের বাংলা ভাষা সমৃদ্ধকরণ প্রকল্পের আওতায় সফটওয়্যার ও টুলসের ব্যবহার শুরু হলে তা চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে বাংলা ভাষাকে বৈশ্বিকরণের সুযোগ সৃষ্টি করবে। ডিজিটাল ডিভাইসে আরও ভালোভাবে এবং সহজে বাংলা ভাষায় লেখাপড়া ও অনুবাদ সহজ হবে।


আমরা আমাদের মাতৃভাষা বাংলাকে টিকিয়ে রাখতে সক্ষম হয়েছি। বাঙালির ঐক্যবদ্ধতার কাছে পশ্চিমাদের চোখ-রাঙানো প্রতিহত করতে পেরেছি। এত ত্যাগ-তিতিক্ষার বিনিময়ে পাওয়া এ অর্জন রক্ষা করা আমাদের নৈতিক দায়িত্বের মধ্যেই পড়ে। বাংলা বানান ও বাংলা উচ্চারণ শুদ্ধ করে উপস্থাপন করা প্রয়োজন। এ ক্ষেত্রে বাংলা একাডেমি কর্তৃক সর্বশেষ প্রণীত অভিধান সব সময় পাশে রাখব। উচ্চারণে আরও সতর্ক হব।


বাংলা একটি সমৃদ্ধ, শ্রুতিমধুর ও সহজ-সরল ভাষা। মনের আবেগ ও ভাব প্রকাশে বাংলা ভাষায় শব্দের প্রাচুর্য নিয়ে গর্ব করা যায়। পৃথিবীর ইতিহাসে মাতৃভাষার জন্য আত্মত্যাগের এমন ঘটনা বিরল। এত আত্মত্যাগ ও সংগ্রামের মধ্য দিয়ে যে ভাষায় রাষ্ট্রীয়ভাবে কথা বলার অধিকার আদায় করা হয়েছে, সেই ভাষাকে আমরা বড়ই অবজ্ঞা করি


সম্ভাবনাময় ডিজিটাল বাংলাদেশ দ্রুতগতিতে এগিয়ে চলেছে। প্রান্তিক পর্যায়ে মোবাইল, ট্যাবলেট, ল্যাপটপ ও ডেস্কটপে ইন্টারনেট সংযোগের ফলে এ গতি আরো বেশি বৃদ্ধি পেয়েছে। তথ্যপ্রযুক্তির প্রচার ও প্রসারের ফলে গত এক দশকে বাংলাদেশ আমূল বদলে গেছে। তবে বাংলাদেশে প্রযুক্তিপণ্যের ব্যবহার শুরু হয়েছে আরো পাঁচ-ছয় দশক আগে। 


বাংলাদেশে কমপিউটারের ক্রমবিকাশ


আধুনিক কমপিউটারের বিকাশ শুরু হয় ষাটের দশকের প্রথম ভাগ থেকে। বাংলাদেশে প্রথম কমপিউটার স্থাপিত হয় ১৯৬৪ সালে পরমাণু শক্তি কেন্দ্র ঢাকায়। বাংলাদেশে দ্বিতীয় কমপিউটারটি স্থাপিত হয় ১৯৬৫ সালে আদমজী জুট মিলে। কমপিউটারটি ছিল আইবিএম ১৪০০ সিরিজের। এরপর ষাটের দশকের শেষ দিকে ইউনাইটেড ব্যাংক লিমিটেড (বর্তমানে জনতা ব্যাংক) স্থাপন করে আইবিএম ১৯০১ কমপিউটার। স্বাধীনতার পূর্বে ১৯৬৯ সালে পরিসংখ্যান ব্যুরোতে স্থাপিত হয় ১৯৭৮-৭৯ সালে বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ্ববিদ্যালয় প্রথম কমপিউটার স্থাপন করে।


১৯৮৫-৮৬ সালে অ্যাপল কমপিউটার বাংলাদেশে আসে। ১৯৮৭ সালের ১৬ মে সেই কমপিউটার দিয়ে আনন্দপত্র নামের একটি বাংলা পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ১৯৮৬ সালে মাইনুল ইসলাম তৈরি করেন ‘মাইনুললিপি’ নামক একটি বাংলা ফন্টের সুবিধা ছিল কোনো ড্রাইভার কিংবা সফটওয়্যারের সাহায্য ছাড়াই এ ফন্ট দিয়ে ম্যাকিনটোশ কমপিউটারে খুব সহজেই বাংলা লেখা যেত। এরপর যুক্তাক্ষর সমস্যা সমাধানের জন্য মাইনুল ইসলাম চার স্তরবিশিষ্ট কিবোর্ড ব্যবহার করেন। তিনি নিজের উদ্ভাবিত বাংলা ফন্ট ‘মাইনুলিপি’ ব্যবহার করে অ্যাপল-ম্যাকিনটোশ কমপিউটারে বাংলা লেখার ব্যবস্থা করেন। এ ক্ষেত্রে বাংলার জন্য আলাদা কোনো কিবোর্ড ব্যবহার না করে ইংরেজি কিবোর্ড দিয়েই কাজ চালানো হয়েছিল। ইংরেজি ও বাংলার আলাদা ধরনের বর্ণক্রম এবং বাংলার যুক্তাক্ষরজনিত সমস্যা সমাধান করা হয়েছিল ম্যাকিনটোশ কমপিউটারের চার স্তর কিবোর্ড ব্যবহারের সুবিধাকে কাজে লাগিয়ে। পর পরই ‘শহীদলিপি’ ও ‘জব্বারলিপি’ নামে আরও দুটো বাংলা ফন্ট উদ্ভাবিত হয় এবং একই পদ্ধতিতে ম্যাকিনটোশ কমপিউটারে ব্যবহার করা হয়। 


কমপিউটারে লেখার অক্ষরকে সুন্দরভাবে দেখার জন্য রয়েছে নানা ফন্ট। আরও সহজে বিভিন্ন সফটওয়্যারের মাধ্যমে কমপিউটারে বাংলা লিখতে পারে সাধারণ মানুষ। এমনকি রয়েছে বাংলাসমৃদ্ধ নানা কিবোর্ডও। 


বাংলা কিবোর্ডের ধারণাটা প্রথম প্রয়োগ করেন শহীদ মুনীর চৌধুরী ১৯৬৫ সালে তার ‘মুনীর’ কিবোর্ডের মাধ্যমে। এটি ছিল টাইপ রাইটারের জন্য তৈরি করা একটি কিবোর্ড লেআউট। মূলত টাইপরাইটারের জন্য আবিষ্কৃত হলেও পরবর্তীতে কমপিউটিং জগতে ‘মুনীর লেআউট’ গুরুত্বপূর্ণ অবদান রাখে। পরবর্তীতে যখন কমপিউটার এলো, তখন থেকেই বাংলা অন্তর্ভুক্ত করার চিন্তা হলো, লেআউট তো রেডি; এবার সাথে প্রয়োজন সফটওয়্যার বা মূল প্রোগ্রামিং, যা কমপিউটারের বোধগম্য ভাষায় রূপান্তর করবে এবং ‘ফন্ট’ যা কমপিউটারের মনিটরে দেখাবে।


১৯৮২ সালে বাংলাদেশ বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি বিশ্ববিদ্যালয়ের তড়িৎ কৌশল বিভাগের ড. সৈয়দ মাহবুবুর রহমানের তত্ত্বাবধানে কমপিউটারে বাংলা ব্যবহারের ওপর গবেষণা শুরু হয়। এরপর চলমান গবেষণাগুলোর মধ্যে সাইফ উদ দোহা শহীদ সর্বপ্রথম বাংলা সফটওয়্যার আবিষ্কার করতে সক্ষম হোন। প্রথমে মুনীর লেআউট ও কোয়েট্রি লেআউট ব্যবহার করে ২৫ জানুয়ারি সহকর্মীদের সহায়তায় বানিয়ে ফেলেন দুই বছরের পরিশ্রমের ফসল বাংলা লেখার সর্বপ্রথম সফটওয়্যার ‘শহীদলিপি’। অ্যাপোলের ম্যাকিনটোশ কমপিউটারে শহীদলিপি ব্যবহার করে লেখা যেত বাংলা।


সাংবাদিকতায় জড়িত বর্তমান পোস্ট এন্ড টেলিকমিউনিকেশন বিভাগের মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার লন্ডনে গিয়েছিলেন মুদ্রণের কাজ সম্পর্কিত যন্ত্রাংশ কিনতে। সেখানে গিয়ে দেখলেন পার্সোনাল কমপিউটারের সাথে প্রিন্টারকে সংযুক্ত করে মুদ্রণের কাজ করে। তিনি একটি পার্সোনাল কমপিউটার ও প্রিন্টার সাথে করে কিনে নিয়ে আসেন। তারপর নতুন বাংলা সফটওয়্যার তৈরিতে কাজ করতে থাকেন। কোন একজন বিদেশির পরামর্শে একটি ইংরেজি ফন্টের অনুকরণে তৈরি করে ফেলেন বাংলা ফন্ট তন্বী সুনন্দা। ভারতীয় ইঞ্জিনিয়ার দেবেন্দ্র যোশী তাকে বানিয়ে দেন বাংলা লেখার জন্য একটি সফটওয়্যার। ১৯৮৮ সালের ডিসেম্বরে মোস্তাফা জব্বার ও গোলাম ফারুক আহমদ উন্মোচন করেন দেড় বছরের ফসল বাংলা লেখার সফটওয়্যার ‘বিজয়’। বাংলা সফটওয়্যার প্রবেশ করে উন্নত যুগে। ১৯৯৩ সালে সেইফ ওয়ার্কশ ‘বর্ণ’-এর উইন্ডোজ সংস্করণ ‘বর্ণনা’ তৈরি করে যার মূল আকর্ষণ ছিল, পাশাপাশি এটি বাংলা বানানের ভুল ধরিয়ে দিতে পারত। একই সালে বাংলাদেশ সরকার বাজারে আনে বাংলা লেখার সফটওয়্যার ‘জাতীয়’। তবে জাতীয় খুব বেশি জনপ্রিয় হয়নি। যুগের সাথে তাল  মেলাতে মোস্তাফা জব্বার পরবর্তীতে নিয়ে আসেন ‘বিজয়’-এর উইন্ডোজ সংস্করণ।


২০০৬ সাল, নবজাগরণ যুগের শুরু। এ সালে ঘটে বাংলা কমপিউটিং শিল্পে এক নতুন বিপ্লব। মেহেদী হাসান, রিফাত-উন-নবী আর ওমিক্রন ল্যাবের সদস্যরা পরিশ্রম করে তৈরি করেন বাংলা লেখার নতুন পদ্ধতি-অভ্র ফোনেটিক। এর মাধ্যমে ইংরেজি কিবোর্ড ব্যবহার করেই খুব সহজেই বাংলা লেখা যায়। যেমন কেউ ইংরেজিতে আমি বাংলায় গান গাই লিখলে সেটা হয়ে যাবেÑ আমি বাংলায় গান গাই। যদিও এর আগে হাসিন হায়দার নামক একজন ডেভেলপার ফোনেটিকভিত্তিক বাংলা কিবোর্ড আবিষ্কার করেন বলে জানা যায়। মেহেদী হাসানের এ যুগান্তকারী আবিষ্কার বাংলার জগতে নিয়ে এলো নতুন এক বিপ্লব। দিনের পর দিন মেহেদী হাসান তার এ সফটওয়্যারে নতুন নতুন সুবিধা যুক্ত করেন। কমপিউটারে ইন্টারনেট ব্রাউজারে বাংলা লেখাগুলো খুব ছোট দেখা  যেত, যার কারণ উইন্ডোজের বৃন্দা ফন্ট। ওমিক্রন ল্যাবের তানবীর ইসলাম সিয়াম সেজন্য বানান সিয়ামরূপালী নামক ফন্ট, যা এ সমস্যার সমাধান করে। সুতন্বী এমজে ফন্টের বিকল্প হিসাবে বানানো হয় কালপুরু। যুক্ত করা হয় স্পেল চেকার, উইনিকোড থেকে বিজয় কনভার্টার; এ ছাড়া ছিল অনেক সুবিধা। মেহেদী হাসান তার এ মূল্যবান আবিষ্কারকে সবার কথা ভেবে বিনামূল্যে ব্যবহারের জন্য উন্মুক্ত করে দেন। তার মতে, ভাষা হওয়া উচিত সবার কাছে উন্মুক্ত।


এরপর স্মার্টফনে, ট্যাবসহ অন্যান্য গেজেটে বাংলা লেখার জন্যে আস্তে থাকে নানারকম সফটওয়্যার ও কিবোর্ড, যেগুলোর মাধ্যমে খুব সহজে বাংলাই টাইপ করে লিখতে পারেন ব্যবহারকারীরা।


পরবর্তী বছরে অর্থাৎ ১৯৮৮ সালে আনন্দ কমপিউটার্সের উদ্যোগে তৈরি হয় অ্যাপল-ম্যাকিনটোশ কমপিউটারে ব্যবহার উপযোগী প্রথম ইন্টারফেস ‘বিজয়’। বিজয় ইন্টারফেসটি ছিল ম্যাকিনটোশভিত্তিক এবং অ্যাপল-ম্যাকিনটোশ কমপিউটারের মূল্য অত্যধিক হওয়ায় এর ব্যবহারকারীর সংখ্যা ছিল সীমিত, মূলত প্রকাশনার কাজেই তা ব্যবহার হতো। ১৯৮৫ সালে আমেরিকাতে ড. মুহম্মদ জাফর ইকবাল ম্যাকিনটোশের জন্য একটি বাংলা ফন্ট তৈরি করেন। তিনি ইংরেজি বর্ণমালার অনুকরণে বাংলা ব্যঞ্জনবর্ণের যেগুলো যুক্তাক্ষর তৈরি করে সেগুলোর একটি স্বাভাবিক মাপের আকৃতির পাশাপাশি একটি ছোট মাপের আকৃতি নির্মাণ করেন যুক্তাক্ষরের একটি অংশ হিসেবে ব্যবহারের জন্য। 


বাংলা সফটওয়্যারের অভাবনীয় সংখ্যাধিক্যতা থেকে দুটি বিষয় পরিষ্কারÑ কমপিউটারে বাংলা লেখা সহজ নয় এবং অনেক নির্মাতাই চেষ্টা করেছেন এই মাধ্যমে বাংলা লেখার কাজটিকে সহজ করতে। কিন্তু বলা যেতে পারে কেউই এতে পুরো সফল হননি। এ যাবৎ প্রকাশিত বাংলা সফটওয়্যারগুলো ব্যবহার করার প্রধান সমস্যা হলো সম্পূর্ণ অপরিকল্পিতভাবে সাজানো একটি নতুন কিবোর্ড লেআউট অনুশীলন করে মুখস্থ করা। 


শুধুমাত্র পেশাজীবী ছাড়া আর কেউ ইংরেজি কিবোর্ডের পাশাপাশি বাংলা জন্যে আর একটি কিবোর্ড মুখস্থ করবেন না এটাই স্বাভাবিক। তাই দুই ডজনাধিক বাংলা সফটওয়্যার বাজারে থাকলেও বাংলাদেশি কমপিউটার ব্যবহারকারীদের শতকরা পাঁচজনেরও কম কমপিউটারে বাংলা লিখতে পারেন। কিবোর্ড ব্যবহার করে বাংলা লেখা রপ্ত কারা অত্যন্ত কঠিন। 


বাংলা বর্ণের সংখ্যাধিক্যতাকে বাংলা সফটওয়্যারের মূল অন্তরায় হিসেবে চিহ্নিত করা হয়ে থাকে। অথচ চীনা, জাপানি প্রভৃতি ভাষার সহস্রাধিক বর্ণ অতি সহজে ২৬টি ইংরেজি মূল ব্যবহারের জ্ঞান দিয়ে টাইপ করার ব্যবস্থা সেই সব দেশ করে নিয়েছে। 


বাংলাদেশে কমপিউটার ব্যবহারের শুরু থেকে আজ পর্যন্ত একটির পর একটি বাংলা সফটওয়্যার প্রকাশিত হয়েছে। এর কোনোটিই ব্যবহারকারীদের সন্তুষ্টি লাভ করতে সক্ষম না হলেও বাংলাদেশে বর্তমানে সর্বাধিক ব্যবহৃত বাংলা সফটওয়্যারের তালিকার শীর্ষে রয়েছে বিজয়। পেশাদার বাংলা সফটওয়্যার ব্যবহারকারীদের অধিকাংশই বিজয়ের ব্যবহারকারী। পরে সম্ভবত মুনীর অপটিমা টাইপ রাইটারের অনুকরণে তৈরি মুনীর কিবোর্ডের স্থান যা বেশ কয়েকটি প্যাকেজের সাথে বাজারজাত করা হয়েছে। 


কমপিউটারে বাংলা হরফ ব্যবহারের জটিলতার চূড়ান্ত সমাধান পদে পদে আটকে থাকছে। আসকিভিত্তিক পুরনো ফন্টে স্মার্টফোন ও ইন্টারনেট প্রভৃতি ওয়েবক্ষেত্রে বাংলা বর্ণমালা ব্যবহার করা যেত না। ফন্টের সর্বজনীন কারিগরি ব্যবস্থা ‘ইউনিকোড’ আসার পর এ জটিলতা দূর হয়েছিল। তাতে সে সংকট দূর হলেও ইউনিকোডের ফন্ট বিন্যাসে বাংলা নিয়ে নতুন জটিলতা সৃষ্টি হয়। ইউনিকোডে বাংলা ভাষার সাংকেতিক ব্যবস্থা রয়েছে ভিন্ন আঙ্গিকে। ইন্টারনেটে বাংলা লেখার ক্ষেত্রে সীমাবদ্ধতা তৈরি করছে বলে ভাষা বিশেষজ্ঞরা মনে করছেন। সর্বশেষ হালনাগাদ ইউনিকোডে আরও কিছু অব্যবস্থা বিশেষজ্ঞরা চিহ্নিত করেছেন। বাংলা ভাষায় ব্যবহৃত যতিচিহ্ন দাঁড়ির বদলে এসেছে দেবনাগরী বর্ণমালার মোটা ও দীর্ঘ দাঁড়ি। এতে বাংলা ভাষার দ্বৈত দাঁড়ি রাখা হয়নি। বাংলাদেশি টাকার চিহ্নকে অভিহিত করা হয়েছে রুপি হিসেবে। ভাষাবিজ্ঞানী ও ভাষা প্রযুক্তিবিদেরা বলছেন, ইউনিকোডে বাংলা ভাষার প্রকৃত প্রতিফলন ঘটেনি। সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, ইউনিকোডের বাংলা এর নিজস্ব ভাষারীতি অনুসারেই হওয়া উচিত।


ইউনিকোডের বাংলা ছকে সরাসরি এই অক্ষরগুলো না থাকায় বাংলায় ওয়েব ঠিকানা লিখতে সমস্যা হয়। আমরা যেভাবে লিখি, সেভাবেই পুরো অক্ষর তৈরি হতে হবে। ইউনিকোডের শুরু ১৯৮৭ সালে অ্যাপল কমপিউটারের উদ্যোগে। পরে মাইক্রোসফটসহ বড় বড় তথ্যপ্রযুক্তি প্রতিষ্ঠান এ উদ্যোগে যুক্ত হয়ে ইউনিকোড কনসোর্টিয়াম গঠন করে। অ্যাপলের পরিবেশক হিসেবে ১৯৮৮ সালে থাইল্যান্ডে অ্যাপলের একটি সম্মেলন অনুষ্ঠিত হয়। বাংলাদেশ দীর্ঘদিন এর সদস্য ছিল না। ফলে ইউনিকোডে বাংলা ভাষার ছক কেমন হবে, বাংলাদেশের পক্ষ থেকে সে বিষয়ে কিছু বলা যায়নি। 


২০১০ সালে বাংলাদেশ প্রতিনিধি হিসেবে বিসিসি ইউনিকোড কনসোর্টিয়ামের সদস্য হয়। পরবর্তী সময়ে এসেছে ইন্টারনেটে অন্য ভাষার টপ লেভেল ডোমেইন ডট বাংলা নামের বিষয়টি। এখানেও বাংলাদেশের প্রতিনিধিত্ব ছিল না। ২০১৮ সালের মাঝামাঝি বাংলাদেশ টেলিযোগাযোগ নিয়ন্ত্রণ কমিশন আইসিএএনএনের সদস্য হয়। ডাক, টেলিযোগাযোগ মন্ত্রী মোস্তাফা জব্বার বলেন, ‘বাংলা ভাষা নিয়ে ইউনিকোডের বর্তমান ছক একেবারেই গ্রহণযোগ্য নয়। হিন্দিতে যা-ই থাকুক, বাংলায় তা গ্রহণযোগ্য হতে পারে না। বাংলাদেশের অংশগ্রহণ না থাকায় ভারতের সাথে যোগাযোগ করেই ইউনিকোডের বাংলা তৈরি করা হয়েছে। বিষয়টি সমাধানে সরকার একাধিক কমিটি গঠন করেছে। বিসিসি ও বিটিআরসি আইসিএএনএন ও ইউনিকোড কনসোর্টিয়ামের সভাগুলোতে ইউনিকোডের বাংলায় বাংলাদেশের দাবি জোরালোভাবে তুলে ধরছে।’ 


কমপিউটার, স্মার্টফোন থেকে শুরু করে একেবারে সরল বাটন ফোন, সবখানেই আপনি দিব্যি বাংলায় লিখে ফেলতে পারছেন যখন তখন, খুব সহজে। বাংলায় টাইপ করার ব্যাপারটি যত সহজ দেখছি আমরা আজকের দিনে, দেড় যুগ আগেও বিষয়টা অতটা সহজ ছিল না। আর অর্ধশতাব্দী আগে বাংলায় টাইপ ব্যাপারটিই ঠিকমতো ছিল না। অবাক করা হলেও ঘটনাটি এমনই।


তবে এখনও অনেক সীমাবদ্ধতা রয়েছে। এখন সবচেয়ে জনপ্রিয় হলো বিজয় সফটওয়্যার ও অনলাইনের জন্য ইউনিকোড। কিন্তু যুক্ত অক্ষর লেখার ক্ষেত্রে নানা সমস্যা হচ্ছে পাঠক ও লেখককে সমস্যা ও লজ্জায় পড়তে হয়। যেমন অনেক সংযুক্ত অক্ষর লেখা যায় না, এমনকি লেখার পর ভেঙ্গে যায়, অনেক সময় হয়তো পাঠক ভাবতে পারেন সংশ্লিষ্ট লেখক সঠিক বানানটি সম্পর্কে অবগত নন। বিষয়টি আসলে তা নয়, এটি সফটওয়্যারের সমস্যা। এসব সমস্যা কীভাবে দূর করা যায় সেগুলো নিয়ে ইউনিকোড ও বিজয় সফটওয়্যার নিয়ে কাজ করছেন তাদের এই সীমাবদ্ধতা দূর করার ব্যাপারে নতুন করে উদ্যোগ গ্রহণ করতে হবে। আমরা প্রত্যাশা করব খুব অল্প সময়ের মধ্যেই এসব সমস্যার সমাধান হবে।


লেখক : প্রাবন্ধিক ও গবেষক








১ টি মন্তব্য

  • Bibechok

    Bibechok

    ২০২৪-১২-০৯ ১৬:৫০:১৮

    পুরা দুনিয়ায় ই্ংরেজী ভাষার জন্য qwert একটি কীবোড্রের মত বাংলা ভাষার জন্যও ১টি মাত্র কীবোড প্রনয়ন করতে হবে।



মতামত দিন

আপনি লগ ইন অবস্থায় নেই।
আপনার মতামতটি দেওয়ার জন্য লগ ইন করুন। যদি রেজিষ্ট্রেশন করা না থাকে প্রথমে রেজিষ্ট্রেশন করুন।







পাসওয়ার্ড ভুলে গেছেন? পুনরায় রিসেট করুন






রিভিউ

আপনি লগ ইন অবস্থায় নেই।
আপনার রিভিউ দেওয়ার জন্য লগ ইন করুন। যদি রেজিষ্ট্রেশন করা না থাকে প্রথমে রেজিষ্ট্রেশন করুন।